বিশেষ সাক্ষাৎকার: মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর- না, আমরা নির্বাচনে যাব না by মিজানুর রহমান খান
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের জন্ম ১৯৪৮ সালের ১ আগস্ট ঠাকুরগাঁওয়ে।
১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। এ
সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) সভাপতি ছিলেন।
এরপর
ভাসানী ন্যাপে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের পশ্চিম দিনাজপুর থেকে
সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালে দিনাজপুর সরকারি কলেজে অর্থনীতিতে
শিক্ষকতা শুরু। ১৯৭৮ সালে প্রেষণে উপপ্রধানমন্ত্রী এস এ বারি এটির একান্ত
সচিব হন। ’৮২-এর মার্চে পুনরায় শিক্ষকতায় এবং পরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়
থেকে ইস্তফা দিয়ে ১৯৮৯ সালে ঠাকুরগাঁও পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
বিএনপির টিকিটে ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে সংসদ নির্বাচন করে অকৃতকার্য হন। ২০০১
সালে ঠাকুরগাঁও থেকে সংসদ সদস্য হয়ে তিনি কৃষি প্রতিমন্ত্রী ও বেসামরিক
বিমান প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৯ সালে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম
মহাসচিব। ২০১১ সালের মার্চে খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের মৃত্যুর পর থেকে
তিনি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করছেন। ৯ অক্টোবর মির্জা
ফখরুল ইসলাম আলমগীর তাঁর উত্তরার বাসভবনে প্রথম আলোর মুখোমুখি হন।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান। নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়ে
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপির পাল্টাপাল্টি অবস্থানে দেশের
মানুষ উদ্বিগ্ন। সংকট নিরসনে বিভিন্ন মহল থেকে সংলাপের কথা বলা হচ্ছে।
চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন বিএনপির
ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
প্রথম আলো: আপনার বাড়ির নাম কুসুমিত অথচ আপনি কণ্টকিত রাজনীতির জাল বুনছেন। নির্বাচন ঠেকানোর ঘোষণায় দেশের মানুষ খুবই উদ্বিগ্ন।
মির্জা ফখরুল: কুসুম তো কণ্টকে আকীর্ণ থাকে। গোলাপের চারদিকে কাটা থাকে। আঘাত তখনই আসে যখন কুসুম উপড়ানোর চেষ্টা চলে। আমাদের চেয়ারপারসন যেটা বলেছেন, সেটা দুঃখের সঙ্গে একান্ত বাধ্য হয়েই বলেছেন। ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের পর থেকেই আমরা বলি এর ফল শুভ হবে না। বিগত কয়েক মাসে আমরা কঠোর কর্মসূচি দিইনি।
প্রথম আলো: এটা কতটা উদারতা আর কতটা অপারগতা তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। অনেকে বলেন বিএনপির আন্দোলনে জনগণ সাড়া দেয়নি।
মির্জা ফখরুল: এটা আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের ভ্রান্ত ধারণা। আমরা ইতিবাচক ও সহযোগিতার রাজনীতি করতে চেয়েছি। তদুপরি আমরা সংঘাত এড়াতে সচেষ্ট। প্রধানমন্ত্রী লন্ডনে বলেছিলেন সংসদ বিলোপ করে দেওয়া হবে। ছোট মন্ত্রিসভা হবে। ইচ্ছা করলে বিরোধী দলের লোকও আসতে পারে। সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ নির্বাচন করা হবে। কিন্তু দেখা গেছে প্রধানমন্ত্রী আন্তরিক নন। নিজের কথা নিজেই বদলাচ্ছেন।
প্রথম আলো: তার মানে এটা দিলে মানবেন?
মির্জা ফখরুল: আমাদের কথাই ছিল নির্দলীয় সরকারের যেকোনো প্রস্তাব এলে তা খতিয়ে দেখব, অনমনীয় থাকব না। আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে একটা পথ বেরিয়ে আসবে। এখনো আমাদের নেত্রী সে কথাই বলে চলেছেন।
প্রথম আলো: আপনার নেত্রী দুই মহাসচিবের বৈঠক চাইছেন। কিন্তু লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তো নেই। সেটা এই অর্থে যে আপনি কেন ভারপ্রাপ্তে ভারাক্রান্ত? বিএনপির একটি কোটারি গোষ্ঠী, বিশেষ করে যাঁরা তারেক রহমানের সমর্থক, তারাই কি এটা চাইছেন না।
মির্জা ফখরুল: এটা অপপ্রচার। সম্পূর্ণরূপে ভ্রান্ত ধারণা। দলের কাউন্সিল হয়নি বলেই এটা হয়তো এখনো পূর্ণাঙ্গ হয়নি। কিন্তু এটা তো সমস্যা নয়।
প্রথম আলো: দুই মহাসচিবের মধ্যে পর্দার আড়ালে কী কথা হয়েছিল?
