অবৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়ি by নুরুজ্জামান লাবু
রাজধানী ঢাকায় এখন অবৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়ি। হাত বাড়ালেই মিলছে আগ্নেয়াস্ত্র। বেশির ভাগ অস্ত্রই আসছে সীমান্ত এলাকা থেকে। সহজেই চলে যাচ্ছে সন্ত্রাসীদের হাতে। প্রতিনিয়ত হাত বদলও হচ্ছে এসব। ভাড়ায় খাটছে অনেক অবৈধ অস্ত্র। এমনকি বৈধ অস্ত্রধারীরাও তাদের অস্ত্র ভাড়া দিচ্ছে সন্ত্রাসীদের কাছে। আবার ভুয়া লাইসেন্স দেখিয়েও অস্ত্র কিনছেন অনেক সন্ত্রাসী চক্র। ছোট-বড় সব সন্ত্রাসীদের হাতেই এখন শোভা পাচ্ছে অস্ত্র। এ কারণে রাজধানীতে প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে গুলির ঘটনা। অস্ত্র উদ্ধারে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানও অনেকটা ঝিমিয়ে পড়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে সন্ত্রাসী ও অস্ত্র ব্যবসায়ীরা। গত দুই মাসে রাজধানীতেই অন্তত ৫০টি গুলির ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া সাম্প্রতি সময়ে বেড়ে যাওয়া ছিনতাইয়ের ঘটনার প্রায় প্রত্যেকটিতেই অস্ত্রের ব্যবহার দেখা গেছে। কিন্তু এসব ঘটনায় কোন অস্ত্রধারীকেই গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। উদ্ধার হয়নি একটি আগ্নেয়াস্ত্রও। তবে সম্প্রতি পৃথক কয়েকটি অভিযানে ডিবি ও থানা পুলিশ কিছু অস্ত্র উদ্ধার করেছে। বিক্রির উদ্দেশ্যে অস্ত্র ব্যবসায়ীরা এসব অস্ত্র ঢাকায় এনেছিল। তবে ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) মীর রেজাউল আলম বলেন, পুলিশের অভিযান স্তিমিত হয়ে আছে এমনটি বলা যাবে না। পুলিশ অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে আসছে। ঈদকে কেন্দ্র করে চাঁদাবাজি-সন্ত্রাস ঠেকাতে থানা পুলিশসহ গোয়েন্দা ইউনিটগুলোকেও বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। অস্ত্রবাজ সন্ত্রাসীদের কঠোর হাতে দমন করা হবে।
সূত্র জানায়, রাজধানী ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে ব্যাপক অস্ত্র মজুত রয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই সীমান্ত এলাকা দিয়ে অস্ত্র আসছে ঢাকায়। হাত বদল হয়ে চলে যাচ্ছে আন্ডারওয়ার্ল্ডের বিভিন্ন গ্রুপের কাছে। অস্ত্রের বাজারের দামও এখন চড়া। সামনে ঈদ উপলক্ষে ছিঁচকে চোর থেকে শুরু করে ছিনতাইকারীরাও এখন অস্ত্রের মজুত বাড়াচ্ছে। যে সব অস্ত্র আগে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকায় বিকিকিনি হতো সেগুলো এখন ৫০ হাজার টাকার বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। রাজনৈতিক ক্যাডারদের কাছে বিক্রি হচ্ছে আরও বেশি দামে। বেড়ে গেছে গুলির দামও। একটি অস্ত্রের সঙ্গে দু’টি ম্যাগাজিনে ১০ রাউন্ড গুলি দেয়া হয়। এর বাইরে প্রতি পিস গুলি এখন হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবু অবৈধ অস্ত্রের চাহিদা এখন তুঙ্গে।
সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে র্যাব-পুলিশের সাদা পোশাকের অভিযান নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় সব ধরনের অভিযানেই অতিমাত্রায় সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। কেবল বিশ্বস্ত সোর্সের তথ্যের ভিত্তিতেই চলছে অভিযান। গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, সোর্সের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য সবসময় সঠিক থাকে না। অনেক সময় ‘মিসইনফরমেশন’ও থাকে। আর অস্ত্র উদ্ধারে সাধারণত সোর্স নিয়োগ করে ক্রেতা সেজে উদ্ধার করা হয়। পুরো অভিযান চলে সাদা পোশাকে। কিন্তু এখন সাদা পোশাকের অভিযান নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় অভিযান কিছুটা কমানো হয়েছে। ওই কর্মকর্তা স্বীকার করেন, অভিযান কমে যাওয়ার সুযোগ নিচ্ছে সন্ত্রাসীরা। অপর একটি সূত্র জানায়, নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠার পর থেকেই কার্যত র্যাবের অভিযান অনেক কমে গেছে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে সীমান্ত এলাকায় সবচেয়ে বেশি অভিযান চালাতো র্যাব। তাদের অভিযান অনেকাংশে কমে যাওয়ায় সন্ত্রাসীরা এখন সহজেই অস্ত্র বহন করতে পারছে। গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা সাম্প্রতিক সময় অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার বাড়ার কথা স্বীকার করে বলেন, বেশ কিছু দিন বন্ধ থাকার পর সীমান্ত এলাকা থেকে আবারও বিভিন্ন পথে অস্ত্র আসছে। ফলে সহজেই সন্ত্রাসীদের কাছে অস্ত্র পৌঁছে যাচ্ছে। অস্ত্র বহনে নারী, ফল ও সবজির ট্রাকসহ বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। ওই কর্মকর্তা বলেন, অনেক সময় শরীরের সঙ্গে বা ব্যাগে করেও সাধারণ বেশে অস্ত্র আনা হয়। এছাড়া রাস্তায় কয়েকবার হাত বদল হয়েও অস্ত্র আসে ঢাকায়। এ কারণে সোর্সের দেয়া নিশ্চিত তথ্য ছাড়া অস্ত্র উদ্ধার করাও যাচ্ছে না। ডিবির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) সাইফুল ইসলাম জানান, অস্ত্র উদ্ধারে ডিবি পুলিশ নিয়মিত অভিযান চালিয়ে থাকে। অনেক অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী ও ছিনতাইকারী জেল থেকে জামিনে ছাড়া পেয়ে আবারও অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। জেল থেকে ছাড়া পাওয়া অপরাধীদের তালিকা করে অভিযান চালানো হচ্ছে।
সূত্র জানায়, রাজধানীর আন্ডারওয়ার্ল্ডে এখন সবচেয়ে বেশি মজুত রয়েছে ৭ দশমিক ৬৫ বোরের পিস্তল। এছাড়া ২২ বোর, ৭ দশমিক ৬২ বোর, ৯ এমএম পিস্তলের মজুতও রয়েছে অনেক। এসব অস্ত্র বিকিকিনি হচ্ছে ৪০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকায়। ৭ দশমিক ৬৫ বোরের পিস্তলের ৭ ইঞ্চি ও ৫ ইঞ্চি নামে দু’টি ভাগ রয়েছে। এর মধ্যে ৫ ইঞ্চির ক্ষুদ্রাস্ত্রটির চাহিদা সবচেয়ে বেশি। এটি শরীরের সঙ্গে সহজেই বহন করা যায় বলে আন্ডারওয়ার্ল্ডে এর চাহিদা ব্যাপক। অবৈধ অস্ত্রের সবচেয়ে বেশি চালান আসে সীমান্তের ২০টি পয়েন্ট থেকে। এগুলো হলো চাঁপাই নবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ, যশোরের শার্শা ও বেনাপোল, কুষ্টিয়ার দৌলতপুর, মেহেরপুরের গাংনী, রাজশাহীর গোদাগাড়ী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া, নওগাঁ’র পত্নীতলা, কুমিল্লার বিবিরবাজার, চৌদ্দগ্রাম, ফেনীর বিলোনিয়া, আমতলী, কক্সবাজারের টেকনাফ, চুয়াডাঙ্গা, সাতক্ষীরা, দিনাজপুরের বিরল এলাকা। সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক অস্ত্র ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের বরাত দিয়ে ডিবির এক কর্মকর্তা জানান, চাঁপাই নবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ, মনাকষা ও যশোরের শার্শা ও বেনাপোল দিয়ে বেশি অস্ত্র ঢুকছে। গত ৭ই জুন গাবতলী থেকে এনায়েতুল্লা ওরফে তুল্লা নামে এক অস্ত্র ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তার কাছ থেকে দু’টি বিদেশী পিস্তল, একটি ম্যাগাজিন ও ১১ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর তুল্লা জানায়, সে চাঁপাই নবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ সীমান্ত থেকে অস্ত্রগুলো নিয়ে আসে। ঢাকায় আন্ডারওয়ার্ল্ডের একটি গ্রুপের কাছে অস্ত্রগুলি সরবরাহ করার কথা ছিল তার। ওই অভিযানে নেতৃত্ব দানকারী মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার (এসি) জাহাঙ্গীর আলম বলেন, অস্ত্র ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন কৌশলে রাজধানীতে অস্ত্র আনার চেষ্টা করছে। গোয়েন্দা নজরদারি ও সোর্স নিয়োগ করে অস্ত্র উদ্ধার করা হচ্ছে। গত ২০শে জুন কাফরুল থানার এসআই প্রেমদাস রায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে হূমায়ূন কবীর বাবু ও আরিফুর রহমান লিখন নামের দুই অস্ত্র ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করে। তাদের কাছ থেকে দু’টি রিভলবার ও ১১৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর তারা জানিয়েছে, সদ্য কারামুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশের লোকজনের কাছে অস্ত্রগুলি সরবরাহ করার কথা ছিল। এসআই প্রেমদাস রায় জানান, জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী অস্ত্রগুলি যাদের কাছে সরবরাহ করার কথা ছিল তাদের গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চালানো হচ্ছে।
ভুয়া লাইসেন্সেও চলছে অস্ত্র বিকিকিনি: সীমান্তপথ দিয়ে আসা অবৈধ অস্ত্র সংগ্রহের পাশাপাশি ভূয়া লাইসেন্স দিয়েও অস্ত্র বিকিকিনি চলছে। সম্প্রতি এমন একটি চক্রকে গ্রেপ্তার করেছে পল্টন থানা পুলিশ। পুলিশ জানায়, গত ২৮ এপ্রিল কক্সবাজারের বাসিন্দা ফজলুল করিম ও সাহাবুদ্দিন নামে দুই ব্যক্তি পল্টনের ইমরান আর্মস অ্যান্ড কোং নামে একটি বৈধ অস্ত্রের দোকান থেকে লাইসেন্স দেখিয়ে একটি এনপিবি পিস্তল কিনে নিয়ে যায়। তাৎক্ষণিক লাইসেন্সটি পরীক্ষা করে না দেখলেও পরে ইমরান অ্যান্ড কোং-এর মালিক কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারে লাইসেন্সটি ভুয়া। একই ব্যক্তি গত ৮ই মে লাইসেন্সের নাম বদলিয়ে আরেকটি অস্ত্র কিনতে আসলে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বৈধ অস্ত্র কেনাবেচার সময় লাইসেন্সটি সঠিক না জাল তা যাচাই করার নিয়ম থাকলেও জটিলতার কারণে বৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীরা চোখের দেখায় সত্যতা যাচাই করে অস্ত্র বিক্রি করে। এ কারণে সন্ত্রাসী চক্র কৌশলে হুবহু আসল লাইসেন্স বানিয়ে অস্ত্র কেনে- যা খালি চোখে ধরাও যায় না। একজন বৈধ অস্ত্রের দোকানদার জানান, ঢাকার বাইরে থেকে যারা অস্ত্র কিনতে আসে তাদের লাইসেন্স অনেক সময় যাচাই করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
