হাতছাড়া হচ্ছে বেতারের ঐতিহ্যবাহী শাহবাগ ভবন
বাংলাদেশ
বেতার যখন তার প্রতিষ্ঠার ৭৫তম বার্ষিকী পালন করছে, তখন সেই প্রতিষ্ঠানের
ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাথে জড়িত ভবনটি তাদের হাতছাড়া হতে যাচ্ছে। ঢাকার শাহবাগ
এলাকায় রাষ্ট্রীয় এই গণমাধ্যমের সদর দপ্তরের ভবনটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব
মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়কে দেয়া হচ্ছে। সরকারের উচ্চ পর্যায়ে এ ব্যাপারে
ইতিমধ্যেই সিদ্ধান্ত হয়েছে। বেতারের সাথে জড়িত ছিলেন এমন অনেকেই বলেছেন,
অনেক ঘটনার সাক্ষী এই ভবনটিকে অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে দেয়ায় ইতিহাস এবং
ঐতিহ্য নষ্ট হওয়ার একটা আশংকা তৈরি হয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ
বলেছে, ভবনটিকে ঘিরে ইতিহাস-ঐতিহ্য রক্ষা করেই খালি জায়গায় অটিস্টিকদের
জন্য চিকিৎসা কেন্দ্র করার চিন্তা করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠার ৭৫ বছরের মধ্যে
পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে বেতারের সদর দপ্তর রয়েছে ঢাকার শাহবাগে।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর শাহ্বাগের ভবনেই বাংলাদেশ বেতার নামে প্রতিষ্ঠানটি
নতুন করে যাত্রা শুরু করেছিল। সেই ভবনটিই থাকছে না বেতারের হাতে।
প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে বৈঠক থেকে ভবনটিকে
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে দেয়ার সিদ্ধান্ত
হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে বেতারের নতুন যাত্রায় অন্যতম একজন সংগঠক ছিলেন
কামাল লোহানী। তিনি মনে করেন, সরকারের এমন সিদ্ধান্তের কারণে বাঙালির
সংগ্রামের ইতিহাস নষ্ট হওয়ার আশংকা থাকছে। এটি তিনি মেনে নিতে পারছেন না।
তিনি বলছিলেন, ''মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
রহমানের ভাষণ এই ভবন থেকেই সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল।
কিন্তু পাকিস্তানি শাসকের নিষেধাজ্ঞায় সেদিন সেই ভাষণ সম্প্রচার করতে না
পেরে বেতারের কর্মকর্তা কর্মচারিরা সব অনুষ্ঠান সম্প্রচার বন্ধ করে
দিয়েছিলেন। পরে পাকিস্তানি শাসক অনুমতি দিলে পরদিন সকালে ভাষণ প্রচার করা
হয়েছিল।'' ''মুক্তিযুদ্ধের পর এই ভবনেই বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন এবং প্রথম
সরাসরি জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এই ভবন দখল
করেই সামরিক শাসকরা তাদের প্রচারণা চালিয়েছিলেন।'' শাহবাগে বেতার যাত্রা
শুরু করেছিলো দু’টি স্টুডিওকে সম্বল করে। ঐতিহাসিক অনেক ঘটনার সাক্ষী সেই
স্টুডিওতে গিয়ে দেখা যায়, বেতার সেখান থেকেই এখনও অনেক অনুষ্ঠান করছে।
সেখানে কথা হচ্ছিল বেতারের সাবেক উপ মহাপরিচালক আশফাকুর রহমান খানের সাথে।
ষাটের দশকের শুরু থেকে চার দশকেরও বেশি সময় তিনি বেতারের সাথে কাটিয়েছেন।
তিনি বলছিলেন, ''৭ মার্চের ভাষণ প্রচার করতে না পেরে বেতারের কর্মকর্তা
কর্মচারীরাই প্রথম আসহযোগ আন্দোলনে সাড়া দিয়েছিলেন। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট
থেকে অনেক পট পরিবর্তন হলেও সামরিক শাসকরা দীর্ঘ সময় এই বেতার ভবন দখলে
রেখেছিল।'' ৭৫ বছর আগে ১৯৩৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর বেতার যাত্রা শুরু করেছিল
ঢাকা ধ্বনি বিস্তার কেন্দ্র নামে। নাজিমউদ্দিন রোডে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
