র্যাবকে পুলিশ থেকে আলাদা করার প্রস্তাব by রোজিনা ইসলাম
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে (র্যাব) পুলিশ থেকে আলাদা করে সরাসরি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে আসার প্রস্তাব করা হয়েছে। পাশাপাশি এই বাহিনীকে সংস্কারেরও প্রস্তাব তৈরি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। র্যাব এখন পুলিশের একটি বিশেষ ব্যাটালিয়ন।
সংস্কারের প্রস্তাবে এই বাহিনীর সদস্যদের পদায়ন, শৃঙ্খলা, কোটা ব্যবস্থাপনা, প্রশিক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা ছাড়পত্রের বিষয়ে বিভিন্ন সুপারিশ করা হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, একটি কম্পোজিট (সমন্বিত) বাহিনী হওয়া সত্ত্বেও বর্তমানে পুলিশ বাহিনীর একটি ইউনিট হিসেবে র্যাবের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে র্যাবের অপারেশনে পুলিশ বাহিনীর কোনো কার্যকর ভূমিকা নেই। প্রস্তাবে বলা হয়, একটি সমন্বিত বাহিনীকে অন্য একটি বাহিনীর অধীনে রাখা ঠিক নয়।
পুলিশের অধীন বিশেষ ব্যাটালিয়ন হলেও র্যাব ও পুলিশের সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব গত কয়েক বছরে প্রকাশ্য হয়ে উঠেছে। নিজেদের মধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেছে। গত বছরের জুলাই মাসে র্যাবে কর্মরত সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে ১৬টি অপ্রীতিকর ঘটনার বিবরণ দিয়ে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলে একটি প্রতিবেদন পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, কর্মস্থলে দুই বাহিনীর সদস্যরা পরস্পরকে সহ্য করতে পারছেন না। একে অপরের কাজে বাধা দিচ্ছেন। এসব নিয়ে মামলা ও সাধারণ ডায়েরি করার ঘটনাও ঘটেছে।
তবে সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় র্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তার জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠায় এ বাহিনী নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা চলছে। বিএনপির শাসনামলে এ বাহিনী গঠিত হলেও দলটির প্রধান খালেদা জিয়া সম্প্রতি এ বাহিনী বিলুপ্তির দাবি জানান। ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের’ অভিযোগ তুলে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোও র্যাব বিলুপ্তির দাবি তুলেছে। দেশীয় নানা সংগঠনও এ বাহিনীর কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে আসছে।
এ অবস্থায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় র্যাবকে সংস্কারের এ প্রস্তাব তৈরি করেছে। প্রস্তাবটি ইতিমধ্যে স্বরাষ্ট্রসচিবের অনুমোদনের পর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে দেওয়া হয়েছে। শিগগিরই এর অনুমোদন চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হবে।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রস্তাবটি আমরা পর্যালোচনা করছি। তবে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেবেন প্রধানমন্ত্রী।’
সংস্কার প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সন্ত্রাস দমন ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য একটি দক্ষ, আধুনিক ও কার্যকর বাহিনী হিসেবে পুলিশের অতিরিক্ত এলিট ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে র্যাব গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তবে গত এক দশকের বেশি সময়ে দায়িত্ব পালনকালে র্যাবের গঠন, নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা এবং অন্যান্য কিছু ক্ষেত্রে ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখা গেছে। এ অবস্থায় র্যাবের সংস্কার করা জরুরি হওয়ায় এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমরা অনেক দিন থেকেই র্যাব সংস্কারের দাবি জানিয়ে আসছি। অনেক বিষয়ই সংস্কার প্রস্তাবে উঠে এসেছে। তবে আমরা মনে করি, কোনো বাহিনী থেকে না এনে নতুনভাবে রর্যাব কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে বাহিনীর উপযোগী করে প্রশিক্ষিত করা উচিত। সশস্ত্র বাহিনী থেকে র্যাবে কোনো কর্মকর্তাকে আনা উচিত নয়। তবে এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে পরিপূর্ণ একটি সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করে তা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো উচিত।’
