সরকারকে বাধা দেয় কে?
১৮ জুলাই ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের দুটি সংগঠনের একটি করে অংশ যৌথভাবে এক ইফতার মাহফিলের আয়োজন করেছিল। তাদের আমন্ত্রণে সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি সেখানে সাংবাদিকদের উদ্দেশে একটি বক্তৃতাও করেছেন, যার কিছু বিবরণ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর বক্তৃতার অনেক কথার মধ্যে যে অংশটি সংবাদমাধ্যমের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, তা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। তিনি সংবাদমাধ্যমের উদ্দেশে বলেন, ‘সরকারের সমালোচনা করুন, কিন্তু সরকারের সামনে বাধা সৃষ্টি করবেন না।’ আমাদের কৌতূহল, সংবাদমাধ্যম কীভাবে সরকারের সামনে বাধা সৃষ্টি করে? কী ধরনের বাধার কথা বলা হচ্ছে? সংবাদমাধ্যম কী করলে সরকারের কর্মসম্পাদনে বাধা সৃষ্টি হয়? প্রধানমন্ত্রীর উক্তির মধ্যে অবশ্য কিছু ইশারা মেলে। তিনি বলেছেন, ‘সরকারবিরোধীদের ইন্ধন বা উসকানি দেবেন না। এটা গণমাধ্যমের কাজ নয়।’
এ রকম পরামর্শের কারণ সম্ভবত এই যে বাংলাদেশে কিছু কিছু সংবাদমাধ্যম সরকারবিরোধীদের ইন্ধন বা উসকানি দিয়ে থাকে। তারা এমন অসত্য ও ভিত্তিহীন প্রচারণা চালায়, যার ফলে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। কিন্তু বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) যে অংশ ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) যে অংশ মিলিতভাবে ওই ইফতার মাহফিলের আয়োজন করেছিল, তারা সরকারবান্ধব হিসেবেই পরিচিত। সে কারণেই তারা প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানিয়েছিল প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করতে এবং প্রধানমন্ত্রীও তাদের অনুরোধ রক্ষা করে ওই মাহফিলে যোগ দিয়েছিলেন। সরকারের সামনে বাধা সৃষ্টি না করা, সরকারবিরোধীদের ইন্ধন বা উসকানি না দেওয়ার পরামর্শ অন্তত তাদের দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। কারণ, তারা সরকারবান্ধব; তারা সরকারবিরোধীদের ইন্ধন বা উসকানি দেয় না। বরং পারলে উল্টোটাই করে। তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এই যে প্রধানমন্ত্রী সেদিন সরকারবান্ধব সাংবাদিকদের মাহফিলে ওই কথাগুলো বলেছেন সাংবাদিক সমাজের সেই অংশের উদ্দেশে, যারা সরকারবান্ধব নয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যটি এমনভাবে প্রকাশিত হয়েছে, যাতে মনে হয় সামগ্রিকভাবে গোটা সংবাদমাধ্যমকে উদ্দেশ করেই তিনি কথাগুলো বলেছেন। আসলে রাজনৈতিক দলের মুখপত্রের মতো আচরণ করে এমন হাতে গোনা দু-একটি সংবাদপ্রতিষ্ঠান ছাড়া সামগ্রিকভাবে সংবাদমাধ্যমের উদ্দেশে এমন কথা বলার সুযোগ নেই। নির্দিষ্টভাবে কোনো সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেলের আচরণে সরকারের অভিযোগ থাকলে সে ব্যাপারে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ আছে। প্রেস কাউন্সিলে অভিযোগ করা যায়, সেখানে সন্তোষজনক প্রতিকার না মিললে আদালতেও যাওয়ার বিধান রয়েছে। তা ছাড়া, সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে ‘ইন্ধন’ বা ‘উসকানি’র অভিযোগের মধ্যেও সুনির্দিষ্টতা থাকে না। আসলে দেখা উচিত কোনো সংবাদপ্রতিষ্ঠান দেশের প্রচলিত আইনের পরিপন্থী আচরণ করছে কি না। সংবাদপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে আইনের পরিপন্থী আচরণের মধ্যে প্রধান কয়েকটি হলো অসত্য, মিথ্যা, ভিত্তিহীন সংবাদ বা গুজব প্রচার করা; এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করা, যার ফলে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সম্মানের হানি ঘটা কিংবা জনশৃঙ্খলা বিনষ্ট হওয়া, দাঙ্গা-হাঙ্গামা লাগার আশঙ্কা থাকে। এ ধরনের প্রতিটি আচরণের ক্ষেত্রেই আইনগত প্রতিকারের ব্যবস্থা অন্যান্য দেশের মতো এ দেশেও আছে। সে কারণে গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সরকারপ্রধানেরা সাধারণভাবে সংবাদমাধ্যমকে লক্ষ্য করে এ ধরনের শাসনমূলক কথা বলেন না।
