'নিরঙ্কুশ' গণরায়েও স্বস্তি নেই by ড. ইমতিয়াজ আহমেদ
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে।
নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক অঙ্গনে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে
এবং অনেকে মনে করেন, তা আরও প্রকট হয়েছে। কীভাবে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে,
সেটা সবাই দেখেছেন। যারা 'নিরঙ্কুশ' গণরায় পেয়েছেন, তারা আদৌ স্বস্তিতে
নেই। অন্যদিকে নির্বাচনে 'ধরাশায়ী' বিরোধী পক্ষও পরবর্তী কর্মপন্থা নিয়ে
চিন্তা-ভাবনা শুরু করেছেন। তারা কি পরাজিত হয়েছেন? আওয়ামী লীগ এবং তার
মিত্ররা কি জয়ী হয়েছে? এসব প্রশ্ন এখন সর্বত্র আলোচিত। এর মধ্যেই একটি
বিষয়ে বোধকরি এখন সবাই একমত হবেন_ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সবচেয়ে বড়
শিক্ষা হচ্ছে, বাংলাদেশে আপাতত দলীয় কোনো সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ
নির্বাচন সম্ভব নয়। ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টিতে একক প্রার্থী থাকায় ৫২ শতাংশ
আসনে ভোটাররা তাদের অধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। বিষয়টি এমন নয় যে,
ওইসব আসনে প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা এমন তুঙ্গে যে কেউই তাদের বিরুদ্ধে
দাঁড়াতে উৎসাহ বোধ করেননি। এসব আসনে কেন একক প্রার্থী ছিলেন, সেটা সবার
জানা।
নির্বাচন হয়েছে ১৪৭ আসনে। এসব আসনে ক্ষমতাসীনদের বিভিন্ন শরিক দলের প্রার্থী ছিলেন। কোথাও কোথাও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন। কোথাও ছিল একেবারেই অচেনা মুখ। নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল খুব কম। জাল ভোট পড়েছে প্রচুর এবং তার প্রমাণ আমরা সংবাদপত্রে দেখেছি। এর প্রতিকারে নির্বাচন কমিশন কিছুই করেনি। তারা সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় ছিল। এটাও হয়তো কেউ কেউ বলবেন, তারা চলেছে শাসকদের মর্জি অনুসারে। ১৪৭ আসনের নির্বাচনে তারা নিজেদের সংবিধান ও আইন প্রদত্ত ক্ষমতা প্রয়োগে ব্যর্থ হয়েছে। যদি ৩০০ আসনে নির্বাচন পরিচালনা করতে হতো, তাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াত? ভোটার উপস্থিতি এতই কম ছিল যে, নির্বাচন কমিশন কয়েকদিন সময় নিয়েছে 'সঠিক হিসাব' তুলে ধরার জন্য। আগের নির্বাচনগুলোয় আমরা দেখেছি, নির্বাচনের দিনই কমিশন আনুমানিক হিসাব বলতে পেরেছে। শেষ পর্যন্ত যে ৩৯ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে কমিশন দাবি করেছে, বাস্তবে যারা ভোটকেন্দ্র ঘুরে দেখেছেন, তারা কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারছেন না।
নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষক এসেছেন মাত্র চারজন_ ভারত ও ভুটান থেকে। দেশের মধ্যে গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন মনিটর করেছে। নাজমুল আহসান কলিমুল্লার 'জানিপপ' কিছু আসনের কেন্দ্রে ভোট প্রদানের হার মনিটর করেছে। এতে দেখা যায়, শেষ ২ ঘণ্টায় ভোট প্রদানের হার অস্বাভাবিক বেশি ছিল।
তৃতীয় যে বিষয়টি লক্ষণীয়, ৪০টিরও বেশি কেন্দ্রে একটি ভোটও পড়েনি। আওয়ামী লীগ দাবি করে, তাদের দল তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত। এ দলটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে দৃঢ়সংকল্প ছিল এবং দলের নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছিল সর্বোচ্চ সংখ্যায় ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে। কিন্তু যেসব কেন্দ্রে একজন ভোটারও উপস্থিত হননি, সেখানে কি এই দলের একজন নেতা বা কর্মীও নেই? নির্বাচনের আগে এবং নির্বাচনের দিনে বিরোধীরা সহিংস কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে এবং ভোটারদের মধ্যে ভয়ভীতি ছিল_ এ দাবি করছে সরকার। কিন্তু এর মধ্যেও তো সেসব কেন্দ্রে ভোট গ্রহণের প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেছে। তদুপরি ছিল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক উপস্থিতি। ১৪৭ আসনে যে ভোট পড়েছে তা থেকেও বলা যায়, আওয়ামী লীগের সমর্থকদেরও বড় অংশ নির্বাচনে ভোট দিতে আসেনি।
