বিচারপতি সাহাবুদ্দীন হয়তো কল্পনাও করেন নি by সাজেদুল হক
এক বেসামরিক অভ্যুত্থানে মৃত্যু হয়েছিল
বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার। চারটি বাদে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল সব
সংবাদপত্র। সে অন্ধকার সময় থেকে আলোতে আসতে নানা কাঠখড় পোহাতে হয়েছে সংবাদ
মাধ্যমকে। লড়াই ছিল অত্যন্ত কঠিন। এরশাদ জমানায় সাপ্তাহিক খবরের কাগজে
দুর্নীতিপরায়ণদের উল্লাসের নৃত্য লিখে সরকারি রোষানলে পড়েছিলেন সাংবাদিক
মতিউর রহমান চৌধুরী। রূপকাশ্রয়ী ওই লেখা প্রকাশের পর পত্রিকাটি বন্ধ করে
দেয়া হয়। লেখকের বিরুদ্ধে জারি করা হয় হুলিয়া। তখন তিনি উপ-সাগরীয় যুদ্ধ
কভারের জন্য সৌদি আরবে অবস্থান করছিলেন। এরপর আদালত পর্যন্ত গড়ায় বিষয়টি।
সুপ্রিম কোর্ট এক ঐতিহাসিক রায় দেন। যে রায়ে খবরের কাগজের প্রকাশনা আবার
শুরু হয়। সম্পাদক-প্রকাশকের উপর থেকে হুলিয়া প্রত্যাহার করা হয়। সংবাদ
মাধ্যমের স্বাধীনতার পথ খোলে। পরে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদ যখন
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হন তখন সংবাদ মাধ্যমের ওপর থেকে কালাকানুন
তুলে দেন। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে সংবাদ মাধ্যম সবসময় অবাধ স্বাধীনতা ভোগ
করেছে সে কথা হয়তো সত্য নয়। নানামুখী চাপের মধ্যে থেকেই মিডিয়াকে কাজ করতে
হয়েছে। বিশেষ করে ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে যখন-তখন উপদেশ নাজিলের ঘটনা ঘটেছে।
টকশো নিয়ে সরকারি মহলের মাথাব্যথা নতুন কিছু নয়। তবে সমাজকল্যাণ মন্ত্রী
সৈয়দ মহসিন আলী কোন রাখডাক রাখেননি। ‘সাংবাদিকতার এই নতুন শিক্ষক’
সাংবাদিকদের সাংবাদিকতা শেখানোর পাশাপাশি ঘোষণা দিয়েছেন- এমন আইন করা হবে
যে মিডিয়ার কোন স্বাধীনতা থাকবে না। অবশ্য তিনি অভিবাদন পাওয়ারও যোগ্য।
গণতান্ত্রিক দুনিয়ায় বাংলাদেশের স্থান এখন কোথায় তা আরও একবার পরিষ্কার করে
দিলেন সৈয়দ মহসিন আলী। যদিও তিনি সরকারি একটি গোপন পরিকল্পনাও হয়তো ফাঁস
করে দিয়েছেন। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের পর এমনিতেই বাংলাদেশ এক নতুন যুগে
প্রবেশ করেছে। এ যে এক নতুন কিসিমের শাসন ব্যবস্থা তা সবাই মেনে নিয়েছেন।
বহু পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতেই এ সময়ের সংবাদ মাধ্যম যেন অর্ধমৃত। টিভি
টকশোগুলোতে প্রাণ নেই। যেন সবাই মেপে মেপে কথা বলছেন। অতিথিরাও বহুক্ষেত্রে
পূর্বনির্ধারিত। তবে স্বাধীন সংবাদ মাধ্যমকে গলা টিপে ধরার আয়োজন চলছে
পুরোদমেই। দ্য প্রিন্টিং প্রেসেস অ্যান্ড পাবলিকেশনস (ডিক্লারেশন অ্যান্ড
রেজিস্ট্রেশন) অ্যাক্ট ২০১৪ শিরোনামে সংশোধিত আইনের খসড়া তৈরির কাজ এগিয়ে
চলছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত আর রাষ্ট্রবিরোধী কাজের অভিযোগে সংবাদপত্র
বন্ধ করে দেয়ার ক্ষমতা তুলে দেয়া হচ্ছে জেলা প্রশাসকদের হাতে। পুরো
ব্যাপারটিতেও অবশ্য রাজচালাকির আশ্রয় নেয়া হয়েছে। তথ্য মন্ত্রণালয় পুরো
বিষয়টির উদ্যোক্তা হলেও তা উত্থাপন করা হয়েছে একজন জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে।
আর ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী কাজের মতো স্পর্শকাতর দু’টি বিষয় সামনে নিয়ে আসা
হয়েছে। নিজেদের গণতান্ত্রিক দাবি করা একটি সরকারের উজির প্রকাশ্যে কেন
সংবাদ মাধ্যমের কণ্ঠরোধের ঘোষণা দিচ্ছেন আর কেনই বা সরকার এ ধরনের একটি
উদ্যোগ নিয়ে এগোচ্ছে তা কৌতুহলোদ্দীপক। কারণ, গণতান্ত্রিক দুনিয়ায় গণতন্ত্র
আর সংবাদ মাধ্যম একে অন্যের হাত ধরে এগিয়ে গেছে। সংবাদপত্রকে ফোর্থ
স্টেটের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধান আর সুপ্রিম কোর্টের একাধিক
রায়ে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে। তারপরও কেন এ
উদ্যোগ-আতঙ্ক। পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ বলছেন, বাংলাদেশে এখন সরকারকে
চ্যালেঞ্জ করার মতো কোন রাজনৈতিক শক্তি নেই। নীতিনির্ধারকদের ধারণা,
একমাত্র স্বাধীন সংবাদ মাধ্যমের কাছ থেকেই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে
সরকার। যে কারণে সংবাদ মাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরার এ আয়োজন। সাংবাদিক আশরাফ
কায়সার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন- ‘দুর্বল গণভিত্তির সরকারই মিডিয়া নিয়ে
বেশি আতঙ্কে ভোগে। টকশো নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ধারাবাহিক সমালোচনা,
সংবাদপত্রের প্রকাশনা বাতিলে তথ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ আর মিডিয়ায়
স্বাধীনতা নিয়ে মন্ত্রীদের উষ্মা সরকারের দুর্বলতা ও অপরিপক্বতার প্রকাশ।’
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসনের বিখ্যাত উক্তি- সকলের সকল
নিরাপত্তা সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার মধ্যে নিহিত। বাংলাদেশে সংবাদ
মাধ্যমের স্বাধীনতা আজ হুমকির মুখে। সকলের স্বাধীনতাও কি হুমকির মুখে নয়?
বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদ বাংলাদেশের বিচারাঙ্গনে এক শ্রদ্ধেয় নাম।
প্রধান উপদেষ্টা এবং প্রেসিডেন্টের আসনে বসেও তিনি প্রায় সর্বমহলে প্রশংসিত
হয়েছেন। যদিও যারা তার দ্বারা স্বার্থ হাসিল করতে পারেনি তাদের কাছে তিনি
অপ্রিয়। স্বাধীন সাংবাদিকতা বিরোধী কালাকানুন তুলে দেয়ায় বাংলাদেশের
সংবাদমাধ্যম সবসময়ই তার প্রতি কৃতার্থ। প্রবীণ এ সাবেক প্রেসিডেন্ট হয়তো
কোনদিন কল্পনাও করতে পারেননি দুই যুগ পর তার জীবদ্দশাতেই বাংলাদেশ কালো
আইনে ফেরার আয়োজনে মগ্ন থাকবে।
No comments