সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান দায় চালকের নয়, সরকারের -সাক্ষাৎকারে শামসুল হক by ফারুক ওয়াসিফ
শামসুল হকের
জন্ম ১৯৬২ সালে। তাঁর পিএইচডি সম্পন্ন হয় যুক্তরাজ্যের সাউদাম্পটন
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের
(বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগে অধ্যাপনা করছেন। দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের
সাবেক পরিচালক শামসুল হকের গবেষণাগ্রন্থ হাইওয়ে অ্যান্ড রেলওয়ে
ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকাশিত হয়েছে অস্ট্রিয়া থেকে।
# সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফারুক ওয়াসিফ
প্রথম আলো # সড়ক দুর্যোগপ্রবণ এলাকা বা দুর্গত এলাকায় পরিণত হয়েছে। এর সত্যিকার চিত্রটা কী?
শামসুল হক # সরকার দাবি করে যে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা কমছে; কিন্তু বাস্তবতা হলো উল্টো। পুলিশের রেকর্ডে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত-আহতের আসল চিত্র আসে না। ২০১০ সালে ধারাবাহিকভাবে বার্ষিক মৃত্যুর সংখ্যা ছিল প্রায় তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার। এখন সেটা পুলিশের হিসাবে এক হাজার ৯০০। পুলিশ প্রথম থেকেই সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের পরিসংখ্যানের দায়িত্ব আবশ্যিক বলে মানেনি, তাদের গাফিলতিও ছিল। এ কারণে প্রকৃত প্রতিবেদন উঠে আসে না। এই তথ্য অবমূল্যায়নের হার ৩৫ থেকে ৫৪ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের জরিপে নিহতের সংখ্যা বছরে প্রায় ১২ হাজার, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে এটা প্রায় ১৮ হাজার। তার মানে বিরাট ব্যবধান।
শহরাঞ্চলে মোট নিহতের ৭০ ভাগই পথচারী, সারা দেশ মিলিয়ে এই হার প্রায় ৫৪ শতাংশ। এটা নীরব মৃত্যু; এসব খবরের বেশির ভাগই কিন্তু পুলিশের কাছে যায় না। পুলিশ বেশি নজর দেয় দুটি বাহনের মধ্যে সংঘর্ষ হলে, যেখানে মালিক–বিমার প্রশ্ন জড়িত। সমস্যার প্রকৃতি এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাপ না জানা থাকলে প্রতিকার হবে কী করে? রাজনীতিবিদেরাও বিষয়টাকে গুরুত্ব দিতে চান না। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে সড়ক দুর্ঘটনায় অর্থনৈতিক ক্ষতি জিডিপির ১ থেকে ২ শতাংশ। দেড় শতাংশ ধরলেও প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা! এত লোক নিহত হচ্ছে, উদীয়মান অর্থনীতির বিরাট রক্তক্ষরণ—অথচ সরকার সিরিয়াস না। মহাসড়ককে ভিত্তি করে বাণিজ্য হচ্ছে, অথচ নিরাপদ করা হচ্ছে না।
প্রথম আলো # এসব আসলে কতটা দুর্ঘটনা আর কতটা দায়িত্বহীনতা?