সার্বিক অবস্থা বিচার করে এখন কিন্তু অনেকেই বলবেন, ১৯৭১ সালের আওয়ামী লীগ এবং ২০১৪ সালের আওয়ামী লীগ এক নয়। বর্তমানে আওয়ামী লীগ পরিচালনায় রাজনীতিকদের চেয়ে সাবেক আমলাদের ভূমিকা বেশি_ এ কথা বলা হচ্ছে। তাদের কেউ কেউ অনেক বছর বিদেশে ছিলেন। তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে তাদের মোটেই যোগাযোগ নেই। ব্যর্থ বামদের ভূমিকারও সমালোচনা হচ্ছে। তারা নিজ দলে থাকার সময়ে জনসমর্থন আদায়ে মোটেই সফল হননি। এখন রয়েছেন শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠজন হিসেবে, তার আশপাশে। আওয়ামী লীগ একটি লড়াকু দল হিসেবে পরিচিত। কিন্তু ৫ জানুয়ারি তারা সফলতা দেখাতে পারেনি। এখন তারা কী করবে? আজ কিংবা কাল তাদের সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়, এমন একটি নির্বাচনে যেতেই হবে। তখন কি তারা মনোবল ফিরে পাবে?
চতুর্থত, এবারের নির্বাচন কতটা গ্রহণযোগ্য, সে প্রশ্ন দেশ-বিদেশের সর্বত্র। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য এখন পর্যন্ত কোনো দেশের সরকার শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন বার্তা পাঠায়নি। অথচ এটাই রেওয়াজ। এমনকি ভারত সরকারও এটা করেনি। সম্ভবত ভোটারদের কম উপস্থিতি তাদেরও নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে।
আন্তর্জাতিক মহল তিনটি বিষয়কে সামনে আনছে_ এক. রাজনৈতিক সহিংসতা কমিয়ে আনা; দুই. সংলাপ অনুষ্ঠান এবং তিন. পুনরায় নির্বাচন অনুষ্ঠান। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘ_ সবারই এক কথা। স্পষ্ট যে বিদেশিরা এ নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য মনে না করায় বড় কোনো বিনিয়োগ আপাতত বাংলাদেশে আসবে না। এর প্রভাব মন্দ হতে বাধ্য। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা আইএলও বলেছে, বাংলাদেশে বেকারত্বের হার বাড়ছে। নতুন যারা শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছে, তাদের সবার কাজ মিলছে না। নতুন বিনিয়োগ না এলে কর্মসংস্থান পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। অর্থনীতির ওপর চাপ পড়বে। সরকার বলেছিল, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা এবং পাশাপাশি অনিশ্চয়তার অবসান ঘটানোর জন্য নির্বাচন করতে হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে তা অর্জিত হচ্ছে না।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হাতে কিন্তু আরও কার্ড রয়েছে। বাংলাদেশ তার রফতানি বাণিজ্যের জন্য যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওপর সম্পূূর্ণ নির্ভরশীল। যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে কয়েকটি পণ্যের ক্ষেত্রে জিএসপি সুবিধা বন্ধ রেখেছে। সেটা ফেরত পাওয়া আপাতত সম্ভব নয় বলেই মনে হয়। ইউরোপের দেশগুলো তৈরি পোশাকশিল্পে এ সুবিধা প্রত্যাহার করে নিতে পারে, এমন শঙ্কা এখন আর অমূলক নয়। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে অর্থনীতি প্রচণ্ড চাপে পড়বে এবং রাজনীতিও অন্যদিকে মোড় নেবে, তাতে সন্দেহ নেই।
