আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মৃত ঘোড়ার সৎকার by ড. আবদুস সাত্তার মোল্লা
প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস
হওয়ায় কষ্ট পেয়ে জনপ্রিয় লেখক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল
‘দোহাই, আমাদের শিশুদের ক্রিমিনাল বানাবেন না’ শিরোনাম দিয়ে হৃদয়ের আর্তি
পেশ করেছেন কর্তৃপক্ষের কাছে (যুগান্তর, ২৭.১১.১৪)। তিনি জাতীয়
শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন কমিটির সদস্য হিসেবে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা
গ্রহণের নীতিগত সিদ্ধান্তকেই চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। সপ্তাহখানেক পর
(০৫.১১.১৪) একই বিষয়ের ওপর তার ‘মৃত ঘোড়া সমাচার’ শীর্ষক দীর্ঘ নিবন্ধ
প্রকাশিত হয়। এ নিবন্ধে অধ্যাপক ইকবাল প্রাথমিক সমাপনী এবং জুনিয়র স্কুল
সার্টিফিকেট পরীক্ষা উভয়কে ‘মৃত ঘোড়া’ আখ্যা দিয়ে এদের দুর্গন্ধ থেকে
বাঁচার জন্য দ্রুত ‘কবর দিতে’ আহ্বান জানিয়েছেন। আমাদের
প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় চারটি পাবলিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫-এর ছড়াছড়ি এবং পরীক্ষার
প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা লক্ষ্য করে বেশ কয়েকজন লেখক বিভিন্ন পত্রিকায়
প্রকাশিত নিবন্ধে প্রথম পরীক্ষা দুটো বাতিল করার দাবি জানিয়েছেন। বস্তুত
পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস প্রক্রিয়াটি অনেকটা ইংরেজ ঐতিহাসিক লর্ড ম্যাকলের
শিক্ষাবিষয়ক Downward Filtration Theory অনুসরণে বিসিএস পরীক্ষা থেকে শুরু
করে নিচ দিকে গড়াতে গড়াতে পঞ্চম শ্রেণীর শিশুদের প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা
পর্যন্ত নেমে এসেছে। এটি আমাদের রোধ করতেই হবে। কিন্তু প্রাথমিক সমাপনী এবং
জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা গ্রহণ করাই কি এ দুরবস্থার জন্য দায়ী?
একজন শিক্ষা গবেষক হিসেবে আমি পরীক্ষাগুলো তুলে দেয়ার পক্ষে নই। প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করার জন্য তো নয়ই, আনন্দের সঙ্গে শিশু-কিশোরদের শিক্ষালাভ নিশ্চিত করার জন্যও এসব পরীক্ষা তুলে দেয়ার দরকার নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ নিজেই ‘শিক্ষার সর্বোচ্চ মান অর্জনই আমাদের লক্ষ্য’ শীর্ষক নিবন্ধে (যুগান্তর ০৯.১১.১৪) সর্বশেষ প্রবর্তিত এ পরীক্ষা দুটোর প্রয়োজনীয়তা এবং সুবিধাদি তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন ‘সার্টিফিকেট পাওয়ার আশায় পঞ্চম শ্রেণী বা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত টিকে থাকার একটা আকর্ষণ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে নবপ্রবর্তিত এ পরীক্ষা দুটো প্রাথমিক ও নিুমাধ্যমিক পর্যায়ে ঝরে পড়ার হার কমাতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে।’ তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, নগরে অবস্থিত এবং ধনী পরিবারের সন্তানদের জন্য পরীক্ষা দুটো তেমন প্রয়োজনীয় না হলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুদের জন্য এগুলো উৎসবে পরিণত হয়েছে; আর সন্তানরা শিশু বয়সেই পাবলিক পরীক্ষা দেয়ার বিষয়টি পিতা-মাতার জন্য গৌরব বয়ে আনছে। অধিকন্তু আগে অল্প সংখ্যক শিক্ষার্থী পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতে বৃত্তি পরীক্ষার মতো পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নিত, অন্যরা সে সুযোগ পেত না; সবার জন্য এ স্তরে পাবলিক পরীক্ষা প্রবর্তনে বৈষম্য দূর হয়ে সমমান অর্জনের পথ সুগম হয়েছে। সর্বোপরি পাবলিক পরীক্ষা এ স্তরের শিশুদের আত্মবিশ্বাসী করে তুলছে।