শামসুল হক # আমাদের পরিকল্পনা ও নকশা প্রণয়ন, রক্ষণাবেক্ষণ, পরিচালনার তদারকি—সব ক্ষেত্রেই বিশৃঙ্খলা। সংজ্ঞা অনুযায়ী মহাসড়কে লোকাল গাড়ি ও পথচারী আসার কথা নয়। শ্রেণিবিন্যাসের দিক থেকে স্থানীয় রাস্তা, মধ্যম পর্যায়ের রাস্তা, প্রধান সড়ক; তার পরে ধমনি সড়ক বা মহাসড়ক। সংজ্ঞা অনুসারে মহাসড়ক কোনো এলাকাকে রাজধানীর সঙ্গে অথবা বন্দরনগরের সঙ্গে সংযুক্ত করে এবং এর মান হবে সর্বোচ্চ পর্যায়ের। এই মান আসে ব্যবহারকারীদের মধ্যে শৃঙ্খলা দিয়ে। সব ব্যবহারকারী যদি সমগতির হলে সড়কের ঝুঁকি কম থাকে। সে কারণেই মহাসড়কে দ্রুতগতির ও বড় গাড়ি চলে বিধায় স্থানীয় চলাচলের গাড়ি ও পথচারীদের কোনোমতেই মিশতে দেওয়া হয় না। তারা নিচ দিয়ে বা ওপর দিয়ে চলে যায়। এর জন্য প্রতিবন্ধকতা থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে যত্রতত্র মহাসড়কে যে কেউ ঢুকে পড়তে পারে। এটা পরিকল্পনার বিশৃঙ্খলার প্রমাণ। সে অর্থে আমাদের দেশে সংজ্ঞা অনুযায়ী মহাসড়ক/ধমনি সড়ক নেই। কিন্তু এটা দরকার অর্থনৈতিক তৎপরতাকে গতিশীল করা এবং উৎসবে বড় আকারে মানুষ চলাচলের জন্য। যদি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কোথাও হোঁচট খেতে না হতো, তাহলে কী পরিমাণ সময় ও অর্থ বেঁচে যেত!
প্রথম আলো # ঘন বসতি, ভূমির স্বল্পতা, মানুষের আচরণ মিলিয়ে আমাদের প্রধান যোগাযোগের ব্যবস্থা কি সড়কনির্ভর হওয়া উচিত হয়েছে, নাকি রেল ও নৌপথকে অবলম্বন করাও দরকার ছিল?
শামসুল হক # সব দেশেই পানিপথ, সড়ক ও রেলের মধ্যে ভারসাম্য থাকে। নৌপথ সরকার, যাত্রী ও ব্যবসায়ী সবার জন্যই ভালো ছিল। বছরে পাঁচ হাজার কিলোমিটার নৌপথ চলাচলের উপযোগী থাকে। তাই নদী ও রেল মিলিয়ে যোগাযোগের সমন্বয় করা গেলে, জীবন, সময় ও অর্থের এত বিপুল খেসারত দিতে হতো না। তবে সড়কপথ ডোর টু ডোর সুবিধা দেয়, নৌ ও রেলপথের সুবিধাটা টার্মিনাল টু টার্মিনাল। জনগণও সড়ক বেশি পছন্দ করে। ডোনার এজেন্সিগুলোও গোড়া থেকেই ব্যবসায়িক স্বার্থে সড়ক উন্নয়নে আগ্রহী। কারণ, তাতে গাড়ি, পার্টস ইত্যাদির ব্যবসা চলে। সুতরাং সড়ককে পছন্দ করে সরকার, ডোনার ও পরিবহন ব্যবসায়ী। এ জন্যই যোগাযোগব্যবস্থায় ভারসাম্য নেই।
প্রথম আলো # এরই পরিণতি ওই ২০ হাজার মানুষের মৃত্যু এবং ১৫ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি?
শামসুল হক # একদম তাই। তবে এটা হতো না যদি আমাদের পরিকল্পনায় শৃঙ্খলা থাকত। সরকার যদি প্রথম থেকেই মহাসড়কে কাউকে ঢুকতে না দিত...ভারত কিন্তু ১৯৯৮ সালে এই নীতি নিয়েছে। তারা দেখল, অবকাঠামোর কল্যাণে চীন এগিয়ে যাচ্ছে। কীভাবে? তারা সড়ককে দ্বিস্তরবিশিষ্ট করে নিয়েছে। মহাসড়কে চলবে দূরগামী বাহন, সমান্তরালে পার্শ্বরাস্তায় চলবে আঞ্চলিক বাহন। জমি যেহেতু কম, তাই সবাই এই পদ্ধতি নেয়। এতে জাতীয় ও আঞ্চলিক অর্থনীতি উভয়ই উপকৃত হয়। উচ্চগতির জন্য কিন্তু দুর্ঘটনা হয় না। এটা হয় অসম গতির গাড়ি এক সড়কে চলাচল করলে। দুই লেনের সড়কে যখন একটা রিকশা বা নছিমন চলে, তখন তা কমপক্ষে ২০০ গাড়িকে ওভারটেক করতে বাধ্য করে। দুর্ঘটনার সম্ভাবনা এতেই বাড়ে। তখন আমরা চালককে দোষ দিই, কিন্তু এই বিশৃঙ্খলা ট্রিগার করল ওসব স্বল্পগতির বাহন।
প্রথম আলো # রাজনীতি, ব্যবসা, দুর্নীতি যখন এত ব্যাপক, তখন ভালো পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা কীভাবে আশা করা যায়?