নির্বাচনের পর দেশের নানা স্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা শুরু হয়েছে। ২০০১ সালের নির্বাচনের পরও এটা ঘটেছে। তখন অবশ্য বেশিরভাগ ঘটনা ঘটেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। আওয়ামী লীগ ওই নির্বাচন হেরে যায় এবং বিএনপি ক্ষমতায় আসে। এবার নির্বাচনের আগে বলা হচ্ছিল, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতায় এলে সাম্প্রদায়িক হানাহানি বাড়বে এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা বিপন্ন হবে। কিন্তু এবার তো ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ। বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী নির্বাচন বয়কট করেছে। তাহলে নির্বাচনের পর কেন সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হচ্ছে? কেনই-বা সরকার তা প্রতিরোধ করতে পারছে না? যশোরে ক্ষমতাসীন দলের দুই নেতা পরস্পরের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ করেছেন। অন্যান্য স্থান থেকেও অভিযোগ আসছে যে, আক্রান্তরা খবর দেওয়ার পরও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী কিংবা প্রশাসন ও পুলিশ দ্রুত তাদের পাশে দাঁড়ায়নি। জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে হামলায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ করা হচ্ছে এবং তা হয়তো অনেকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে। কিন্তু তারা তো ক্ষমতায় নেই। যশোরে বলা হয়েছে, জামায়াতে ইসলামী ও আওয়ামী লীগ মিলেই হিন্দুদের ওপর হামলা করেছে। সরকার কী জবাব দেবে? ভারতের বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী জ্ঞান পাণ্ডে তার গবেষণায় দেখিয়েছেন, সাম্প্রদায়িক হামলার জন্য ধর্ম মুখ্য কারণ নয়। বরং সংখ্যালঘুরা বারবার এর শিকার হয় রাজনীতি ও অর্থনীতির খেলায়। বাংলাদেশে এ কার্ড এখন ব্যবহার করছে কারা? এ কার্ড কিন্তু ভারতেও খেলা হচ্ছে। উত্তর প্রদেশের কিছু স্থানে মুসলিমরা আক্রান্ত হচ্ছে এবং রাজ্য বা কেন্দ্র সরকার তার প্রতিকারে কিছুই করতে পারছে না। গত কয়েক দশকের অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশে এখন একটি বিষয়ে সমঝোতা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে যে, কোনো দলই রাজনীতিতে ধর্মের কার্ড ব্যবহার করবে না। এটা করা গেলে রাজনীতির অঙ্গনে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা জরুরি_ এ নিয়ে দ্বিমত নেই। নতুন নির্বাচন হতেই হবে এবং এতে সব দলের সমান সুবিধা নিশ্চিত করা চাই। যে সরকার এটা করতে পারবে, তাদের হাতেই নির্বাচনের সময়ে দায়িত্ব দিতে হবে। জনগণ এর বাইরে কোনো ব্যবস্থা মেনে নেবে না। অন্য পথে চললে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও মিলবে না।
জামায়াতে ইসলামী অনেকদিন ধরেই আলোচনায়। তারা সহিংস কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। তাদের নিষিদ্ধ করার দাবিও রয়েছে। কিন্তু নিষিদ্ধ করলেই কি তারা সমাজ থেকে ভ্যানিশ হয়ে যাবে? সরকারি দল বলছে, জামায়াতে ইসলামীর সংশ্রব ত্যাগ করতে হবে বিএনপিকে। এটা বিএনপি করবে কি-না সেটা তাদের ব্যাপার। জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে অসহিষ্ণু রাজনীতির প্রচার করছে। তারা মানুষে মানুষে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে বলেও প্রচার রয়েছে। তাদের নিষিদ্ধ করলেই এ বিষয়টি কিন্তু সমাজ থেকে চলে যাবে না। শুভবুদ্ধি সম্পন্ন সব রাজনৈতিক দল এবং সামাজিক শক্তির করণীয় হচ্ছে অসহিষ্ণু ধারার প্রভাব থেকে জনগণকে মুক্ত করায় সচেষ্ট হওয়া। তেমন জোরালো কর্মকাণ্ড কিছু লক্ষণীয় হচ্ছে না।
বাংলাদেশের সমাজে দ্বন্দ্ব এখন প্রকট। এটা রয়েছে বিভিন্ন দলের মধ্যে এবং একই সঙ্গে সমাজের অভ্যন্তরেও। রাজনীতিতে তৃতীয় শক্তির হস্তক্ষেপ নিয়েও কিন্তু আলোচনা হয়। তবে এখন কিন্তু নতুন একটি শক্তির প্রতিও নজর দেওয়ার সময় এসেছে। আমরা প্রচলিত অর্থে তৃতীয় শক্তি বলতে যাদের বোঝাই, তাদের বাইরেই এ শক্তি প্রবল হচ্ছে বলে আমার ধারণা। তারা গতানুগতিক ধারায় চলতে আগ্রহী নয়। প্রধান দুটি দলের বাইরেই তারা চিন্তা-ভাবনা করছে। প্রচলিত রাজনীতির ধারা তাদের পছন্দ নয়। সমাজে বিদ্যমান দুর্নীতি-অনিয়ম তারা অপছন্দ করছে। নির্বাচনের সময়ে প্রার্থীদের সম্পদ বিবরণী যেভাবে এসেছে, সেটা তাদের ক্ষুব্ধ করেছে। যে রাজনীতি এভাবে সম্পদ বাড়ায়, সেটা তাদের পছন্দ নয়। এ শক্তিতে রয়েছে তারুণ্যের বিপুল প্রাধান্য এবং এদের উপেক্ষা করা মোটেই সমীচীন হবে না।
অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
নির্বাচন হয়েছে ১৪৭ আসনে। এসব আসনে ক্ষমতাসীনদের বিভিন্ন শরিক দলের প্রার্থী ছিলেন। কোথাও কোথাও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন। কোথাও ছিল একেবারেই অচেনা মুখ। নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল খুব কম। জাল ভোট পড়েছে প্রচুর এবং তার প্রমাণ আমরা সংবাদপত্রে দেখেছি। এর প্রতিকারে নির্বাচন কমিশন কিছুই করেনি। তারা সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় ছিল। এটাও হয়তো কেউ কেউ বলবেন, তারা চলেছে শাসকদের মর্জি অনুসারে। ১৪৭ আসনের নির্বাচনে তারা নিজেদের সংবিধান ও আইন প্রদত্ত ক্ষমতা প্রয়োগে ব্যর্থ হয়েছে। যদি ৩০০ আসনে নির্বাচন পরিচালনা করতে হতো, তাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াত? ভোটার উপস্থিতি এতই কম ছিল যে, নির্বাচন কমিশন কয়েকদিন সময় নিয়েছে 'সঠিক হিসাব' তুলে ধরার জন্য। আগের নির্বাচনগুলোয় আমরা দেখেছি, নির্বাচনের দিনই কমিশন আনুমানিক হিসাব বলতে পেরেছে। শেষ পর্যন্ত যে ৩৯ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে কমিশন দাবি করেছে, বাস্তবে যারা ভোটকেন্দ্র ঘুরে দেখেছেন, তারা কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারছেন না।
নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষক এসেছেন মাত্র চারজন_ ভারত ও ভুটান থেকে। দেশের মধ্যে গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন মনিটর করেছে। নাজমুল আহসান কলিমুল্লার 'জানিপপ' কিছু আসনের কেন্দ্রে ভোট প্রদানের হার মনিটর করেছে। এতে দেখা যায়, শেষ ২ ঘণ্টায় ভোট প্রদানের হার অস্বাভাবিক বেশি ছিল।
তৃতীয় যে বিষয়টি লক্ষণীয়, ৪০টিরও বেশি কেন্দ্রে একটি ভোটও পড়েনি। আওয়ামী লীগ দাবি করে, তাদের দল তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত। এ দলটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে দৃঢ়সংকল্প ছিল এবং দলের নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছিল সর্বোচ্চ সংখ্যায় ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে। কিন্তু যেসব কেন্দ্রে একজন ভোটারও উপস্থিত হননি, সেখানে কি এই দলের একজন নেতা বা কর্মীও নেই? নির্বাচনের আগে এবং নির্বাচনের দিনে বিরোধীরা সহিংস কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে এবং ভোটারদের মধ্যে ভয়ভীতি ছিল_ এ দাবি করছে সরকার। কিন্তু এর মধ্যেও তো সেসব কেন্দ্রে ভোট গ্রহণের প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেছে। তদুপরি ছিল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক উপস্থিতি। ১৪৭ আসনে যে ভোট পড়েছে তা থেকেও বলা যায়, আওয়ামী লীগের সমর্থকদেরও বড় অংশ নির্বাচনে ভোট দিতে আসেনি।
সার্বিক অবস্থা বিচার করে এখন কিন্তু অনেকেই বলবেন, ১৯৭১ সালের আওয়ামী লীগ এবং ২০১৪ সালের আওয়ামী লীগ এক নয়। বর্তমানে আওয়ামী লীগ পরিচালনায় রাজনীতিকদের চেয়ে সাবেক আমলাদের ভূমিকা বেশি_ এ কথা বলা হচ্ছে। তাদের কেউ কেউ অনেক বছর বিদেশে ছিলেন। তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে তাদের মোটেই যোগাযোগ নেই। ব্যর্থ বামদের ভূমিকারও সমালোচনা হচ্ছে। তারা নিজ দলে থাকার সময়ে জনসমর্থন আদায়ে মোটেই সফল হননি। এখন রয়েছেন শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠজন হিসেবে, তার আশপাশে। আওয়ামী লীগ একটি লড়াকু দল হিসেবে পরিচিত। কিন্তু ৫ জানুয়ারি তারা সফলতা দেখাতে পারেনি। এখন তারা কী করবে? আজ কিংবা কাল তাদের সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়, এমন একটি নির্বাচনে যেতেই হবে। তখন কি তারা মনোবল ফিরে পাবে?
