খাদ্যসাহায্যের মৃত্যুচক্র by মইনুল ইসলাম
সম্প্রতি কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাম উল্লেখ না করে বাজারে খাদ্যশস্যের দাম পড়ে যাওয়া ঠেকাতে উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য সাগরে ফেলে দেওয়ার প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছেন তাঁর একটি বক্তৃতায়। পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, এই ব্যাপারটি ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত পর পর পাঁচ বছর ঘটিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাদের কৃষি খাতে উৎপাদনের যে স্ফীতি দেখা দিয়েছিল, তার মোকাবিলায় ওই পাঁচ বছর একাধারে আটলান্টিক মহাসাগরে উদ্বৃত্ত খাদ্য নিক্ষেপ করতে হয়েছিল অভ্যন্তরীণ খাদ্য বাজারে খাদ্যশস্যের দাম স্থিতিশীল রাখার প্রয়োজনে। এই ঘটনার মাধ্যমেই জন্ম হয়েছিল খাদ্যসাহায্যের।
পাঠকদের ইতিহাসের আরেকটু পেছনে নিয়ে গেলে বুঝতে সুবিধা হবে, কেন বছরের পর বছর এহেন খাদ্যশস্য উদ্বৃত্তের ঝামেলায় পড়তে হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রকে। সমস্যার গোড়াটা রয়ে গেছে ১৯২৯-১৯৩৫ সালের বিশ্ব মহামন্দার মোকাবিলায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট কর্তৃক গৃহীত ‘নিউ ডিল’ কর্মসূচির মধ্যে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৯৩২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী ছিলেন রুজভেল্ট। ওই নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির নির্বাচনী ইশতিহারের নাম ছিল ‘নিউ ডিল’। রুজভেল্ট প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে ১৯৩৩ সাল থেকে ক্রমান্বয়ে ওই ‘নিউ ডিল’ কর্মসূচি বাস্তবায়ন শুরু করেছিলেন, যার অন্যতম প্রধান কর্মসূচি ছিল কৃষিতে খাদ্যশস্যের দাম স্থিতিশীল করার জন্য ‘নিম্নতম দাম নির্ধারণনীতি’ এবং উৎপাদন না করে জমি পতিত রেখে দেওয়ার জন্য জমির মালিককে একরভিত্তিক ‘ক্ষতিপূরণ’ প্রদান। এই দুটি নীতির মধ্যে বোধগম্য কারণেই প্রথম নীতিটা ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠা স্বাভাবিক, কারণ সুনির্দিষ্ট দামে কৃষক যত বেশি উৎপাদন করবেন, তত বেশি তাঁর আয় সুনিশ্চিত হবে।
কিন্তু এই নীতির ফলে উদ্বৃত্তের ঝামেলা সৃষ্টি হওয়ার আগেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় আসল ঝামেলাটা টের পাওয়া গিয়েছিল যুদ্ধের পর। প্রথমে মার্কিন সরকার উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য নির্দিষ্ট দামে কিনে নতুন নতুন গুদামে মজুত করতে শুরু করল। কিন্তু পর পর দু-তিন বছর যখন ক্রমাগতভাবে উদ্বৃত্তের পাহাড় জমে উঠতে শুরু করল, তখন ভুলটা বোঝা গেল। সরকার পড়ল বিপাকে। উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য কেনার জন্য বাজেটে ব্যয় বরাদ্দ, ক্রয়ের ব্যবস্থা গড়ে তোলা, সংগৃহীত খাদ্যশস্য পরিবহন, গুদামজাতকরণ এবং মজুত করা খাদ্য বিক্রয় বা বিতরণ—প্রতিটি বিষয়ই ব্যয়বহুল। এক মৌসুমের গুদামজাত খাদ্য বিক্রি বা বিতরণ করে গুদাম খালি না করলে পরের মৌসুমের খাদ্য সংগ্রহের ঝামেলা বেড়ে যাচ্ছিল। আবার বিক্রির চেষ্টা করলে খাদ্যশস্যের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজার দামে ধস নামছিল। এই সমস্যা থেকে রেহাই পেতে পর পর পাঁচ বছর উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য জাহাজে বোঝাই করে আটলান্টিক মহাসাগরে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।