এদিকে বৈধ অস্ত্র ব্যবসার আড়ালে অবৈধ অস্ত্রের কেনাবেচার অভিযোগও রয়েছে অনেক অস্ত্র ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে। গত বছর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ এমন এক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তারও করেছিল। এছাড়া রাজনৈতিক ক্যাডারদের অনেকেই প্রভাব খাটিয়ে বৈধ অস্ত্র বাগিয়ে নিলেও তা ভাড়ায় খাটানো হয়। এমন কিছু অভিযোগের প্রেক্ষিতে ডিবি পুলিশ তা তদন্ত শুরু করেছে বলেও একটি সূত্র জানিয়েছে। ওই সূত্র জানায়, এই অভিযোগের জলজ্যান্ত উদাহরণ নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের প্রধান অভিযুক্ত নূর হোসেন। তার নিজের লোকজনের ১১টি আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স ছিল- যা দিয়ে সে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল নারায়ণগঞ্জে। এমন নূর হোসেনের সংখ্যা অনেক।
সূত্র জানায়, রাজধানী ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে ব্যাপক অস্ত্র মজুত রয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই সীমান্ত এলাকা দিয়ে অস্ত্র আসছে ঢাকায়। হাত বদল হয়ে চলে যাচ্ছে আন্ডারওয়ার্ল্ডের বিভিন্ন গ্রুপের কাছে। অস্ত্রের বাজারের দামও এখন চড়া। সামনে ঈদ উপলক্ষে ছিঁচকে চোর থেকে শুরু করে ছিনতাইকারীরাও এখন অস্ত্রের মজুত বাড়াচ্ছে। যে সব অস্ত্র আগে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকায় বিকিকিনি হতো সেগুলো এখন ৫০ হাজার টাকার বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। রাজনৈতিক ক্যাডারদের কাছে বিক্রি হচ্ছে আরও বেশি দামে। বেড়ে গেছে গুলির দামও। একটি অস্ত্রের সঙ্গে দু’টি ম্যাগাজিনে ১০ রাউন্ড গুলি দেয়া হয়। এর বাইরে প্রতি পিস গুলি এখন হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবু অবৈধ অস্ত্রের চাহিদা এখন তুঙ্গে।
সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে র্যাব-পুলিশের সাদা পোশাকের অভিযান নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় সব ধরনের অভিযানেই অতিমাত্রায় সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। কেবল বিশ্বস্ত সোর্সের তথ্যের ভিত্তিতেই চলছে অভিযান। গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, সোর্সের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য সবসময় সঠিক থাকে না। অনেক সময় ‘মিসইনফরমেশন’ও থাকে। আর অস্ত্র উদ্ধারে সাধারণত সোর্স নিয়োগ করে ক্রেতা সেজে উদ্ধার করা হয়। পুরো অভিযান চলে সাদা পোশাকে। কিন্তু এখন সাদা পোশাকের অভিযান নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় অভিযান কিছুটা কমানো হয়েছে। ওই কর্মকর্তা স্বীকার করেন, অভিযান কমে যাওয়ার সুযোগ নিচ্ছে সন্ত্রাসীরা। অপর একটি সূত্র জানায়, নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠার পর থেকেই কার্যত র্যাবের অভিযান অনেক কমে গেছে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে সীমান্ত এলাকায় সবচেয়ে বেশি অভিযান চালাতো র্যাব। তাদের অভিযান অনেকাংশে কমে যাওয়ায় সন্ত্রাসীরা এখন সহজেই অস্ত্র বহন করতে