মির্জা ফখরুল: আমি দেশে ছিলাম না। পত্রিকায় দেখেছি একটা আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। এর চেয়ে বেশি কিছু জানি না।
প্রথম আলো: কিন্তু বিষয়টি আপনার না জানার কথা নয়। উদ্যোগটা কাদের দিক থেকে ছিল।
মির্জা ফখরুল: সম্ভবত প্রাথমিক পর্যায়ে সরকারি দল থেকেই।
প্রথম আলো: ড. গওহর রিজভীর বাসভবনে এক বা দুই দফা বৈঠক কি সত্যি হয়েছিল?
মির্জা ফখরুল: আমি তেমনটাই শুনেছি।
প্রথম আলো: তাতে দুই মহাসচিবের বৈঠকের বিষয়টি প্রাধান্য পাচ্ছিল।
মির্জা ফখরুল: সম্ভবত।
প্রথম আলো: গত মে মাসে আপনি সিঙ্গাপুরে চিকিৎসার জন্য যাওয়ার ফলে সেটা হয়নি। অন্য কেউ গিয়েছিলেন।
মির্জা ফখরুল: তাই শুনেছি। দেখুন, এ মুহূর্তে এ নিয়ে কোনো অনুমাননির্ভরতার সুযোগ নেই।
প্রথম আলো: আচ্ছা, ওই আলোচনা ভেঙে যাওয়ার জন্য শুধু আওয়ামী লীগই দায়ী?
মির্জা ফখরুল: সম্পূর্ণভাবে। আমরা যেকোনো স্থানে যেকোনো সময় আলোচনা চাই।
প্রথম আলো: সংগ্রাম কমিটি সহিংস নাকি অহিংস হবে?
মির্জা ফখরুল: অহিংস ও নিয়মতান্ত্রিক হবে।
প্রথম আলো: শেখ হাসিনাকে রেখে নির্বাচনে যাবেন না বলছেন। তাহলে কীভাবে সমঝোতা হবে। এটা কি এতটাই নির্দিষ্ট যে আপনি বলতে পারেন এটা পুরোপুরি সন্দেহাতীত সিদ্ধান্ত?
মির্জা ফখরুল : এটা একদম সন্দেহাতীত। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের কোনো সম্ভাবনাই থাকবে না, যদি কোনো আওয়ামী লীগার সরকারপ্রধান হন। আর তিনি তো আবার আওয়ামী লীগের সভানেত্রী।
প্রথম আলো: খালেদা জিয়া নির্দিষ্ট করে শুধু শেখ হাসিনার কথা বলেছেন। আপনি কি আরেকটু ব্যাপকতা দিয়ে আওয়ামী লীগের কেউ থাকতে পারবে না, এমনটাই বলছেন?
মির্জা ফখরুল : আমাদের নেত্রী বলেছেন আওয়ামী লীগের নেত্রী থাকবেন না এবং সরকারের চরিত্র হতে হবে দলনিরপেক্ষ।
প্রথম আলো: এর আগে আপনিই কিন্তু লন্ডনি প্রস্তাবের কথা বলেছিলেন। একটু আশাবাদী হচ্ছিলাম আওয়ামী লীগের কাউকে রেখেও একটা সর্বদলীয় সমাধান হতে পারে। আপনার বক্তব্য একটু স্ববিরোধী হয়ে গেল কি না?
মির্জা ফখরুল : না, হলো না। কারণ, সেই সময়টা তাঁরা পার করেছেন। এখন পর্যন্ত তাঁরা যে ভাষায় কথা বলছেন, তাতে আর সেই জায়গা থাকছে না। বরং এখন আমরা যা বলছি সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
প্রথম আলো: আপনাদের কথায় মনে হয় নির্দলীয় সরকার হলেই হবে না, নতুন নির্বাচন কমিশনও লাগবে। আরও কোনো শর্ত?