মন্ত্রী মহোদয়ের যুক্তিগুলোর সঙ্গে আমি আরও কয়েকটি পয়েন্ট যোগ করতে চাই। ১. বিশ্বের সব দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় তিনটি প্রধান স্তর হচ্ছে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা। প্রতিটি স্তরের শিক্ষায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি। প্রাথমিক শিক্ষা ওপরের দুই স্তরের শিক্ষার ভিত রচনা করে বলে এ স্তরে ভিতটা মজবুত করা এবং কতটা মজবুত হল তার গ্রহণযোগ্য মূল্যায়ন প্রয়োজন। ২. যারা প্রাথমিক সমাপনী ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা তুলে দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তাদের অনেকেই ইউরোপ-আমেরিকার উদাহরণ টেনেছেন। ইউরোপ-আমেরিকার বিদ্যালয় প্রশাসন নিজেদের শিক্ষার্থীদের সঠিক শিক্ষাদান ও মূল্যায়নে যে নির্ভরযোগ্যতা অর্জন করেছে, এশিয়া-আফ্রিকার অনেক দেশই এখনও তা পারেনি। তাই জাপান, থাইল্যান্ড এবং সিঙ্গাপুরের মতো অপেক্ষাকৃত উন্নত এশীয় দেশগুলোতেও ষষ্ঠ শ্রেণীর প্রাথমিক শিক্ষা শেষে সমাপনী পরীক্ষা হয়। অধ্যাপক ইকবাল উল্লেখ করেছেন, জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০-এ পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাথমিক সমাপনী পাবলিক পরীক্ষার উল্লেখ নেই। কিন্তু তিনি লক্ষ্য করেননি, পরীক্ষাটি শিক্ষানীতি-২০১০ প্রবর্তনের আগে (২০০৯ সাল) থেকে শুরু হয়েছে।
তবে উচ্চশিক্ষার জন্য সিঙ্গাপুর অবস্থানকালেই জেনেছি- সেখানে Primary School Leaving Examination (PSLE) শিক্ষার্থীদের নিজ বিদ্যালয়েই অনুষ্ঠিত হয়; ষষ্ঠ শ্রেণীর শিশুদের দূরবর্তী বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে পরীক্ষার খাঁটিত্ব প্রমাণ করতে হয় না। বাংলাদেশেও প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের নিজ বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হতে পারে; এতে এ শিশু পরীক্ষার্থীদের ওপর অপ্রয়োজনীয় মানসিক চাপটি রহিত হবে- অভিভাবকদেরও তাদের শিশু সন্তানদের পরীক্ষাকালীন লজিংয়ের ব্যবস্থা বা দূরে যাতায়াত নিয়ে ভাবতে হবে না।
পরীক্ষাকে খাঁটি রাখার জন্য প্রত্যবেক্ষক অন্য বিদ্যালয় থেকে নিয়োগ দেয়া যায়। বাংলাদেশ যখন প্রাথমিক শিক্ষাস্তরকে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের ন্যায় অন্তত ষষ্ঠ শ্রেণীতে উন্নীত করতে পারবে, তখন বিশ্বে খুব কম প্রচলিত জুনিয়র স্কুল/সেকেন্ডারি সার্টিফিকেট পরীক্ষাটি তুলে দেয়া যাবে।
অর্থাৎ আমার চিন্তায় জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষাটি এখনও ‘মৃত ঘোড়া’য় পরিণত হয়নি। আর প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষাটি (প্রাথমিক শিক্ষাস্তর যখন যে শ্রেণীতে শেষ হয়) সব সময় না হলেও দীর্ঘদিন বহাল থাকার প্রয়োজন হতে পারে; ‘মৃত ঘোড়া’ ঘোষণা করে একে কবর দিয়ে দিলে এই পাবলিক পরীক্ষাটি প্রবর্তনের ফলে প্রাথমিক স্তরের প্রধান শিক্ষালয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে যে জবাবদিহিতার সূচনা হয়েছে তা আবার হারিয়ে যাবে। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ‘মৃত ঘোড়া’র অস্তিত্ব ঠিকই বিদ্যমান; এর দূষণ প্রক্রিয়া রোধ করতে না পারলে ঘোড়ার মৃতদেহ জীবিত সবাইকে তলিয়ে দিতে পারে!