এর পরিপ্রেক্ষিতেই মার্কিন নীতিনির্ধারকেরা হিসাব-নিকাশ করে দেখল, মহাসাগরে ফেলে না দিয়ে জাহাজগুলোর খাদ্যশস্য যদি বিভিন্ন মার্কিনপন্থী দেশে ‘খাদ্যসাহায্য’ প্রদানের জন্য প্রেরিত হয়, তাহলে খাদ্যশস্যের কোনো মূল্য আদায় না করলেও সংগ্রহ-খরচ, মজুত খরচ, পরিবহন খরচ ও জাহাজভাড়া দিতে সাহায্যগ্রহীতা দেশ রাজি হলে ওই ব্যবস্থাটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিরাট ব্যয়সাশ্রয়ী হবে। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, ঠিক এহেন হিসাব-নিকাশ থেকেই ১৯৫৪ সাল থেকে তদানীন্তন ঠান্ডাযুদ্ধের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে মার্কিন-মক্কেল রাষ্ট্র পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মিসর, তুরস্ক ও ফিলিপাইনে এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ দক্ষিণ কোরিয়া ও দক্ষিণ ভিয়েতনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য সাহায্যের প্রক্রিয়াটি শুরু করা হয়েছিল। এ সম্পর্কে প্রামাণ্য দলিল উপস্থাপিত হয়েছে ইউএসএইডের একজন সাবেক কর্মকর্তা টেরেসা হেয়টার রচিত বিশ্বের বেস্ট সেলার এইড অ্যাজ ইমপেরিয়ালিজম গ্রন্থে।
ওই সময়টায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ‘মোহাম্মদ আলী বগুড়া’, গভর্নর জেনারেল ছিলেন জাঁদরেল আমলা গোলাম মোহাম্মদ। এর পরের পাঁচ বছরের টালমাটাল পাকিস্তানি রাজনীতিতে উত্থান-পতনের যে গোপন ষড়যন্ত্রের ইতিহাস রচিত হয়েছিল, তার প্রতিটি পরিবর্তনের পেছনে প্রধান কুশীলবের ভূমিকা পালন করেছে মার্কিনরাই। ওই পর্যায়ের শুরুতে পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্যঘাটতি না থাকলেও পাকিস্তানের ভুল নীতি, অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হয়ে প্রথমবারের মতো ১৯৫৭ সাল থেকে পূর্ব পাকিস্তান ক্রমবর্ধমান ‘খাদ্যশস্য ঘাটতি অঞ্চলে’ পরিণত হয়েছিল। সস্তায় পাওয়া খাদ্য দিয়ে শুরু করা হয়েছিল ওয়ার্কস প্রোগ্রাম ও টেস্ট রিলিফ, সম্প্রসারিত হয়েছিল রেশনিং। একই সঙ্গে, পাকিস্তানের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় পূর্ব পাকিস্তানের কৃষি উন্নয়ন অবহেলার শিকার হয়ে স্থবিরতার পঙ্কে নিমজ্জিত হয়েছিল। ওই পরিকল্পনা প্রণয়নে পরামর্শক ছিল ‘হার্ভার্ড গ্রুপ অব ইকোনমিস্টস’। খাদ্যসাহায্যের ক্ষেত্রে প্রস্তুত করার জন্য কৃষিকে অবহেলা করা হয়েছিল কি না বলা মুশকিল, তবে পূর্ব পাকিস্তানের খাদ্যঘাটতি ১৯৫৭ সালে শুরু হয়ে ক্রমেই বাড়তে বাড়তে ১৯৭০ সালে প্রায় ৩৫ লাখ টনে পৌঁছে গিয়েছিল।
সমস্যার উল্টো পিঠে দেখা যাবে, খাদ্যসাহায্যের জালে বিভিন্ন দেশকে আটকে ফেলার পর খাদ্যশস্য আর ‘সাহায্য’ থাকেনি। সাহায্যের শর্তগুলো ক্রমান্বয়ে এমন শক্ত ও জটিল করে ফেলা হয়েছিল যে পুরো ব্যাপারটাই একটা নিষ্ঠুর ব্ল্যাকমেলিংয়ের খেলায় পরিণত হয়ে গিয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘পিএল ৪৮০’ খাদ্য কর্মসূচির টাইটেল ১ থেকে টাইটেল ৪ পর্যন্ত প্রতিটি কর্মসূচির শর্তাবলি ক্রমেই কঠোর থেকে কঠোরতর করা হয়েছে, এবং এগুলো সবই পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে গলাধঃকরণ করতে হয়েছে প্রায় ৫০ বছর। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া ক্রমেই বড়সড় খাদ্যসাহায্যদাতা হিসেবে ভূমিকা পালন করলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পিএল ৪৮০ কর্মসূচির মতো এত অপমানজনক শর্ত আর কোনো দেশ বাংলাদেশের ওপর চাপায়নি।
পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকেই খাদ্যশস্যের উচ্চ দাম নির্ধারণ শুরু করা হয়েছে, এবং খাদ্যের মোট মূল্যের অর্ধেক স্থানীয় মুদ্রায় পরিশোধ করার শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। ওই মূল্য বাবদ প্রাপ্ত অর্থ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজের ইচ্ছেমতন পাকিস্তান ও বাংলাদেশে খরচ করতে পারত, কিন্তু কোথায় খরচ করা হচ্ছে, তা জানার কোনো অধিকার দেশের সরকারের ছিল না। টেরেসা হেয়টার বলছেন, সন্দেহ করার কারণ রয়েছে যে মার্কিনপন্থী রাজনৈতিক দল, রাজনৈতিক নেতা, সামরিক অফিসার, সিভিল আমলা, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক এবং সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তি ও সংগঠনগুলোর আনুগত্য কেনার জন্য এই অর্থ দেদার ব্যবহার করা হতো বিশ্বের দেশে দেশে। প্রয়োজনে, সামরিক অভ্যুত্থান এবং গণ-আন্দোলন উসকে দেওয়ার জন্যও এই ফান্ড ব্যবহার করা হয়েছে বিভিন্ন দেশে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করায় তাদের কাছ থেকে কোনো সাহায্য নেবে না বলে জানিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সরকার। কিন্তু খোন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বাধীন মার্কিন লবি ক্রমেই বঙ্গবন্ধুর মন জয় করে নিয়েছিল। তাই অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীনের জোর আপত্তি অগ্রাহ্য করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফকে আহ্বান জানিয়েছিল বাংলাদেশ। কেউ কেউ মনে করেন, বিশাল খাদ্যঘাটতি মোকাবিলায় ব্যর্থ হওয়ার ভয় বঙ্গবন্ধুকে ওই সিদ্ধান্ত গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশের সে সময়ের প্রকট খাদ্যঘাটতি ও অর্থনৈতিক সংকটের পূর্ণ সুযোগ নিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বব্যাংক। প্রথমে পাকিস্তানের ঋণের দায় নিতে হবে দাবি জানিয়ে সময়ে ক্ষপণের চাণক্যনীতি গ্রহণ করেছিল তারা। পরে বাংলাদেশ কিউবার কাছে পাটের বস্তা রপ্তানি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-আরোপিত অবরোধ কেন লঙ্ঘন করল, তার কৈফিয়ত চেয়ে ১৯৭৪ সালে খাদ্যশস্যবাহী কয়েকটি জাহাজের যাত্রা বিলম্বিত করে দিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ওই জাহাজগুলো সময়মতো বাংলাদেশে পৌঁছাতে পারলে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে অনেক মানুষের মৃত্যু এড়ানো যেত হয়তো বা! অধ্যাপক নুরুল ইসলামের বই মেকিং অব আ নেশন বাংলাদেশ: অ্যান ইকোনমিস্ট’স টেইল-এ এই কাহিনির বর্ণনা রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর এ দেশে বৈদেশিক সাহায্যের বান ডেকেছিল, যার প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশই থাকত খাদ্যসাহায্য। ১৯৮০-৮১ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান জিডিপির ১৩ দশমিক ৭ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল বলে দাবি করেছেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান।
১৯৫৭ সালে খাদ্যঘাটতি শুরু হওয়ার ৫৪ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর ২০১১ সালে বাংলাদেশ আবার ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। ১৯৭২ সালে দেড় কোটি টন ধান লাগত আমাদের, অথচ উৎপাদন করতে পারতাম মাত্র এক কোটি ১০ লাখ টন। গত বছর এ দেশে তিন কোটি ৬০ লাখ টন ধান উৎপাদিত হয়েছে। ১৬ কোটি মানুষের খাদ্যশস্য জোগান দিয়েও এখন প্রতিবছর মোটা ধান উদ্বৃত্ত হচ্ছে আমাদের। অবশ্য প্রায় ২০ লাখ টন গম আমদানি করতে হচ্ছে, কিন্তু খয়রাত করতে হচ্ছে না। নিজেদের রপ্তানি আয় এবং প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের অর্থে আমদানি করতে পারছি। বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান এখন এ দেশের জিডিপির ২ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে, যার ৯৮ থেকে ৯৯ শতাংশই প্রকল্প ঋণ ও অনুদান। মাত্র ১ থেকে ২ শতাংশ খাদ্যসাহায্য। এখন আমরা আর পণ্যসাহায্য নিই না। এই সাফল্যকে যেন আমরা খাটো করে না দেখি। আল্লাহর রহমতে খাদ্যসাহায্যের মরণচক্র থেকে এই জাতিকে উদ্ধার করেছে এ দেশের কৃষক সমাজ। তাদের সঠিক প্রণোদনা দিয়ে দেশে একটি কৃষিবিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ড. মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি।