মির্জা ফখরুল : বর্তমান ইসি সক্ষম নয় মনে করি। শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন করা উচিত।
প্রথম আলো: শোনা যাচ্ছে শো অব ফোর্স হিসেবে তারা সেনাকে থানা সদরে রাখবে। এর বাইরে পাঠাবে না।
মির্জা ফখরুল : আমরা এ বিষয়ে কিছু শুনিনি। সেনারা ভোটকেন্দ্রে কোনো দিনই ছিল না। স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে ছিল। আগে যেভাবে ছিল সেভাবেই থাকতে হবে।
প্রথম আলো: নতুন ধারার রাজনীতির কথা আগেও শুনেছি। কিন্তু প্রতিহিংসার রাজনীতি বিএনপি করেছে।
মির্জা ফখরুল : আপনি দৃষ্টান্ত দেখান—
প্রথম আলো: জন্মদিনে কেক কাটা এর অন্যতম। এতে উষ্মা প্রকাশ করে মওদুদ আহমদও লিখেছেন।
মির্জা ফখরুল : মওদুদ আহমদের বই দিয়ে বিএনপির রাজনীতিকে বোঝা যাবে না। একটি দলে বিভিন্ন ধরনের লোক থাকবেন, তাঁরা বিভিন্ন ধরনের চিন্তা করবেন। কেক কাটা নিয়ে একটি অযথা ইস্যু সৃষ্টি করা হয়। এর কোনো প্রভাব আছে বলেই আমি মনে করি না। কেক কাটায় দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। এটা সহনশীলতার বিষয়। রাজনৈতিক সহনশীলতাই মুখ্য। আমাকে আপনার রাজনৈতিক চিন্তার প্রতি সহনশীল থাকতে হবে। এখন যেটা হচ্ছে, তা ব্যক্তিগত আক্রোশ। আমার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে আমি আবর্জনার ট্রাকে আগুন দিয়েছি। এটা পুরোপুরি ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে করা হয়েছে। আমার বিরুদ্ধে একটি রাজনৈতিক মামলা দেওয়া হোক। সেটা গ্রহণযোগ্য।
প্রথম আলো: ঠিক এই ধরনের মামলা আপনারাও করেছেন। ফের ক্ষমতায় গিয়েও করবেন না, সে লক্ষ্যে জনমনে আস্থা সৃষ্টিতে বা কোনো গুণগত পরিবর্তন আনতে বিএনপিকে সৎ মনে হয় না। জনগণ আপনাদের দিকে সম্ভবত সেভাবে তাকাতে পারে না।
মির্জা ফখরুল : আপনার ধারণা ভ্রান্তিপ্রসূত। বিএনপির দিকে যদি নাই তাকানো যেত তাহলে বিগত পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হতো না। অনেকে বলেন, এটা হচ্ছে নেগেটিভ ভোট।
প্রথম আলো: অনেকে নয়, বলুন এটাই বড় সত্য। গত পাঁচ বছরে বিএনপি কী করেছে? সংসদে না গেলে সরকার পড়ে না, তাহলে সংসদে যেতে তাকে কে না করেছে। আর সরকারের প্রতি অনাস্থা মানুষ কীভাবে জানাবে? পথ রেখেছেন কোন? পারলে ‘না’ ভোটের ব্যবস্থা করুন। এখানে তো আপনাদের ঐক্য আছে।
মির্জা ফখরুল : আমরা যাঁরা শিক্ষিত মানুষ বা এলিট শ্রেণী, তাঁরা মনে হয় বাংলাদেশের জনগণের নাড়ির স্পন্দন ধরতে পারি না। এর ফলে দুই রকমের চিন্তা আসে। একটা হচ্ছে ভালো কাজ কী হওয়া উচিত। তা হয়তো আমিও মানি। সাধারণ মানুষের ভেতরে আরেকটি চিন্তা কাজ করে। তারই প্রতিফলন ঘটে বিভিন্ন নির্বাচনে। সাধারণ মানুষ সাধারণভাবে কোনো ভুল করতে পারে না। এখানে মানুষ তুলনা করে। বিএনপির আমলে কেমন ছিলাম, এখন আমরা কেমন আছি। এই তুলনা করেই ভোটটা দেয়। ১০ টাকা চালের কেজি খাওয়ানোর কথা বলে এখন ৪০ টাকা চলছে। কুইক রেন্টালে বিরাট খরচা হলো। অথচ লোডশেডিং কমছে না। মানুষ নতুন বাড়িঘর করলে আর বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। পদ্মা সেতুর মতো দুর্নীতি বিএনপি আমলে হয়েছিল কি না, সেটা মানুষ চিন্তা করছে।
প্রথম আলো: আপনার হয়তো যুক্তি আছে। কিন্তু একটি বিষয় এখনো অপ্রমাণিত। নির্দলীয় সরকারের যে বড়াইটা আমরা করি, সেটা কিন্তু কোনো দলকে টানা দুবার জিতিয়ে দেয়নি। বিরোধী দলের কাছেই ক্ষমতা হস্তান্তর এর কৃতিত্ব।
মির্জা ফখরুল : এটা কিছুটা নেতিবাচক চিন্তাপ্রসূত এবং সরলীকরণ। বিষয়টা ভিন্ন জায়গায়। সরকারি দলই থাকে চালকের আসনে। তাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হয় গণতন্ত্রকে তারা কোথায় নিয়ে যাবে। সাইবার অ্যাক্টের সংশোধন হলো। এখন আপনি বলুন এটা কীভাবে মুক্তচিন্তাকে সাহায্য করবে?
