গাজায় হামলা যুদ্ধাপরাধ -জাতিসংঘ
ইসরাইলকে সতর্ক করলেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার নাভি পিল্লাই। তিনি বললেন, বলা যায় তারা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করছে। এটাকে যুদ্ধাপরাধ বলা যেতে পারে। গাজায় যে পরিমাণ বেসামরিক মানুষ, বিশেষ করে নারী
ও শিশু মারা যাচ্ছে, বাড়িঘরে, মসজিদে, বিভিন্ন কমপ্লেক্সে হামলা করা হচ্ছে তাতে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি এ কথা বলেন। জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের জরুরি সভার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এমন মন্তব্য করেন তিনি। একই সঙ্গে তিনি হামাসের রকেট ও মর্টার হামলার নিন্দা করেন। গাজা উপত্যকায় এমন সামরিক হামলায় জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক এই শীর্ষ কর্মকর্তা হতবাক। তিনি বলেন, ইসরাইল যে অভিযান চালাচ্ছে তা বেসামরিক মানুষকে রক্ষায় যথেষ্ট নয়। এতে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন হওয়ার জোর আশঙ্কা রয়েছে। এটা যুদ্ধাপরাধের পর্যায়ে পড়তে পারে। এর জবাবে জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলকে পক্ষপাতী হিসেবে অভিহিত করেছে ইসরাইল। তারা জাতিসংঘের অন্যান্য তদন্তের মতো তাদেরকে সহায়তা না-ও করতে পারে। গত ১৫ দিনের এ যুদ্ধে কমপক্ষে ৬৪৯ ফিলিস্তিনি ও ৩১ ইসরাইলি নিহত হয়েছেন। ফিলিস্তিনের নিহতদের মধ্যে বেশির ভাগই বেসামরিক মানুষ। তাদের মধ্যে রয়েছে শিশু ও নারী। নাভি পিল্লাই বলেন, গাজা উপত্যকায় যে বিপুল সংখ্যক শিশুকে হত্যা করা হয়েছে তা মানবাধিকারের লঙ্ঘন। ওদিকে চলমান যুদ্ধে শান্তি প্রক্রিয়া চালাতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি গতকাল ইসরাইলে পৌঁছেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে তিনি গতকাল তেল আবিবের কাছে বেন গুরিয়ন বিমানবন্দরে পৌঁছেন। ওদিকে মঙ্গলবার রাতভরও হামলা অব্যাহত রাখে ইসরাইল। খান ইউনুস এলাকায় বিমান হামলায় নিহত হন কমপক্ষে ৫ জন। গাজায় ধ্বংসস্তূপের ভিতর থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল এক ফিলিস্তিনি নারীকে। কিন্তু ক্ষতের কারণে তিনি মারা যান। ওই হামলায় তার পরিবারের ১০ সদস্য নিহত হয়েছেন। এ পরিবারটি জার্মান। এ পরিবারের বেঁচে আছেন মাত্র একজন। তার নাম সালেহ কেলানি। যুদ্ধ নিয়ে পশ্চিমারা দ্বিমুখী নীতি নিয়েছে বলে তার অভিযোগ। তিনি বলেন, কেন জার্মানি এ বিষয়ে কোন কথা বলছে না? তাদের কাছে আছে জার্মানির পাসপোর্ট। তিনি প্রশ্ন করেন, এসব হত্যার বিরুদ্ধে জার্মানিতে, আনগেলা মেরকেল-এর পক্ষ থেকে প্রতিবাদ কই? ইসরাইলিরা যখন হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে তখন ইউরোপ, আমেরিকাসহ সরা বিশ্ব কি এ বিষয়ে সচেতন? তারা সচেতন নয় বলেই এ বিষয়ে কিছুই বলা হচ্ছে না। তিনি বলেন, আমরা যে এলাকায় বসবাস করি সেটা তো কোন হামাসের জায়গা নয়। সেখানে হামাস থাকেও না। তাহলে কেন সেখানে বোমা মারা হলো? কেন আমাদের পরিবারকে ধ্বংস করে দেয়া হলো? জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি-মুন ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানালেও তাতে কর্ণপাত করছে না ইসরাইল। ওদিকে এ যুদ্ধের মধ্যে আটকেপড়া পরিবারগুলো নিরাপত্তার জন্য হন্যে হয়ে ছুটছে। কিন্তু গাজার সর্বত্রই যুদ্ধক্ষেত্র। তারা যাবেন কোথায়? শুজাইয়া এলাকায় শামালিস পরিবারের ওপর তিনবার বোমা হামলা হয়েছে তিন স্থানে। তারা দেখেছেন চোখের পলকে ধুলোয় মিশে যাচ্ছে বাড়ি। এ অবস্থায় এ পরিবারটি গাজা সিটিতে পৌঁছে এক আত্মীয়ের বাসায়। কিন্তু সোমবার রাতে সেখানেও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়। এতে নিহত হন ৮ জন। আহত হন অনেকে। এর মধ্যে রয়েছে ২১ বছর বয়সী মোহাম্মদ শামালি। পরিবারের অন্য সদস্যরা আশ্রয় নেন অন্যের বাড়িতে। সেখানেও গতকাল সকালে বোমা হামলা হয়েছে। এতে আহত হয়েছেন কমপক্ষে ২০ জন।
কাতারের আমীর ও সৌদি বাদশাহ্র বৈঠক: উপসাগরীয় ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কে নজিরবিহীনভাবে দূরত্ব ও ফাটল সৃষ্টির পর প্রথমবারের মতো কাতারের আমীর মঙ্গলবার রাতে সৌদি আরব পৌঁছেছেন। আকস্মিক এ সফরে কাতারের আমীর শেখ তামিম বিন হামাদ আল-থানি উপকূলীয় শহর জেদ্দায় সৌদি আরবের বাদশাহ্ আবদুল্লাহ্র সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ফিলিস্তিন অধ্যুষিত গাজায় যুদ্ধবিরতি ইস্যুতে বৈঠক করেন তারা। এ সময় তারা যুদ্ধবিরতিতে ইসরাইল ও হামাসকে রাজি করাতে সম্ভাব্য বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন। আলোচনায় সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স সালমান ও ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স মুকরিন উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন- বাদশাহ্ আবদুল্লাহ্র নিরাপত্তা উপদেষ্টা যুবরাজ বানদার বিন সুলতান ও বাদশাহের পুত্র যুবরাজ মিতেব। মিতেব সৌদি আরবের ন্যাশনাল গার্ডের প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন।
অবরোধ প্রত্যাহার দাবি: যুদ্ধবিরতির অংশ হিসেবে গাজার ওপর থেকে অর্থনৈতিক ‘অবরোধ’ প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন ফিলিস্তিনি প্রধানমন্ত্রী রামি হামদাল্লাহ। জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি-মুন মধ্যপ্রাচ্য সফরে থাকার সময় এ দাবি জানান তিনি। সহিংসতা বন্ধে মধ্যপ্রাচ্য সফরে রয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। তারা অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানান এবং এর কারণগুলো খুঁজে বের করে সেগুলো সমাধানের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন। ফিলিস্তিনি প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা আমাদের জনগণের জন্য সুবিচার চাই, যারা প্রতিদিন এবং গত ৪৭ বছর ইসরাইলি দখলদারিত্বের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত অবিচারের শিকার হচ্ছেন। তিনি বলেন, সময় হয়েছে এ আগ্রাসন বন্ধের এবং অবরোধ অবসানের। গাজায় হামাস ক্ষমতা নেয়ার পর ২০০৭ সালে ইসরাইল ও মিশর এ অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছিল। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছিলেন, মিশরের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের জন্য দায়ী থাকবে হামাস। পক্ষান্তরে, হামাস তাদের বিবৃতিতে বলেছে, ফিলিস্তিনি সীমান্তে মানুষ যেখানে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারবে না ও স্বাধীনভাবে মালামাল আনা-নেয়া যাবে না- তেমন এমন শর্ত-সংবলিত যুদ্ধবিরতিতে তারা সম্মত হবেন না।