শামসুল হক # আমাদের সড়কে চলছে পরিকল্পনার এবং ভূমি ব্যবহারের বিশৃঙ্খলা। গাড়ির লাইসেন্স ও চালকের লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়াও দুর্নীতিগ্রস্ত। এসবের কারণেই কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটে। মোটর ভেহিকেল অর্ডিন্যান্স ১৯৮৩ অনুযায়ী, একজন চালকের লাইসেন্স দেওয়ার আগে তাঁর ৩৫ মিনিটের মহাসড়কে গাড়ি চালানোর পরীক্ষা ও তাত্ত্বিক পরীক্ষা নিতে হয়। এটা করার জন্য সরকারের লোকবল খুবই কম। বিআরটিএর হাতে এককভাবে সব দায়িত্ব কেন্দ্রীভূত। তারা রেজিস্ট্রেশন করবে, লাইসেন্স দেবে, ফিটনেসও পরীক্ষা করবে! কোথাও এটা হয় না।
প্রথম আলো # এই প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার কীভাবে করা যায়?
শামসুল হক # সরকারের খুব দ্রুত বিআরটিএর সংস্কারে যাওয়া দরকার। বিআরটিএর হিসাবে গাড়ি আছে ২১ লাখ, চালক আছে ১৩ লাখ। তার ওপর একটা বাণিজ্যিক গাড়ি চালাতে গেলে একাধিক চালকের প্রয়োজন হয়। সে কারণে ঘাটতি প্রায় ১৫/১৬ লাখ। এ অবস্থায় নতুন গাড়ির রেজিস্ট্রেশনের সময়ই সরকার আসলে সেই গাড়িটা হেলপার দিয়ে চালানোর অবস্থা সৃষ্টি করে। এই প্রেক্ষাপটে কোনোভাবেই নতুন গাড়ির নিবন্ধন দেওয়ার নৈতিক অধিকার সরকারের থাকে না। এভাবে সরকার নিজেই স্বঘোষিত চালক সৃষ্টিকে উৎসাহিত করছে। তার মানে, ঝুঁকি কমানোর বদলে সরকারই তা বাড়াচ্ছে। আবার দুর্ঘটনার তদন্তও তারাই করে, এবং তাতে নিজেদের দায় অস্বীকার করে।
প্রথম আলো # এটা তো সচেতন নৈরাজ্য! খুনি নৈরাজ্যও বলা যায়।
শামসুল হক # কেবল চালককে দোষ দিয়ে লাভ নেই। এটা রাষ্ট্রের সচেতন নৈরাজ্য। সারা দেশে মাত্র ৪১ জন ফিটনেস পরিদর্শক আছেন। এ থেকেই বোঝা যায়, পুরো ব্যাপারটা চলছে সম্পূর্ণ অবহেলার মধ্যে। এ কারণেই সড়ক দুর্ঘটনা ব্যবস্থাপনার অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে।
প্রথম আলো # মহাসড়কগুলোকে এ অবস্থায় ব্যবহারযোগ্য ও গতিশীল করতে হলে কী করতে হবে?