চতুর্থত, এবারের নির্বাচন কতটা গ্রহণযোগ্য, সে প্রশ্ন দেশ-বিদেশের সর্বত্র। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য এখন পর্যন্ত কোনো দেশের সরকার শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন বার্তা পাঠায়নি। অথচ এটাই রেওয়াজ। এমনকি ভারত সরকারও এটা করেনি। সম্ভবত ভোটারদের কম উপস্থিতি তাদেরও নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে।
আন্তর্জাতিক মহল তিনটি বিষয়কে সামনে আনছে_ এক. রাজনৈতিক সহিংসতা কমিয়ে আনা; দুই. সংলাপ অনুষ্ঠান এবং তিন. পুনরায় নির্বাচন অনুষ্ঠান। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘ_ সবারই এক কথা। স্পষ্ট যে বিদেশিরা এ নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য মনে না করায় বড় কোনো বিনিয়োগ আপাতত বাংলাদেশে আসবে না। এর প্রভাব মন্দ হতে বাধ্য। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা আইএলও বলেছে, বাংলাদেশে বেকারত্বের হার বাড়ছে। নতুন যারা শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছে, তাদের সবার কাজ মিলছে না। নতুন বিনিয়োগ না এলে কর্মসংস্থান পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। অর্থনীতির ওপর চাপ পড়বে। সরকার বলেছিল, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা এবং পাশাপাশি অনিশ্চয়তার অবসান ঘটানোর জন্য নির্বাচন করতে হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে তা অর্জিত হচ্ছে না।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হাতে কিন্তু আরও কার্ড রয়েছে। বাংলাদেশ তার রফতানি বাণিজ্যের জন্য যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওপর সম্পূূর্ণ নির্ভরশীল। যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে কয়েকটি পণ্যের ক্ষেত্রে জিএসপি সুবিধা বন্ধ রেখেছে। সেটা ফেরত পাওয়া আপাতত সম্ভব নয় বলেই মনে হয়। ইউরোপের দেশগুলো তৈরি পোশাকশিল্পে এ সুবিধা প্রত্যাহার করে নিতে পারে, এমন শঙ্কা এখন আর অমূলক নয়। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে অর্থনীতি প্রচণ্ড চাপে পড়বে এবং রাজনীতিও অন্যদিকে মোড় নেবে, তাতে সন্দেহ নেই।
নির্বাচনের পর দেশের নানা স্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা শুরু হয়েছে। ২০০১ সালের নির্বাচনের পরও এটা ঘটেছে। তখন অবশ্য বেশিরভাগ ঘটনা ঘটেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। আওয়ামী লীগ ওই নির্বাচন হেরে যায় এবং বিএনপি ক্ষমতায় আসে। এবার নির্বাচনের আগে বলা হচ্ছিল, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতায় এলে সাম্প্রদায়িক হানাহানি বাড়বে এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা বিপন্ন হবে। কিন্তু এবার তো ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ। বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী নির্বাচন বয়কট করেছে। তাহলে নির্বাচনের পর কেন সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হচ্ছে? কেনই-বা সরকার তা প্রতিরোধ করতে পারছে না? যশোরে ক্ষমতাসীন দলের দুই নেতা পরস্পরের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ করেছেন। অন্যান্য স্থান থেকেও অভিযোগ আসছে যে, আক্রান্তরা খবর দেওয়ার পরও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী কিংবা প্রশাসন ও পুলিশ দ্রুত তাদের পাশে