গাজায় বাড়ছে শিশুর লাশ
গাজা উপকূলে ইসরাইলি আগ্রাসনের তৃতীয় সপ্তাহ পূরণ হতে চলেছে। এই সংঘর্ষ শিশুদের ওপর খুব মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। গাজা থেকে যেসব প্রতিবেদন পাওয়া যাচ্ছে, সে সবের মধ্যে রয়েছে ট্যাংকের গোলার আঘাতে বেসামরিক মানুষের বসতি ধ্বংসের পাশাপাশি শিশু মৃত্যুর ঘটনাও। ট্যাংকের গোলার আঘাতে নিহত হয়েছে ৫ মাস বয়সী শিশু। এক হামলায় সৈকতে ক্রীড়ারত ৪ শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। ইসরাইলে যখনই রকেট হামলার সাইরেন বাজানো হয়, তখনই সাধারণ ইসরাইলিরা শিশু সন্তান কোলে নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে ছোটে। ঘনবসতিপূর্ণ গাজায় ইসরাইলি সামরিক বাহিনী কর্তৃক ২ সপ্তাহ ধরে বিমান হামলার পর গত সপ্তাহে স্থল অভিযান শুরু হয়। পরিসংখ্যান খুব নির্মম। জেরুজালেমে ইউনিসেফ-এর যোগাযোগ প্রধান ক্যাথরিন ওয়েবেল বলেছেন, জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী ৮ই জুলাই সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর থেকে ১৮ বছরের কমবয়সী অন্তত ১২১ জন ফিলিস্তিনি শিশু নিহত হয়েছে। ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে এই সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশ। তিনি আরও বলেন, ২০ ও ২১শে জুলাইয়ের মধ্যে অন্তত ২৮ জন শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। জাতিসংঘের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী ৪৭৯ ফিলিস্তিনি ও ২৭ ইসরাইলি নিহত হয়েছে এই সংঘর্ষে। কিন্তু নিরপরাধ শিশুদের মৃত্যুর বিষয়টি মানবাধিকার সংগঠন, বিশ্বনেতা ও সমালোচকরা সোচ্চার হয়েছেন। ২২শে জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি-মুন যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, নিজের সন্তানকে কবর দিতে হচ্ছে অনেক মায়ের। একদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, বেসামরিক মানুষের মৃত্যু থামানো উচিত। তবে এর বেশির ভাগ ঘটনার দায় ইসরাইলের। ইসরাইলি মনোবিদরা বলছেন, যুদ্ধের প্রভাব ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনি শিশুদের মনে দাগ কাটছে। অনেক বিশেষজ্ঞই বলছেন, শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত না হলেও, অনেক শিশুই মানসিক আঘাতে ভুগতে পারে। জাতিসংঘের একটি সংস্থা বলছে, অন্তত ৭২৩৯০ জন শিশুর সরাসরি ও বিশেষ মনোসাহায্য প্রয়োজন। গাজার ১৩ বছর বয়সী সামিরা আক্তার এক লাখ শিশুর মধ্যে একজন, যাদের পরিবার উদ্বাস্তু হয়ে জাতিসংঘের একটি স্কুলে সাহায্যের আশায় দিন গুনছে। সামিরা বলে, আমি এই স্কুলকে ঘৃণা করি। আমি আমার বোনদের নিয়ে খেলতে চাই, অন্যদের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে চাই। ১২ বছর বয়সী শাদ মাজেদ গাজার শিফা হাসপাতালের বেডে পড়ে আছে। সে বলে, আমি যুদ্ধ ঘৃণা করি। আমি এর শেষ চাই। আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাই। দয়া করে আমাদের বাঁচতে দিন।