শামসুল হক # খুব দ্রুত সরকারকে মধ্যম আয়ের দেশের প্রধান খুঁটি হিসেবে অবকাঠামোর উন্নয়ন করতে হবে। সরকার চার লেনের রাস্তা ঠিকই বানাচ্ছে, কিন্তু আবার আগের মতো দুই লেন দুই লেন করে দিচ্ছে। এখানে নিম্নগতির বাহনের অনুপ্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করছে না। মহাসড়কের দুই পাশে ডিভাইডার দিয়ে তার সমান্তরালে লোকাল গাড়ির জন্য ব্যবস্থা করা দরকার। কেউ সড়কে নামছে ১০ ঘণ্টার জন্য, আরেকজন ১০ মিনিটের যাত্রা করবে। এদের উদ্দেশ্যই তো আলাদা। এদের অবশ্যই আলাদা করে দিতে হবে। এটা করা খুবই সম্ভব। হাটিকুমরুল মহাসড়কে ইতিমধ্যে এই ব্যবস্থা আছে, সেটা খুব সুন্দর চলছে। সেখানে দুর্ঘটনা খুবই কম। প্রকৃত দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমরা সব সময় রক্তের পক্ষে আমাদের মতামত ও বিশ্লেষণ দিয়ে দিই। অর্থাৎ সাইকেলের সঙ্গে রিকশার দুর্ঘটনা হলে রিকশার পক্ষে, রিকশার সঙ্গে কারের হলে রিকশার পক্ষে, বাসের সঙ্গে ট্রাকের হলে বাসের পক্ষে বিশ্লেষণ দিয়ে দিই। বাংলাদেশে ওভারটেক করার মূল কারণ, সামনে কোনো ধীরগতির গাড়ির উপস্থিতি। একটা বাণিজ্যিক বাহনের সময় মেইনটেইন করার দরকার হয়, তাই তার ওভারটেক করার প্রয়োজন হয়। এটাই মূল সমস্যা।
প্রথম আলো # মানবাধিকারের দিক থেকেও তো বিষয়টা ভয়াবহ। প্রায় ২০ হাজার মৃত্যু, অসুবিধাজনক বাহনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকা। এর কারণে মানুষের মানসিকতা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। গতির স্বস্তি ও নিরাপত্তা পাওয়া তাই মানবাধিকারের অংশ কি না।
শামসুল হক # অবশ্যই। মানুষ যে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে, সামাজিক সহিংসতা যে বাড়ছে, দুর্ঘটনা ঘটলে পিটিয়ে মেরে ফেলার সামাজিক ক্রসফায়ারের যেসব ঘটনা ঘটছে, এর জন্য কিছুটা দায়ী এই নৈরাজ্যকর সড়কব্যবস্থা। দুর্ঘটনার পর চালকের দাঁড়িয়ে থাকার উপায় নেই। তাই সে পালিয়ে যাওয়ার সময় আরও মানুষ হত্যা করে। সড়কের বাস্তবতা মানুষের ধৈর্যের সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে। তাই সড়ককে চলার উপযোগী করতে হলে দুই ধরনের যোগ্যতা সৃষ্টি করতে হবে। একটা হলো দ্রুতগতির অন্যটা ধীরগতির। দুই ধরনের গাড়ি ও গতি চালক ও যাত্রীদের দুই ধরনের মানসিকতা তৈরি করে। এই বিষম বাস্তবতা বিক্ষিপ্ত মানসিকতার জন্ম দেয়।
প্রায় ৭০ শতাংশ দুর্ঘটনা হয় মহাসড়কে। তাও আবার হয় মাত্র ৪ শতাংশ স্থানে। তাহলে এই ৪ শতাংশ স্থানে সুনির্দিষ্ট সমাধান করা যায় না? সারা দেশে ৫৪ শতাংশ এবং শহর এলাকাতে ৭০ শতাংশ যারা মারা যায়, তারা হলো পথচারী। কারণ, ফুটপাত দখল হয়ে আছে। সরকার চাইলে কোনো খরচ না করেই কেবল আইন প্রয়োগ করে ফুটপাতগুলো তিন মাসের জন্য অবমুক্ত করতে পারে। সরকার কখনোই এই সংকটকে গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছে না। এর থেকে বের হওয়ার কতগুলো সরল পথ আছে, আন্তরিকতার অভাবে সরকার সেটা করছে না। তা ছাড়া, নানা রকম ব্যবসায়িক ও কায়েমি স্বার্থও বাধা তৈরি করে। দুর্ভাগ্যজনক আমরা কোনো দিন সমস্যার গোড়ায় সমাধান তৈরি করি না। একে বাড়তে দিয়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যাই। তাহলে দাঁড়াল: পুলিশের মাধ্যমে দুর্ঘটনায় হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত চিত্র একেবারেই আসছে না। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকভাবে কাজ করছে না এবং বিজ্ঞানভিত্তিক জনবান্ধব পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা নেই। তাই আমি বলি, সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান দায় চালকের নয়, সরকারের।
প্রথম আলো # আপনাকে ধন্যবাদ।
শামসুল হক # ধন্যবাদ।
# সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফারুক ওয়াসিফ
প্রথম আলো # সড়ক দুর্যোগপ্রবণ এলাকা বা দুর্গত এলাকায় পরিণত হয়েছে। এর সত্যিকার চিত্রটা কী?
