পাসপোর্ট নিয়ে চার দেশে বাংলাদেশীদের হাহাকার by দীন ইসলাম
আগামী
বছরের ২৪শে নভেম্বরের মধ্যে হাতে লেখা পাসপোর্টের বদলে পৃথিবীর সব দেশের
নাগরিকদের যন্ত্রে পাঠযোগ্য পাসপোর্ট (এমআরপি) থাকতে হবে। এটাই জাতিসংঘের
বিশেষায়িত সংস্থা আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান এসোসিয়েশনের বেঁধে দেয়া নিয়ম।
এ কারণে সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ
দূতাবাসের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। ওই সব দূতাবাস প্রয়োজন
অনুযায়ী প্রবাসী বাংলাদেশীদের এমআরপি দিতে না পারায় তাদের হতাশার তথ্য
জানিয়ে চিঠি দিচ্ছে। ওই সব চিঠিতে এমআরপি ওয়ার্ক স্টেশন বাড়ানোর অনুরোধ
জানাচ্ছে। একই সঙ্গে প্রবাসী বাংলাদেশীদের মধ্যে এমআরপি প্রাপ্তি নিয়ে
হাহাকার তৈরি হয়েছে। এতসব ঝামেলার মধ্যেও পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র
মন্ত্রণালয়ের দ্বন্দ্ব থামছে না। তারা একে অপরের দিকে কাদা ছোড়াছুড়িতে
ব্যস্ত রয়েছে। তবে বিদেশে মিশনগুলো থেকে দূতাবাসের শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছ
থেকে এমআরপি বিতরণের বাস্তব চিত্র পাওয়ার পর পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র
মন্ত্রণালয় নড়েচড়ে বসেছে। এরই মধ্যে বিদেশে এমআরপি অগ্রগতি নিবিড়ভাবে
পর্যালোচনা এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিদ্যমান/সম্ভাব্য প্রতিবন্ধকতা দূর
করার সুপারিশ দিতে অতিরিক্ত পররাষ্ট্র সচিব (দ্বিপক্ষীয়) এর নেতৃত্বে একটি
উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি গঠনের আগে ৯ই ডিসেম্বর সংযুক্ত
আরব আমিরাতসহ কয়েকটি দেশে এমআরপি কার্যক্রম গতিশীল করতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর
সভাপতিত্বে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে এমআরপি প্রদানে কয়েকটি দেশে
জটিলতা সৃষ্টি সম্পর্কে আলোচিত হয়। এদিকে গত ১৭ই নভেম্বর প্রবাসীদের মধ্যে
এমআরপি বিতরণে কাতার দূতাবাসের বর্তমান অবস্থা জানিয়ে স্বরাষ্ট্র
মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে একটি চিঠি দেন ওই দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ
দূতাবাসের শীর্ষ কর্মকর্তা সৈয়দ মাসুদ মাহমুদ খন্দকার। ওই চিঠিতে তিনি
বলেন, কাতারস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে ২০১২ সালের ৪ঠা জানুয়ারি একটি মাত্র
ওয়ার্ক স্টেশন স্থাপনের মাধ্যমে মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি)-এর
কার্যক্রম শুরু হয়। শুরু থেকে অন্তত ৫/৬টি ওয়ার্ক স্টেশনের চাহিদার বিপরীতে
মাত্র একটি ওয়ার্ক স্টেশনের মাধ্যমে এমআরপি কার্যক্রম পরিচালনায়
দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি হয়। পরে গত মে মাসে দূতাবাসে আরও একটি ওয়ার্ক স্টেশন
স্থাপন করা হয়। বর্তমানে দু’টি ওয়ার্ক স্টেশনের মাধ্যমে প্রতিদিন গড়ে
২০০-২২০টি আবেদনপত্র গ্রহণের বিপরীতে দূতাবাস মাত্র ১০০-১১০টি এমআরপি
এনরোলমেন্ট করতে সক্ষম হচ্ছে। যার ফলে জমাকৃত আবেদনপত্রের সংখ্যা এ পর্যন্ত
প্রায় আট হাজার ছাড়িয়েছে। এ পর্যায়ে একজন আবেদনকারীকে পাসপোর্ট ডেলিভারি
নেয়ার জন্য আবেদনের দিন থেকে প্রায় ৪/৫ মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। যা
প্রবাসী বাংলাদেশীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে
(সার্ভার সমস্যা) গত ২রা নভেম্বর থেকে এমআরপি এনরোলমেন্ট কার্যক্রম
সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে। ফলে সার্বিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট
কর্তৃপক্ষের আন্তরিক সহায়তায় ঢাকা থেকে ডিএইচএল-এর মাধ্যমে নতুন একটি
সার্ভার দোহাতে পৌঁছানোর কথা রয়েছে। তাই এমআরপি কার্যক্রম পুনরায় শুরু হবে
বলে আশা করা যায়। কাতার বাংলাদেশ দূতাবাসের চিঠিতে বলা হয়েছে, মাত্র দু’টি
ওয়ার্ক স্টেশনের মাধ্যমে ২০১৫ সালের নভেম্বরের মধ্যে প্রবাসী বাংলাদেশী
সকলকে এমআরপি পাসপোর্ট প্রদান দূতাবাসের পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব নয়। জমাকৃত