পদায়ন: সংস্কার প্রস্তাবের পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ থেকে আসা র্যাবের সদস্যরা সরাসরি র্যাবে যোগ দেন। কিন্তু এ বাহিনীতে আসা পুলিশ সুপার এবং এর ওপরের পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পদ স্থাপন করে। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও নিম্ন পদমর্যাদার কর্মকর্তা-কর্মচারীকে পুলিশ অধিদপ্তর সরাসরি র্যাবে পদায়ন করে।
সংস্কার প্রস্তাবে বলা হয়, সরকারের বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী, প্রতিটি বিভাগে কর্মরত সদস্যরা প্রেষণে নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয়ে যোগদান করে পরবর্তী সময়ে প্রেষণে নির্ধারিত কর্মস্থলে যাবেন। কিন্তু র্যাবে পদায়নের ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যরা ছাড়া অন্যদের পদায়নে প্রেষণ নীতিমালা অনুসরণ করা হয় না।
প্রস্তাবে বলা হয়, র্যাবে প্রেষণে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রেষণ নীতিমালা অনুযায়ী সব বাহিনী থেকে আসা সদস্যরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পদায়নের জন্য ন্যস্ত হবেন এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিধিবিধান অনুযায়ী তাঁদের র্যাবে বিন্যস্ত করবে।
শৃঙ্খলা: সংস্কার প্রস্তাবের পর্যালোচনা অংশে বলা হয়েছে, র্যাবে কর্মরত সব সদস্যের শৃঙ্খলা নিজ নিজ আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ফলে এ বাহিনীতে কর্মরত সামরিক সদস্যসহ অন্য বাহিনীর সদস্যরা একই ধরনের অনিয়ম বা অপরাধ করলে তাঁদের নিজ নিজ মাতৃবাহিনীর বিধিবিধান অনুযায়ী শৃঙ্খলামূলক শাস্তি দেওয়া হয়। একই বাহিনীতে কর্মরত থেকে একই ধরনের অনিয়ম বা অপরাধ করলেও শাস্তি হয় ভিন্ন ভিন্ন। ফলে সদস্যদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
সংস্কার প্রস্তাবে বলা হয়, সামরিক ও অন্য যে বাহিনী থেকেই আসুক না কেন, র্যাবে কর্মরত অবস্থায় অনিয়ম বা অপরাধ করলে সবার জন্য একই ধরনের শৃঙ্খলামূলক বিধিবিধান অনুসরণ করা উচিত। এ ক্ষেত্রে র্যাবের জন্য একটি বিশেষ বিধি (শৃঙ্খলা ও আপিল) প্রণয়ন করার সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রশিক্ষণ: র্যাবের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের ঘাটতি আছে উল্লেখ করে সংস্কার প্রস্তাবে বলা হয়, র্যাবে কাজ করার সময় দেখা যায়, সামরিক বাহিনী থেকে আসা সদস্যরা বেসামরিক আইন, বিধিবিধান, প্রথা ইত্যাদি সম্পর্কে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত নন। আবার পুলিশ-বিজিবি-আনসার থেকে আসা সদস্যরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটি বিশেষায়িত সমন্বিত বাহিনীতে কাজ করার মতো প্রশিক্ষণ ও মানসিকতার সামর্থ্য থাকে না।
প্রস্তাবে বলা হয়েছে, র্যাবে নিয়োগ পাওয়ার পর এর আইন ও বিধিবিধানের ওপর প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁদের পদায়ন করা উচিত। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এ প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে হবে।
কোটা ব্যবস্থাপনা: সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, আনসার ও জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিয়ে র্যাব একটি সমন্বিত বাহিনী। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্বাহী আদেশে গঠিত এ বাহিনীতে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের ৪৪ শতাংশ, পুলিশ ৪৪ শতাংশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ ০৬ শতাংশ, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী ৪ শতাংশ, কোস্টগার্ড ১ শতাংশ ও বেসামরিক প্রশাসন ১ শতাংশ হারে কোটা বিভাজন করা আছে। র্যাবের নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ পুলিশ অধিদপ্তর।
