অনুপ চেটিয়া এবং নূর হোসেনের বিনিময় প্রসঙ্গে by ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী
২২ জুলাই যুগান্তরে অরবিন্দ রায় অনুপ চেটিয়ার বিনিময়ে নূর হোসেন! শিরোনামে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি লিখেছেন, আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী (উলফা) নেতা অনুপ চেটিয়ার সঙ্গে নূর হোসেনের বিনিময় হওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, অনুপ চেটিয়ার সঙ্গে নূরের বিনিময় করা হলে বিনিময় হার সমান থাকবে কি? এ প্রশ্নের জবাব পেতে হলে উভয়ের তুলনামূলক পরিচিতি জানা দরকার। অনুপ চেটিয়া হচ্ছেন আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা, তিনি আসামকে ভারতের থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে চান। যদি কোনোদিন সফল হন তাহলে তিনি অসমিয়াদের চোখে হবেন আসামের স্থপতি। এককথায় জাতির জনক বলতে যা বোঝায়, তিনি হবেন সেই অভিধার একজন। .... বাংলাদেশের কাছে ভারতের দাবি অনুপ চেটিয়াকে যেন তাদের হাতে তুলে দেয়া হয়। অনুপ চেটিয়া একটি রাজ্যের কেন্দ্রীয় নেতা, শুদ্ধ-নিষিদ্ধ পরের বিষয়। ...
অরবিন্দ রায়কে তার এ সময়োচিত মন্তব্যের জন্য সাধুবাদ জানাতে হয়। অনুপ চেটিয়াকে ভারতের হাতে তুলে দেয়ার জন্য ভারত সরকার দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করে আসছে। ভারতের দিক থেকে সেটা স্বাভাবিক। কারণ, অনুপ চেটিয়াকে ছাড়া স্বাধীন আসামের দাবিতে লড়াইরত উলফার সঙ্গে কোনো কার্যকর সমঝোতার জন্য তার সম্মতি অত্যাবশ্যক বলে মনে হয়। কিন্তু সাত-সাতজন মানুষকে প্রকাশ্য দিবালোকে অপহরণ করে ঠাণ্ডা মাথায় নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যা করে বস্তাবন্দি অবস্থায় নদীতে ফেলে দিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, তেমন একজনের সঙ্গে আসামের জনগণের অন্তত একাংশের এ নন্দিত নেতাকে বিনিময় করার প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়। ভারত যদি তেমন আবদার করে থাকে, তাহলে বিনয়ের সঙ্গে তা প্রত্যাখ্যান করতে হবে।
অনুপ চেটিয়া দীর্ঘদিন বাংলাদেশের কারাগারে আটক আছেন। ১৯৯৭ সালের ২১ ডিসেম্বর তাকে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করার অভিযোগে ফরেনার্স ও পাসপোর্ট আইনে গ্রেফতার করা হয়। অতঃপর তিনি আদালতের রায়ে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। দণ্ড শেষে তিনি বাংলাদেশ সরকারের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। সরকার এখন এ ব্যাপারে আদালতের নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছে। অনুপ চেটিয়া ও তার সহকর্মীরা বাংলাদেশের শত্র“ নন। তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভারতের হাতে তুলে দেয়া হলে তারা নিগৃহীত হতে পারেন। জীবন সংশয়ের আশংকাও রয়েছে।
আমাদের আগের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও একবার বলেছিলেন, অনুপ চেটিয়াকে শিগগিরই ভারতের হাতে তুলে দেয়া হবে। একসময় এ কথাও বলা হয়েছিল যে, বন্দি বিনিময়ের প্রক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিনিময়ে অনুপ চেটিয়াকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হবে। অনুপ চেটিয়াকে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সঙ্গে তুলনা করাও গুরুতর অন্যায়। কারণ, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পরিচালিত আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অনুপ চেটিয়ারা আমাদের অকৃত্রিম সুহৃদ ও সহযোগী ছিলেন।