তাঁরা সংবাদমাধ্যমকে গণতন্ত্র, সংবিধান, আইনের শাসন, সরকারের কর্মসম্পাদন ও জনস্বার্থের ‘ওয়াচডগ’ বা পাহারাদার হিসেবে দেখেন। এই আধুনিক যুগে কোনো শাসকই যেমন জনসাধারণকে লক্ষ্য করে হুঁশিয়ারিমূলক বা শাসনমূলক বক্তব্য দেন না, তেমনি পুরো সংবাদমাধ্যমকে লক্ষ্য করেও তা করেন না। কারণ, সংবাদমাধ্যম জনসাধারণের কণ্ঠস্বর, যে জনসাধারণ সরকারকে নির্বাচিত করে কিংবা কোনো শাসকের শাসনক্ষমতায় থাকা সহ্য করে। জনসাধারণের মতামত, আশা-প্রত্যাশা, অভিযোগ-অনুযোগ ইত্যাদির প্রতিফলন ঘটে সংবাদমাধ্যমেই। সরকারপ্রধানের এমন বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সংবাদমাধ্যমের ব্যাপারে সরকারের একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশিত হয়, যা স্বাধীন ও দায়িত্বশীল সংবাদমাধ্যম প্রত্যাশা করে না। আমাদের প্রধানমন্ত্রী জানেন এবং তিনি সেদিন বলেছেনও যে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ সরকারের কাজের সহায়ক হতে পারে, সমাজের অসংগতি দূর করতে পারে। বস্তুত সরকারের সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের সম্পর্ক এই দৃষ্টিভঙ্গিতেই বিচার করা উচিত। কিন্তু তা সব সময় করা হয় না। অনেক সময় বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রচারিত হলেই বরং সরকারের কোনো মহল ক্ষুব্ধ হয়, ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করে। বিশেষত সরকারি দল, সরকার ও আইন প্রয়োগকারী সশস্ত্র বাহিনীগুলোর সদস্যদের অনিয়ম, দুর্নীতি, সন্ত্রাস ইত্যাদি সম্পর্কে বিশদ ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশিত হলে তাঁরা বিরূপ প্রতিক্রিয়া করেন, সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে সরকারবিরোধিতার অভিযোগ তোলেন এবং যে সংবাদপ্রতিষ্ঠান এভাবে সরকারের বিরাগভাজন হয়, তাকে নানাভাবে হেনস্তা করার চেষ্টা করা হয়। সংবাদমাধ্যমের বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের ফলে সরকারের কাজে বাধা সৃষ্টি হয় না, এই কথা সবাই জানে। বাধা সৃষ্টি হয় দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী ও আমলাদের বেআইনি ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার পথে। তাঁদের কারও কারও মুখোশ খসে পড়ে কুৎসিত চেহারা জনসমক্ষে বেরিয়ে যায়। ক্ষমতাসীন দলের যেসব নেতা-কর্মী চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাস ও খুনখারাবি করেন, তাঁদের ওই সব অপরাধ সংঘটনের পথেও বাধা সৃষ্টি হয় সংবাদমাধ্যমের কারণে। ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তির অধিকারী লোকদের হত্যা-অপহরণসহ নানা গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ ঘটানোর পরও আইনের ঊর্ধ্বে থেকে যাওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি হতে পারে সংবাদমাধ্যমের কারণে। ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা যখন পরস্পরের মধ্যে খুনোখুনি করে, তখন সেই সংবাদ সরকার ও সরকারি দলকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিতে পারে। ঘুষের টাকাসহ মন্ত্রীর এপিএসের গাড়িচালক ধরা পড়লে সংবাদমাধ্যম যদি সে খবর জনসাধারণকে জানিয়ে দেয়, তাহলে ওই মন্ত্রী ও সরকারের মুখে চুনকালি লাগে। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য বিদেশি বন্ধুদের দেওয়া সম্মাননা ক্রেস্টের সোনা-রুপা ষোলো আনাই মেরে দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলের সরকারের মন্ত্রী-সচিবেরা মিলে—এই সংবাদ পরিবেশিত হলে সরকারের অবশ্যই বেকায়দা হয়ে যায়। সংবাদমাধ্যমের নিরবচ্ছিন্ন চাপের কারণে নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় র্যাবের মতো এলিট ফোর্সকেও বিব্রত হতে হয়, তার তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হতে হয় সরকারকে। সংবাদমাধ্যমের এসব কাজই যদি হয়ে থাকে সরকারের সামনে বাধা সৃষ্টি করা, তাহলে সংবাদমাধ্যম নাচার।