পারছে। গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা সাম্প্রতিক সময় অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার বাড়ার কথা স্বীকার করে বলেন, বেশ কিছু দিন বন্ধ থাকার পর সীমান্ত এলাকা থেকে আবারও বিভিন্ন পথে অস্ত্র আসছে। ফলে সহজেই সন্ত্রাসীদের কাছে অস্ত্র পৌঁছে যাচ্ছে। অস্ত্র বহনে নারী, ফল ও সবজির ট্রাকসহ বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। ওই কর্মকর্তা বলেন, অনেক সময় শরীরের সঙ্গে বা ব্যাগে করেও সাধারণ বেশে অস্ত্র আনা হয়। এছাড়া রাস্তায় কয়েকবার হাত বদল হয়েও অস্ত্র আসে ঢাকায়। এ কারণে সোর্সের দেয়া নিশ্চিত তথ্য ছাড়া অস্ত্র উদ্ধার করাও যাচ্ছে না। ডিবির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) সাইফুল ইসলাম জানান, অস্ত্র উদ্ধারে ডিবি পুলিশ নিয়মিত অভিযান চালিয়ে থাকে। অনেক অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী ও ছিনতাইকারী জেল থেকে জামিনে ছাড়া পেয়ে আবারও অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। জেল থেকে ছাড়া পাওয়া অপরাধীদের তালিকা করে অভিযান চালানো হচ্ছে।
সূত্র জানায়, রাজধানীর আন্ডারওয়ার্ল্ডে এখন সবচেয়ে বেশি মজুত রয়েছে ৭ দশমিক ৬৫ বোরের পিস্তল। এছাড়া ২২ বোর, ৭ দশমিক ৬২ বোর, ৯ এমএম পিস্তলের মজুতও রয়েছে অনেক। এসব অস্ত্র বিকিকিনি হচ্ছে ৪০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকায়। ৭ দশমিক ৬৫ বোরের পিস্তলের ৭ ইঞ্চি ও ৫ ইঞ্চি নামে দু’টি ভাগ রয়েছে। এর মধ্যে ৫ ইঞ্চির ক্ষুদ্রাস্ত্রটির চাহিদা সবচেয়ে বেশি। এটি শরীরের সঙ্গে সহজেই বহন করা যায় বলে আন্ডারওয়ার্ল্ডে এর চাহিদা ব্যাপক। অবৈধ অস্ত্রের সবচেয়ে বেশি চালান আসে সীমান্তের ২০টি পয়েন্ট থেকে। এগুলো হলো চাঁপাই নবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ, যশোরের শার্শা ও বেনাপোল, কুষ্টিয়ার দৌলতপুর, মেহেরপুরের গাংনী, রাজশাহীর গোদাগাড়ী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া, নওগাঁ’র পত্নীতলা, কুমিল্লার বিবিরবাজার, চৌদ্দগ্রাম, ফেনীর বিলোনিয়া, আমতলী, কক্সবাজারের টেকনাফ, চুয়াডাঙ্গা, সাতক্ষীরা, দিনাজপুরের বিরল এলাকা। সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক অস্ত্র ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের বরাত দিয়ে ডিবির এক কর্মকর্তা জানান, চাঁপাই নবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ, মনাকষা ও যশোরের শার্শা ও বেনাপোল দিয়ে বেশি অস্ত্র ঢুকছে। গত ৭ই জুন গাবতলী থেকে এনায়েতুল্লা ওরফে তুল্লা নামে এক অস্ত্র ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তার কাছ থেকে দু’টি বিদেশী পিস্তল, একটি ম্যাগাজিন ও ১১ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর তুল্লা জানায়, সে চাঁপাই নবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ সীমান্ত থেকে অস্ত্রগুলো নিয়ে আসে। ঢাকায় আন্ডারওয়ার্ল্ডের একটি গ্রুপের কাছে অস্ত্রগুলি সরবরাহ করার কথা ছিল তার। ওই অভিযানে নেতৃত্ব দানকারী মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার (এসি) জাহাঙ্গীর আলম বলেন, অস্ত্র ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন কৌশলে রাজধানীতে অস্ত্র আনার চেষ্টা করছে। গোয়েন্দা নজরদারি ও সোর্স নিয়োগ করে অস্ত্র উদ্ধার করা হচ্ছে। গত ২০শে জুন কাফরুল থানার এসআই প্রেমদাস রায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে হূমায়ূন কবীর বাবু ও আরিফুর রহমান লিখন নামের দুই অস্ত্র ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করে। তাদের কাছ থেকে দু’টি রিভলবার ও ১১৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর তারা জানিয়েছে, সদ্য কারামুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশের লোকজনের কাছে অস্ত্রগুলি সরবরাহ করার কথা ছিল। এসআই প্রেমদাস রায় জানান, জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী অস্ত্রগুলি যাদের কাছে সরবরাহ করার কথা ছিল তাদের গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চালানো হচ্ছে।
ভুয়া লাইসেন্সেও চলছে অস্ত্র বিকিকিনি: সীমান্তপথ দিয়ে আসা অবৈধ অস্ত্র সংগ্রহের পাশাপাশি ভূয়া লাইসেন্স দিয়েও অস্ত্র বিকিকিনি চলছে। সম্প্রতি এমন একটি চক্রকে গ্রেপ্তার করেছে পল্টন থানা পুলিশ। পুলিশ জানায়, গত ২৮ এপ্রিল কক্সবাজারের বাসিন্দা ফজলুল করিম ও সাহাবুদ্দিন নামে দুই ব্যক্তি পল্টনের ইমরান আর্মস অ্যান্ড কোং নামে একটি বৈধ অস্ত্রের দোকান থেকে লাইসেন্স দেখিয়ে একটি এনপিবি পিস্তল কিনে নিয়ে যায়। তাৎক্ষণিক লাইসেন্সটি পরীক্ষা করে না দেখলেও পরে ইমরান অ্যান্ড কোং-এর মালিক কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারে লাইসেন্সটি ভুয়া। একই ব্যক্তি গত ৮ই মে লাইসেন্সের নাম বদলিয়ে আরেকটি অস্ত্র কিনতে আসলে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বৈধ অস্ত্র কেনাবেচার সময় লাইসেন্সটি সঠিক না জাল তা যাচাই করার নিয়ম থাকলেও জটিলতার কারণে বৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীরা চোখের দেখায় সত্যতা যাচাই করে অস্ত্র বিক্রি করে। এ কারণে সন্ত্রাসী চক্র কৌশলে হুবহু আসল লাইসেন্স বানিয়ে অস্ত্র কেনে- যা খালি চোখে ধরাও যায় না। একজন বৈধ অস্ত্রের দোকানদার জানান, ঢাকার বাইরে থেকে যারা অস্ত্র কিনতে আসে তাদের লাইসেন্স অনেক সময় যাচাই করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
এদিকে বৈধ অস্ত্র ব্যবসার আড়ালে অবৈধ অস্ত্রের কেনাবেচার অভিযোগও রয়েছে অনেক অস্ত্র ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে। গত বছর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ এমন এক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তারও করেছিল। এছাড়া রাজনৈতিক ক্যাডারদের অনেকেই প্রভাব খাটিয়ে বৈধ অস্ত্র বাগিয়ে নিলেও তা ভাড়ায় খাটানো হয়। এমন কিছু অভিযোগের প্রেক্ষিতে ডিবি পুলিশ তা তদন্ত শুরু করেছে বলেও একটি সূত্র জানিয়েছে। ওই সূত্র জানায়, এই অভিযোগের জলজ্যান্ত উদাহরণ নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের প্রধান অভিযুক্ত নূর হোসেন। তার নিজের লোকজনের ১১টি আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স ছিল- যা দিয়ে সে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল নারায়ণগঞ্জে। এমন নূর হোসেনের সংখ্যা অনেক।
No comments