প্রথম আলো: পরিহাসটা সেখানেই, ২০০৬ সালে এই আইনের ৫৭ ধারায় যে উদ্ভট কালাকানুন আপনারা পাস করেছিলেন, ক্ষমতাসীনেরা তা বাতিল না করে আরও খারাপ করেছে। আপনাদের তো সে কারণেই এক পাল্লায় মাপি।
মির্জা ফখরুল : আজ যদি আওয়ামী লীগ সেটা পরিবর্তন করত তাহলে সেটাই হতো ইতিবাচক। কোনো আইনেই আজ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ কোনো ইতিবাচক দিক নিয়ে আসেনি। যেমন বিশেষ ক্ষমতা আইন।
প্রথম আলো: একদম ঠিক বলেছেন। আপনারা বাতিল করেননি। বিচার বিভাগ পৃথক্করণ আপনারা দেননি। বাহাত্তরের রাষ্ট্র গঠন ত্রুটি না শুধরিয়ে আপনারা একসঙ্গে চলছেন—
মির্জা ফখরুল : এ বিষয়গুলো শুরু করতে হবে। আমরা বিরোধী দল থেকে ইতিবাচক দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছি। তাই বলছি, আমরা সরকার গঠন করতে পারলে সব বিষয়কে অত্যন্ত ইতিবাচকভাবে দেখার চেষ্টা করব।
প্রথম আলো: ১৫ আগস্টে কেক কাটা না হয় ব্যক্তিগত, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলাকে কী বলবেন। এই জঘন্য অপরাধের বিশ্বাসযোগ্য উপায়ে তদন্ত ও বিচার-প্রক্রিয়া চালু করতে আপনারা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
মির্জা ফখরুল : এর পরের পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাকে বলতে দিন। এবার তিনটি অভিযোগপত্র পরিবর্তন করা হলো। নতুন আইও নিয়োগ করা হলো।
প্রথম আলো: আপনি বিএনপির ব্যর্থতা ব্যাখ্যা করুন। আপনি কিন্তু আওয়ামী লীগের সমালোচনায় গেলেন।
মির্জা ফখরুল : স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের লোক এসেছিল। তারা তদন্তের চেষ্টা করেছে। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী কোনো সহযোগিতা দেননি। সে সময়ে আমরা তাদের সহযোগিতা পেতে বিভিন্ন রকম চেষ্টা চালিয়েছি, সেটা পাইনি। যাঁরা এর দায়িত্বে ছিলেন, সে ক্ষেত্রে তাঁরা কিছু কিছু ভুল করে থাকতে পারেন। তাঁদের হয়তো বিচ্যুতি ঘটেছে।
প্রথম আলো: সে জন্য আপনাদের কোনো অনুশোচনা নেই। আওয়ামী লীগের কাছে কোনো ক্ষমা প্রার্থনা নেই। যদি নতুন ধারা বলতে শুভ কিছু বোঝাতে চান, তাহলে এটা বাদ দিয়ে হবে না। সমঝোতার এই পথে আসতে হবে।
মির্জা ফখরুল : সেই সমঝোতা বা রিকন্সিলিয়েশন তখনই হবে, যখন আপনি আমাকে দায়ী করবেন না। আপনি আমাদের দলের নেতাকে (তারেক রহমান) সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে তৃতীয় দফায় দেওয়া অভিযোগপত্রে অভিযুক্ত করছেন। আমাদের ভুলত্রুটি শুধরানোর সুযোগটা সৃষ্টি করবে সরকার। আমি স্বীকার করছি আমাদের কিছু ভুল ছিল। সেই ভুলগুলোকে বর্তমান সরকার দূর করা তো দূরে থাক, তাকে পুঁজি করে বিরোধী দলকে কী করে নির্মূল করা যায়, সেই কাজ তারা করছে। এ ব্যাপারে আপনাদের খুব বেশি সমালোচনা আমরা কিন্তু দেখি না।
প্রথম আলো: সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন চালানো ও জঙ্গিদের মদদ দেওয়ার সঙ্গে আপনাদের যেসব মন্ত্রী অভিযুক্ত ছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে বিএনপি কোনো শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে বলে আজও জানা যায় না। তাহলে বিএনপিকে কেন দেশি-বিদেশিরা এই প্রশ্নে ভরসা করবে?