শামসুল হক # সরকার দাবি করে যে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা কমছে; কিন্তু বাস্তবতা হলো উল্টো। পুলিশের রেকর্ডে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত-আহতের আসল চিত্র আসে না। ২০১০ সালে ধারাবাহিকভাবে বার্ষিক মৃত্যুর সংখ্যা ছিল প্রায় তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার। এখন সেটা পুলিশের হিসাবে এক হাজার ৯০০। পুলিশ প্রথম থেকেই সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের পরিসংখ্যানের দায়িত্ব আবশ্যিক বলে মানেনি, তাদের গাফিলতিও ছিল। এ কারণে প্রকৃত প্রতিবেদন উঠে আসে না। এই তথ্য অবমূল্যায়নের হার ৩৫ থেকে ৫৪ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের জরিপে নিহতের সংখ্যা বছরে প্রায় ১২ হাজার, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে এটা প্রায় ১৮ হাজার। তার মানে বিরাট ব্যবধান।
শহরাঞ্চলে মোট নিহতের ৭০ ভাগই পথচারী, সারা দেশ মিলিয়ে এই হার প্রায় ৫৪ শতাংশ। এটা নীরব মৃত্যু; এসব খবরের বেশির ভাগই কিন্তু পুলিশের কাছে যায় না। পুলিশ বেশি নজর দেয় দুটি বাহনের মধ্যে সংঘর্ষ হলে, যেখানে মালিক–বিমার প্রশ্ন জড়িত। সমস্যার প্রকৃতি এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাপ না জানা থাকলে প্রতিকার হবে কী করে? রাজনীতিবিদেরাও বিষয়টাকে গুরুত্ব দিতে চান না। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে সড়ক দুর্ঘটনায় অর্থনৈতিক ক্ষতি জিডিপির ১ থেকে ২ শতাংশ। দেড় শতাংশ ধরলেও প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা! এত লোক নিহত হচ্ছে, উদীয়মান অর্থনীতির বিরাট রক্তক্ষরণ—অথচ সরকার সিরিয়াস না। মহাসড়ককে ভিত্তি করে বাণিজ্য হচ্ছে, অথচ নিরাপদ করা হচ্ছে না।
প্রথম আলো # এসব আসলে কতটা দুর্ঘটনা আর কতটা দায়িত্বহীনতা?
শামসুল হক # আমাদের পরিকল্পনা ও নকশা প্রণয়ন, রক্ষণাবেক্ষণ, পরিচালনার তদারকি—সব ক্ষেত্রেই বিশৃঙ্খলা। সংজ্ঞা অনুযায়ী মহাসড়কে লোকাল গাড়ি ও পথচারী আসার কথা নয়। শ্রেণিবিন্যাসের দিক থেকে স্থানীয় রাস্তা, মধ্যম পর্যায়ের রাস্তা, প্রধান সড়ক; তার পরে ধমনি সড়ক বা মহাসড়ক। সংজ্ঞা অনুসারে মহাসড়ক কোনো এলাকাকে রাজধানীর সঙ্গে অথবা বন্দরনগরের সঙ্গে সংযুক্ত করে এবং এর মান হবে সর্বোচ্চ পর্যায়ের। এই মান আসে ব্যবহারকারীদের মধ্যে শৃঙ্খলা দিয়ে। সব ব্যবহারকারী যদি সমগতির হলে সড়কের ঝুঁকি কম থাকে। সে কারণেই মহাসড়কে দ্রুতগতির ও বড় গাড়ি চলে বিধায় স্থানীয় চলাচলের গাড়ি ও পথচারীদের কোনোমতেই মিশতে দেওয়া হয় না। তারা নিচ দিয়ে বা ওপর দিয়ে চলে যায়। এর জন্য প্রতিবন্ধকতা থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে যত্রতত্র মহাসড়কে যে কেউ ঢুকে পড়তে পারে। এটা পরিকল্পনার বিশৃঙ্খলার প্রমাণ। সে অর্থে আমাদের দেশে সংজ্ঞা অনুযায়ী মহাসড়ক/ধমনি সড়ক নেই। কিন্তু এটা দরকার অর্থনৈতিক তৎপরতাকে গতিশীল করা এবং উৎসবে বড় আকারে মানুষ চলাচলের জন্য। যদি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কোথাও হোঁচট খেতে না হতো, তাহলে কী পরিমাণ সময় ও অর্থ বেঁচে যেত!
