তথ্য কমিশনই তথ্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বড় বাধা by বদিউল আলম মজুমদার
সম্প্রতি রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া উপজেলার কোলকন্দ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মমিনুল ইসলামের আমন্ত্রণে আমার সেখানে যাওয়ার সুযোগ হয়। সেই ইউনিয়নে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কর্তৃক বাস্তবায়িত ‘ইউনিয়ন পরিষদ গভর্নেন্স প্রজেক্ট’ প্রকাশিত একটি পোস্টার আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পোস্টারে লেখা ছিল: ‘তথ্য দিতে বাধ্য সবাই/আপনি যদি চান/সরকারি-বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠান’। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা তার সম্পূর্ণ বিপরীত। স্মরণ করা যেতে পারে যে গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের দীর্ঘদিনের দাবির মুখে ২০০৮ সালে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নাগরিকদের তথ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তথ্য অধিকার অধ্যাদেশ, ২০০৮ জারি করা হয়। অধ্যাদেশটি বিভিন্ন পর্যায়ের অংশীজনদের সঙ্গে ব্যাপক আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে প্রণীত হয়। নির্বাচনের পর নবম জাতীয় সংসদ অধ্যাদেশটি অনুমোদন করে। ব্যাপক আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে প্রণীত হওয়ায় এটি একটি শক্তিশালী আইন হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতিও পেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, কানাডাভিত্তিক সংগঠন ‘সেন্টার ফর ল অ্যান্ড ডেমোক্রেসি’র মূল্যায়ন অনুযায়ী, আমাদের আইনটি বিশ্বের ২০টি শক্তিশালী আইনের মধ্যে একটি।
নাগরিকের তথ্য জানার অধিকার একটি বহুল স্বীকৃত বিষয়। আদালত অনেক দিন থেকেই তথ্য প্রাপ্তির অধিকারকে নাগরিকের বাক্স্বাধীনতার অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে আসছেন। কারণ, নাগরিকের মতামত সৃষ্টি ও মত প্রকাশের সহায়তার জন্য তথ্য আবশ্যক। স্টেট অব ইউপি বনাম রাজ নারায়ণ [(১৯৭৫)৪এসএসসি ৪২৮] মামলায় ভারতীয় আদালত আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে ঘোষণা করেন যে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের ‘এজেন্ট’ হিসেবে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের দায়বদ্ধ হতে হয়, ফলে তাঁদের কোনো কিছু, সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া, জনগণের কাছ থেকে গোপন রাখার অবকাশ নেই। তথ্য অধিকার আইনের প্রস্তাবনায় আইনটির উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে: ‘যেহেতু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে চিন্তা, বিবেক ও বাক্স্বাধীনতা নাগরিকদের অন্যতম মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত এবং তথ্য প্রাপ্তির অধিকার চিন্তা, বিবেক ও বাক্স্বাধীনতার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ; এবং যেহেতু জনগণ প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক ও জনগণের ক্ষমতায়নের জন্য তথ্য অধিকার নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক; এবং যেহেতু জনগণের তথ্য অধিকার নিশ্চিত করা হইলে সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থা এবং সরকারি ও বিদেশি অর্থায়নে সৃষ্ট বা পরিচালিত বেসরকারি সংস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পাইবে, দুর্নীতি হ্রাস পাইবে ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হইবে; এবং যেহেতু সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থা এবং সরকারি ও বিদেশি অর্থায়নে সৃষ্ট বা পরিচালিত বেসরকারি সংস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বিধান করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়;’ তাই ‘তথ্যের অবাধ প্রবাহ এবং জনগণের তথ্য অধিকার নিশ্চিত করার বিধান করিবার লক্ষ্যে’ তথ্য অধিকার আইন প্রণয়ন করা হলো।
দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনের কারণে আমাদের সমাজে তথ্য গোপনের একটি অশুভ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। এ সংস্কৃতি থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যে এবং তথ্য অধিকার আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে আইনে একটি তথ্য কমিশন গঠনের বিধান রাখা হয়। আইনের ১৩ ধারা অনুযায়ী তথ্য কমিশনের উদ্দেশ্য হলো, মূলত তথ্য চেয়ে প্রত্যাখ্যাত সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিদের অভিযোগ নিষ্পন্ন করা। এ ছাড়া আইনে তথ্য কমিশনকে স্ব–প্রণোদিত হয়ে অথবা কোনো অভিযোগের ভিত্তিতে উত্থাপিত বিষয় সম্পর্কে অনুসন্ধান করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ২০০৯ সালে আইনটি সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত হলেও গত পাঁচ বছরে আমরা নাগরিকেরা এর সুফল পাওয়া থেকে ব্যাপকভাবে বঞ্চিত। প্রতিবেশী ভারতের মতো তথ্য অধিকারের দাবিতে আমাদের দেশে এখনো একটি আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। বিরাজমান তথ্য গোপন করে রাখার সংস্কৃতিতেও কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসেনি। এ পরিস্থিতির পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। তবে একটি বড় কারণ দলীয় অনুগত ব্যক্তিদের নিয়ে সরকারের আজ্ঞাবহ একটি তথ্য কমিশন গঠন, যে কমিশনের সদস্যরা নাগরিকের তথ্য পাওয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে ক্ষমতাসীনদের খুশি করার, অন্তত নাখোশ না করার ব্যাপারেই যেন বেশি আগ্রহী। রাজনৈতিক দলের বাৎসরিক আয়-ব্যয়ের হিসাব পাওয়ার আমাদের দীর্ঘ তিন বছরের একটি ব্যর্থ ও তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে তথ্য কমিশনের এমন জনবিরোধী ভূমিকা আমাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়েছে।
রাজনৈতিক দলের বাধ্যতামূলক নিবন্ধনের শর্ত হিসেবে প্রতিটি নিবন্ধিত দলকে প্রতিবছর তাদের আয়-ব্যয়ের অডিট করা হিসাব নির্বাচন কমিশনে জমা দিতে হয়। এই বাধ্যবাধকতার উদ্দেশ্য হলো, সংবিধান-স্বীকৃত ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার জন্য অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাজনৈতিক দলের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। তাই জনগণের অবগতির জন্য নির্বাচন কমিশনের এ তথ্য প্রকাশ করার কথা। আর যদি প্রকাশ না-ই করা হয়, তাহলে কমিশনের পক্ষে এ তথ্য নেওয়া অযৌক্তিক। বস্তুত, তা হবে রাজনৈতিক দলকে হয়রানি করার শামিল।
২০১১ সালের ৩ আগস্ট সুশাসনের জন্য নাগরিক—সুজনের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলের অডিট করা হিসাবের কপি চেয়ে আমি নির্বাচন কমিশনে লিখিত আবেদন করি। তথ্য না পেয়ে ২০১২ সালের ১৮ জুলাই ও ৫ আগস্ট এবং ২০১৩ সালের ১৬ এপ্রিল ও ১২ জুন আমি পুনরায় আবেদন করি। পরবর্তী সময়ে ২০১৩ সালের ১৪ জুলাই কমিশনের পক্ষ থেকে আমাদের জানানো হয় যে ‘নির্বাচন কমিশনে জমাকৃত রাজনৈতিক দলের বাৎসরিক আয়-ব্যয়ের হিসাব (অডিট রিপোর্ট) নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব তথ্য নয়,’ তাই আমি যেন এগুলো সংশ্লিষ্ট দলের কাছ থেকে সংগ্রহ করি। এরপর কমিশনের আপিল কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেও আমি তথ্য পেতে ব্যর্থ হই।
পরবর্তী সময়ে ২০১৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর রাজনৈতিক দলের আয়-ব্যয়ের হিসাবের কপি পাওয়ার লক্ষ্যে আমি তথ্য কমিশনের দ্বারস্থ হই। উভয় পক্ষকে শোনার পর কমিশন তার ২০১৩ সালের ২২ অক্টোবরের রায়ে আমাকে পুনরায় নির্বাচন কমিশনে আবেদন করতে বলে। একই সঙ্গে আইনের ৯(৮) ধারার অধীনে রাজনৈতিক দলের সম্মতির ভিত্তিতে আবেদনকৃত তথ্য আমাকে প্রদান করতে
নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দেয়। এরপর ২৩ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশন আমাকে লিখিতভাবে জানায় যে মাত্র তিনটি দল, যার মধ্যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অন্তর্ভুক্ত নয়, তাদের দলের আয়-ব্যয়ের হিসাবের কপি আমাকে দিতে সম্মত হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে আমি তথ্য কমিশনের কাছে ২০১৪ সালের ১ জুন অভিযোগ দায়ের করি যে নির্বাচন কমিশন তথ্য অধিকার আইনের অধীনে একটি ‘কর্তৃপক্ষ’ এবং কমিশনের কাছে জমা দেওয়া সকল তথ্য ‘পাবলিক ডকুমেন্ট’, কারও গোপনীয় তথ্য নয় এবং এগুলো প্রকাশ করতে নির্বাচন কমিশন বাধ্য। তথ্য কমিশনের নির্দেশে নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলসমূহের কাছে তথ্য অধিকার আইনের ধারা ৯(৮)-এর ভিত্তিতে ‘তৃতীয় পক্ষে’র মতামত নেওয়ার যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তাতে আইনের সঠিক পাঠ ও প্রয়োগ প্রতিফলিত হয়নি। এই অভিযোগের ভিত্তিতে ১৬ জুলাই তথ্য কমিশনে আরেকটি শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানিকালে আমি যুক্তি উত্থাপন করি যে রাজনৈতিক দল ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নয় এবং দলের আয়-ব্যয়ের হিসাবও গোপন তথ্য নয়। কারণ, এসব তথ্য জনগণের স্বার্থে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বিধিমালা অনুযায়ী কমিশনকে প্রদান করা হয়েছে। তাই আইনের ৯(৮) ধারা এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। একই সঙ্গে আমি রাজনৈতিক দলকে তথ্য অধিকার আইনের অধীনে ‘কর্তৃপক্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করারও দাবি করি। প্রসঙ্গত, গত বছর ভারতীয় তথ্য কমিশন রাজনৈতিক দলকে কর্তৃপক্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছে, যার ফলে ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলো তাদের তথ্য অধিকার আইনের অধীনে জনগণকে তথ্য দিতে বাধ্য হবে।
দুর্ভাগ্যবশত, শুনানি শেষে তথ্য কমিশনের ২০১৩ সালের ২২ অক্টোবরে দেওয়া রায় বহাল রাখা হয়। অর্থাৎ আমাদের বড় রাজনৈতিক দলগুলো সম্মতি দেয়নি বলে তাদের বাৎসরিক আয়-ব্যয়ের হিসাবের তথ্যপ্রাপ্তি থেকে আমাকে বঞ্চিত করা হয়। আমরা মনে করি যে কমিশনের এই রায় তথ্য অধিকার আইনের বিধান ও চেতনার সম্পূর্ণ পরিপন্থী এবং এর মাধ্যমে জনস্বার্থকে নগ্নভাবে জলাঞ্জলি দেওয়া হয়েছে। মূলত এতে করে তথ্য অধিকার আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্যই ভণ্ডুল হয়ে গেছে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক—সুজন।
নাগরিকের তথ্য জানার অধিকার একটি বহুল স্বীকৃত বিষয়। আদালত অনেক দিন থেকেই তথ্য প্রাপ্তির অধিকারকে নাগরিকের বাক্স্বাধীনতার অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে আসছেন। কারণ, নাগরিকের মতামত সৃষ্টি ও মত প্রকাশের সহায়তার জন্য তথ্য আবশ্যক। স্টেট অব ইউপি বনাম রাজ নারায়ণ [(১৯৭৫)৪এসএসসি ৪২৮] মামলায় ভারতীয় আদালত আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে ঘোষণা করেন যে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের ‘এজেন্ট’ হিসেবে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের দায়বদ্ধ হতে হয়, ফলে তাঁদের কোনো কিছু, সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া, জনগণের কাছ থেকে গোপন রাখার অবকাশ নেই। তথ্য অধিকার আইনের প্রস্তাবনায় আইনটির উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে: ‘যেহেতু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে চিন্তা, বিবেক ও বাক্স্বাধীনতা নাগরিকদের