চলাচলের অযোগ্য রাজধানী by আহমেদ জামাল
রাজধানীর রাস্তাঘাট চলাচলের অযোগ্য হয়ে
পড়েছে। খানাখন্দে ভরে গেছে গলি থেকে প্রধান সড়ক। যানজট জলজটের সঙ্গে
ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট রাজধানীর নাগরিক জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে। ঈদ উপলক্ষে
রাজধানীর রাস্তাঘাটে মানুষের চলাচল বেড়েছে। কিন্তু খানাখন্দে ভরা রাস্তায়
যাতায়াত করতে গিয়ে মানুষ প্রতিনিয়ত নানা দুর্ভোগের সম্মুখীন হচ্ছে। প্রায়
দুই কোটি লোক অধ্যুষিত রাজধানীর রাস্তাঘাটের তদারকের দায়িত্ব ঢাকা সিটি
করপোরেশনের। রাস্তাঘাট উন্নয়নে বিভক্ত ডিসিসি প্রতি বছর শ’ শ’ কোটি টাকা
বরাদ্দ দেয়। বছর শেষে বরাদ্দকৃত টাকা ব্যয়ও হয়। কিন্তু রাস্তাঘাটের উন্নয়ন
দেখা যায় না। দেখা যায় কোথাও কাদা আর পানিতে একাকার। কোথাও এবড়োখেবড়ো
রাস্তা দিয়ে পায়ে চলাও দায়। ওয়াসা টিঅ্যান্ডটি তিতাস গ্যাসসহ বিভিন্ন সেবা
সংস্থার উন্নয়নকাজের খোঁড়াখুঁড়ি রাস্তার অবস্থাকে দিনে দিনে নাজুক করে
তুলেছে। মৌচাক-মগবাজার ফ্লাইওভার নির্মাণকাজ নগরবাসীর জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার
ঘা রূপে চিহ্নিত হয়েছে। তবে নগরবাসীর এ দুর্ভোগের জন্য ঢাকা ওয়াসাকে দায়ী
করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী। ওয়াসার পানি নিষ্কাশন
ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে নগরীর রাস্তাঘাটের এমন দুর্গতি বলে মন্তব্য করেন
তিনি। রাজধানীর বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিল, আরামবাগ, ফকিরেরপুল, শান্তিনগর,
মালিবাগ, মগবাজার, মৌচাক, টিকাটুলী, ওয়ারী থেকে শুরু করে অভিজাত এলাকা
গুলশান, বারিধারা, বনানী, ধানমন্ডি সর্বত্র একই চিত্র। চলমান বর্ষায়
পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। ভুক্তভোগীদের মতে, রাজধানীর সবচেয়ে বেশি
জনবসতি ঢাকা সিটি করপোরেশনের দক্ষিণ অংশে। প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়,
বাংলাদেশ ব্যাংকসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো এ অংশে অবস্থিত।
আর্থিক সঙ্কটের কারণে এই সিটি করপোরেশন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়মিত
বেতন-ভাতা দিতে হিমশিম খাচ্ছে। রাস্তাঘাট উন্নয়নে ঠিকাদারদের ১৫০ কোটি
টাকার বিল বকেয়া পড়ে আছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন গত অর্থবছরে নগরীর ৫৩
দশমিক ২৫ কিলোমিটার রাস্তা ৩৮ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার নর্দমা উন্নয়নে ৯৭ কোটি
টাকা বরাদ্দ দেয়। এ ছাড়া আরবান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইমপ্রুভমেন্ট প্রকল্পের
আওতায় রাস্তাঘাট উন্নয়নে ১০৫ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। বছর শেষে এসব
উন্নয়নকাজের ছিটেফোঁটাও চোখে পড়ছে না। রাস্তাঘাটের এ দুরবস্থার কথা স্বীকার
করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম
বলেন, নগরীর পানি নিষ্কাশন সমস্যাই রাস্তাঘাটের এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী।
তিনি বলেন, আমরা টাকা খরচ করে রাস্তা মেরামত করি। কিন্তু বৃষ্টির পানি তা