বাংলাদেশে ১৯৯২ সাল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় বহুনির্বাচনী প্রশ্ন পদ্ধতি প্রবর্তনের সঙ্গে নমুনা প্রশ্নের ব্যাংককে ভুলবশত ‘সিলেবাস’ ঘোষণা করায় রচনামূলক প্রশ্নে ফেল করেও দ্বিতীয়, এমনকি প্রথম বিভাগে পাস করার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছিল। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত এভাবে পাস করা ‘গ্র্যাজুয়েটদের’ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়ানো কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। কারণ তারা লেখাপড়াকে বড় বেশি সহজ কাজ বলে ভাবত। MCQ-এর সিলেবাস নামক মৃত ঘোড়াটিকে কবর দিয়েই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এগিয়ে চলছিল। আবার পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলকে জিপিএ আকারে প্রকাশ করা শুরু হলে জিপিএ-৫ নামক ঘোড়াটি জাতির শিক্ষাকে তাড়িয়ে বেড়াতে শুরু করে। জাতি এখন জিপিএ-৫-এর পেছনে পাগলের মতো ছুটে চলছে! জিপিএ-৫-এর মোহই এখন শিক্ষাব্যবস্থার ‘মৃত ঘোড়া’; একে এ মুহূর্তে কবরস্থ করা জরুরি।
লেখাপড়ার প্রধান উদ্দেশ্য কি জিপিএ-৫ পাওয়া? প্রাথমিক সমাপনী বা জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেলে তা কোথায়, কী দামে বেচা যায়? প্রাপ্ত মূল্যে কী কী জিনিস কেনা যায়? কী কারণে শিক্ষা প্রশাসন, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে জিপিএ-৫-এর পেছনে পাগলের মতো ছোটাছুটি করতে হবে? জিপিএ-৫-এর পেছনে দৌড়াতে গিয়ে পঞ্চম আর অষ্টম শ্রেণীর দ্বিতীয়ার্ধে নতুন পাঠ্যবিষয় পড়া বাদ দিয়ে শুধু পূর্বপঠিত বিষয়ের প্রশ্নোত্তর আর কোচিংয়ে কেন সময় নষ্ট করতে হবে? স্বাভাবিকভাবে আনন্দের সঙ্গে পাঠ্যাভ্যাস করে গেলে পরীক্ষায় ফলাফল ভালো হবে না- এরূপ ভুল ধারণার জন্মের কারণ সমূলে উৎপাটন করতে হবে।
পরীক্ষা তো শিক্ষাক্রমের সেই অংশ, যার মাধ্যমে কতটা বিদ্যা অর্জিত হয়েছে এবং অর্জিত জ্ঞান শিক্ষার্থীরা প্রয়োগ, বিশ্লেষণ, মূল্যায়ন- এসব করতে পারে কিনা তার মূল্যায়ন করা হয়। পরীক্ষাকে শিক্ষালাভের অংশ হিসেবে না দেখে আমরা কেন একে আতংক অথবা উন্নয়নের একমাত্র সিঁড়ি, এমনকি শিক্ষা বিভাগের সবার বা সরকারের ‘উন্নয়নের জোয়ার’ হিসেবে দেখব? সম্প্রতি প্রশ্নপত্র ফাঁসের যে কেলেংকারি চলছে তার মূলেও তো রয়েছে জিপিএ-৫-এর প্রদর্শনী! পবিত্র মনে পূর্ণ আন্তরিকতা, পরম সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে অগ্রসর না হলে কি কোনো জাতি উন্নতি করতে পারে?
পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করতে হলে প্রথম কাজ হবে জিপিএ-৫-এর প্রতি মোহ ত্যাগ করে এর প্রদর্শনী বন্ধ করা। তারপর দেখতে হবে শিক্ষা বিভাগের কোনো স্তরে কারও মাথায় এমন বাজে চিন্তা ঢুকে আছে কিনা যে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া তেমন খারাপ কিছু নয়; বরং এ কাজ করে কিছু অর্থ উপার্জন সম্ভব। জাতি-বিনাশী এরূপ ‘অসম্ভব’ জঘন্য চিন্তা কারও মাথায় থাকলে তা এ মুহূর্তে ঝেড়ে ফেলতে হবে। পরবর্তী কাজ হবে প্রশ্ন প্রণয়ন, মডারেশন, কম্পিউটার কম্পোজ, মুদ্রণ, সংরক্ষণ এবং বিতরণের মতো প্রাথমিক উৎসের প্রত্যেকটি স্তরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জনবল মনোবৈজ্ঞানিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগদান। যাদের পক্ষে লোভ/ভয়ের কোনো অবস্থাতেই বেশি নিচে নামা সম্ভব নয়, এ কাজ শুধু তাদেরই জন্য।
জাতির সামনে অনুসরণীয়-অনুকরণীয় জীবন্ত মডেলের অভাব বাংলাদেশের জন্য এক চরম দুর্ভাগ্য। দেশের কলুষিত সামাজিক পরিবেশে চরিত্র ঠিক রাখা পরম নীতিবানদের জন্যও কঠিন হতে পারে। তাই কোনো পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে কোন স্তরে কার মাধ্যমে সেটি ঘটেছে তা বিচার বিভাগীয় তদন্তে উদ্ঘাটন করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে পরে এ কাজের সঙ্গে জড়িত কারোর আর চারিত্রিক স্খলন ঘটে।
ফেসবুক, ই-মেইল, মোবাইল মেসেজিং ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের গৌণ উৎস বলে জানা যায়। সুতরাং এসব মাধ্যম যদি কোনোভাবে (যেমন- কম্পিউটার কম্পোজার বা ট্রেজারির পাহারাদারের কাছ থেকে) প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রাথমিক উপায় হিসেবে ব্যবহৃত হয়, শুধু তাহলেই এসব বন্ধ করা প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধের একটি উপায় হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
ড. আবদুস সাত্তার মোল্লা : শিক্ষা গবেষক; ওএসডি, মাউশি অধিদফতর
একজন শিক্ষা গবেষক হিসেবে আমি পরীক্ষাগুলো তুলে দেয়ার পক্ষে নই। প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করার জন্য তো নয়ই, আনন্দের সঙ্গে শিশু-কিশোরদের শিক্ষালাভ নিশ্চিত করার জন্যও এসব পরীক্ষা তুলে দেয়ার দরকার নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ নিজেই ‘শিক্ষার সর্বোচ্চ মান অর্জনই আমাদের লক্ষ্য’ শীর্ষক নিবন্ধে (যুগান্তর ০৯.১১.১৪) সর্বশেষ প্রবর্তিত এ পরীক্ষা দুটোর প্রয়োজনীয়তা এবং সুবিধাদি তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন ‘সার্টিফিকেট পাওয়ার আশায় পঞ্চম শ্রেণী বা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত টিকে থাকার একটা আকর্ষণ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে নবপ্রবর্তিত এ পরীক্ষা দুটো প্রাথমিক ও নিুমাধ্যমিক পর্যায়ে ঝরে পড়ার হার কমাতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে।’ তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, নগরে অবস্থিত এবং ধনী পরিবারের সন্তানদের জন্য পরীক্ষা দুটো তেমন প্রয়োজনীয় না হলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুদের জন্য এগুলো উৎসবে পরিণত হয়েছে; আর সন্তানরা শিশু বয়সেই পাবলিক পরীক্ষা দেয়ার বিষয়টি পিতা-মাতার জন্য গৌরব বয়ে আনছে। অধিকন্তু আগে অল্প সংখ্যক শিক্ষার্থী পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতে বৃত্তি পরীক্ষার মতো পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নিত, অন্যরা সে সুযোগ পেত না; সবার জন্য এ স্তরে পাবলিক পরীক্ষা প্রবর্তনে বৈষম্য দূর হয়ে সমমান অর্জনের পথ সুগম হয়েছে। সর্বোপরি পাবলিক পরীক্ষা এ স্তরের শিশুদের আত্মবিশ্বাসী করে তুলছে।
মন্ত্রী মহোদয়ের যুক্তিগুলোর সঙ্গে আমি আরও কয়েকটি পয়েন্ট যোগ করতে চাই। ১. বিশ্বের সব দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় তিনটি প্রধান স্তর হচ্ছে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা। প্রতিটি স্তরের শিক্ষায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি। প্রাথমিক শিক্ষা ওপরের দুই স্তরের শিক্ষার ভিত রচনা করে বলে এ স্তরে ভিতটা মজবুত করা এবং কতটা মজবুত হল তার গ্রহণযোগ্য মূল্যায়ন প্রয়োজন। ২. যারা প্রাথমিক সমাপনী ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা তুলে দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তাদের অনেকেই ইউরোপ-আমেরিকার উদাহরণ টেনেছেন। ইউরোপ-আমেরিকার বিদ্যালয় প্রশাসন নিজেদের শিক্ষার্থীদের সঠিক শিক্ষাদান ও মূল্যায়নে যে নির্ভরযোগ্যতা অর্জন করেছে, এশিয়া-আফ্রিকার অনেক দেশই এখনও তা পারেনি। তাই জাপান, থাইল্যান্ড এবং সিঙ্গাপুরের মতো অপেক্ষাকৃত উন্নত এশীয় দেশগুলোতেও ষষ্ঠ শ্রেণীর প্রাথমিক শিক্ষা শেষে সমাপনী পরীক্ষা হয়। অধ্যাপক ইকবাল উল্লেখ করেছেন, জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০-এ পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাথমিক সমাপনী পাবলিক পরীক্ষার উল্লেখ নেই। কিন্তু তিনি লক্ষ্য করেননি, পরীক্ষাটি শিক্ষানীতি-২০১০ প্রবর্তনের আগে (২০০৯ সাল) থেকে শুরু হয়েছে।
তবে উচ্চশিক্ষার জন্য সিঙ্গাপুর অবস্থানকালেই জেনেছি- সেখানে Primary School Leaving Examination (PSLE) শিক্ষার্থীদের নিজ বিদ্যালয়েই অনুষ্ঠিত হয়; ষষ্ঠ শ্রেণীর শিশুদের দূরবর্তী বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে পরীক্ষার খাঁটিত্ব প্রমাণ করতে হয় না। বাংলাদেশেও প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের নিজ বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হতে পারে; এতে এ শিশু পরীক্ষার্থীদের ওপর অপ্রয়োজনীয় মানসিক চাপটি রহিত হবে- অভিভাবকদেরও তাদের শিশু সন্তানদের পরীক্ষাকালীন লজিংয়ের ব্যবস্থা বা দূরে যাতায়াত নিয়ে ভাবতে হবে না।
