বিএনপি হেরে গেলে কী হবে?
শনিবার, সাপ্তাহিক ছুটির দিন। ঘুম থেকে উঠেই প্রতিদিনকার মতো সকালের কাগজ, প্রথম আলো হাতে নিলাম। পুরো পত্রিকার শিরোনামগুলোতে চোখ বোলাতেই একটি শিরোনামে উদ্বিগ্ন হলাম: ‘হেরে গেছেন খালেদা জিয়া’। সোহরাব হাসান তাঁর ‘কালের পুরাণে’ উপরিউক্ত শিরোনাম লিখেছেন। শিরোনামে যা বলা হয়েছে তা যদি সত্যিই ঘটে থাকে, তাহলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক রাজনীতির সমীকরণ ভেবে উদ্বিগ্ন না হয়ে উপায় নেই। ‘হেরে গেছেন খালেদা জিয়া’ শিরোনামের লেখায় লেখক দল হিসেবে বিএনপিকে একটি চরম সংকটে উপনীত হিসেবে দেখছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি দুটি বিষয়কে উল্লেখ করেছেন। একটি হলো, বিএনপির রাজনৈতিক চরিত্রের পরিবর্তন তথা মধ্যপন্থা থেকে উগ্রপন্থা সমর্থনের কাছাকাছি যাওয়া। এ ক্ষেত্রে আন্দোলনের জন্য জামায়াত ও হেফাজতে ইসলামের ওপর নির্ভরশীলতাকে উদ্ধৃত করা হয়েছে। অন্যটি হলো, বিএনপি পরিচালনার দ্বৈত কেন্দ্র: লন্ডনভিত্তিক তথা তারেকভিত্তিক এবং ঢাকাভিত্তিক তথা খালেদাভিত্তিক। এর মাধ্যমে লেখক পুরোনো তথা ২০০১ সালের বিএনপি সরকার পরিচালনায় দুটি ভরকেন্দ্র তথা হাওয়া ভবন ও গণভবনকেই আলোচনায় এনেছেন। সবশেষে দাবি করা হয়েছে, আন্দোলনের ক্ষেত্রে উগ্রপন্থার নির্ভরতা এবং কৌশলের ক্ষেত্রে দুটি ভরকেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণের ফলে বিএনপির ডাকে জনগণ রাস্তায় নেমে না আসায় বিএনপি আন্দোলন ও নির্বাচনবিরোধী রণকৌশলে হেরে গেছে। আসলে আন্দোলন ও নির্বাচনবিরোধী কৌশলে বিএনপি হেরে যায়নি।
প্রথমত, নির্বাচনবিরোধী আন্দোলনে বিএনপির মূল ইস্যু ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি দেশের জনসাধারণ ও আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন আদায়। বিএনপি এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সফল। দেশের অভ্যন্তরে পরিচালিত বিভিন্ন জরিপ অনুযায়ী এটা স্পষ্ট যে দেশের মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা বিএনপির জন্য চূড়ান্ত সফলতার বিষয়। কিন্তু এই দাবির প্রতি সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে সমর্থনের ভিত্তি তৈরি করা হলো এর মৌলিক বিজয়। পাশাপাশি, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আবশ্যকতার বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলেরও সমর্থন বিএনপি পেয়েছে। এর ফলেই নির্বাচন ২০১৪-এ ভারত ছাড়া আন্তর্জাতিক কোনো পর্যবেক্ষকই ছিল না। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষের অধিকাংশ সুশীল নাগরিকও বিএনপির সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবির পক্ষে সুস্পষ্টভাবে অবস্থান নিয়েছেন। একটি দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে তীব্র আন্দোলনই চূড়ান্ত কথা নয়, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায় এর প্রতি স্থানীয় জনগণ ও আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন তৈরি করাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ, দাবি আদায়ের বিষয়টি আন্দোলনকে তীব্রতর করার রাজনৈতিক পরিবেশের ওপর এবং সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। রাজনীতিবিজ্ঞান বলে, গণদাবি সরকার কার্যকর না-ও করতে পারে। তবে এর ফলে দীর্ঘ মেয়াদে ভিন্ন কারণেও সরকারের পতন হয় এবং রাষ্ট্র সংকটে পড়ে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এখনো সরকারবিরোধী আন্দোলন চলছে।