অন্যতম মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত এবং তথ্য প্রাপ্তির অধিকার চিন্তা, বিবেক ও বাক্স্বাধীনতার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ; এবং যেহেতু জনগণ প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক ও জনগণের ক্ষমতায়নের জন্য তথ্য অধিকার নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক; এবং যেহেতু জনগণের তথ্য অধিকার নিশ্চিত করা হইলে সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থা এবং সরকারি ও বিদেশি অর্থায়নে সৃষ্ট বা পরিচালিত বেসরকারি সংস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পাইবে, দুর্নীতি হ্রাস পাইবে ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হইবে; এবং যেহেতু সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থা এবং সরকারি ও বিদেশি অর্থায়নে সৃষ্ট বা পরিচালিত বেসরকারি সংস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বিধান করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়;’ তাই ‘তথ্যের অবাধ প্রবাহ এবং জনগণের তথ্য অধিকার নিশ্চিত করার বিধান করিবার লক্ষ্যে’ তথ্য অধিকার আইন প্রণয়ন করা হলো।
দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনের কারণে আমাদের সমাজে তথ্য গোপনের একটি অশুভ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। এ সংস্কৃতি থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যে এবং তথ্য অধিকার আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে আইনে একটি তথ্য কমিশন গঠনের বিধান রাখা হয়। আইনের ১৩ ধারা অনুযায়ী তথ্য কমিশনের উদ্দেশ্য হলো, মূলত তথ্য চেয়ে প্রত্যাখ্যাত সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিদের অভিযোগ নিষ্পন্ন করা। এ ছাড়া আইনে তথ্য কমিশনকে স্ব–প্রণোদিত হয়ে অথবা কোনো অভিযোগের ভিত্তিতে উত্থাপিত বিষয় সম্পর্কে অনুসন্ধান করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ২০০৯ সালে আইনটি সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত হলেও গত পাঁচ বছরে আমরা নাগরিকেরা এর সুফল পাওয়া থেকে ব্যাপকভাবে বঞ্চিত। প্রতিবেশী ভারতের মতো তথ্য অধিকারের দাবিতে আমাদের দেশে এখনো একটি আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। বিরাজমান তথ্য গোপন করে রাখার সংস্কৃতিতেও কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসেনি। এ পরিস্থিতির পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। তবে একটি বড় কারণ দলীয় অনুগত ব্যক্তিদের নিয়ে সরকারের আজ্ঞাবহ একটি তথ্য কমিশন গঠন, যে কমিশনের সদস্যরা নাগরিকের তথ্য পাওয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে ক্ষমতাসীনদের খুশি করার, অন্তত নাখোশ না করার ব্যাপারেই যেন বেশি আগ্রহী। রাজনৈতিক দলের বাৎসরিক আয়-ব্যয়ের হিসাব পাওয়ার আমাদের দীর্ঘ তিন বছরের একটি ব্যর্থ ও তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে তথ্য কমিশনের এমন জনবিরোধী ভূমিকা আমাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়েছে।
রাজনৈতিক দলের বাধ্যতামূলক নিবন্ধনের শর্ত হিসেবে প্রতিটি নিবন্ধিত দলকে প্রতিবছর তাদের আয়-ব্যয়ের অডিট করা হিসাব নির্বাচন কমিশনে জমা দিতে হয়। এই বাধ্যবাধকতার উদ্দেশ্য হলো, সংবিধান-স্বীকৃত ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার জন্য অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাজনৈতিক দলের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। তাই জনগণের অবগতির জন্য নির্বাচন কমিশনের এ তথ্য প্রকাশ করার কথা। আর যদি প্রকাশ না-ই করা হয়, তাহলে কমিশনের পক্ষে এ তথ্য নেওয়া অযৌক্তিক। বস্তুত, তা হবে রাজনৈতিক দলকে হয়রানি করার শামিল।