প্রথম আলো # ঘন বসতি, ভূমির স্বল্পতা, মানুষের আচরণ মিলিয়ে আমাদের প্রধান যোগাযোগের ব্যবস্থা কি সড়কনির্ভর হওয়া উচিত হয়েছে, নাকি রেল ও নৌপথকে অবলম্বন করাও দরকার ছিল?
শামসুল হক # সব দেশেই পানিপথ, সড়ক ও রেলের মধ্যে ভারসাম্য থাকে। নৌপথ সরকার, যাত্রী ও ব্যবসায়ী সবার জন্যই ভালো ছিল। বছরে পাঁচ হাজার কিলোমিটার নৌপথ চলাচলের উপযোগী থাকে। তাই নদী ও রেল মিলিয়ে যোগাযোগের সমন্বয় করা গেলে, জীবন, সময় ও অর্থের এত বিপুল খেসারত দিতে হতো না। তবে সড়কপথ ডোর টু ডোর সুবিধা দেয়, নৌ ও রেলপথের সুবিধাটা টার্মিনাল টু টার্মিনাল। জনগণও সড়ক বেশি পছন্দ করে। ডোনার এজেন্সিগুলোও গোড়া থেকেই ব্যবসায়িক স্বার্থে সড়ক উন্নয়নে আগ্রহী। কারণ, তাতে গাড়ি, পার্টস ইত্যাদির ব্যবসা চলে। সুতরাং সড়ককে পছন্দ করে সরকার, ডোনার ও পরিবহন ব্যবসায়ী। এ জন্যই যোগাযোগব্যবস্থায় ভারসাম্য নেই।
প্রথম আলো # এরই পরিণতি ওই ২০ হাজার মানুষের মৃত্যু এবং ১৫ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি?
শামসুল হক # একদম তাই। তবে এটা হতো না যদি আমাদের পরিকল্পনায় শৃঙ্খলা থাকত। সরকার যদি প্রথম থেকেই মহাসড়কে কাউকে ঢুকতে না দিত...ভারত কিন্তু ১৯৯৮ সালে এই নীতি নিয়েছে। তারা দেখল, অবকাঠামোর কল্যাণে চীন এগিয়ে যাচ্ছে। কীভাবে? তারা সড়ককে দ্বিস্তরবিশিষ্ট করে নিয়েছে। মহাসড়কে চলবে দূরগামী বাহন, সমান্তরালে পার্শ্বরাস্তায় চলবে আঞ্চলিক বাহন। জমি যেহেতু কম, তাই সবাই এই পদ্ধতি নেয়। এতে জাতীয় ও আঞ্চলিক অর্থনীতি উভয়ই উপকৃত হয়। উচ্চগতির জন্য কিন্তু দুর্ঘটনা হয় না। এটা হয় অসম গতির গাড়ি এক সড়কে চলাচল করলে। দুই লেনের সড়কে যখন একটা রিকশা বা নছিমন চলে, তখন তা কমপক্ষে ২০০ গাড়িকে ওভারটেক করতে বাধ্য করে। দুর্ঘটনার সম্ভাবনা এতেই বাড়ে। তখন আমরা চালককে দোষ দিই, কিন্তু এই বিশৃঙ্খলা ট্রিগার করল ওসব স্বল্পগতির বাহন।
প্রথম আলো # রাজনীতি, ব্যবসা, দুর্নীতি যখন এত ব্যাপক, তখন ভালো পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা কীভাবে আশা করা যায়?