প্রায় আট হাজার আবেদনপত্রসহ আরো আনুমানিক লক্ষাধিক প্রবাসী বাংলাদেশীকে
নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে পাসপোর্ট দিতে হলে দূতাবাসে জরুরিভিত্তিতে আরো
৫-৬টি ওয়ার্ক স্টেশন প্রয়োজন। এ বিষয়ে আপনার ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপ কামনা
করছি। কাতারের বাইরে সৌদি আরবেও প্রবাসীরা এমআরপি’র জন্য দ্বারে দ্বারে
ঘুরছেন। দেশে ফিরে আবার পাসপোর্ট নিয়ে সৌদি আরবে যাবেন এমন সুযোগও নেই। ফলে
বাধ্য হয়ে সৌদি দূতাবাসের আশেপাশে গজিয়ে ওঠা দালালদের শরণাপন্ন হতে হচ্ছে
প্রবাসী বাংলাদেশী শ্রমিকদের। এ বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার সৌদি দূতাবাসের
উপ-মিশন প্রধান মোহাম্মদ আইয়ুব এক সংবাদ সম্মেলন করে যত্রতত্র মেশিন রিডেবল
পাসপোর্ট বা এমআরপি ফি জমা দিয়ে প্রতারিত না হওয়ার অনুরোধ জানায় সৌদি আরবে
বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশীরা। তিনি বলেন, রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাস, জেদ্দা
বাংলাদেশ কন্স্যুলেট এবং আইরিশ করপোরেশন বারহাট ছাড়া অন্য কারও এমআরপি জমা
নেয়ার বৈধতা নেই। উল্লিখিত ৩ প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কোথাও টাকা নিলে, ওই
ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন, দূতাবাস বা কন্স্যুলেটে
খবর দেয়ার আহ্বান জানান উপ-মিশন প্রধান। সময় এবং শ্রম দিয়ে অনলাইনে এমআরপি
ফরম পূরণ করে ২০/৩০ রিয়াল নেয়া যাবে। তবে পাসপোর্টের ফি জমা নেয়া যাবে না।
এদিকে, ২০১৫ সালে সৌদি আরব প্রবাসী সব বাংলাদেশীদের এমআরপি দেয়ার জন্য
আউটসোর্সিং কোম্পানি আইরিশ করপোরেশন বারহাটের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র
মন্ত্রণালয় এবং পাসপোর্ট অধিদপ্তরের চুক্তিবদ্ধ হয়। চুক্তি অনুযায়ী প্রতি
পাসপোর্ট এনরোলমেন্ট বাবদ সরকারি ফি (জন্ম নিবন্ধনসহ) ১৪৫ রিয়াল এবং ৯ ডলার
(৩৫ রিয়াল) মোট ১৮০ রিয়াল নেয়ার কথা থাকলেও তারা নামে বেনামে বিভিন্ন
অফিসকে ইউজার পাসওয়ার্ড দিয়ে ২৫৫ থেকে ৩৫০ রিয়াল হাতিয়ে নিচ্ছে। আবেদন পূরণ
করা থেকে শুরু করে এমআরপি যাবতীয় সব কাজ আইরিশ নিজেরা ১৮০ রিয়ালে করার কথা
থাকলেও এই কাজটি করার জন্য প্রবাসীদের কাছ থেকে নেয়া হচ্ছে ২৫৫ থেকে ৩৫০
রিয়াল। কিন্তু রিসিট দেয়া হচ্ছে ১৮০ রিয়ালের। বাকি টাকার রিসিট না দেয়ার
ব্যাপারে দায়সারা বক্তব্য দিচ্ছে আইরিশ। এর ভিত্তিতেই সংবাদ সম্মেলন করে
দূতাবাসের অবস্থান পরিষ্কার করা হয়। এদিকে মালয়েশিয়াতে বসবাসরত ৬ লাখ
বাংলাদেশীকে এমআরপি দিতে গত ফেব্রুয়ারিতে ডাটাএজ-আইপিপল কনসোর্টিয়ামের
সঙ্গে চুক্তি করে সরকার। গত ১২ই ফেব্রুয়ারি সই করা চুক্তিতে বলা হয়, তারা
মালয়েশিয়ার আটটি প্রদেশে পাসপোর্ট দেয়ার জন্য আবেদন ও বিতরণ কেন্দ্র খুলবে।
সেখান থেকেই এমআরপি দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে। মালয়েশিয়ায় কর্মরত বাংলাদেশী
শ্রমিকদের সুবিধার জন্য এ উদ্যোগ নেয়া হয়। প্রতি কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন গড়ে
দুই থেকে তিনশ’ আবেদনকারীকে এমআরপি দেয়ার কথা বলা হয়। স্বরাষ্ট্র
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন প্রদেশে আবেদন জমা নেয়ার পর ওই সব
আবেদনের একটি কপি অনলাইনের মাধ্যমে ঢাকার বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরে
পাঠিয়ে দেয়ার কথা। কিন্তু ঢাকায় এমআরপি দেয়ার কাজটি করছে ডি লা রুই
ইন্টারন্যাশনাল নামে পোল্যান্ড ভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান। আর সফটওয়্যার
তৈরির কাজটি করার কথা আইরিশ নামের একটি কোম্পানির। এমন নানা প্যাঁচের কারণে
মালয়েশিয়াতে বসবাসরত প্রবাসীদের এমআরপি পেতে দেরি হচ্ছে। এছাড়া, সংযুক্ত
আরব আমিরাতে ভিসা জটিলতায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা যেতে পারছেন
না। একই সঙ্গে আউটসোর্সিং কোম্পানি অনুমতি না পাওয়ায় তারা ওই দেশে কাজ
শুরু করতে পারেননি। ফলে সংযুক্ত আরব আমিরাতেও এমআরপি প্রদান কার্যত বন্ধ
হয়ে গেছে।
No comments