বিরোধীরা নিশ্চিহ্ন। এর অর্থ এই নয় যে দাবি মিইয়ে গেছে এবং সরকার সফল হয়েছে। সর্বোপরি, আওয়ামী লীগের জন্য এটা চ্যালেঞ্জ ছিল যে নিজেদের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন করা। কিন্তু ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের যে চিত্র দেশি-বিদেশি মিডিয়ায় উঠে এসেছে তাতেও খালেদা জিয়ার অভিযোগই প্রমাণিত হয়েছে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে না। বিএনপির চূড়ান্ত সফলতা হলো ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের প্রতি জনসমর্থনের ভিত্তি স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্পষ্ট করা এবং ২০০৮ সালের ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য একটি সরকারের পরিবর্তে ২০১৪ সালের জনসমর্থনহীন একটি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার সুযোগ তৈরি করা এবং এই সরকারকে বৈধতার চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলা। দ্বিতীয়ত, বিএনপি হারেনি আন্দোলনের মাত্রাগতি বিষয়েও। বিএনপির কর্মসূচিগুলো ১৮-দলীয় জোটের কর্মসূচি হওয়ায় এবং যুদ্ধাপরাধের বিচারের কারণে জামায়াতের ব্যাপক অংশগ্রহণ থাকায় আন্দোলনে সহিংসতার মাত্রাটি ভিন্নরূপ লাভ করলেও বিএনপি নিজেই এই আন্দোলনে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। এই আন্দোলনে বিএনপিরই অসংখ্য লোক হতাহত হয়েছে এবং কারাবরণ করেছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার, অর্থনীতিকে সচল রাখার ক্ষেত্রে সফলতা সত্ত্বেও ভিন্নমতকে নিয়ন্ত্রণ করে ২০১৪ সালের একটি সরকারের গণবৈধতার প্রশ্ন এই সরকার ভবিষ্যতে যত দিন ক্ষমতায় থাকবে তত দিনই বারবার ফিরে আসবে, সন্দেহ নেই। একটি রাষ্ট্রের জন্মদানকারী আওয়ামী লীগের এই চরিত্র শোভনীয় নয়।
রাজনীতিবিজ্ঞান বলে, আন্দোলন তখনই সরকারের পতন ঘটায়, যখন সরকার নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর সমর্থন হারায়। এরশাদের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। জেনারেল নুরুদ্দীনের সমর্থনই শেষ পরিণতি ঠিক করেছে। দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, বিএনপি হেরে গেলে কী হবে? জামায়াতসংশ্লিষ্টতাকে আমলে না নিলে বিএনপির বর্তমান আন্দোলনের মূল বিষয় ছিল, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা, সরকারি বাহিনীর বিপত্তি ছাড়া সভা-সমাবেশের সুযোগ তৈরি করা, গ্রেপ্তার-নির্যাতনের প্রতিবাদ করা, অন্যায়ভাবে বিরোধীদলীয় নেতাকে গৃহবন্দী রাখার বিষয়ে সরকারকে চ্যালেঞ্জ করা, সর্বোপরি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। ২০১৪ সালের নির্বাচনকেন্দ্রিক আন্দোলনে বিএনপি যদি হেরে গিয়ে থাকে, তাহলে এই ইস্যুগুলোই হেরে গেল। এতে গণতন্ত্র কি বাঁচবে? বিএনপির মতো বিরোধী দলকে যেখানে আওয়ামী লীগ আমলে নেয় না, সেখানে জাতীয় পার্টির মতো সরকারের লেজুড়বৃত্তিক বিরোধী দলের সঙ্গে মিলে বর্তমান আওয়ামী লীগ যে নয়া গণতন্ত্রের রূপ দেখাচ্ছে, তার ভবিষ্যৎ কল্পনা করুন। এটা মালয়েশিয়ার সেমি ডেমোক্রেসি নয়, দক্ষিণ কোরিয়া বা সিঙ্গাপুরের উপকারী কর্তৃত্ববাদ নয়। এটা ইন্দোনেশিয়ার নিউ অর্ডার বা ওল্ড অর্ডারের ইঙ্গিত কি? যদি তা-ই হয়, এটা বাংলাদেশের জনগণ, রাষ্ট্র এমনকি স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের জন্যও ভালো নয়। সবশেষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কণ্ঠে আবৃত্তি করি: ‘থামো একটুকু; বুঝিতে পারি নে; ভালো করে ভেবে দেখি/ বিশ্ববিলোপ বিমল আঁধার চিরকাল রবে সে কি?’ (সুরদাসের প্রার্থনা, মানসী)
সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
kazipoliticalscience@gmail.com
সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
kazipoliticalscience@gmail.com
No comments