মির্জা ফখরুল : অবশ্যই করবে। কারণ, এক হাজারের বেশি জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। জঙ্গিবাদকে আমরা কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেব না, সেই মনোভাব থেকেই তা করা হয়েছে। জঙ্গিবাদে আমরা বিশ্বাস করি না। জঙ্গিবাদ পুরোপুরি নির্মূল করতে হবে। কিছু লোক বিএনপিকে ভুলভাবে চিত্রিত করেছে, সেটা জামায়াতের সঙ্গে জোট থাকার কারণে করেছে। কিন্তু সেটা ন্যায্য নয়। বিএনপি সেই দল, যারা গণতন্ত্র ও বহুদলীয় ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করেছে। সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছে।
প্রথম আলো: আপনার যুক্তি আংশিক সত্য। কিন্তু এও সত্য যে এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক চরম কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থার নাগপাশ থেকে আমরা মুক্তি পাইনি। এক ব্যক্তির হাতে দল, মন্ত্রিসভা, সংসদ ও বিচার বিভাগের সর্বময় ক্ষমতা কুক্ষিগত হয়েছে। দুই দলের মধ্যে এসব নিয়ে কোনো কাজিয়া নেই।
মির্জা ফখরুল : অবশ্যই কাজিয়া আছে। আপনার সঙ্গে এ বিষয়ে একদম একমত নই।
প্রথম আলো: কিন্তু এটাই ধ্রুব সত্য যে চতুর্থ সংশোধনীতে বিচার বিভাগের যে স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছিল, তা সামরিক ফরমানে ফেরত আসেনি। বরং জিয়ার দুটি ডিক্রি শেখ হাসিনা এবারে নতুন করে পাস করলেন। বলুন এটা সত্য নয়?
মির্জা ফখরুল : আপনি বাকশালের নিন্দা করছেন না। বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তনকে প্রশংসা করছেন না। ভালো দিকগুলোর প্রশংসা না করলে অন্যগুলো কাজ করবে না। সামনের দিকে আরও এগোতে পারব না। আপনাকে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। ইউরোপ-ইংল্যান্ডে এক দিনে গণতন্ত্র আসেনি। ২৫০-৩০০ বছর লেগেছে। আমাদের একটা ভঙ্গুর ও অনিখুঁত গণতন্ত্র। কিন্তু তা অত্যন্ত প্রাণবন্ত, গতিময় ও ক্রিয়াশীল। সমগ্র বাংলাদেশি সমাজে একটি গণতান্ত্রিক চাহিদা আছে। একটা আকুতি আছে। তবে সব সময় সরকারি দলকেই সঠিক ভূমিকায় নেতৃত্ব দিতে হবে।
প্রথম আলো: তারেক রহমান কেন নির্বাসিত? স্বাস্থ্যগত কারণ যদি বলেন তাহলে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার কী হাল আপনারা করেছেন? বিদেশের মাটিতে রাজনীতি কেন? এত কিছুর পরও তিনি কেন অপরিহার্য?
মির্জা ফখরুল : বিশ্বের বহু দেশের নেতারা বিদেশে থেকে-
মির্জা ফখরুল: কুসুম তো কণ্টকে আকীর্ণ থাকে। গোলাপের চারদিকে কাটা থাকে। আঘাত তখনই আসে যখন কুসুম উপড়ানোর চেষ্টা চলে। আমাদের চেয়ারপারসন যেটা বলেছেন, সেটা দুঃখের সঙ্গে একান্ত বাধ্য হয়েই বলেছেন। ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের পর থেকেই আমরা বলি এর ফল শুভ হবে না। বিগত কয়েক মাসে আমরা কঠোর কর্মসূচি দিইনি।
প্রথম আলো: এটা কতটা উদারতা আর কতটা অপারগতা তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। অনেকে বলেন বিএনপির আন্দোলনে জনগণ সাড়া দেয়নি।
মির্জা ফখরুল: এটা আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের ভ্রান্ত ধারণা। আমরা ইতিবাচক ও সহযোগিতার রাজনীতি করতে চেয়েছি। তদুপরি আমরা সংঘাত এড়াতে সচেষ্ট। প্রধানমন্ত্রী লন্ডনে বলেছিলেন সংসদ বিলোপ করে দেওয়া হবে। ছোট মন্ত্রিসভা হবে। ইচ্ছা করলে বিরোধী দলের লোকও আসতে পারে। সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ নির্বাচন করা হবে। কিন্তু দেখা গেছে প্রধানমন্ত্রী আন্তরিক নন। নিজের কথা নিজেই বদলাচ্ছেন।
প্রথম আলো: তার মানে এটা দিলে মানবেন?