পাঠকদের ইতিহাসের আরেকটু পেছনে নিয়ে গেলে বুঝতে সুবিধা হবে, কেন বছরের পর বছর এহেন খাদ্যশস্য উদ্বৃত্তের ঝামেলায় পড়তে হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রকে। সমস্যার গোড়াটা রয়ে গেছে ১৯২৯-১৯৩৫ সালের বিশ্ব মহামন্দার মোকাবিলায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট কর্তৃক গৃহীত ‘নিউ ডিল’ কর্মসূচির মধ্যে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৯৩২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী ছিলেন রুজভেল্ট। ওই নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির নির্বাচনী ইশতিহারের নাম ছিল ‘নিউ ডিল’। রুজভেল্ট প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে ১৯৩৩ সাল থেকে ক্রমান্বয়ে ওই ‘নিউ ডিল’ কর্মসূচি বাস্তবায়ন শুরু করেছিলেন, যার অন্যতম প্রধান কর্মসূচি ছিল কৃষিতে খাদ্যশস্যের দাম স্থিতিশীল করার জন্য ‘নিম্নতম দাম নির্ধারণনীতি’ এবং উৎপাদন না করে জমি পতিত রেখে দেওয়ার জন্য জমির মালিককে একরভিত্তিক ‘ক্ষতিপূরণ’ প্রদান। এই দুটি নীতির মধ্যে বোধগম্য কারণেই প্রথম নীতিটা ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠা স্বাভাবিক, কারণ সুনির্দিষ্ট দামে কৃষক যত বেশি উৎপাদন করবেন, তত বেশি তাঁর আয় সুনিশ্চিত হবে।
কিন্তু এই নীতির ফলে উদ্বৃত্তের ঝামেলা সৃষ্টি হওয়ার আগেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় আসল ঝামেলাটা টের পাওয়া গিয়েছিল যুদ্ধের পর। প্রথমে মার্কিন সরকার উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য নির্দিষ্ট দামে কিনে নতুন নতুন গুদামে মজুত করতে শুরু করল। কিন্তু পর পর দু-তিন বছর যখন ক্রমাগতভাবে উদ্বৃত্তের পাহাড় জমে উঠতে শুরু করল, তখন ভুলটা বোঝা গেল। সরকার পড়ল বিপাকে। উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য কেনার জন্য বাজেটে ব্যয় বরাদ্দ, ক্রয়ের ব্যবস্থা গড়ে তোলা, সংগৃহীত খাদ্যশস্য পরিবহন, গুদামজাতকরণ এবং মজুত করা খাদ্য বিক্রয় বা বিতরণ—প্রতিটি বিষয়ই ব্যয়বহুল। এক মৌসুমের গুদামজাত খাদ্য বিক্রি বা বিতরণ করে গুদাম খালি না করলে পরের মৌসুমের খাদ্য সংগ্রহের ঝামেলা বেড়ে যাচ্ছিল। আবার বিক্রির চেষ্টা করলে খাদ্যশস্যের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজার দামে ধস নামছিল। এই সমস্যা থেকে রেহাই পেতে পর পর পাঁচ বছর উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য জাহাজে বোঝাই করে আটলান্টিক মহাসাগরে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।
এর পরিপ্রেক্ষিতেই মার্কিন নীতিনির্ধারকেরা হিসাব-নিকাশ করে দেখল, মহাসাগরে ফেলে না দিয়ে জাহাজগুলোর খাদ্যশস্য যদি বিভিন্ন মার্কিনপন্থী দেশে ‘খাদ্যসাহায্য’ প্রদানের জন্য প্রেরিত হয়, তাহলে খাদ্যশস্যের কোনো মূল্য আদায় না করলেও সংগ্রহ-খরচ, মজুত খরচ, পরিবহন খরচ ও জাহাজভাড়া দিতে সাহায্যগ্রহীতা দেশ রাজি হলে ওই ব্যবস্থাটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিরাট ব্যয়সাশ্রয়ী হবে। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, ঠিক এহেন হিসাব-নিকাশ থেকেই ১৯৫৪ সাল থেকে তদানীন্তন ঠান্ডাযুদ্ধের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে মার্কিন-মক্কেল রাষ্ট্র পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মিসর, তুরস্ক ও ফিলিপাইনে এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ দক্ষিণ কোরিয়া ও দক্ষিণ ভিয়েতনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য সাহায্যের প্রক্রিয়াটি শুরু করা হয়েছিল। এ সম্পর্কে প্রামাণ্য দলিল উপস্থাপিত হয়েছে ইউএসএইডের একজন সাবেক কর্মকর্তা টেরেসা হেয়টার রচিত বিশ্বের বেস্ট সেলার এইড অ্যাজ ইমপেরিয়ালিজম গ্রন্থে।
ওই সময়টায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ‘মোহাম্মদ আলী বগুড়া’, গভর্নর জেনারেল ছিলেন জাঁদরেল আমলা গোলাম মোহাম্মদ। এর পরের পাঁচ বছরের টালমাটাল পাকিস্তানি রাজনীতিতে উত্থান-পতনের যে গোপন ষড়যন্ত্রের ইতিহাস রচিত হয়েছিল, তার প্রতিটি পরিবর্তনের পেছনে প্রধান কুশীলবের ভূমিকা পালন করেছে মার্কিনরাই। ওই পর্যায়ের শুরুতে পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্যঘাটতি না থাকলেও পাকিস্তানের ভুল নীতি, অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হয়ে প্রথমবারের মতো ১৯৫৭ সাল থেকে পূর্ব পাকিস্তান ক্রমবর্ধমান ‘খাদ্যশস্য ঘাটতি অঞ্চলে’ পরিণত হয়েছিল। সস্তায় পাওয়া খাদ্য দিয়ে শুরু করা হয়েছিল ওয়ার্কস প্রোগ্রাম ও টেস্ট রিলিফ, সম্প্রসারিত হয়েছিল রেশনিং। একই সঙ্গে, পাকিস্তানের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় পূর্ব পাকিস্তানের কৃষি উন্নয়ন অবহেলার শিকার হয়ে স্থবিরতার পঙ্কে নিমজ্জিত হয়েছিল। ওই পরিকল্পনা প্রণয়নে পরামর্শক ছিল ‘হার্ভার্ড গ্রুপ অব ইকোনমিস্টস’। খাদ্যসাহায্যের ক্ষেত্রে প্রস্তুত করার জন্য কৃষিকে অবহেলা করা হয়েছিল কি না বলা মুশকিল, তবে পূর্ব পাকিস্তানের খাদ্যঘাটতি ১৯৫৭ সালে শুরু হয়ে ক্রমেই বাড়তে বাড়তে ১৯৭০ সালে প্রায় ৩৫ লাখ টনে পৌঁছে গিয়েছিল।
সমস্যার উল্টো পিঠে দেখা যাবে, খাদ্যসাহায্যের জালে বিভিন্ন দেশকে আটকে ফেলার পর খাদ্যশস্য আর ‘সাহায্য’ থাকেনি। সাহায্যের শর্তগুলো ক্রমান্বয়ে এমন শক্ত ও জটিল করে ফেলা হয়েছিল যে পুরো ব্যাপারটাই একটা নিষ্ঠুর ব্ল্যাকমেলিংয়ের খেলায় পরিণত হয়ে গিয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘পিএল ৪৮০’ খাদ্য কর্মসূচির টাইটেল ১ থেকে টাইটেল ৪ পর্যন্ত প্রতিটি কর্মসূচির শর্তাবলি ক্রমেই কঠোর থেকে কঠোরতর করা হয়েছে, এবং এগুলো সবই পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে গলাধঃকরণ করতে হয়েছে প্রায় ৫০ বছর। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া ক্রমেই বড়সড় খাদ্যসাহায্যদাতা হিসেবে ভূমিকা পালন করলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পিএল ৪৮০ কর্মসূচির মতো এত অপমানজনক শর্ত আর কোনো দেশ বাংলাদেশের ওপর চাপায়নি।
পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকেই খাদ্যশস্যের উচ্চ দাম নির্ধারণ শুরু করা হয়েছে, এবং খাদ্যের মোট মূল্যের অর্ধেক স্থানীয় মুদ্রায় পরিশোধ করার শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। ওই মূল্য বাবদ প্রাপ্ত অর্থ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজের ইচ্ছেমতন পাকিস্তান ও বাংলাদেশে খরচ করতে পারত, কিন্তু কোথায় খরচ করা হচ্ছে, তা জানার কোনো অধিকার দেশের সরকারের ছিল না। টেরেসা হেয়টার বলছেন, সন্দেহ করার কারণ রয়েছে যে মার্কিনপন্থী রাজনৈতিক দল, রাজনৈতিক নেতা, সামরিক অফিসার, সিভিল আমলা, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক এবং সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তি