পরীক্ষাকে খাঁটি রাখার জন্য প্রত্যবেক্ষক অন্য বিদ্যালয় থেকে নিয়োগ দেয়া যায়। বাংলাদেশ যখন প্রাথমিক শিক্ষাস্তরকে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের ন্যায় অন্তত ষষ্ঠ শ্রেণীতে উন্নীত করতে পারবে, তখন বিশ্বে খুব কম প্রচলিত জুনিয়র স্কুল/সেকেন্ডারি সার্টিফিকেট পরীক্ষাটি তুলে দেয়া যাবে।
অর্থাৎ আমার চিন্তায় জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষাটি এখনও ‘মৃত ঘোড়া’য় পরিণত হয়নি। আর প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষাটি (প্রাথমিক শিক্ষাস্তর যখন যে শ্রেণীতে শেষ হয়) সব সময় না হলেও দীর্ঘদিন বহাল থাকার প্রয়োজন হতে পারে; ‘মৃত ঘোড়া’ ঘোষণা করে একে কবর দিয়ে দিলে এই পাবলিক পরীক্ষাটি প্রবর্তনের ফলে প্রাথমিক স্তরের প্রধান শিক্ষালয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে যে জবাবদিহিতার সূচনা হয়েছে তা আবার হারিয়ে যাবে। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ‘মৃত ঘোড়া’র অস্তিত্ব ঠিকই বিদ্যমান; এর দূষণ প্রক্রিয়া রোধ করতে না পারলে ঘোড়ার মৃতদেহ জীবিত সবাইকে তলিয়ে দিতে পারে!
বাংলাদেশে ১৯৯২ সাল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় বহুনির্বাচনী প্রশ্ন পদ্ধতি প্রবর্তনের সঙ্গে নমুনা প্রশ্নের ব্যাংককে ভুলবশত ‘সিলেবাস’ ঘোষণা করায় রচনামূলক প্রশ্নে ফেল করেও দ্বিতীয়, এমনকি প্রথম বিভাগে পাস করার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছিল। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত এভাবে পাস করা ‘গ্র্যাজুয়েটদের’ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়ানো কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। কারণ তারা লেখাপড়াকে বড় বেশি সহজ কাজ বলে ভাবত। MCQ-এর সিলেবাস নামক মৃত ঘোড়াটিকে কবর দিয়েই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এগিয়ে চলছিল। আবার পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলকে জিপিএ আকারে প্রকাশ করা শুরু হলে জিপিএ-৫ নামক ঘোড়াটি জাতির শিক্ষাকে তাড়িয়ে বেড়াতে শুরু করে। জাতি এখন জিপিএ-৫-এর পেছনে পাগলের মতো ছুটে চলছে! জিপিএ-৫-এর মোহই এখন শিক্ষাব্যবস্থার ‘মৃত ঘোড়া’; একে এ মুহূর্তে কবরস্থ করা জরুরি।
লেখাপড়ার প্রধান উদ্দেশ্য কি জিপিএ-৫ পাওয়া? প্রাথমিক সমাপনী বা জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেলে তা কোথায়, কী দামে বেচা যায়? প্রাপ্ত মূল্যে কী কী জিনিস কেনা যায়? কী কারণে শিক্ষা প্রশাসন, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে জিপিএ-৫-এর পেছনে পাগলের মতো ছোটাছুটি করতে হবে? জিপিএ-৫-এর পেছনে দৌড়াতে গিয়ে পঞ্চম আর অষ্টম শ্রেণীর দ্বিতীয়ার্ধে নতুন পাঠ্যবিষয় পড়া বাদ দিয়ে শুধু পূর্বপঠিত বিষয়ের প্রশ্নোত্তর আর কোচিংয়ে কেন সময় নষ্ট করতে হবে? স্বাভাবিকভাবে আনন্দের সঙ্গে পাঠ্যাভ্যাস করে গেলে পরীক্ষায় ফলাফল ভালো হবে না- এরূপ ভুল ধারণার জন্মের কারণ সমূলে উৎপাটন করতে হবে।