মির্জা ফখরুল: আমাদের কথাই ছিল নির্দলীয় সরকারের যেকোনো প্রস্তাব এলে তা খতিয়ে দেখব, অনমনীয় থাকব না। আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে একটা পথ বেরিয়ে আসবে। এখনো আমাদের নেত্রী সে কথাই বলে চলেছেন।
প্রথম আলো: আপনার নেত্রী দুই মহাসচিবের বৈঠক চাইছেন। কিন্তু লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তো নেই। সেটা এই অর্থে যে আপনি কেন ভারপ্রাপ্তে ভারাক্রান্ত? বিএনপির একটি কোটারি গোষ্ঠী, বিশেষ করে যাঁরা তারেক রহমানের সমর্থক, তারাই কি এটা চাইছেন না।
মির্জা ফখরুল: এটা অপপ্রচার। সম্পূর্ণরূপে ভ্রান্ত ধারণা। দলের কাউন্সিল হয়নি বলেই এটা হয়তো এখনো পূর্ণাঙ্গ হয়নি। কিন্তু এটা তো সমস্যা নয়।
প্রথম আলো: দুই মহাসচিবের মধ্যে পর্দার আড়ালে কী কথা হয়েছিল?
মির্জা ফখরুল: আমি দেশে ছিলাম না। পত্রিকায় দেখেছি একটা আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। এর চেয়ে বেশি কিছু জানি না।
প্রথম আলো: কিন্তু বিষয়টি আপনার না জানার কথা নয়। উদ্যোগটা কাদের দিক থেকে ছিল।
মির্জা ফখরুল: সম্ভবত প্রাথমিক পর্যায়ে সরকারি দল থেকেই।
প্রথম আলো: ড. গওহর রিজভীর বাসভবনে এক বা দুই দফা বৈঠক কি সত্যি হয়েছিল?
মির্জা ফখরুল: আমি তেমনটাই শুনেছি।
প্রথম আলো: তাতে দুই মহাসচিবের বৈঠকের বিষয়টি প্রাধান্য পাচ্ছিল।
মির্জা ফখরুল: সম্ভবত।
প্রথম আলো: গত মে মাসে আপনি সিঙ্গাপুরে চিকিৎসার জন্য যাওয়ার ফলে সেটা হয়নি। অন্য কেউ গিয়েছিলেন।
মির্জা ফখরুল: তাই শুনেছি। দেখুন, এ মুহূর্তে এ নিয়ে কোনো অনুমাননির্ভরতার সুযোগ নেই।
প্রথম আলো: আচ্ছা, ওই আলোচনা ভেঙে যাওয়ার জন্য শুধু আওয়ামী লীগই দায়ী?
মির্জা ফখরুল: সম্পূর্ণভাবে। আমরা যেকোনো স্থানে যেকোনো সময় আলোচনা চাই।
প্রথম আলো: সংগ্রাম কমিটি সহিংস নাকি অহিংস হবে?
মির্জা ফখরুল: অহিংস ও নিয়মতান্ত্রিক হবে।
প্রথম আলো: শেখ হাসিনাকে রেখে নির্বাচনে যাবেন না বলছেন। তাহলে কীভাবে সমঝোতা হবে। এটা কি এতটাই নির্দিষ্ট যে আপনি বলতে পারেন এটা পুরোপুরি সন্দেহাতীত সিদ্ধান্ত?
মির্জা ফখরুল : এটা একদম সন্দেহাতীত। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের কোনো সম্ভাবনাই থাকবে না, যদি কোনো আওয়ামী লীগার সরকারপ্রধান হন। আর তিনি তো আবার আওয়ামী লীগের সভানেত্রী।
প্রথম আলো: খালেদা জিয়া নির্দিষ্ট করে শুধু শেখ হাসিনার কথা বলেছেন। আপনি কি আরেকটু ব্যাপকতা দিয়ে আওয়ামী লীগের কেউ থাকতে পারবে না, এমনটাই বলছেন?