আসাম, কাশ্মীরসহ ভারতের কিছু রাজ্যে স্বাধীনতা সংগ্রাম নতুন কিছু নয়। আমরা নীতিগতভাবে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার বিরোধী। কিন্তু কোনো দেশের স্বাধীনতাকামী বা সরকারবিরোধী কোনো ব্যক্তি যদি রাজনৈতিক নিগ্রহ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আশ্রয় প্রার্থনা করেন, তাহলে তাকে আশ্রয় প্রদান করা যে কোনো সার্বভৌম রাষ্ট্রের নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব। তিনি যদি স্বেচ্ছায় তার দেশে ফিরে যেতে চান ভিন্ন কথা। কিন্তু তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ফেরত পাঠিয়ে বিপদের মুখে ঠেলে দেয়া গুরুতর অন্যায় হবে। সেটা হবে আন্তর্জাতিক রীতির খেলাফ।
ভারত সরকার আসামের স্বাধীনতাকামী নেতাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার যে উদ্যোগ নিয়েছে আমরা তার সাফল্য কামনা করব। এর আগে উলফার শীর্ষ নেতা অরবিন্দ রাজখোয়াসহ বেশ কয়েকজনকে বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিভাবে, কোন আইন বা রীতি অনুসরণ করে তা করা হয়েছে- সে বিষয়টি স্পষ্ট নয়। শোনা যায়, বাংলাদেশ সরকারই তাদের সীমান্তে ভারতীয় বাহিনীর কাছে হাজির হতে বাধ্য করেছে। কিন্তু তারপরও আসামের স্বাধীনতাকামীদের আন্দোলন থেমে যায়নি। কাজেই, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত হবে না, যাতে করে আমাদের এ প্রতিবেশী অঞ্চলের জনগণ বা জনগণের কোনো অংশ বাংলাদেশের প্রতি বিরূপ হয়ে ওঠে, বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের চিরস্থায়ী বৈরিতা সৃষ্টি হয়।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশ সরকার এ রকম অসম ও অনৈতিক বিনিময়ের প্রস্তাবের সম্মতি দিতে পারে না।
দুই
আসামসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রতিটি রাজ্যেই স্বাধীনতার দাবি নিয়ে গড়ে উঠেছে সশস্ত্র বিদ্রোহী বাহিনী। সাত-আটটি সংগঠিত বিদ্রোহী গোষ্ঠী দীর্ঘকাল ধরে দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই করে চলেছে। ভারত সরকারকে তাদের মোকাবেলায় হিমশিম খেতে হচ্ছে। সেজন্য সেখানে প্রায় ৭ লাখ নিয়মিত সৈন্য মোতায়েন রয়েছে। দুর্গম পার্বত্য এলাকায় বিদ্রোহীদের দমন করে প্রশাসন চালিয়ে যেতে রক্তক্ষয়ী সংঘাতে বিপুল অর্থ, অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ খরচ করতে হচ্ছে ভারত সরকারকে।
এ বিদ্রোহীদের স্বাধীনতার দাবি কতটা যৌক্তিক সে বিচারে আমরা যাব না। তার বিচার করবেন সংশ্লিষ্ট জনগণ। রাষ্ট্র হিসেবে স্বীয় অখণ্ডতা বজায় রাখার জন্য ভারত সরকার এ বিদ্রোহ দমনে কঠোর অবস্থান নেবে, সেটাও স্বাভাবিক। সে ব্যাপারেও আমাদের কিছু বলার নেই।
