গাজা আগ্রাসন -এ যুদ্ধে কে জিতবে? by ইউরি আভনেরি
উইনস্টন চার্চিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়
পাঁচ বছর লন্ডনের অধিবাসীদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। লন্ডন শহরের
মানুষদের রকেট ও বোমাবর্ষণের মুখে ঠেলে দিয়ে তিনি নিজে ১০ নম্বর ডাউনিং
স্ট্রিটের নিচে সুরক্ষিত বাঙ্কারে গিয়ে লুকিয়ে ছিলেন। জার্মানির নেতারা
শান্তির প্রস্তাব দিলেও তিনি উদ্ভট আদর্শিক কারণে তা প্রত্যাখ্যান
করেছিলেন।
সময় সময় তিনি এই গোপন ডেরা থেকে বেরিয়ে এসে ধ্বংসস্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতেন, তারপর আবার সেই ইঁদুরের গর্তে ঢুকতেন। আর লন্ডনের জনগণের উদ্দেশে তিনি বলতেন, ‘ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বলবে, এটাই আপনাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়’। ফলে বোমাবর্ষণ ছাড়া জার্মান বিমানবাহিনীর হাতে আর কোনো উপায় ছিল না। যদিও এই বাহিনীর কর্তারা বলেছেন, তাঁরা শুধু সামরিক স্থাপনায় আঘাত করেছেন।
সময় সময় তিনি এই গোপন ডেরা থেকে বেরিয়ে এসে ধ্বংসস্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতেন, তারপর আবার সেই ইঁদুরের গর্তে ঢুকতেন। আর লন্ডনের জনগণের উদ্দেশে তিনি বলতেন, ‘ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বলবে, এটাই আপনাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়’। ফলে বোমাবর্ষণ ছাড়া জার্মান বিমানবাহিনীর হাতে আর কোনো উপায় ছিল না। যদিও এই বাহিনীর কর্তারা বলেছেন, তাঁরা শুধু সামরিক স্থাপনায় আঘাত করেছেন।
জার্মান বিমানবাহিনী লন্ডন শহরের অধিবাসীদের শহর ছেড়ে চলে যেতে বলেছিল, ফলে অনেক শিশুকেই সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অধিকাংশ লন্ডনবাসী চার্চিলের আহ্বানে সাড়া দিয়ে শহরে থেকে যায়। পরিণামে তারা এই যুদ্ধের ‘পরোক্ষ ক্ষতি’র শিকার হয়।
ওদিকে জার্মান বাহিনী ধারণা করেছিল, লন্ডনবাসীর ঘরবাড়ি ধ্বংস ও তাদের পরিজনদের হত্যা করলে তারা চার্চিল ও তাঁর যুদ্ধংদেহী সমরনায়কদের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠবে। কিন্তু তাদের সে আশা পূরণ হয়নি। উল্টো চার্চিলের গ্রহণযোগ্যতা দিনের পর দিন বাড়তে থাকে, আর যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এসে চার্চিল রীতিমতো ঈশ্বরে পরিণত হন।
চার বছর পর চাকা একদম উল্টো দিকে ঘুরে যায়। ব্রিটিশ ও মার্কিন বিমানবাহিনী জার্মান শহরগুলোয় বোমা মেরে সেগুলো একদম গুঁড়িয়ে দেয়। সেখানে একটা পাথরখণ্ডও আর আস্ত ছিল না, গৌরবময় প্রাসাদগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। ‘নিরপরাধ বেসামরিক’ মানুষজন তুলোর মতো উড়ে যায়, তাদের পুড়িয়ে মারা হয় বা তারা নিছক হারিয়ে যায়। ইউরোপের অন্যতম সুন্দর শহর ড্রেসডেন কয়েক ঘণ্টার অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে কয়লা হয়ে যায়।
কাগজে-কলমে এর উদ্দেশ্য ছিল জার্মান যুদ্ধশিল্প গুঁড়িয়ে দেওয়া। কিন্তু সেই অভীষ্ট অর্জিত হয়নি। আসল লক্ষ্য ছিল, বেসামরিক মানুষকে আতঙ্কিত করা, যাতে তারা তাদের নেতাদের সরিয়ে দেয় বা আত্মসমর্পণে বাধ্য করে। সেটা হয়নি। হিটলারের বিরুদ্ধে গুরুতর বিদ্রোহ করেছেন কয়েকজন ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা, সেটাও সফল হয়নি। আমজনতা সরকারের বিরুদ্ধে মাঠে নামেনি। উল্টো গোয়েবলস বলে বসেন, ‘তারা আমাদের ঘর ভাঙতে পারে, কিন্তু আমাদের ইচ্ছাশক্তিকে ভাঙতে পারবে না।