ও শিশু মারা যাচ্ছে, বাড়িঘরে, মসজিদে, বিভিন্ন কমপ্লেক্সে হামলা করা হচ্ছে তাতে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি এ কথা বলেন। জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের জরুরি সভার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এমন মন্তব্য করেন তিনি। একই সঙ্গে তিনি হামাসের রকেট ও মর্টার হামলার নিন্দা করেন। গাজা উপত্যকায় এমন সামরিক হামলায় জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক এই শীর্ষ কর্মকর্তা হতবাক। তিনি বলেন, ইসরাইল যে অভিযান চালাচ্ছে তা বেসামরিক মানুষকে রক্ষায় যথেষ্ট নয়। এতে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন হওয়ার জোর আশঙ্কা রয়েছে। এটা যুদ্ধাপরাধের পর্যায়ে পড়তে পারে। এর জবাবে জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলকে পক্ষপাতী হিসেবে অভিহিত করেছে ইসরাইল। তারা জাতিসংঘের অন্যান্য তদন্তের মতো তাদেরকে সহায়তা না-ও করতে পারে। গত ১৫ দিনের এ যুদ্ধে কমপক্ষে ৬৪৯ ফিলিস্তিনি ও ৩১ ইসরাইলি নিহত হয়েছেন। ফিলিস্তিনের নিহতদের মধ্যে বেশির ভাগই বেসামরিক মানুষ। তাদের মধ্যে রয়েছে শিশু ও নারী। নাভি পিল্লাই বলেন, গাজা উপত্যকায় যে বিপুল সংখ্যক শিশুকে হত্যা করা হয়েছে তা মানবাধিকারের লঙ্ঘন। ওদিকে চলমান যুদ্ধে শান্তি প্রক্রিয়া চালাতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি গতকাল ইসরাইলে পৌঁছেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে তিনি গতকাল তেল আবিবের কাছে বেন গুরিয়ন বিমানবন্দরে পৌঁছেন। ওদিকে মঙ্গলবার রাতভরও হামলা অব্যাহত রাখে ইসরাইল। খান ইউনুস এলাকায় বিমান হামলায় নিহত হন কমপক্ষে ৫ জন। গাজায় ধ্বংসস্তূপের ভিতর থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল এক ফিলিস্তিনি নারীকে। কিন্তু ক্ষতের কারণে তিনি মারা যান। ওই হামলায় তার পরিবারের ১০ সদস্য নিহত হয়েছেন। এ পরিবারটি জার্মান। এ পরিবারের বেঁচে আছেন মাত্র একজন। তার নাম সালেহ কেলানি। যুদ্ধ নিয়ে পশ্চিমারা দ্বিমুখী নীতি নিয়েছে বলে তার অভিযোগ। তিনি বলেন, কেন জার্মানি এ বিষয়ে কোন কথা বলছে না? তাদের কাছে আছে জার্মানির পাসপোর্ট। তিনি প্রশ্ন করেন, এসব হত্যার বিরুদ্ধে জার্মানিতে, আনগেলা মেরকেল-এর পক্ষ থেকে প্রতিবাদ কই? ইসরাইলিরা যখন হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে তখন ইউরোপ, আমেরিকাসহ সরা বিশ্ব কি এ বিষয়ে সচেতন? তারা সচেতন নয় বলেই এ বিষয়ে কিছুই বলা হচ্ছে না। তিনি বলেন, আমরা যে এলাকায় বসবাস করি সেটা তো কোন হামাসের জায়গা নয়। সেখানে হামাস থাকেও না। তাহলে কেন সেখানে বোমা মারা হলো? কেন আমাদের পরিবারকে ধ্বংস করে দেয়া হলো? জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি-মুন ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানালেও তাতে কর্ণপাত করছে না ইসরাইল। ওদিকে এ যুদ্ধের মধ্যে আটকেপড়া পরিবারগুলো নিরাপত্তার জন্য হন্যে হয়ে ছুটছে। কিন্তু গাজার