যা খসে তা বসে না by রণজিৎ বিশ্বাস
প্রতিদিন কথা জমা হচ্ছে, প্রতিদিন কথা
হারাচ্ছি। হারানো কথা হাতড়ালে দু'একদিন পরও মাঝে মধ্যে ফিরে পাই, তারপর আর
পাই না। পাই না তো পাই-ই না। তখন মন বলে_ মানো আর না মানো, বয়স তোমার
হয়েছে। সত্যি সত্যিই, বয়স কিছু হয়েছে। বয়স হয়েছে বলেই কম বয়সে পাওয়া এক
বয়সী সহকর্মীর কথা খুব মনে পড়ছে। মিস্টার বিশ্বাস, আপনি কতটুকু মানের জানি না_ তারুণ্যে থাকে স্মৃতির জোর, বয়সকালে বোধের জোর।
সতেরো আঠারো উনিশ কুড়ি বাইশ বছরের একটা তরুণ যত মনে রাখতে পারে, আমি এই
পঞ্চাশ পঞ্চান্ন বয়সে তত মনে রাখতে পারি না। আবার দেখুন, আমি যতটা বুঝতে
পারি, যতটা পারি অনুভব করতে, সে ততটা পারে না।
একটা কুড়ি বাইশ বছরের ছেলে টেবিলে ঘুষি মেরে, হয়তো কাচ ভেঙেও কথা বলতে পারে। আমি তেমন পারি না। আমি দেখেছি, আমি বা আমার বয়সী মানুষের তা ইচ্ছেও করে না। আমাদের রুচিতে বাধে, আমরা বিশ্লেষণমুখী হই। আপনি ভালো করে দেখুন, আপনার মধ্যেও কিন্তু ক্রমশ তেমন একটা বোধ জাগছে।
কেউ আমাদের অসম্মান করলে বা আমাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলে আমি তৎক্ষণাৎ উত্তেজিত হই না। আমি ভাবি, নিশ্চয়ই আমি কোনো অন্যায় করেছি, নিশ্চয়ই ওর উত্তেজনার কোনো কারণ না জেনে হলেও আমি ঘটিয়ে ফেলেছি। আমি কার্যকারণ সন্ধানের চেষ্টা করি।
পরে, আমি ওই সহকর্মীর বয়সে পেঁৗছার পর অনুভব করেছি, কথা সত্যি, কথাটা সহি। এই সহি কথার জন্যই আরেকটা অনুভব জীবনের যোগফল সবসময় সমান। কেউ কিছু পাচ্ছে, কেউ কিছু হারাচ্ছে। কিন্তু যোগফল সমানই থাকছে। পুরোপুরি সমান না হলেও মোটামুটি সমান। ভাবনাকে আরও যদি ছড়াই, চমকে চমকে বুঝতে পাই_ যে শ্রমজীবী কচুঘেচু খেয়ে মাথার 'পরে ইট দিয়ে ঘুমোয় এবং তার পেটে কোনো পীড়া হয় না সে লোক ওই লোকের চেয়ে কম সুখী নয় যার অর্থ ঠেললে ঠেলা যায় না, যার বিত্তের তার কাছে নেই, যার খাবার অপচয় করার সামর্থ্য আছে কিন্তু হজম করার ক্ষমতা নেই এবং ওষুধের পর ওষুধ খাওয়ার পরও চোখে তার ঘুম নেই।
আরেকজন শিক্ষক, কবি ওহীদুল আলম, সাহিত্যিক মাহবুব-উল-আলমের ছোট ভাই, যার আরেক ভাই নজরুল সুহৃদ দিদারুল আলম এবং যিনি দীর্ঘদিন ছিলেন চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক, চলি্লশ বছর আগে একদিন চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে কয়েকটি শব্দের ইংরেজি উচ্চারণ শেখাতে শেখাতে (যেমন ঊভভড়ৎঃ-এর উচ্চারণ অ্যাফার্ট, অ্যাফট নয়; যেমন_ জরমড়ৎড়ঁং-এর উচ্চারণ রিগারাস, রাইগোরাস নয়; যেমন_ ঋৎড়হঃ-এর উচ্চারণ ফ্রান্ট, ফ্রন্ট নয়) আমাকে একটা বাক্য দিয়েছিলেন। "শোন 'দৌহিত্র'_ তোমারও একদিন বয়স হবে। বয়স যা ছাড়ায় তা আর ফেরায় না। এটি গাছের ঝরাপাতার মতো। তার বোঁটা যখন খসে, সেটি আর ডালে গিয়ে বসে না।
মনে আছে। কিন্তু মনে কিছু থাকলে ও মেনে কিছু নিলে যেমন আচরণ করতে হয়, যেমন ভীত ও সচেতন হতে হয়, যেমন করে কাজগুলো করতে হয় ও সংসারটাকে যেমন করে গোছাতে হয়, তেমন করে কিছু করা হলো না, হচ্ছেও না তেমন কিছু, হয়তো হবেও না কোনো দিন। কী জানি, হয়তো তেমন হয়ও না। উপদেশ যারা দিই, তারাও তা অনেক সময় মানি না, মানতে পারি না।
রণজিৎ বিশ্বাস : কথাসাহিত্যিক
একটা কুড়ি বাইশ বছরের ছেলে টেবিলে ঘুষি মেরে, হয়তো কাচ ভেঙেও কথা বলতে পারে। আমি তেমন পারি না। আমি দেখেছি, আমি বা আমার বয়সী মানুষের তা ইচ্ছেও করে না। আমাদের রুচিতে বাধে, আমরা বিশ্লেষণমুখী হই। আপনি ভালো করে দেখুন, আপনার মধ্যেও কিন্তু ক্রমশ তেমন একটা বোধ জাগছে।
কেউ আমাদের অসম্মান করলে বা আমাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলে আমি তৎক্ষণাৎ উত্তেজিত হই না। আমি ভাবি, নিশ্চয়ই আমি কোনো অন্যায় করেছি, নিশ্চয়ই ওর উত্তেজনার কোনো কারণ না জেনে হলেও আমি ঘটিয়ে ফেলেছি। আমি কার্যকারণ সন্ধানের চেষ্টা করি।
পরে, আমি ওই সহকর্মীর বয়সে পেঁৗছার পর অনুভব করেছি, কথা সত্যি, কথাটা সহি। এই সহি কথার জন্যই আরেকটা অনুভব জীবনের যোগফল সবসময় সমান। কেউ কিছু পাচ্ছে, কেউ কিছু হারাচ্ছে। কিন্তু যোগফল সমানই থাকছে। পুরোপুরি সমান না হলেও মোটামুটি সমান। ভাবনাকে আরও যদি ছড়াই, চমকে চমকে বুঝতে পাই_ যে শ্রমজীবী কচুঘেচু খেয়ে মাথার 'পরে ইট দিয়ে ঘুমোয় এবং তার পেটে কোনো পীড়া হয় না সে লোক ওই লোকের চেয়ে কম সুখী নয় যার অর্থ ঠেললে ঠেলা যায় না, যার বিত্তের তার কাছে নেই, যার খাবার অপচয় করার সামর্থ্য আছে কিন্তু হজম করার ক্ষমতা নেই এবং ওষুধের পর ওষুধ খাওয়ার পরও চোখে তার ঘুম নেই।
আরেকজন শিক্ষক, কবি ওহীদুল আলম, সাহিত্যিক মাহবুব-উল-আলমের ছোট ভাই, যার আরেক ভাই নজরুল সুহৃদ দিদারুল আলম এবং যিনি দীর্ঘদিন ছিলেন চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক, চলি্লশ বছর আগে একদিন চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে কয়েকটি শব্দের ইংরেজি উচ্চারণ শেখাতে শেখাতে (যেমন ঊভভড়ৎঃ-এর উচ্চারণ অ্যাফার্ট, অ্যাফট নয়; যেমন_ জরমড়ৎড়ঁং-এর উচ্চারণ রিগারাস, রাইগোরাস নয়; যেমন_ ঋৎড়হঃ-এর উচ্চারণ ফ্রান্ট, ফ্রন্ট নয়) আমাকে একটা বাক্য দিয়েছিলেন। "শোন 'দৌহিত্র'_ তোমারও একদিন বয়স হবে। বয়স যা ছাড়ায় তা আর ফেরায় না। এটি গাছের ঝরাপাতার মতো। তার বোঁটা যখন খসে, সেটি আর ডালে গিয়ে বসে না।
মনে আছে। কিন্তু মনে কিছু থাকলে ও মেনে কিছু নিলে যেমন আচরণ করতে হয়, যেমন ভীত ও সচেতন হতে হয়, যেমন করে কাজগুলো করতে হয় ও সংসারটাকে যেমন করে গোছাতে হয়, তেমন করে কিছু করা হলো না, হচ্ছেও না তেমন কিছু, হয়তো হবেও না কোনো দিন। কী জানি, হয়তো তেমন হয়ও না। উপদেশ যারা দিই, তারাও তা অনেক সময় মানি না, মানতে পারি না।
রণজিৎ বিশ্বাস : কথাসাহিত্যিক
No comments