স্পষ্টত এ বিরোধে আমরা উভয় সংকটে রয়েছি। ভারত আমাদের বিশাল ও শক্তিধর প্রতিবেশী। কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রতিরক্ষা-সর্ব ক্ষেত্রেই দুদেশের আদান-প্রদান ব্যাপক ও সুগভীর। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণেও ভারতের সঙ্গে সংঘাত বাংলাদেশের কাম্য হতে পারে না। অপরদিকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাত রাজ্যের সঙ্গেও বাংলাদেশের সম্পর্ক আবহমানকালের। আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, মিজোরামের সঙ্গে রয়েছে আমাদের অভিন্ন সীমান্ত। সেই সীমান্তবর্তী এলাকায় বিরাজ করে বহু সহস্র বছরের অবিভাজিত সমাজ-সংস্কৃতি ও অর্থনীতি। অদূরেই মনিপুর, নাগাল্যান্ড, অরুণাচল। দিল্লির সঙ্গে এসব রাজ্যের দূরত্ব অনেক; কেবল ভৌগোলিক দূরত্বই নয়, মানসিক দূরত্বও বিস্তর। ইংরেজ আগমনের আগে এসব অঞ্চলে কখনোই দিল্লির শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মনে রাখা দরকার, ইংরেজের ঔপনিবেশিক শাসনেও এ সমুদয় অঞ্চল সামগ্রিকভাবে দিল্লির প্রত্যক্ষ শাসনে ছিল না। অপরদিকে ঐতিহাসিক, নৃতাত্ত্বিক, ভৌগোলিক- সবদিক থেকেই বাংলাদেশের সঙ্গে এ অঞ্চলের সম্পর্ক অনাদিকালের। বিশেষ করে আসাম ও ত্রিপুরার ভাষা, বর্ণমালা, সংস্কৃতি-লোকাচারের সঙ্গে বাংলার ভাষা, বর্ণমালা ও সংস্কৃতি-লোকাচারের ভিন্নতা বুঝতে গবেষণা করতে হয়। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণেও এ সম্পর্ক বহাল থাকবে অনন্তকাল অবধি। পৃথিবী যতই এগিয়ে যাচ্ছে, এ একদা দুর্গম অঞ্চলের মানুষও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে এসব অঞ্চল এখন আর আগের মতো দুর্গম নয়। অতি দ্রুত বাইরের জগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে। আর সেই সম্পৃক্ততায় বাংলাদেশ থাকছে প্রকৃতি-নির্ধারিত সন্ধিস্থল হয়ে। ভারত নিজেই এ অঞ্চলে যাতায়াতের তার নিত্যনতুন পথ খুঁজছে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে। সেসব পথন্ম উন্মুক্ত হবে, বাংলাদেশের সঙ্গে এ অঞ্চলের যোগাযোগ ও পরস্পর নির্ভরশীলতা ততই বাড়তে থাকবে।
আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে এ অঞ্চলের জনগণের বিভিন্ন অংশ নিঃস্বার্থভাবে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। একাত্তরে এসব রাজ্যের বিভিন্ন শহর ও গ্রামাঞ্চলে গিয়ে তাদের আন্তরিকতায় অভিভূত হয়েছি। আমাদের স্বাধীনতায় তাদের সেই অবদান ভুলে যাওয়া হবে চরম অকৃতজ্ঞতা। তাই আসাম, তথা এ সাত রাজ্যের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নির্ধারণের সময় এ বাস্তবতা মাথায় রেখেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার অর্জনের সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা দিতে না পারলেও তাদের কোনোভাবে হেনস্থা করা যাবে না।
তিন
মনে রাখা দরকার, ইংরেজ শাসনের ১২১ বছর ছাড়া (১৮২৬-১৯৪৭) আসাম কখনোই পরাধীন ছিল না। আসামের জনগণের একটা বড় অংশ সেই স্বাধীনতা ফিরে পেতে চায় সেটা অপরাধ হতে পারে না। তারা তা অর্জন করতে পারবে কি-না, আমরা বলতে পারব না। ইতিহাস সেটা নির্ধারণ করবে। আসামের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ স্বাধীনতা চায় কি-না, সেটাও স্পষ্ট নয়। (আমরা যখন স্বাধীনতা চাওয়া শুরু করেছিলাম, তখন আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ কি তার পক্ষে ছিল?)