দাঁড়ায়নি। জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে হামলায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ করা হচ্ছে এবং তা হয়তো অনেকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে। কিন্তু তারা তো ক্ষমতায় নেই। যশোরে বলা হয়েছে, জামায়াতে ইসলামী ও আওয়ামী লীগ মিলেই হিন্দুদের ওপর হামলা করেছে। সরকার কী জবাব দেবে? ভারতের বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী জ্ঞান পাণ্ডে তার গবেষণায় দেখিয়েছেন, সাম্প্রদায়িক হামলার জন্য ধর্ম মুখ্য কারণ নয়। বরং সংখ্যালঘুরা বারবার এর শিকার হয় রাজনীতি ও অর্থনীতির খেলায়। বাংলাদেশে এ কার্ড এখন ব্যবহার করছে কারা? এ কার্ড কিন্তু ভারতেও খেলা হচ্ছে। উত্তর প্রদেশের কিছু স্থানে মুসলিমরা আক্রান্ত হচ্ছে এবং রাজ্য বা কেন্দ্র সরকার তার প্রতিকারে কিছুই করতে পারছে না। গত কয়েক দশকের অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশে এখন একটি বিষয়ে সমঝোতা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে যে, কোনো দলই রাজনীতিতে ধর্মের কার্ড ব্যবহার করবে না। এটা করা গেলে রাজনীতির অঙ্গনে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা জরুরি_ এ নিয়ে দ্বিমত নেই। নতুন নির্বাচন হতেই হবে এবং এতে সব দলের সমান সুবিধা নিশ্চিত করা চাই। যে সরকার এটা করতে পারবে, তাদের হাতেই নির্বাচনের সময়ে দায়িত্ব দিতে হবে। জনগণ এর বাইরে কোনো ব্যবস্থা মেনে নেবে না। অন্য পথে চললে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও মিলবে না।
জামায়াতে ইসলামী অনেকদিন ধরেই আলোচনায়। তারা সহিংস কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। তাদের নিষিদ্ধ করার দাবিও রয়েছে। কিন্তু নিষিদ্ধ করলেই কি তারা সমাজ থেকে ভ্যানিশ হয়ে যাবে? সরকারি দল বলছে, জামায়াতে ইসলামীর সংশ্রব ত্যাগ করতে হবে বিএনপিকে। এটা বিএনপি করবে কি-না সেটা তাদের ব্যাপার। জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে অসহিষ্ণু রাজনীতির প্রচার করছে। তারা মানুষে মানুষে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে বলেও প্রচার রয়েছে। তাদের নিষিদ্ধ করলেই এ বিষয়টি কিন্তু সমাজ থেকে চলে যাবে না। শুভবুদ্ধি সম্পন্ন সব রাজনৈতিক দল এবং সামাজিক শক্তির করণীয় হচ্ছে অসহিষ্ণু ধারার প্রভাব থেকে জনগণকে মুক্ত করায় সচেষ্ট হওয়া। তেমন জোরালো কর্মকাণ্ড কিছু লক্ষণীয় হচ্ছে না।
বাংলাদেশের সমাজে দ্বন্দ্ব এখন প্রকট। এটা রয়েছে বিভিন্ন দলের মধ্যে এবং একই সঙ্গে সমাজের অভ্যন্তরেও। রাজনীতিতে তৃতীয় শক্তির হস্তক্ষেপ নিয়েও কিন্তু আলোচনা হয়। তবে এখন কিন্তু নতুন একটি শক্তির প্রতিও নজর দেওয়ার সময় এসেছে। আমরা প্রচলিত অর্থে তৃতীয় শক্তি বলতে যাদের বোঝাই, তাদের বাইরেই এ শক্তি প্রবল হচ্ছে বলে আমার ধারণা। তারা গতানুগতিক ধারায় চলতে আগ্রহী নয়। প্রধান দুটি দলের বাইরেই তারা চিন্তা-ভাবনা করছে। প্রচলিত রাজনীতির ধারা তাদের পছন্দ নয়। সমাজে বিদ্যমান দুর্নীতি-অনিয়ম তারা অপছন্দ করছে। নির্বাচনের সময়ে প্রার্থীদের সম্পদ বিবরণী যেভাবে এসেছে, সেটা তাদের ক্ষুব্ধ করেছে। যে রাজনীতি এভাবে সম্পদ বাড়ায়, সেটা তাদের পছন্দ নয়। এ শক্তিতে রয়েছে তারুণ্যের বিপুল প্রাধান্য এবং এদের উপেক্ষা করা মোটেই সমীচীন হবে না।
অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments