প্রেমিকের ঘাড়ে দোষ চাপিয়েছে লিনা
গিয়াস উদ্দিন মাতব্বরের স্ত্রী লাভলী
আক্তার লিনা। কিন্তু এই পরিচয় গোপন করে বিয়ে করেছিল কলেজ ছাত্র তানভীর
আহমেদকে। তাকে নিয়ে স্বামীর মতই বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছে সে। ঈদের আগে
তানভীরকে সঙ্গে নিয়ে কেনাকাটা করেছে। তানভীরের সঙ্গে সময় কাটিয়েছে
রাজধানীর একটি আবাসিক হোটেলে। এভাবে প্রায়ই তানভীর-লিনা একান্তে সময়
কাটাতো। তিন দিনের রিমান্ডে পুলিশকে বিভিন্ন তথ্য দিলেও স্বামী হত্যার
অপরাধ স্বীকার করেনি সে। লিনার পরিকল্পনাতেই তার স্বামী গিয়াসকে হত্যা করে
তানভীর ও তার দুই বন্ধু। তানভীর ও তার বন্ধুরা আদালতে এসব কথা স্বীকার
করলেও স্বামী হত্যার দায় প্রেমিক ও তার বন্ধুদের ওপর চাপিয়েছে লিনা। যদিও
লিনার প্রেমিক কলেজ ছাত্র তানভীর আহমেদ ও তার দুই বন্ধু ইতিমধ্যে হত্যার
দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি দিয়েছে। গতকাল নিহত গিয়াসের
স্ত্রী লিনা ও কমার্স কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র আকিবুল ইসলাম জিসান
আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। এদিকে, নিহতের স্বজনরা দাবি করেছেন
লিনাকে রক্ষা করতে তৎপর হয়ে উঠেছে একটি মহল। যে কারণে নামকাওয়াস্তে
জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে লিনাকে। তারা এই মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ
করেছেন।
আদালতে জবাবন্দিতে প্রেমিক তানভীর ও তার দুই বন্ধুর ওপর খুনের দায় চাপিয়েছে লাভলী আক্তার লিনা। সে বলেছে, প্রেমের সম্পর্কের কারণেই লিনাকে কাছে পেতে চাইছিল তানভীর। সে অনেক দিন থেকে লিনার বাসায় আসার জন্য পীড়াপীড়ি করছিল। ঘটনার দিন ১৯শে অক্টোবর রাতে লিনার সঙ্গে দেখা করার জন্য বাসায় যায় তানভীর। তবে তানভীরের দুই বন্ধু মুক্ত ও জিসান বাসায় কখন ঢুকেছিল তা বুঝতে পারেনি বলে আদালতকে জানায় লিনা। তারা বাসায় ঢুকে লিনার হাত, পা ও মুখ বেঁধে রাখে। একই ভাবে অন্য কক্ষে তার সন্তানদের জিম্মি করে রাখে তানভীর ও তার দুই বন্ধু। এর মধ্যেই রাত পৌনে ১১টার দিকে ফ্ল্যাটের গেট নিজ হাতে থাকা চাবি দিয়ে খুলে বাসায় ঢুকেন গিয়াস উদ্দিন মাতব্বর। সঙ্গে সঙ্গে গিয়াসকে তানভীর ও তার দুই বন্ধু আঘাত করে। এভাবেই গিয়াসকে হত্যা করে তারা পালিয়ে যায়। গিয়াসকে হত্যা করতে চায়নি দাবি করে লিনা জানায়, গিয়াসের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনে সে অতিষ্ঠ ছিল। বিষয়টি সে তানভীরকে বলেছে। কিন্তু গিয়াসকে হত্যা করতে সে বলেনি। তার অজান্তেই প্রেমিক তানভীর ও তার দুই বন্ধু এই হত্যাকা- ঘটিয়েছে বলে লিনা জানায়। কিন্তু জিসান আদালতে জানিয়েছে, লিনার পরিকল্পনাতেই গিয়াসকে হত্যা করা হয়েছে। লিনা দীর্ঘদিন থেকেই গিয়াসকে হত্যার জন্য তানভীরকে চাপ দিচ্ছিল। এই কারণেই গত ঈদের আগে জিসান ও মুক্তকে গিয়াসকে হত্যার প্রস্তাব দেয় তানভীর। জিসানকে তখন তার মা-বাবা বাড়ি থেকে বের করে দেন। যে কারণে সে সহজে রাজি হয়। কিন্তু ওই সময়ে জিসানকে বাধা দিয়েছে মুক্ত। মুক্ত বলেছে, কাউকে খুন করা ঠিক হবে না। কিন্তু কিছু দিন পরে পারিবারিক কারণে মুক্তকে বাড়ি থেকে বের করে দেন তার বাবা-মা। ঠিক তখনই তানভীরের দেয়া প্রস্তাবে রাজি হয় জিসান ও মুক্ত। হত্যাকা-ের আগে তানভীরকে ১০ হাজার টাকা দিয়েছিল লিনা। ওই টাকা দিয়ে খুনের সময় ব্যবহৃত সরঞ্জাম ক্রয় করে তানভীর। জিসান জানায়, তারা মূলত ৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে এই হত্যাকা-ে সম্পৃক্ত হয়। হত্যার পর তাদের ১৫ হাজার টাকা দেয় তানভীর। বাকি টাকা পরে দেয়ার কথা ছিল। গতকাল দুপুর ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ ইউনুছ খানের আদালতে জবানবন্দি দেয় লিনা। পরে বেলা ২টা থেকে ৫টা পর্যন্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট অশোক কুমার দত্তের আদালতে জবানবন্দি দেয় জিসান। তার আগে ২৪শে অক্টোবর জিসানের মতো প্রায় একই রকম জবানবন্দি দেয় সরকারি বিজ্ঞান কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র সাদমান ইসলাম মুক্ত। হত্যাকা-ের পর ২২শে অক্টোবর হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে বিএন কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র তানভীর আহমেদ।
এদিকে, আদালতে লিনা হত্যার দায় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও পুলিশের কাছে জিজ্ঞাসাবাদে নানা তথ্য দিয়েছে সে। ১৫ই অক্টোবর কাজীপাড়ার বিয়ে করে লিনা ও তানভীর। বয়সে ১০ থেকে ১২ বছরের ছোট তানভীরকে বিয়ে করার পর থেকেই তাকে কাছে পেতে বিভোর ছিল লিনা। লিনার মতে, তানভীরকে সে অনেক টাকার মালিক বানাতে চেয়েছিল। সে বলেছে, শুনেছি তানভীর তার দাদা রমজান আলীর টাকায় বিএন কলেজে পড়ালেখা করে। এজন্য তাকে সুখী করতে চেয়েছিলাম। বিয়ে সম্পর্কে লিনা জানিয়েছে, বিয়ের পর তাকে তানভীরের বাসায় নিয়ে যায়। ওই দিন তানভীরের বাসায় কেউ ছিল না। তারা তখন অন্তরঙ্গ সময় কাটিয়েছে। বিয়ের দিন গোলাপি রঙের একটি থ্রি পিস পড়েছিল লিনা। এছাড়াও লিনা তার এক বান্ধবীর বাসায় নিয়ে যেতো তানভীরকে। ওই বাসায় কয়েকদিন যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। পরে মাঝে মাঝে একটি আবাসিক হোটেলে ঘণ্টা দুয়েক সময় কাটাতো তারা। গত ঈদের আগে গাউছিয়া, নিউ মার্কেটে কেনাকাটা করেছে দু’জন। এসময় একটি আবাসিক হোটেলে প্রায় দুই ঘণ্টা অন্তরঙ্গ সময় কাটিয়েছে তানভীর ও লিনা। এছাড়াও কখনও কখনও মিরপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেনে সময় কাটাতো তারা। শ্বশুরবাড়ির লোকজন লিনাকে সন্দেহ করতো। তাই মাঝে মাঝে নিজের সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে বের হতো সে। তানভীরকে আব্বু বলে ডাকতো তার পাঁচ বছর বয়সী সন্তান নিহাল। স্ত্রী হিসেবে লিনাকে সব সময় কাছে পেতে চাইতো তানভীরও। অন্যদিকে শুরু থেকেই স্বামী গিয়াস উদ্দিন মাতব্বরকে মেনে নিতে পারেনি লিনা। দুবার বাসায় নিজ প্রেমিকসহ ধরা পড়ার পর থেকে গিয়াস তাকে মানসিক ও শারীরিকভাবে অত্যাচার করতো বলে জানায়। এ থেকেই সে গিয়াসের প্রতি অতিষ্ঠ ছিল সে। উল্লেখ্য, গত ১৯শে অক্টোবর রোববার রাতে মিরপুর-১০-এর সি ব্লকের ১৫ নম্বর লেনের নিজ বাড়ির পঞ্চম তলায় হত্যা করা হয় গিয়াস উদ্দিন মাতব্বরকে। তিনি একজন ঝুট ব্যবসায়ী। ২০০৩ সালের ১৪ই অক্টোবর গিয়াসের সঙ্গে লিনার বিয়ে হয়। লাভলী আক্তার লিনা মিরপুর-১১ এর সি ব্লকের ১০ নম্বর সড়কের ১৪ নম্বর লাইনের লিয়াকত আলী মোল্লার কন্যা। এই দম্পতির নয় বছর বয়সী ইশিকা নামে এক কন্যা ও পাঁচ বছর বয়সী নিহাল নামে এক পুত্র রয়েছে। গিয়াস হত্যার পরপর তার স্ত্রী লাভলী আক্তার লিনাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে গত ২১শে অক্টোবর রাতে মিরপুরের বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেপ্তার করা হয় তানভীর, জিসান ও মুক্তকে। তানভীর আহমেদ মিরপুর ১০-এর পল্লবীর ১৪ নম্বর সড়কের ১৪ নম্বর বাসার আবু সাঈদ আজাদের পুত্র। তাদের গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলা সদরে। তার বন্ধু আকিবুল ইসলাম জিসান মাদারীপুর জেলা সদরের লেকেরপাড় এলাকার মিজানুর রহমানের পুত্র। অপর বন্ধু সাদমান ইসলাম মুক্ত টাঙ্গাইলের আদালতপাড়ার বাসিন্দা আবদুল লতিফের পুত্র। সে মিরপুর ১০-এর পল্লবীর এ ব্লকের ৪ নম্বর সড়কের ৮ নম্বর বাসায় থাকে।
No comments