শেষমেশ জার্মানি আত্মসমর্পণ করে যুদ্ধের একদম অন্তিম সময়ে। মিলিয়ন মিলিয়ন টন বোমা মেরেও কোনো কাজ হয়নি। তারা শুধু জনগণের নৈতিক শক্তি চাগিয়ে দিয়েছে আর নেতার (ফুহরার) প্রতি আনুগত্য অটুট রাখার চেষ্টা করেছে।
গাজার ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। সবাই জিজ্ঞাসা করছে, এই দফায় কে জিতল? ইহুদিদের আদলে প্রশ্নটির উত্তর আরেকটি প্রশ্ন দিয়ে দেওয়া যায়: কীভাবে তা নিরূপণ করা যায়? জয়লাভের ধ্রুপদি সংজ্ঞা হচ্ছে, যুদ্ধের ময়দানে যাঁরা শেষ পর্যন্ত থাকেন, তাঁরাই জয়ী। কিন্তু এখানে কেউই সরেনি। এখন পর্যন্ত হামাস ও ইসরায়েল উভয়েই আছে।
প্রুশিয়ার প্রখ্যাত যুদ্ধতত্ত্ববিদ কার্ল ভন ক্লজউইটজের একটি বিখ্যাত কথা হচ্ছে এ রকম, যুদ্ধ আসলে ঘুরপথে নীতিরই সম্প্রসারণ মাত্র। কিন্তু এই যুদ্ধে কোনো পক্ষেরই পরিষ্কার রাজনৈতিক লক্ষ্য নেই। সে কারণে জয়-পরাজয় এভাবে নিরূপণ করা যাবে না। গাজায় ব্যাপক বোমাবর্ষণ করেও হামাসকে আত্মসমর্পণে রাজি করানো যায়নি। অন্যদিকে, হামাসের রকেট হামলাও সফল হয়নি। তারা রকেট মারলে ইসরায়েল সেগুলো আকাশেই নিষ্ক্রিয় করে দিচ্ছে। ফলে এখন পর্যন্ত উভয় পক্ষই জয় থেকে দূরে আছে।
এ ডামাডোলের মধ্যে অনেকে ভুলে যেতে পারেন, হামাস আসলে ইসরায়েলেরই সৃষ্টি। ফাতাহ ছিল ইসরায়েলের ঘোর শত্রু, একে বিশ্বসন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। ধর্মনিরপেক্ষ আরাফাতকে ইসলামপন্থীরা ঘৃণা করত। কিন্তু ইসরায়েলের কাছে এই ইসলামপন্থীরাই কম ক্ষতিকর হিসেবে বিবেচিত হলো, যাদের আবার গোপন মিত্রও বানানো যায়। শিন বেটের প্রধানকে আমি একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তাঁরা হামাসকে সৃষ্টি করেছেন কি না। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, না। তবে হামাস তাঁদের কাছে সহনীয়।
কিন্তু প্রথম ইনতিফাদার পর হামাসের প্রধান শেখ আহমেদ ইয়াসিনকে গ্রেপ্তার করা হলে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। আর ফাতাহ হয়ে যায় ইসরায়েলের মিত্র, হামাস হয় সন্ত্রাসী। কিন্তু ব্যাপারটা কি এ রকম? কয়েকজন ইসরায়েলি কর্মকর্তার মতে, হামাস বলে কিছু নেই, এটাকে উদ্ভাবন করতে হয়। গাজা উপত্যকা হামাসের নিয়ন্ত্রণে। সেখানে কিছু হলে হামাসকে দায়ী করা যায়। তারাই সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করে। ফলে যুদ্ধবিরতির ক্ষেত্রেও তারা নির্ভরযোগ্য অংশীদার।
ফিলিস্তিনের গত নির্বাচনে হামাস বিজয়ী হলেও তাদের ক্ষমতায় যেতে দেওয়া হয়নি। ফলে তারা জোর করে গাজা উপত্যকা দখল করে নেয়। সব নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা যায়, সেখানকার অধিকাংশ মানুষই হামাসের প্রতি অনুগত।
ইসরায়েলের সব বিশেষজ্ঞের মতে, গাজা যদি হামাসের নিয়ন্ত্রণে না থাকে, তাহলে সেখানে অধিকতর চরমপন্থী দলের উদ্ভব হতে পারে। সেটা হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। ফলে এই যুদ্ধের উদ্দেশ্যকে মহীয়ান করে বলা যায়, এটা হামাসকে ধ্বংস করার জন্য নয়, বরং একে আরও দুর্বল অবস্থায় ক্ষমতায় রাখার জন্যই এ যুদ্ধ। কিন্তু সেটা কীভাবে করা সম্ভব? ইসরায়েল সরকারের অতি ডানপন্থীদের মতে, পুরো গাজার দখল নেওয়ার মধ্য দিয়েই এটা করা সম্ভব। কিন্তু তারপর?
পুরো গাজার দখল নেওয়াটা ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর কাছে দুঃস্বপ্নের মতো। সেটা হলে ১৮ লাখ মানুষের দেখভাল ও ভরণপোষণেরও দায়িত্ব নিতে হবে (এদের অধিকাংশই ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল থেকে পালিয়ে যাওয়া উদ্বাস্তু ও তাদের বংশধর)। একটি চিরস্থায়ী গেরিলা যুদ্ধ শুরু হবে, ইসরায়েলের কেউই তা চায় না।
দখল করে চলে এলে কেমন হয়? কথাটা সহজে বলা গেলেও এরূপ অভিযানে ব্যাপক রক্তক্ষয় হবে। হাজার খানেক ফিলিস্তিনি মারা যাবে। ‘মোল্টেন মতবাদ’ (অলিখিত) অনুযায়ী একজন ইসরায়েলি সেনার জীবন বাঁচাতে দরকার হলে ১০০ জন ফিলিস্তিনি হত্যা করা জায়েজ। কিন্তু যদি ডজন খানেক ইসরায়েলি সেনারও মৃত্যু হয়, তাহলেও সে দেশটির অবস্থা বদলে যাবে। সেনাবাহিনী সে ঝুঁকি নিতে চাইবে না।
গত বৃহস্পতিবার মনে হচ্ছিল, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। এতে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু অনেকটাই আশ্বস্ত হয়েছিলেন। কিন্তু এটা একরকম বিভ্রমই ছিল। এই যুদ্ধবিরতির মধ্যস্থতাকারী হচ্ছেন মিসরের নতুন স্বৈরশাসক। তিনি ইসরায়েলের একজন প্রকাশ্য মিত্র, যুক্তরাষ্ট্রের ধামাধরা। সারা দুনিয়ার ইসলামপন্থীরা তাঁকে ঘৃণা করেন। তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডের হাজার খানেক কর্মীকে মেরে ফেলেছেন ও জেলে পুরেছেন। হামাস ও মুসলিম ব্রাদারহুডের আদর্শিক মিল থাকায় তিনি হামাসকে প্রচণ্ড ঘৃণা করেন।
আমার মত হচ্ছে, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন নিজেরা বসে আলোচনা করে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করুক। দুনিয়াতে সমর কমান্ডাররাই এক পক্ষ অন্য পক্ষের কাছে প্রস্তাব পাঠায়, তারপর আলোচনার মাধ্যমে কিছু একটা হয়। অথচ মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল–সিসি নির্বোধের মতো ইসরায়েলের কথায় একতরফা যুদ্ধবিরতি ডেকে বসলেন আর হামাস এককথায় তা প্রত্যাখ্যান করে।
এর শেষ কোথায়? রাজনৈতিক সমাধান না হওয়া পর্যন্ত এ পরিস্থিতি চলতেই থাকবে। রকেট ও বোমা বন্ধ করুন, গাজার মানুষদের স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে দেওয়া হোক, প্রকৃত ঐকমত্যের সরকারের অধীনে ফিলিস্তিনিদের ঐক্য, শান্তি আলোচনা শুরু করা হোক, শান্তি বর্ষিত হোক।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।
ইউরি আভনেরি: ইসরায়েলি লেখক।
No comments