। কিন্তু এ স্বাধীনতাকামী মানুষগুলোকে দুর্বৃত্ত কিংবা অপরাধী আখ্যা দেয়ার ব্যাপারে আমার ঘোরতর আপত্তি আছে। তারা স্বাধীনতা চাচ্ছে। আসামে তাদের সমর্থকের সংখ্যা যে নিতান্তই কম নয়, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। দিল্লি তাদের দমন করার জন্য লাখ লাখ সৈন্য মোতায়েন করেছে। রাজনৈতিকভাবেও নানা প্রক্রিয়ায় তাদের দমন করার চেষ্টা করছে। তাদের প্রতিপক্ষে তাঁবেদার গোষ্ঠী খাড়া করে সর্বাÍক সহায়তা দিয়ে রাজ্য সরকারে ক্ষমতায় রাখছে। পাশাপাশি নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে বিদ্রোহীদের সঙ্গে সমঝোতা করতে। তাদের আলোচনার টেবিলে বসানোর চেষ্টা চলছে। যাদের সঙ্গে এত বড় সংঘাত, তাদের সঙ্গেই যখন সমঝোতার এত প্রয়াস, তখন বুঝতে কষ্ট হয় না এ বিদ্রোহীদের অবস্থান সেখানে কতটা ব্যাপক ও শক্ত। স্পষ্টতই তাদের পক্ষে জনসাধারণের একটি বিরাট অংশ রয়েছে। তাদের আমাদের প্রতিপক্ষ বানানো বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক নয়।
চার
অনুপ চেটিয়ারা তাদের সংগ্রামে জয়ী হবেন কি-না সেটা ইতিহাসই নির্ধারণ করবে। আমরা চাইব উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জনগণ তাদের ইচ্ছার আলোকে নিজেরাই তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করুন। তবে উপমহাদেশজুড়ে মুঘল-ইংরেজের পদাংক অনুসরণকারী সাম্রাজ্যবাদ-উপনিবেশবাদসুলভ কর্তৃত্ববাদী শাসনের যে কালো ছায়া শান্তিকামী মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে, সেই কালো ছায়া থেকে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ মুক্ত হোক, সেই মুক্তির আলোকচ্ছটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পার্বত্য বনভূমিতেও বিচ্ছুরিত হোক, সেটাই হবে আমাদের প্রত্যাশা। অনুপ চেটিয়ারাও নিশ্চিতরূপে সেই প্রত্যাশা নিয়েই লড়ছেন।
আলেকজান্ডারের দস্যুবাহিনী পাঞ্জাবের একটি ক্ষুদ্র রাজ্য তছনছ করে দিয়ে সেই রাজ্যের রাজাকে শিকলে বেঁধে হাজির করেছিল তাদের সর্দার সম্রাটের সামনে। সম্রাট বন্দিকে জিজ্ঞাসা করেন, বন্দি তুমি আমার কাছে কেমন ব্যবহার প্রত্যাশা কর? শৃংখলিত রাজা পুরু শির উঁচু করে বলেছিলেন, রাজার মতো।
দস্যু সম্রাট তক্ষুনি বন্দির শৃংখল খুলে নেয়ার নির্দেশ দেন এবং তাকে রাজার মর্যাদায় আপ্যায়িত করেন। অনুপ চেটিয়াদেরও সেই দৃষ্টিতে দেখতে হবে।
ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী : রাজনীতিক, ভূ-রাজনীতি ও উন্নয়ন গবেষক
shapshin@gtlbd.com
অরবিন্দ রায়কে তার এ সময়োচিত মন্তব্যের জন্য সাধুবাদ জানাতে হয়। অনুপ চেটিয়াকে ভারতের হাতে তুলে দেয়ার জন্য ভারত সরকার দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করে আসছে। ভারতের দিক থেকে সেটা স্বাভাবিক। কারণ, অনুপ চেটিয়াকে ছাড়া স্বাধীন আসামের দাবিতে লড়াইরত উলফার সঙ্গে কোনো কার্যকর সমঝোতার জন্য তার সম্মতি অত্যাবশ্যক বলে মনে হয়। কিন্তু সাত-সাতজন মানুষকে প্রকাশ্য দিবালোকে অপহরণ করে ঠাণ্ডা মাথায় নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যা করে বস্তাবন্দি অবস্থায় নদীতে ফেলে দিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, তেমন একজনের সঙ্গে আসামের জনগণের অন্তত একাংশের এ নন্দিত নেতাকে বিনিময় করার প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়। ভারত যদি তেমন আবদার করে থাকে, তাহলে বিনয়ের সঙ্গে তা প্রত্যাখ্যান করতে হবে।