ও সংগঠনগুলোর আনুগত্য কেনার জন্য এই অর্থ দেদার ব্যবহার করা হতো বিশ্বের দেশে দেশে। প্রয়োজনে, সামরিক অভ্যুত্থান এবং গণ-আন্দোলন উসকে দেওয়ার জন্যও এই ফান্ড ব্যবহার করা হয়েছে বিভিন্ন দেশে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করায় তাদের কাছ থেকে কোনো সাহায্য নেবে না বলে জানিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সরকার। কিন্তু খোন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বাধীন মার্কিন লবি ক্রমেই বঙ্গবন্ধুর মন জয় করে নিয়েছিল। তাই অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীনের জোর আপত্তি অগ্রাহ্য করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফকে আহ্বান জানিয়েছিল বাংলাদেশ। কেউ কেউ মনে করেন, বিশাল খাদ্যঘাটতি মোকাবিলায় ব্যর্থ হওয়ার ভয় বঙ্গবন্ধুকে ওই সিদ্ধান্ত গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশের সে সময়ের প্রকট খাদ্যঘাটতি ও অর্থনৈতিক সংকটের পূর্ণ সুযোগ নিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বব্যাংক। প্রথমে পাকিস্তানের ঋণের দায় নিতে হবে দাবি জানিয়ে সময়ে ক্ষপণের চাণক্যনীতি গ্রহণ করেছিল তারা। পরে বাংলাদেশ কিউবার কাছে পাটের বস্তা রপ্তানি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-আরোপিত অবরোধ কেন লঙ্ঘন করল, তার কৈফিয়ত চেয়ে ১৯৭৪ সালে খাদ্যশস্যবাহী কয়েকটি জাহাজের যাত্রা বিলম্বিত করে দিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ওই জাহাজগুলো সময়মতো বাংলাদেশে পৌঁছাতে পারলে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে অনেক মানুষের মৃত্যু এড়ানো যেত হয়তো বা! অধ্যাপক নুরুল ইসলামের বই মেকিং অব আ নেশন বাংলাদেশ: অ্যান ইকোনমিস্ট’স টেইল-এ এই কাহিনির বর্ণনা রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর এ দেশে বৈদেশিক সাহায্যের বান ডেকেছিল, যার প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশই থাকত খাদ্যসাহায্য। ১৯৮০-৮১ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান জিডিপির ১৩ দশমিক ৭ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল বলে দাবি করেছেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান।
১৯৫৭ সালে খাদ্যঘাটতি শুরু হওয়ার ৫৪ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর ২০১১ সালে বাংলাদেশ আবার ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। ১৯৭২ সালে দেড় কোটি টন ধান লাগত আমাদের, অথচ উৎপাদন করতে পারতাম মাত্র এক কোটি ১০ লাখ টন। গত বছর এ দেশে তিন কোটি ৬০ লাখ টন ধান উৎপাদিত হয়েছে। ১৬ কোটি মানুষের খাদ্যশস্য জোগান দিয়েও এখন প্রতিবছর মোটা ধান উদ্বৃত্ত হচ্ছে আমাদের। অবশ্য প্রায় ২০ লাখ টন গম আমদানি করতে হচ্ছে, কিন্তু খয়রাত করতে হচ্ছে না। নিজেদের রপ্তানি আয় এবং প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের অর্থে আমদানি করতে পারছি। বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান এখন এ দেশের জিডিপির ২ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে, যার ৯৮ থেকে ৯৯ শতাংশই প্রকল্প ঋণ ও অনুদান। মাত্র ১ থেকে ২ শতাংশ খাদ্যসাহায্য। এখন আমরা আর পণ্যসাহায্য নিই না। এই সাফল্যকে যেন আমরা খাটো করে না দেখি। আল্লাহর রহমতে খাদ্যসাহায্যের মরণচক্র থেকে এই জাতিকে উদ্ধার করেছে এ দেশের কৃষক সমাজ। তাদের সঠিক প্রণোদনা দিয়ে দেশে একটি কৃষিবিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ড. মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি।
No comments