মির্জা ফখরুল : আমাদের নেত্রী বলেছেন আওয়ামী লীগের নেত্রী থাকবেন না এবং সরকারের চরিত্র হতে হবে দলনিরপেক্ষ।
প্রথম আলো: এর আগে আপনিই কিন্তু লন্ডনি প্রস্তাবের কথা বলেছিলেন। একটু আশাবাদী হচ্ছিলাম আওয়ামী লীগের কাউকে রেখেও একটা সর্বদলীয় সমাধান হতে পারে। আপনার বক্তব্য একটু স্ববিরোধী হয়ে গেল কি না?
মির্জা ফখরুল : না, হলো না। কারণ, সেই সময়টা তাঁরা পার করেছেন। এখন পর্যন্ত তাঁরা যে ভাষায় কথা বলছেন, তাতে আর সেই জায়গা থাকছে না। বরং এখন আমরা যা বলছি সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
প্রথম আলো: আপনাদের কথায় মনে হয় নির্দলীয় সরকার হলেই হবে না, নতুন নির্বাচন কমিশনও লাগবে। আরও কোনো শর্ত?
মির্জা ফখরুল : বর্তমান ইসি সক্ষম নয় মনে করি। শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন করা উচিত।
প্রথম আলো: শোনা যাচ্ছে শো অব ফোর্স হিসেবে তারা সেনাকে থানা সদরে রাখবে। এর বাইরে পাঠাবে না।
মির্জা ফখরুল : আমরা এ বিষয়ে কিছু শুনিনি। সেনারা ভোটকেন্দ্রে কোনো দিনই ছিল না। স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে ছিল। আগে যেভাবে ছিল সেভাবেই থাকতে হবে।
প্রথম আলো: নতুন ধারার রাজনীতির কথা আগেও শুনেছি। কিন্তু প্রতিহিংসার রাজনীতি বিএনপি করেছে।
মির্জা ফখরুল : আপনি দৃষ্টান্ত দেখান—
প্রথম আলো: জন্মদিনে কেক কাটা এর অন্যতম। এতে উষ্মা প্রকাশ করে মওদুদ আহমদও লিখেছেন।
মির্জা ফখরুল : মওদুদ আহমদের বই দিয়ে বিএনপির রাজনীতিকে বোঝা যাবে না। একটি দলে বিভিন্ন ধরনের লোক থাকবেন, তাঁরা বিভিন্ন ধরনের চিন্তা করবেন। কেক কাটা নিয়ে একটি অযথা ইস্যু সৃষ্টি করা হয়। এর কোনো প্রভাব আছে বলেই আমি মনে করি না। কেক কাটায় দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। এটা সহনশীলতার বিষয়। রাজনৈতিক সহনশীলতাই মুখ্য। আমাকে আপনার রাজনৈতিক চিন্তার প্রতি সহনশীল থাকতে হবে। এখন যেটা হচ্ছে, তা ব্যক্তিগত আক্রোশ। আমার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে আমি আবর্জনার ট্রাকে আগুন দিয়েছি। এটা পুরোপুরি ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে করা হয়েছে। আমার বিরুদ্ধে একটি রাজনৈতিক মামলা দেওয়া হোক। সেটা গ্রহণযোগ্য।
প্রথম আলো: ঠিক এই ধরনের মামলা আপনারাও করেছেন। ফের ক্ষমতায় গিয়েও করবেন না, সে লক্ষ্যে জনমনে আস্থা সৃষ্টিতে বা কোনো গুণগত পরিবর্তন আনতে বিএনপিকে সৎ মনে হয় না। জনগণ আপনাদের দিকে সম্ভবত সেভাবে তাকাতে পারে না।
মির্জা ফখরুল : আপনার ধারণা ভ্রান্তিপ্রসূত। বিএনপির দিকে যদি নাই তাকানো যেত তাহলে বিগত পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হতো না। অনেকে বলেন, এটা হচ্ছে নেগেটিভ ভোট।
প্রথম আলো: অনেকে নয়, বলুন এটাই বড় সত্য। গত পাঁচ বছরে বিএনপি কী করেছে? সংসদে না গেলে সরকার পড়ে না, তাহলে সংসদে যেতে তাকে কে না করেছে। আর সরকারের প্রতি অনাস্থা মানুষ কীভাবে জানাবে? পথ রেখেছেন কোন? পারলে ‘না’ ভোটের ব্যবস্থা করুন। এখানে তো আপনাদের ঐক্য আছে।