অনুপ চেটিয়া দীর্ঘদিন বাংলাদেশের কারাগারে আটক আছেন। ১৯৯৭ সালের ২১ ডিসেম্বর তাকে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করার অভিযোগে ফরেনার্স ও পাসপোর্ট আইনে গ্রেফতার করা হয়। অতঃপর তিনি আদালতের রায়ে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। দণ্ড শেষে তিনি বাংলাদেশ সরকারের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। সরকার এখন এ ব্যাপারে আদালতের নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছে। অনুপ চেটিয়া ও তার সহকর্মীরা বাংলাদেশের শত্র“ নন। তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভারতের হাতে তুলে দেয়া হলে তারা নিগৃহীত হতে পারেন। জীবন সংশয়ের আশংকাও রয়েছে।
আমাদের আগের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও একবার বলেছিলেন, অনুপ চেটিয়াকে শিগগিরই ভারতের হাতে তুলে দেয়া হবে। একসময় এ কথাও বলা হয়েছিল যে, বন্দি বিনিময়ের প্রক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিনিময়ে অনুপ চেটিয়াকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হবে। অনুপ চেটিয়াকে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সঙ্গে তুলনা করাও গুরুতর অন্যায়। কারণ, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পরিচালিত আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অনুপ চেটিয়ারা আমাদের অকৃত্রিম সুহৃদ ও সহযোগী ছিলেন।
আসাম, কাশ্মীরসহ ভারতের কিছু রাজ্যে স্বাধীনতা সংগ্রাম নতুন কিছু নয়। আমরা নীতিগতভাবে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার বিরোধী। কিন্তু কোনো দেশের স্বাধীনতাকামী বা সরকারবিরোধী কোনো ব্যক্তি যদি রাজনৈতিক নিগ্রহ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আশ্রয় প্রার্থনা করেন, তাহলে তাকে আশ্রয় প্রদান করা যে কোনো সার্বভৌম রাষ্ট্রের নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব। তিনি যদি স্বেচ্ছায় তার দেশে ফিরে যেতে চান ভিন্ন কথা। কিন্তু তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ফেরত পাঠিয়ে বিপদের মুখে ঠেলে দেয়া গুরুতর অন্যায় হবে। সেটা হবে আন্তর্জাতিক রীতির খেলাফ।
ভারত সরকার আসামের স্বাধীনতাকামী নেতাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার যে উদ্যোগ নিয়েছে আমরা তার সাফল্য কামনা করব। এর আগে উলফার শীর্ষ নেতা অরবিন্দ রাজখোয়াসহ বেশ কয়েকজনকে বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিভাবে, কোন আইন বা রীতি অনুসরণ করে তা করা হয়েছে- সে বিষয়টি স্পষ্ট নয়। শোনা যায়, বাংলাদেশ সরকারই তাদের সীমান্তে ভারতীয় বাহিনীর কাছে হাজির হতে বাধ্য করেছে। কিন্তু তারপরও আসামের স্বাধীনতাকামীদের আন্দোলন থেমে যায়নি। কাজেই, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত হবে না, যাতে করে আমাদের এ প্রতিবেশী অঞ্চলের জনগণ বা জনগণের কোনো অংশ বাংলাদেশের প্রতি বিরূপ হয়ে ওঠে, বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের চিরস্থায়ী বৈরিতা সৃষ্টি হয়।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশ সরকার এ রকম অসম ও অনৈতিক বিনিময়ের প্রস্তাবের সম্মতি দিতে পারে না।
দুই
আসামসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রতিটি রাজ্যেই স্বাধীনতার দাবি নিয়ে গড়ে উঠেছে সশস্ত্র বিদ্রোহী বাহিনী। সাত-আটটি সংগঠিত বিদ্রোহী গোষ্ঠী দীর্ঘকাল ধরে দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই করে চলেছে। ভারত সরকারকে তাদের মোকাবেলায় হিমশিম খেতে হচ্ছে। সেজন্য সেখানে প্রায় ৭ লাখ নিয়মিত সৈন্য মোতায়েন রয়েছে। দুর্গম পার্বত্য এলাকায় বিদ্রোহীদের দমন করে প্রশাসন চালিয়ে যেতে রক্তক্ষয়ী সংঘাতে বিপুল অর্থ, অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ খরচ করতে হচ্ছে ভারত সরকারকে।
এ বিদ্রোহীদের স্বাধীনতার দাবি কতটা যৌক্তিক সে বিচারে আমরা যাব না। তার বিচার করবেন সংশ্লিষ্ট জনগণ। রাষ্ট্র হিসেবে স্বীয় অখণ্ডতা বজায় রাখার জন্য ভারত সরকার এ বিদ্রোহ দমনে কঠোর অবস্থান নেবে, সেটাও স্বাভাবিক। সে ব্যাপারেও আমাদের কিছু বলার নেই।
স্পষ্টত এ বিরোধে আমরা উভয় সংকটে রয়েছি। ভারত আমাদের বিশাল ও শক্তিধর প্রতিবেশী। কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রতিরক্ষা-সর্ব ক্ষেত্রেই দুদেশের আদান-প্রদান ব্যাপক ও সুগভীর। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণেও ভারতের সঙ্গে সংঘাত বাংলাদেশের কাম্য হতে পারে না। অপরদিকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাত রাজ্যের সঙ্গেও বাংলাদেশের সম্পর্ক আবহমানকালের। আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, মিজোরামের সঙ্গে রয়েছে আমাদের অভিন্ন সীমান্ত। সেই সীমান্তবর্তী এলাকায় বিরাজ করে বহু সহস্র বছরের অবিভাজিত সমাজ-সংস্কৃতি ও অর্থনীতি। অদূরেই মনিপুর, নাগাল্যান্ড, অরুণাচল। দিল্লির সঙ্গে এসব রাজ্যের দূরত্ব অনেক; কেবল ভৌগোলিক দূরত্বই নয়, মানসিক দূরত্বও বিস্তর। ইংরেজ আগমনের আগে এসব অঞ্চলে কখনোই দিল্লির শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মনে রাখা দরকার, ইংরেজের ঔপনিবেশিক শাসনেও এ সমুদয় অঞ্চল সামগ্রিকভাবে দিল্লির প্রত্যক্ষ শাসনে ছিল না। অপরদিকে ঐতিহাসিক, নৃতাত্ত্বিক, ভৌগোলিক- সবদিক থেকেই বাংলাদেশের সঙ্গে এ অঞ্চলের সম্পর্ক অনাদিকালের। বিশেষ করে আসাম ও ত্রিপুরার ভাষা, বর্ণমালা, সংস্কৃতি-লোকাচারের সঙ্গে বাংলার ভাষা, বর্ণমালা ও সংস্কৃতি-লোকাচারের ভিন্নতা বুঝতে গবেষণা করতে হয়। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণেও এ সম্পর্ক বহাল থাকবে অনন্তকাল অবধি। পৃথিবী যতই এগিয়ে যাচ্ছে, এ একদা দুর্গম অঞ্চলের মানুষও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে এসব অঞ্চল এখন আর আগের মতো দুর্গম নয়। অতি দ্রুত বাইরের জগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে। আর সেই সম্পৃক্ততায় বাংলাদেশ থাকছে প্রকৃতি-নির্ধারিত সন্ধিস্থল হয়ে। ভারত নিজেই এ অঞ্চলে যাতায়াতের তার নিত্যনতুন পথ খুঁজছে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে। সেসব পথন্ম উন্মুক্ত হবে, বাংলাদেশের সঙ্গে এ অঞ্চলের যোগাযোগ ও পরস্পর নির্ভরশীলতা ততই বাড়তে থাকবে।
আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে এ অঞ্চলের জনগণের বিভিন্ন অংশ নিঃস্বার্থভাবে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। একাত্তরে এসব রাজ্যের বিভিন্ন শহর ও গ্রামাঞ্চলে গিয়ে তাদের আন্তরিকতায় অভিভূত হয়েছি। আমাদের স্বাধীনতায় তাদের সেই অবদান ভুলে যাওয়া হবে চরম অকৃতজ্ঞতা। তাই আসাম, তথা এ সাত রাজ্যের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নির্ধারণের সময় এ বাস্তবতা মাথায় রেখেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার অর্জনের সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা দিতে না পারলেও তাদের কোনোভাবে হেনস্থা করা যাবে না।