কারণ, এসব করাই সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব। উপরন্তু নিজেকে জনগণের ভোটে নির্বাচিত দাবি করে যে সরকার, সে যখন দেশে সংবিধান বলবৎ থাকা অবস্থায় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে সভা-সমাবেশ-মিছিলসহ সব রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাধা দিয়ে সংবিধানপ্রদত্ত গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে, এমনকি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের মিলনায়তনের ভেতরে ঘরোয়া সভাও করতে দেয় না, তখন সেই খবর পরিবেশন করা সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব বটে। এমনকি সরকারের এমন অগণতান্ত্রিক ও জবরদস্তিমূলক আচরণের সমালোচনা করে কোনো সংবাদপ্রতিষ্ঠান যদি মন্তব্য প্রকাশ করে, তবে তাকে অন্যায়ও বলা যায় না। বিরোধী দলগুলোর নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা ক্ষমতাসীন দলের মাস্তান বাহিনী দিয়ে ভন্ডুল করার সমালোচনা সংবাদমাধ্যম অবশ্যই করবে। এটাকে সরকারবিরোধীদের ইন্ধন বা উসকানি দেওয়া বলা ঠিক হয় না। গণতন্ত্র ও আইনের শাসন থেকে বিচ্যুত হওয়া চলবে না—এ কথা সংবাদমাধ্যম সব সময় বলে যাবে। সহনশীল ও পরমতসহিষ্ণু রাজনৈতিক পরিবেশ বজায় রাখার আহ্বান সংবাদমাধ্যম সব সময়ই জানাবে। এমনকি ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন আইনসিদ্ধ হলেও দেশের সব মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি, এ কথাও যদি কোনো সংবাদপ্রতিষ্ঠান বারবার বলতে থাকে এবং সব দলের অংশগ্রহণে নতুন করে সাধারণ নির্বাচনের দাবি তুলতে থাকে, তবে সেটাকেও সরকারের সামনে বাধা সৃষ্টি করা বলা ঠিক হবে না। প্রধানমন্ত্রী সংবাদমাধ্যমকে ছেড়ে দিয়ে বরং যদি নিজের দল ও সরকারের গভীরে নিবিড় দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, তাহলেই বরং সরকারের সামনের প্রকৃত বাধাগুলো খুঁজে পাবেন। সরকারের সামনে বাধা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের সেই সব নেতা-কর্মী, যাঁরা নানা রকমের গুরুতর অপরাধে লিপ্ত আছেন এবং মাঝেমধ্যেই পরস্পরের প্রাণ সংহার করছেন। সরকারের সামনে বাধা মন্ত্রিসভার সেই সব সদস্য, যাঁদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ব্যাপক, যাঁদের আত্মীয়স্বজনেরা দেশটাকে নিজেদের পারিবারিক সম্পত্তি ভেবে নিয়েছেন। সরকারের সামনে বাধা সৃষ্টি হয় সেই সব আমলার কারণে, যাঁরা ব্যক্তিগত ভাগ্যোন্নয়নের জন্য দেশ ও জনগণের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেন, সরকারের কোনো ভালো উদ্যোগ যাঁদের কারণে সফল হতে পারে না, যাঁরা অনিয়ম-দুর্নীতিতে আকণ্ঠ লিপ্ত থাকেন। সরকারের সেই সব বিভাগ সরকারের সৎ কাজে স্থায়ী বাধা হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে, যেগুলোতে অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দলপ্রীতি স্থায়ী ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। শুধু অসৎ ও স্বার্থপর নয়, অদক্ষ মন্ত্রী-আমলারাও সরকারের পথের বিরাট বাধা। এসব বিষয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জানা থাকার কথা। তাঁর মন্ত্রী-আমলাদের তাঁর থেকে ভালো করে আর কে জানে? কাদের দ্বারা কীভাবে তাঁর শাসনযন্ত্র চলছে, তা তিনি বিলক্ষণ জানেন। তাঁর দলের নেতা-কর্মীদের কার কী স্বভাব-চরিত্র, তা তাঁর চেয়ে ভালো করে কে আর বোঝে?
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@prothom-alo.info
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@prothom-alo.info
No comments