সংস্কার প্রস্তাবে বলা হয়, এ ক্ষেত্রে বেসামরিক প্রশাসনের অনুপাত বাড়ানো হলে র্যাবের দায়িত্ব পালন ও জবাবদিহির ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হবে। র্যাবের অর্থ, জমি, গণমাধ্যম, ক্রয়, আইনি ব্যবস্থাপনাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়োগ করার সুপারিশ করা হয়েছে।
নিরাপত্তা ছাড়পত্র: প্রস্তাবে বলা হয়, র্যাবে পদায়নের ক্ষেত্রে সব বাহিনীর সদস্যদের নিরাপত্তা ছাড়পত্র নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের জন্য প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই) এবং বেসামরিক বাহিনীর সদস্যদের জন্য জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা অধিদপ্তর (এনএসআই) ও পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) ছাড়পত্র নেওয়ার বিধান প্রস্তাব করা হয়েছে।
বাজেট: র্যাবের ব্যবহৃত অস্ত্র, যানবাহন, সরঞ্জামসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী অনেক ক্ষেত্রে ভিন্নতর। এ বিবেচনায় র্যাবের বাজেট পৃথক করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমানে র্যাবের সদর দপ্তর ছাড়া ১৪টি ব্যাটালিয়ন রয়েছে। এ বাহিনীর জনবল ১১ হাজার ১০৩।
এ সংস্কার উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইস্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অবশ্যই বিষয়টি ইতিবাচক, সময়োপযোগী ও গুরুত্বপূর্ণ। এটি একটি ভালো দিক যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবশেষে এ ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি, সশস্ত্র বাহিনী থেকে র্যাবে সদস্য আনা বাদ দেওয়া উচিত। বিশেষ করে মৌলিক ও কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা থাকা ঠিক নয়। এ ছাড়া সংস্কারে মানবাধিকারের বিষয়ে স্পষ্ট সুপারিশ রাখা উচিত।’ প্রস্তাবটি অনুমোদন হওয়ার আগে মানবাধিকার সংস্থা, অংশীদারসহ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা ও বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ মূল্যায়ন করা উচিত বলেও মত দেন তিনি।
সংস্কারের প্রস্তাবে এই বাহিনীর সদস্যদের পদায়ন, শৃঙ্খলা, কোটা ব্যবস্থাপনা, প্রশিক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা ছাড়পত্রের বিষয়ে বিভিন্ন সুপারিশ করা হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, একটি কম্পোজিট (সমন্বিত) বাহিনী হওয়া সত্ত্বেও বর্তমানে পুলিশ বাহিনীর একটি ইউনিট হিসেবে র্যাবের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে র্যাবের অপারেশনে পুলিশ বাহিনীর কোনো কার্যকর ভূমিকা নেই। প্রস্তাবে বলা হয়, একটি সমন্বিত বাহিনীকে অন্য একটি বাহিনীর অধীনে রাখা ঠিক নয়।
পুলিশের অধীন বিশেষ ব্যাটালিয়ন হলেও র্যাব ও পুলিশের সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব গত কয়েক বছরে প্রকাশ্য হয়ে উঠেছে। নিজেদের মধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেছে। গত বছরের জুলাই মাসে র্যাবে কর্মরত সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে ১৬টি অপ্রীতিকর ঘটনার বিবরণ দিয়ে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলে একটি প্রতিবেদন পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, কর্মস্থলে দুই বাহিনীর সদস্যরা পরস্পরকে সহ্য করতে পারছেন না। একে অপরের কাজে বাধা দিচ্ছেন। এসব নিয়ে মামলা ও সাধারণ ডায়েরি করার ঘটনাও ঘটেছে।
তবে সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় র্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তার জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠায় এ বাহিনী নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা চলছে। বিএনপির শাসনামলে এ বাহিনী গঠিত হলেও দলটির প্রধান খালেদা জিয়া সম্প্রতি এ বাহিনী বিলুপ্তির দাবি জানান। ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের’ অভিযোগ তুলে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোও র্যাব বিলুপ্তির দাবি তুলেছে। দেশীয় নানা সংগঠনও এ বাহিনীর কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে আসছে।