ধুয়ে নিয়ে যায়। পানি সরার কোন পথ নেই। এ ব্যাপারে ঢাকা ওয়াসাকে বহুবার বলা
হয়েছে। কাজ হয়নি। যত দিন পানি নিষ্কাশন সমস্যার উন্নতি হবে না, তত দিন
নগরবাসীকে এ দুর্ভোগ থেকে রেহাই দেয়া যাবে না। এ অঞ্চলের বিষফোঁড়া হিসেবে
চিহ্নিত মৌচাক-মগবাজার ফ্লাইওভারের কথা উল্লেখ করে প্রধান প্রকৌশলী বলেন, এ
কাজের তদারক করছে এলজিইডি। তাদেরও আমরা এ জনদুর্ভোগের কথা বারবার স্মরণ
করিয়ে দিয়েছি। কিন্তু কাজ হচ্ছে না। ফলে এ অঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠী আড়াই বছর
ধরে সীমাহীন যন্ত্রণা ভোগ করছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, দুই বছরে এ
ফ্লাইওভারের কাজ শেষ হওয়ার কথা। অথচ আড়াই বছরে তার অর্ধেক কাজও শেষ হয়নি।
ফলে সরকারের অগ্রাধিকার ভিত্তিক এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন নিয়ে দুশ্চিন্তায়
পড়েছে সংশ্লিষ্ট সবাই। এলজিইডির তত্ত্বাবধানে যৌথভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে
কাজ করছে দেশী-বিদেশী দু’টি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার
অতিরিক্ত ছয় মাস পরও কাজ হয়েছে মাত্র ৩৫ ভাগ। সেবা সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে
ভুল তথ্য সরবরাহ করায় সোয়া আট কিলোমিটার প্রকল্পের প্রায় অর্ধেক অংশে এখনও
কাজ শুরু হয়নি। নতুন করে নকশা তৈরি করছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের
সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ। কবে নকশা হবে, কবে কাজ শুরু এ বিষয়ে কেউ কিছু
বলতে পারে না। ফলে এ প্রকল্পটি এখন রাজধানীবাসীর জন্য বিষফোঁড়া হয়ে
দাঁড়িয়েছে। এদিকে প্রকল্পের মেয়াদ এবং ব্যয় দু’টোই বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে
নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। ২০১৬ পর্যন্ত প্রকল্পের সময় বাড়ানো এবং নির্মাণ ব্যয়
৭৭২ কোটির পরিবর্তে প্রায় ১৪০০ কোটি টাকার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এর
পরিপ্রেক্ষিতে শত কোটি টাকা দেয়ার ব্যাপারে সরকার সম্মত হলেও এখনও চূড়ান্ত
অনুমোদন হয়নি। ফলে অর্থনৈতিক বিষয় ও নতুন নকশা প্রণয়নের বিষয়টি সুরাহা না
হওয়া পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। কাজের ধীরগতি ও
রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কারণে প্রকল্প এলাকায় জনদুর্ভোগ চরমে উঠেছে। রাজধানীর
শান্তিনগর থেকে সাতরাস্তা পর্যন্ত সরজমিনে ঘুরে দেখা গেছে জনদুর্ভোগের
ভয়াবহ চিত্র। শান্তিগর এলাকায় কয়েক মাস কাজ বন্ধ। সেখানে রাস্তা খুঁড়ে
পুকুরের মতো করে রাখা আছে। রাস্তার ওপর রাখা হয়েছে ঢিপি সমান মাটি। এ জন্য এ
এলাকায় যানজট সমস্যা প্রতিদিনের। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, মাটি খোঁড়ার
পর কিছু অংশ টিনের বেড়া দেয়া হয়েছে। হঠাৎ করেই কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। এর পর
থেকে এখানে আর কেউ আসেন না। শান্তিনগর থেকে মৌচাক-মালিবাগ রেলগেট হয়ে
প্রকল্পের অপর অংশ আবুল হোটেল পর্যন্ত। অন্যপাশে রাজারবাগ পর্যন্ত নামবে