সর্বত্রই যুদ্ধক্ষেত্র। তারা যাবেন কোথায়? শুজাইয়া এলাকায় শামালিস পরিবারের ওপর তিনবার বোমা হামলা হয়েছে তিন স্থানে। তারা দেখেছেন চোখের পলকে ধুলোয় মিশে যাচ্ছে বাড়ি। এ অবস্থায় এ পরিবারটি গাজা সিটিতে পৌঁছে এক আত্মীয়ের বাসায়। কিন্তু সোমবার রাতে সেখানেও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়। এতে নিহত হন ৮ জন। আহত হন অনেকে। এর মধ্যে রয়েছে ২১ বছর বয়সী মোহাম্মদ শামালি। পরিবারের অন্য সদস্যরা আশ্রয় নেন অন্যের বাড়িতে। সেখানেও গতকাল সকালে বোমা হামলা হয়েছে। এতে আহত হয়েছেন কমপক্ষে ২০ জন।
কাতারের আমীর ও সৌদি বাদশাহ্র বৈঠক: উপসাগরীয় ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কে নজিরবিহীনভাবে দূরত্ব ও ফাটল সৃষ্টির পর প্রথমবারের মতো কাতারের আমীর মঙ্গলবার রাতে সৌদি আরব পৌঁছেছেন। আকস্মিক এ সফরে কাতারের আমীর শেখ তামিম বিন হামাদ আল-থানি উপকূলীয় শহর জেদ্দায় সৌদি আরবের বাদশাহ্ আবদুল্লাহ্র সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ফিলিস্তিন অধ্যুষিত গাজায় যুদ্ধবিরতি ইস্যুতে বৈঠক করেন তারা। এ সময় তারা যুদ্ধবিরতিতে ইসরাইল ও হামাসকে রাজি করাতে সম্ভাব্য বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন। আলোচনায় সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স সালমান ও ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স মুকরিন উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন- বাদশাহ্ আবদুল্লাহ্র নিরাপত্তা উপদেষ্টা যুবরাজ বানদার বিন সুলতান ও বাদশাহের পুত্র যুবরাজ মিতেব। মিতেব সৌদি আরবের ন্যাশনাল গার্ডের প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন।
অবরোধ প্রত্যাহার দাবি: যুদ্ধবিরতির অংশ হিসেবে গাজার ওপর থেকে অর্থনৈতিক ‘অবরোধ’ প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন ফিলিস্তিনি প্রধানমন্ত্রী রামি হামদাল্লাহ। জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি-মুন মধ্যপ্রাচ্য সফরে থাকার সময় এ দাবি জানান তিনি। সহিংসতা বন্ধে মধ্যপ্রাচ্য সফরে রয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। তারা অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানান এবং এর কারণগুলো খুঁজে বের করে সেগুলো সমাধানের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন। ফিলিস্তিনি প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা আমাদের জনগণের জন্য সুবিচার চাই, যারা প্রতিদিন এবং গত ৪৭ বছর ইসরাইলি দখলদারিত্বের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত অবিচারের শিকার হচ্ছেন। তিনি বলেন, সময় হয়েছে এ আগ্রাসন বন্ধের এবং অবরোধ অবসানের। গাজায় হামাস ক্ষমতা নেয়ার পর ২০০৭ সালে ইসরাইল ও মিশর এ অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছিল। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছিলেন, মিশরের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের জন্য দায়ী থাকবে হামাস। পক্ষান্তরে, হামাস তাদের বিবৃতিতে বলেছে, ফিলিস্তিনি সীমান্তে মানুষ যেখানে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারবে না ও স্বাধীনভাবে মালামাল আনা-নেয়া যাবে না- তেমন এমন শর্ত-সংবলিত যুদ্ধবিরতিতে তারা সম্মত হবেন না।