এ অবস্থায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় র্যাবকে সংস্কারের এ প্রস্তাব তৈরি করেছে। প্রস্তাবটি ইতিমধ্যে স্বরাষ্ট্রসচিবের অনুমোদনের পর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে দেওয়া হয়েছে। শিগগিরই এর অনুমোদন চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হবে।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রস্তাবটি আমরা পর্যালোচনা করছি। তবে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেবেন প্রধানমন্ত্রী।’
সংস্কার প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সন্ত্রাস দমন ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য একটি দক্ষ, আধুনিক ও কার্যকর বাহিনী হিসেবে পুলিশের অতিরিক্ত এলিট ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে র্যাব গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তবে গত এক দশকের বেশি সময়ে দায়িত্ব পালনকালে র্যাবের গঠন, নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা এবং অন্যান্য কিছু ক্ষেত্রে ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখা গেছে। এ অবস্থায় র্যাবের সংস্কার করা জরুরি হওয়ায় এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমরা অনেক দিন থেকেই র্যাব সংস্কারের দাবি জানিয়ে আসছি। অনেক বিষয়ই সংস্কার প্রস্তাবে উঠে এসেছে। তবে আমরা মনে করি, কোনো বাহিনী থেকে না এনে নতুনভাবে রর্যাব কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে বাহিনীর উপযোগী করে প্রশিক্ষিত করা উচিত। সশস্ত্র বাহিনী থেকে র্যাবে কোনো কর্মকর্তাকে আনা উচিত নয়। তবে এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে পরিপূর্ণ একটি সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করে তা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো উচিত।’
পদায়ন: সংস্কার প্রস্তাবের পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ থেকে আসা র্যাবের সদস্যরা সরাসরি র্যাবে যোগ দেন। কিন্তু এ বাহিনীতে আসা পুলিশ সুপার এবং এর ওপরের পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পদ স্থাপন করে। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও নিম্ন পদমর্যাদার কর্মকর্তা-কর্মচারীকে পুলিশ অধিদপ্তর সরাসরি র্যাবে পদায়ন করে।
সংস্কার প্রস্তাবে বলা হয়, সরকারের বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী, প্রতিটি বিভাগে কর্মরত সদস্যরা প্রেষণে নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয়ে যোগদান করে পরবর্তী সময়ে প্রেষণে নির্ধারিত কর্মস্থলে যাবেন। কিন্তু র্যাবে পদায়নের ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যরা ছাড়া অন্যদের পদায়নে প্রেষণ নীতিমালা অনুসরণ করা হয় না।
প্রস্তাবে বলা হয়, র্যাবে প্রেষণে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রেষণ নীতিমালা অনুযায়ী সব বাহিনী থেকে আসা সদস্যরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পদায়নের জন্য ন্যস্ত হবেন এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিধিবিধান অনুযায়ী তাঁদের র্যাবে বিন্যস্ত করবে।
শৃঙ্খলা: সংস্কার প্রস্তাবের পর্যালোচনা অংশে বলা হয়েছে, র্যাবে কর্মরত সব সদস্যের শৃঙ্খলা নিজ নিজ আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ফলে এ বাহিনীতে কর্মরত সামরিক সদস্যসহ অন্য বাহিনীর সদস্যরা একই ধরনের অনিয়ম বা অপরাধ করলে তাঁদের নিজ নিজ মাতৃবাহিনীর বিধিবিধান অনুযায়ী শৃঙ্খলামূলক শাস্তি দেওয়া হয়। একই বাহিনীতে কর্মরত থেকে একই ধরনের অনিয়ম বা অপরাধ করলেও শাস্তি হয় ভিন্ন ভিন্ন। ফলে সদস্যদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