রেজিস্ট্রার নাজিরউদ্দিনের বাড়িতে সেই যাত্রা শুরুর অল্প সময়ের মধ্যেই
বেতারের নামকরণ করা হয়েছিল অল ইন্ডিয়া রেডিও। ১৯৪৭এ ভারত-পাকিস্তান ভাগ
হলে বেতার প্রথমে নাম পেয়েছিল পাকিস্তান ব্রডকাস্টিং সার্ভিস ঢাকা। পরে
হয়েছিল রেডিও পাকিস্তান। নাজিমউদ্দিন রোডের সেই বাড়িটি এখন শেখ
বোরহানউদ্দিন কলেজ। পাকিস্তান আমলেই ১৯৬০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শাহ্বাগে
তিন একর জমির উপর ভবন নির্মাণ করে সেখানে নেয়া হয়েছিল বেতারের পুরো
কার্যক্রম। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ বেতারের কিছু কার্যক্রম
শেরে বাংলা নগরে নতুন ভবনে স্থানান্তর করা হলেও সদর দপ্তর এবং মুল
কার্যক্রম শাহ্বাগের ভবনেই রয়ে যায়। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন,
আধুনিকায়নের অংশ হিসেবে বেতারের পুরো কার্যক্রম শেরেবাংলা নগরে এক
জায়গায় নেয়া হচ্ছে। শাহ্বাগে বেতার ভবনের দেয়াল ঘেষেই রয়েছে বারডেম
হাসপাতাল। আর উল্টোদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
হাসপাতাল। এই বড় দু’টি হাসপাতালেরই নজর অনেক আগে থেকে বেতারের ভবনের দিকে
ছিল বলে জানা গেছে। মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ বেতার নামে যাত্রা শুরুর পর
পরই বারডেম হাসপাতাল ভবনসহ ওই জমি চেয়েছিল বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা
রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে। তবে সেসময় বিষয়টি সামনে এগোয়নি।
কিন্তু এখন আবার বড় দু’টি হাসপাতাল বেতারের জায়গা চেয়েছিল। শেখ মুজিব
মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় আগে আবেদন করায় তারা জায়গাটি পেয়েছে বলে সরকারের
পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, ইতিহাস ঐতিহ্যে অংশ এমন ভবন বা জায়গা
একটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় বা হাসপাতাল নিয়ে কি করবে? বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রাণ গোপাল দত্ত দাবি করছেন,
তারা ইতিহাস রক্ষা করেই তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবেন। তারা সেখানে
অটিস্টিক শিশুদের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেন। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক
ইনুও কিন্তু কোন আশংকা বা অভিযোগকে পাত্তা দিতে রাজি নন। তিনি ভবনের চেয়ে
ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে পুরোনো যন্ত্রপাতিকে সংরক্ষণের বিষয়কে গুরুত্ব
দিতে চান। এবং সেই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন। হাসপাতাল
কর্তৃপক্ষ এবং তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের সাথে একমত নন কামাল লোহানী। তিনি মনে
করেন, শাহ্বাগে বেতারের ভবনের তিন একর জমির পুরোটার সাথেই জড়িয়ে আছে
ইতিহাস-ঐতিহ্য। পুরো জায়গাটিই যেখানে সাক্ষী হয়ে আছে, সেখানে অংশবিশেষ
রক্ষা করার কথা বলে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে বলে তার ধারণা। তিনি বলেছেন,
ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষী হিসেবে ভবনসহ পুরো জায়গাটিই সংরক্ষণ করা উচিত।
তবে, বেতারের শাহ্বাগের ভবনসহ জায়গাটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল
বিশ্ববিদ্যালয়কে দেয়ার প্রক্রিয়া একেবারে শেষ পর্যায়ে এসেছে। সরকারের
সিদ্ধান্তের পর জমির দলিল হয়েছে। এখন শুধু হস্তান্তরের পালা।– বিবিসি
No comments