পরীক্ষা তো শিক্ষাক্রমের সেই অংশ, যার মাধ্যমে কতটা বিদ্যা অর্জিত হয়েছে এবং অর্জিত জ্ঞান শিক্ষার্থীরা প্রয়োগ, বিশ্লেষণ, মূল্যায়ন- এসব করতে পারে কিনা তার মূল্যায়ন করা হয়। পরীক্ষাকে শিক্ষালাভের অংশ হিসেবে না দেখে আমরা কেন একে আতংক অথবা উন্নয়নের একমাত্র সিঁড়ি, এমনকি শিক্ষা বিভাগের সবার বা সরকারের ‘উন্নয়নের জোয়ার’ হিসেবে দেখব? সম্প্রতি প্রশ্নপত্র ফাঁসের যে কেলেংকারি চলছে তার মূলেও তো রয়েছে জিপিএ-৫-এর প্রদর্শনী! পবিত্র মনে পূর্ণ আন্তরিকতা, পরম সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে অগ্রসর না হলে কি কোনো জাতি উন্নতি করতে পারে?
পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করতে হলে প্রথম কাজ হবে জিপিএ-৫-এর প্রতি মোহ ত্যাগ করে এর প্রদর্শনী বন্ধ করা। তারপর দেখতে হবে শিক্ষা বিভাগের কোনো স্তরে কারও মাথায় এমন বাজে চিন্তা ঢুকে আছে কিনা যে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া তেমন খারাপ কিছু নয়; বরং এ কাজ করে কিছু অর্থ উপার্জন সম্ভব। জাতি-বিনাশী এরূপ ‘অসম্ভব’ জঘন্য চিন্তা কারও মাথায় থাকলে তা এ মুহূর্তে ঝেড়ে ফেলতে হবে। পরবর্তী কাজ হবে প্রশ্ন প্রণয়ন, মডারেশন, কম্পিউটার কম্পোজ, মুদ্রণ, সংরক্ষণ এবং বিতরণের মতো প্রাথমিক উৎসের প্রত্যেকটি স্তরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জনবল মনোবৈজ্ঞানিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগদান। যাদের পক্ষে লোভ/ভয়ের কোনো অবস্থাতেই বেশি নিচে নামা সম্ভব নয়, এ কাজ শুধু তাদেরই জন্য।
জাতির সামনে অনুসরণীয়-অনুকরণীয় জীবন্ত মডেলের অভাব বাংলাদেশের জন্য এক চরম দুর্ভাগ্য। দেশের কলুষিত সামাজিক পরিবেশে চরিত্র ঠিক রাখা পরম নীতিবানদের জন্যও কঠিন হতে পারে। তাই কোনো পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে কোন স্তরে কার মাধ্যমে সেটি ঘটেছে তা বিচার বিভাগীয় তদন্তে উদ্ঘাটন করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে পরে এ কাজের সঙ্গে জড়িত কারোর আর চারিত্রিক স্খলন ঘটে।
ফেসবুক, ই-মেইল, মোবাইল মেসেজিং ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের গৌণ উৎস বলে জানা যায়। সুতরাং এসব মাধ্যম যদি কোনোভাবে (যেমন- কম্পিউটার কম্পোজার বা ট্রেজারির পাহারাদারের কাছ থেকে) প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রাথমিক উপায় হিসেবে ব্যবহৃত হয়, শুধু তাহলেই এসব বন্ধ করা প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধের একটি উপায় হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
ড. আবদুস সাত্তার মোল্লা : শিক্ষা গবেষক; ওএসডি, মাউশি অধিদফতর
No comments