সংস্কার প্রস্তাবে বলা হয়, সামরিক ও অন্য যে বাহিনী থেকেই আসুক না কেন, র্যাবে কর্মরত অবস্থায় অনিয়ম বা অপরাধ করলে সবার জন্য একই ধরনের শৃঙ্খলামূলক বিধিবিধান অনুসরণ করা উচিত। এ ক্ষেত্রে র্যাবের জন্য একটি বিশেষ বিধি (শৃঙ্খলা ও আপিল) প্রণয়ন করার সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রশিক্ষণ: র্যাবের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের ঘাটতি আছে উল্লেখ করে সংস্কার প্রস্তাবে বলা হয়, র্যাবে কাজ করার সময় দেখা যায়, সামরিক বাহিনী থেকে আসা সদস্যরা বেসামরিক আইন, বিধিবিধান, প্রথা ইত্যাদি সম্পর্কে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত নন। আবার পুলিশ-বিজিবি-আনসার থেকে আসা সদস্যরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটি বিশেষায়িত সমন্বিত বাহিনীতে কাজ করার মতো প্রশিক্ষণ ও মানসিকতার সামর্থ্য থাকে না।
প্রস্তাবে বলা হয়েছে, র্যাবে নিয়োগ পাওয়ার পর এর আইন ও বিধিবিধানের ওপর প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁদের পদায়ন করা উচিত। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এ প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে হবে।
কোটা ব্যবস্থাপনা: সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, আনসার ও জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিয়ে র্যাব একটি সমন্বিত বাহিনী। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্বাহী আদেশে গঠিত এ বাহিনীতে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের ৪৪ শতাংশ, পুলিশ ৪৪ শতাংশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ ০৬ শতাংশ, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী ৪ শতাংশ, কোস্টগার্ড ১ শতাংশ ও বেসামরিক প্রশাসন ১ শতাংশ হারে কোটা বিভাজন করা আছে। র্যাবের নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ পুলিশ অধিদপ্তর।
সংস্কার প্রস্তাবে বলা হয়, এ ক্ষেত্রে বেসামরিক প্রশাসনের অনুপাত বাড়ানো হলে র্যাবের দায়িত্ব পালন ও জবাবদিহির ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হবে। র্যাবের অর্থ, জমি, গণমাধ্যম, ক্রয়, আইনি ব্যবস্থাপনাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়োগ করার সুপারিশ করা হয়েছে।
নিরাপত্তা ছাড়পত্র: প্রস্তাবে বলা হয়, র্যাবে পদায়নের ক্ষেত্রে সব বাহিনীর সদস্যদের নিরাপত্তা ছাড়পত্র নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের জন্য প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই) এবং বেসামরিক বাহিনীর সদস্যদের জন্য জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা অধিদপ্তর (এনএসআই) ও পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) ছাড়পত্র নেওয়ার বিধান প্রস্তাব করা হয়েছে।
বাজেট: র্যাবের ব্যবহৃত অস্ত্র, যানবাহন, সরঞ্জামসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী অনেক ক্ষেত্রে ভিন্নতর। এ বিবেচনায় র্যাবের বাজেট পৃথক করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমানে র্যাবের সদর দপ্তর ছাড়া ১৪টি ব্যাটালিয়ন রয়েছে। এ বাহিনীর জনবল ১১ হাজার ১০৩।
এ সংস্কার উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইস্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অবশ্যই বিষয়টি ইতিবাচক, সময়োপযোগী ও গুরুত্বপূর্ণ। এটি একটি ভালো দিক যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবশেষে এ ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি, সশস্ত্র বাহিনী থেকে র্যাবে সদস্য আনা বাদ দেওয়া উচিত। বিশেষ করে মৌলিক ও কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা থাকা ঠিক নয়। এ ছাড়া সংস্কারে মানবাধিকারের বিষয়ে স্পষ্ট সুপারিশ রাখা উচিত।’ প্রস্তাবটি অনুমোদন হওয়ার আগে মানবাধিকার সংস্থা, অংশীদারসহ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা ও বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ মূল্যায়ন করা উচিত বলেও মত দেন তিনি।
No comments