গাজায় বাড়ছে শিশুর লাশ
গাজা উপকূলে ইসরাইলি আগ্রাসনের তৃতীয় সপ্তাহ পূরণ হতে চলেছে। এই সংঘর্ষ শিশুদের ওপর খুব মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। গাজা থেকে যেসব প্রতিবেদন পাওয়া যাচ্ছে, সে সবের মধ্যে রয়েছে ট্যাংকের গোলার আঘাতে বেসামরিক মানুষের বসতি ধ্বংসের পাশাপাশি শিশু মৃত্যুর ঘটনাও। ট্যাংকের গোলার আঘাতে নিহত হয়েছে ৫ মাস বয়সী শিশু। এক হামলায় সৈকতে ক্রীড়ারত ৪ শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। ইসরাইলে যখনই রকেট হামলার সাইরেন বাজানো হয়, তখনই সাধারণ ইসরাইলিরা শিশু সন্তান কোলে নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে ছোটে। ঘনবসতিপূর্ণ গাজায় ইসরাইলি সামরিক বাহিনী কর্তৃক ২ সপ্তাহ ধরে বিমান হামলার পর গত সপ্তাহে স্থল অভিযান শুরু হয়। পরিসংখ্যান খুব নির্মম। জেরুজালেমে ইউনিসেফ-এর যোগাযোগ প্রধান ক্যাথরিন ওয়েবেল বলেছেন, জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী ৮ই জুলাই সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর থেকে ১৮ বছরের কমবয়সী অন্তত ১২১ জন ফিলিস্তিনি শিশু নিহত হয়েছে। ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে এই সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশ। তিনি আরও বলেন, ২০ ও ২১শে জুলাইয়ের মধ্যে অন্তত ২৮ জন শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। জাতিসংঘের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী ৪৭৯ ফিলিস্তিনি ও ২৭ ইসরাইলি নিহত হয়েছে এই সংঘর্ষে। কিন্তু নিরপরাধ শিশুদের মৃত্যুর বিষয়টি মানবাধিকার সংগঠন, বিশ্বনেতা ও সমালোচকরা সোচ্চার হয়েছেন। ২২শে জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি-মুন যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, নিজের সন্তানকে কবর দিতে হচ্ছে অনেক মায়ের। একদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, বেসামরিক মানুষের মৃত্যু থামানো উচিত। তবে এর বেশির ভাগ ঘটনার দায় ইসরাইলের। ইসরাইলি মনোবিদরা বলছেন, যুদ্ধের প্রভাব ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনি শিশুদের মনে দাগ কাটছে। অনেক বিশেষজ্ঞই বলছেন, শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত না হলেও, অনেক শিশুই মানসিক আঘাতে ভুগতে পারে। জাতিসংঘের একটি সংস্থা বলছে, অন্তত ৭২৩৯০ জন শিশুর সরাসরি ও বিশেষ মনোসাহায্য প্রয়োজন। গাজার ১৩ বছর বয়সী সামিরা আক্তার এক লাখ শিশুর মধ্যে একজন, যাদের পরিবার উদ্বাস্তু হয়ে জাতিসংঘের একটি স্কুলে সাহায্যের আশায় দিন গুনছে। সামিরা বলে, আমি এই স্কুলকে ঘৃণা করি। আমি আমার বোনদের নিয়ে খেলতে চাই, অন্যদের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে চাই। ১২ বছর বয়সী শাদ মাজেদ গাজার শিফা হাসপাতালের বেডে পড়ে আছে। সে বলে, আমি যুদ্ধ ঘৃণা করি। আমি এর শেষ চাই। আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাই। দয়া করে আমাদের বাঁচতে দিন।
No comments