তিন
মনে রাখা দরকার, ইংরেজ শাসনের ১২১ বছর ছাড়া (১৮২৬-১৯৪৭) আসাম কখনোই পরাধীন ছিল না। আসামের জনগণের একটা বড় অংশ সেই স্বাধীনতা ফিরে পেতে চায় সেটা অপরাধ হতে পারে না। তারা তা অর্জন করতে পারবে কি-না, আমরা বলতে পারব না। ইতিহাস সেটা নির্ধারণ করবে। আসামের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ স্বাধীনতা চায় কি-না, সেটাও স্পষ্ট নয়। (আমরা যখন স্বাধীনতা চাওয়া শুরু করেছিলাম, তখন আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ কি তার পক্ষে ছিল?)। কিন্তু এ স্বাধীনতাকামী মানুষগুলোকে দুর্বৃত্ত কিংবা অপরাধী আখ্যা দেয়ার ব্যাপারে আমার ঘোরতর আপত্তি আছে। তারা স্বাধীনতা চাচ্ছে। আসামে তাদের সমর্থকের সংখ্যা যে নিতান্তই কম নয়, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। দিল্লি তাদের দমন করার জন্য লাখ লাখ সৈন্য মোতায়েন করেছে। রাজনৈতিকভাবেও নানা প্রক্রিয়ায় তাদের দমন করার চেষ্টা করছে। তাদের প্রতিপক্ষে তাঁবেদার গোষ্ঠী খাড়া করে সর্বাÍক সহায়তা দিয়ে রাজ্য সরকারে ক্ষমতায় রাখছে। পাশাপাশি নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে বিদ্রোহীদের সঙ্গে সমঝোতা করতে। তাদের আলোচনার টেবিলে বসানোর চেষ্টা চলছে। যাদের সঙ্গে এত বড় সংঘাত, তাদের সঙ্গেই যখন সমঝোতার এত প্রয়াস, তখন বুঝতে কষ্ট হয় না এ বিদ্রোহীদের অবস্থান সেখানে কতটা ব্যাপক ও শক্ত। স্পষ্টতই তাদের পক্ষে জনসাধারণের একটি বিরাট অংশ রয়েছে। তাদের আমাদের প্রতিপক্ষ বানানো বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক নয়।
চার
অনুপ চেটিয়ারা তাদের সংগ্রামে জয়ী হবেন কি-না সেটা ইতিহাসই নির্ধারণ করবে। আমরা চাইব উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জনগণ তাদের ইচ্ছার আলোকে নিজেরাই তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করুন। তবে উপমহাদেশজুড়ে মুঘল-ইংরেজের পদাংক অনুসরণকারী সাম্রাজ্যবাদ-উপনিবেশবাদসুলভ কর্তৃত্ববাদী শাসনের যে কালো ছায়া শান্তিকামী মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে, সেই কালো ছায়া থেকে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ মুক্ত হোক, সেই মুক্তির আলোকচ্ছটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পার্বত্য বনভূমিতেও বিচ্ছুরিত হোক, সেটাই হবে আমাদের প্রত্যাশা। অনুপ চেটিয়ারাও নিশ্চিতরূপে সেই প্রত্যাশা নিয়েই লড়ছেন।
আলেকজান্ডারের দস্যুবাহিনী পাঞ্জাবের একটি ক্ষুদ্র রাজ্য তছনছ করে দিয়ে সেই রাজ্যের রাজাকে শিকলে বেঁধে হাজির করেছিল তাদের সর্দার সম্রাটের সামনে। সম্রাট বন্দিকে জিজ্ঞাসা করেন, বন্দি তুমি আমার কাছে কেমন ব্যবহার প্রত্যাশা কর? শৃংখলিত রাজা পুরু শির উঁচু করে বলেছিলেন, রাজার মতো।
দস্যু সম্রাট তক্ষুনি বন্দির শৃংখল খুলে নেয়ার নির্দেশ দেন এবং তাকে রাজার মর্যাদায় আপ্যায়িত করেন। অনুপ চেটিয়াদেরও সেই দৃষ্টিতে দেখতে হবে।
ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী : রাজনীতিক, ভূ-রাজনীতি ও উন্নয়ন গবেষক
shapshin@gtlbd.com
No comments