শামসুল হক # আমাদের সড়কে চলছে পরিকল্পনার এবং ভূমি ব্যবহারের বিশৃঙ্খলা। গাড়ির লাইসেন্স ও চালকের লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়াও দুর্নীতিগ্রস্ত। এসবের কারণেই কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটে। মোটর ভেহিকেল অর্ডিন্যান্স ১৯৮৩ অনুযায়ী, একজন চালকের লাইসেন্স দেওয়ার আগে তাঁর ৩৫ মিনিটের মহাসড়কে গাড়ি চালানোর পরীক্ষা ও তাত্ত্বিক পরীক্ষা নিতে হয়। এটা করার জন্য সরকারের লোকবল খুবই কম। বিআরটিএর হাতে এককভাবে সব দায়িত্ব কেন্দ্রীভূত। তারা রেজিস্ট্রেশন করবে, লাইসেন্স দেবে, ফিটনেসও পরীক্ষা করবে! কোথাও এটা হয় না।
প্রথম আলো # এই প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার কীভাবে করা যায়?
শামসুল হক # সরকারের খুব দ্রুত বিআরটিএর সংস্কারে যাওয়া দরকার। বিআরটিএর হিসাবে গাড়ি আছে ২১ লাখ, চালক আছে ১৩ লাখ। তার ওপর একটা বাণিজ্যিক গাড়ি চালাতে গেলে একাধিক চালকের প্রয়োজন হয়। সে কারণে ঘাটতি প্রায় ১৫/১৬ লাখ। এ অবস্থায় নতুন গাড়ির রেজিস্ট্রেশনের সময়ই সরকার আসলে সেই গাড়িটা হেলপার দিয়ে চালানোর অবস্থা সৃষ্টি করে। এই প্রেক্ষাপটে কোনোভাবেই নতুন গাড়ির নিবন্ধন দেওয়ার নৈতিক অধিকার সরকারের থাকে না। এভাবে সরকার নিজেই স্বঘোষিত চালক সৃষ্টিকে উৎসাহিত করছে। তার মানে, ঝুঁকি কমানোর বদলে সরকারই তা বাড়াচ্ছে। আবার দুর্ঘটনার তদন্তও তারাই করে, এবং তাতে নিজেদের দায় অস্বীকার করে।
প্রথম আলো # এটা তো সচেতন নৈরাজ্য! খুনি নৈরাজ্যও বলা যায়।
শামসুল হক # কেবল চালককে দোষ দিয়ে লাভ নেই। এটা রাষ্ট্রের সচেতন নৈরাজ্য। সারা দেশে মাত্র ৪১ জন ফিটনেস পরিদর্শক আছেন। এ থেকেই বোঝা যায়, পুরো ব্যাপারটা চলছে সম্পূর্ণ অবহেলার মধ্যে। এ কারণেই সড়ক দুর্ঘটনা ব্যবস্থাপনার অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে।
প্রথম আলো # মহাসড়কগুলোকে এ অবস্থায় ব্যবহারযোগ্য ও গতিশীল করতে হলে কী করতে হবে?