২০১১ সালের ৩ আগস্ট সুশাসনের জন্য নাগরিক—সুজনের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলের অডিট করা হিসাবের কপি চেয়ে আমি নির্বাচন কমিশনে লিখিত আবেদন করি। তথ্য না পেয়ে ২০১২ সালের ১৮ জুলাই ও ৫ আগস্ট এবং ২০১৩ সালের ১৬ এপ্রিল ও ১২ জুন আমি পুনরায় আবেদন করি। পরবর্তী সময়ে ২০১৩ সালের ১৪ জুলাই কমিশনের পক্ষ থেকে আমাদের জানানো হয় যে ‘নির্বাচন কমিশনে জমাকৃত রাজনৈতিক দলের বাৎসরিক আয়-ব্যয়ের হিসাব (অডিট রিপোর্ট) নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব তথ্য নয়,’ তাই আমি যেন এগুলো সংশ্লিষ্ট দলের কাছ থেকে সংগ্রহ করি। এরপর কমিশনের আপিল কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেও আমি তথ্য পেতে ব্যর্থ হই।
পরবর্তী সময়ে ২০১৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর রাজনৈতিক দলের আয়-ব্যয়ের হিসাবের কপি পাওয়ার লক্ষ্যে আমি তথ্য কমিশনের দ্বারস্থ হই। উভয় পক্ষকে শোনার পর কমিশন তার ২০১৩ সালের ২২ অক্টোবরের রায়ে আমাকে পুনরায় নির্বাচন কমিশনে আবেদন করতে বলে। একই সঙ্গে আইনের ৯(৮) ধারার অধীনে রাজনৈতিক দলের সম্মতির ভিত্তিতে আবেদনকৃত তথ্য আমাকে প্রদান করতে
নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দেয়। এরপর ২৩ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশন আমাকে লিখিতভাবে জানায় যে মাত্র তিনটি দল, যার মধ্যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অন্তর্ভুক্ত নয়, তাদের দলের আয়-ব্যয়ের হিসাবের কপি আমাকে দিতে সম্মত হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে আমি তথ্য কমিশনের কাছে ২০১৪ সালের ১ জুন অভিযোগ দায়ের করি যে নির্বাচন কমিশন তথ্য অধিকার আইনের অধীনে একটি ‘কর্তৃপক্ষ’ এবং কমিশনের কাছে জমা দেওয়া সকল তথ্য ‘পাবলিক ডকুমেন্ট’, কারও গোপনীয় তথ্য নয় এবং এগুলো প্রকাশ করতে নির্বাচন কমিশন বাধ্য। তথ্য কমিশনের নির্দেশে নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলসমূহের কাছে তথ্য অধিকার আইনের ধারা ৯(৮)-এর ভিত্তিতে ‘তৃতীয় পক্ষে’র মতামত নেওয়ার যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তাতে আইনের সঠিক পাঠ ও প্রয়োগ প্রতিফলিত হয়নি। এই অভিযোগের ভিত্তিতে ১৬ জুলাই তথ্য কমিশনে আরেকটি শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানিকালে আমি যুক্তি উত্থাপন করি যে রাজনৈতিক দল ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নয় এবং দলের আয়-ব্যয়ের হিসাবও গোপন তথ্য নয়। কারণ, এসব তথ্য জনগণের স্বার্থে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বিধিমালা অনুযায়ী কমিশনকে প্রদান করা হয়েছে। তাই আইনের ৯(৮) ধারা এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। একই সঙ্গে আমি রাজনৈতিক দলকে তথ্য অধিকার আইনের অধীনে ‘কর্তৃপক্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করারও দাবি করি। প্রসঙ্গত, গত বছর ভারতীয় তথ্য কমিশন রাজনৈতিক দলকে কর্তৃপক্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছে, যার ফলে ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলো তাদের তথ্য অধিকার আইনের অধীনে জনগণকে তথ্য দিতে বাধ্য হবে।
দুর্ভাগ্যবশত, শুনানি শেষে তথ্য কমিশনের ২০১৩ সালের ২২ অক্টোবরে দেওয়া রায় বহাল রাখা হয়। অর্থাৎ আমাদের বড় রাজনৈতিক দলগুলো সম্মতি দেয়নি বলে তাদের বাৎসরিক আয়-ব্যয়ের হিসাবের তথ্যপ্রাপ্তি থেকে আমাকে বঞ্চিত করা হয়। আমরা মনে করি যে কমিশনের এই রায় তথ্য অধিকার আইনের বিধান ও চেতনার সম্পূর্ণ পরিপন্থী এবং এর মাধ্যমে জনস্বার্থকে নগ্নভাবে জলাঞ্জলি দেওয়া হয়েছে। মূলত এতে করে তথ্য অধিকার আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্যই ভণ্ডুল হয়ে গেছে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক—সুজন।
No comments