আরেকটি লুপ। কিন্তু এর পুরো অংশেই কাজ বন্ধ। মালিবাগ রেলগেট ও মৌচাক
পয়েন্টে কাজ শুরুর পর বন্ধ হয়ে যায়। তবে গর্তগুলো বন্ধ করা হয়নি। এ কারণে
যানবাহন চলাচলে যেমন অসুবিধা হচ্ছে, তেমনি সাধারণ মানুষের পথ চলতে
দুর্ভোগের শেষ নেই। এদিকে টানা বর্ষণে রাজধানীর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা মিরপুর ও
পল্লবীর সড়ক, অলিগলি তলিয়ে গেছে। দীর্ঘদিন এসব সড়কের সংস্কার না হওয়ায়
দুরবস্থা। কয়েক দিনের অবিরাম বৃষ্টিতে প্রতিটি সড়কে গর্ত ও খানাখন্দ সৃষ্টি
হয়েছে। দুর্ভোগে পড়েছেন মিরপুর এলাকার পাঁচ লাখ বসবাসকারী। স্থানীয়
বাসিন্দাদের অভিযোগ, অল্প বৃষ্টিতেই সড়কে জলাবদ্ধতার সৃৃষ্টি হচ্ছে। অনেক
স্থানে জলাবদ্ধতা সাময়িক হলেও কয়েকটি জায়গায় পানি জমে আছে দিনের পর দিন।
পানি নামে না তিন-চার দিনেও। মিরপুরের প্রধান সড়ক নামে পরিচিত কালশী সড়কের
প্রায় এক কিলোমিটার এলাকায় শতাধিক গর্ত ও খানাখন্দ সৃষ্টি হয়েছে। রূপনগর
সড়কেরও একই অবস্থা। এসব সড়কে প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে হাজার হাজার যানবাহন
চলাচল করছে। মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনের ঝুটপট্টি থেকে প্যারিস রোডমুখী সড়কে
দেড় মাস ধরে পানি জমে আছে। সড়ক বিভাজকের সামান্য অংশ বাদে দুই পাশেই
ময়লা-দুর্গন্ধযুক্ত পানি জমে আছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নিষ্কাশন
লাইন ওয়াসার নালায় গিয়ে মিশেছে। বিপুল পরিমাণ ময়লা-আবর্জনা জমে যাওয়ায়
ওয়াসার সে নালা-নর্দমা বন্ধের অবস্থা। মিরপুর ২ নম্বর সেকশনের শিয়ালবাড়ী
মোড় থেকে রূপনগর আবাসিক এলাকা হয়ে দুয়ারীপাড়া যাওয়ার প্রায় দেড় কিলোমিটার
দীর্ঘ সড়কটির অবস্থা যাচ্ছে তাই। অল্প বৃষ্টি হলেও পানি জমে যায়। এর মধ্যে
ওয়াসা পানির লাইন বসাতে রূপনগর আবাসিক এলাকার ৩৯টি অভ্যন্তরীণ সড়কের মধ্যে
৩১টিই কাটা থাকায় সেখানকার অবস্থা শোচনীয়। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস
অ্যান্ড টেকনোলজির রূপনগর ক্যাম্পাসের সামনের সড়ক, রূপনগর আবাসিক এলাকা
মোড়, আরিফাবাদ হাউজিং, দুয়ারীপাড়া বাজার ও ৯২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ
কার্যালয়ের সামনে পর্যন্ত মূল সড়কে বড় বড় গর্ত এবং পানি জমে আছে। স্থানীয়
বাসিন্দারা জানান, ওয়াসা তিন মাস আগে সড়ক কাটলেও এখনও মেরামত করেনি। ওয়াসার
বক্তব্য রূপনগর এলাকার সব বাড়িতে নতুন পাইপলাইন বসাতে হচ্ছে। এটি
সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ঈদের পরে কাজ শেষ হতে পারে। মিরপুর ১২ থেকে ১৪ নম্বর
যাওয়ার মূল সড়কের দুই পাশে অল্প বৃষ্টিতেই পানি জমে যায়। নামতে দু’-তিন
ঘণ্টা লাগছে। টি-২০ বিশ্বকাপ উপলক্ষে সড়ক দু’টি সংস্কার করা হয়। সংস্কার
কাজের সময় ব্যবহৃত কিছু নির্মাণসামগ্রী এখনও সড়কের পাশে পড়ে আছে। গত
দু’দিনের বৃষ্টিতে মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর থেকে কাজীপাড়া বাসস্ট্যান্ড
পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এ রকম চিত্র রাজধানীর প্রায়
সর্বত্র দেখা যাচ্ছে।
No comments