শামসুল হক # খুব দ্রুত সরকারকে মধ্যম আয়ের দেশের প্রধান খুঁটি হিসেবে অবকাঠামোর উন্নয়ন করতে হবে। সরকার চার লেনের রাস্তা ঠিকই বানাচ্ছে, কিন্তু আবার আগের মতো দুই লেন দুই লেন করে দিচ্ছে। এখানে নিম্নগতির বাহনের অনুপ্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করছে না। মহাসড়কের দুই পাশে ডিভাইডার দিয়ে তার সমান্তরালে লোকাল গাড়ির জন্য ব্যবস্থা করা দরকার। কেউ সড়কে নামছে ১০ ঘণ্টার জন্য, আরেকজন ১০ মিনিটের যাত্রা করবে। এদের উদ্দেশ্যই তো আলাদা। এদের অবশ্যই আলাদা করে দিতে হবে। এটা করা খুবই সম্ভব। হাটিকুমরুল মহাসড়কে ইতিমধ্যে এই ব্যবস্থা আছে, সেটা খুব সুন্দর চলছে। সেখানে দুর্ঘটনা খুবই কম। প্রকৃত দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমরা সব সময় রক্তের পক্ষে আমাদের মতামত ও বিশ্লেষণ দিয়ে দিই। অর্থাৎ সাইকেলের সঙ্গে রিকশার দুর্ঘটনা হলে রিকশার পক্ষে, রিকশার সঙ্গে কারের হলে রিকশার পক্ষে, বাসের সঙ্গে ট্রাকের হলে বাসের পক্ষে বিশ্লেষণ দিয়ে দিই। বাংলাদেশে ওভারটেক করার মূল কারণ, সামনে কোনো ধীরগতির গাড়ির উপস্থিতি। একটা বাণিজ্যিক বাহনের সময় মেইনটেইন করার দরকার হয়, তাই তার ওভারটেক করার প্রয়োজন হয়। এটাই মূল সমস্যা।
প্রথম আলো # মানবাধিকারের দিক থেকেও তো বিষয়টা ভয়াবহ। প্রায় ২০ হাজার মৃত্যু, অসুবিধাজনক বাহনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকা। এর কারণে মানুষের মানসিকতা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। গতির স্বস্তি ও নিরাপত্তা পাওয়া তাই মানবাধিকারের অংশ কি না।
শামসুল হক # অবশ্যই। মানুষ যে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে, সামাজিক সহিংসতা যে বাড়ছে, দুর্ঘটনা ঘটলে পিটিয়ে মেরে ফেলার সামাজিক ক্রসফায়ারের যেসব ঘটনা ঘটছে, এর জন্য কিছুটা দায়ী এই নৈরাজ্যকর সড়কব্যবস্থা। দুর্ঘটনার পর চালকের দাঁড়িয়ে থাকার উপায় নেই। তাই সে পালিয়ে যাওয়ার সময় আরও মানুষ হত্যা করে। সড়কের বাস্তবতা মানুষের ধৈর্যের সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে। তাই সড়ককে চলার উপযোগী করতে হলে দুই ধরনের যোগ্যতা সৃষ্টি করতে হবে। একটা হলো দ্রুতগতির অন্যটা ধীরগতির। দুই ধরনের গাড়ি ও গতি চালক ও যাত্রীদের দুই ধরনের মানসিকতা তৈরি করে। এই বিষম বাস্তবতা বিক্ষিপ্ত মানসিকতার জন্ম দেয়।
প্রায় ৭০ শতাংশ দুর্ঘটনা হয় মহাসড়কে। তাও আবার হয় মাত্র ৪ শতাংশ স্থানে। তাহলে এই ৪ শতাংশ স্থানে সুনির্দিষ্ট সমাধান করা যায় না? সারা দেশে ৫৪ শতাংশ এবং শহর এলাকাতে ৭০ শতাংশ যারা মারা যায়, তারা হলো পথচারী। কারণ, ফুটপাত দখল হয়ে আছে। সরকার চাইলে কোনো খরচ না করেই কেবল আইন প্রয়োগ করে ফুটপাতগুলো তিন মাসের জন্য অবমুক্ত করতে পারে। সরকার কখনোই এই সংকটকে গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছে না। এর থেকে বের হওয়ার কতগুলো সরল পথ আছে, আন্তরিকতার অভাবে সরকার সেটা করছে না। তা ছাড়া, নানা রকম ব্যবসায়িক ও কায়েমি স্বার্থও বাধা তৈরি করে। দুর্ভাগ্যজনক আমরা কোনো দিন সমস্যার গোড়ায় সমাধান তৈরি করি না। একে বাড়তে দিয়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যাই। তাহলে দাঁড়াল: পুলিশের মাধ্যমে দুর্ঘটনায় হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত চিত্র একেবারেই আসছে না। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকভাবে কাজ করছে না এবং বিজ্ঞানভিত্তিক জনবান্ধব পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা নেই। তাই আমি বলি, সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান দায় চালকের নয়, সরকারের।
প্রথম আলো # আপনাকে ধন্যবাদ।
শামসুল হক # ধন্যবাদ।
No comments