মির্জা ফখরুল : আমরা যাঁরা শিক্ষিত মানুষ বা এলিট শ্রেণী, তাঁরা মনে হয় বাংলাদেশের জনগণের নাড়ির স্পন্দন ধরতে পারি না। এর ফলে দুই রকমের চিন্তা আসে। একটা হচ্ছে ভালো কাজ কী হওয়া উচিত। তা হয়তো আমিও মানি। সাধারণ মানুষের ভেতরে আরেকটি চিন্তা কাজ করে। তারই প্রতিফলন ঘটে বিভিন্ন নির্বাচনে। সাধারণ মানুষ সাধারণভাবে কোনো ভুল করতে পারে না। এখানে মানুষ তুলনা করে। বিএনপির আমলে কেমন ছিলাম, এখন আমরা কেমন আছি। এই তুলনা করেই ভোটটা দেয়। ১০ টাকা চালের কেজি খাওয়ানোর কথা বলে এখন ৪০ টাকা চলছে। কুইক রেন্টালে বিরাট খরচা হলো। অথচ লোডশেডিং কমছে না। মানুষ নতুন বাড়িঘর করলে আর বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। পদ্মা সেতুর মতো দুর্নীতি বিএনপি আমলে হয়েছিল কি না, সেটা মানুষ চিন্তা করছে।
প্রথম আলো: আপনার হয়তো যুক্তি আছে। কিন্তু একটি বিষয় এখনো অপ্রমাণিত। নির্দলীয় সরকারের যে বড়াইটা আমরা করি, সেটা কিন্তু কোনো দলকে টানা দুবার জিতিয়ে দেয়নি। বিরোধী দলের কাছেই ক্ষমতা হস্তান্তর এর কৃতিত্ব।
মির্জা ফখরুল : এটা কিছুটা নেতিবাচক চিন্তাপ্রসূত এবং সরলীকরণ। বিষয়টা ভিন্ন জায়গায়। সরকারি দলই থাকে চালকের আসনে। তাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হয় গণতন্ত্রকে তারা কোথায় নিয়ে যাবে। সাইবার অ্যাক্টের সংশোধন হলো। এখন আপনি বলুন এটা কীভাবে মুক্তচিন্তাকে সাহায্য করবে?
প্রথম আলো: পরিহাসটা সেখানেই, ২০০৬ সালে এই আইনের ৫৭ ধারায় যে উদ্ভট কালাকানুন আপনারা পাস করেছিলেন, ক্ষমতাসীনেরা তা বাতিল না করে আরও খারাপ করেছে। আপনাদের তো সে কারণেই এক পাল্লায় মাপি।
মির্জা ফখরুল : আজ যদি আওয়ামী লীগ সেটা পরিবর্তন করত তাহলে সেটাই হতো ইতিবাচক। কোনো আইনেই আজ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ কোনো ইতিবাচক দিক নিয়ে আসেনি। যেমন বিশেষ ক্ষমতা আইন।
প্রথম আলো: একদম ঠিক বলেছেন। আপনারা বাতিল করেননি। বিচার বিভাগ পৃথক্করণ আপনারা দেননি। বাহাত্তরের রাষ্ট্র গঠন ত্রুটি না শুধরিয়ে আপনারা একসঙ্গে চলছেন—
মির্জা ফখরুল : এ বিষয়গুলো শুরু করতে হবে। আমরা বিরোধী দল থেকে ইতিবাচক দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছি। তাই বলছি, আমরা সরকার গঠন করতে পারলে সব বিষয়কে অত্যন্ত ইতিবাচকভাবে দেখার চেষ্টা করব।
প্রথম আলো: ১৫ আগস্টে কেক কাটা না হয় ব্যক্তিগত, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলাকে কী বলবেন। এই জঘন্য অপরাধের বিশ্বাসযোগ্য উপায়ে তদন্ত ও বিচার-প্রক্রিয়া চালু করতে আপনারা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
মির্জা ফখরুল : এর পরের পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাকে বলতে দিন। এবার তিনটি অভিযোগপত্র পরিবর্তন করা হলো। নতুন আইও নিয়োগ করা হলো।
প্রথম আলো: আপনি বিএনপির ব্যর্থতা ব্যাখ্যা করুন। আপনি কিন্তু আওয়ামী লীগের সমালোচনায় গেলেন।
মির্জা ফখরুল : স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের লোক এসেছিল। তারা তদন্তের চেষ্টা করেছে। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী কোনো সহযোগিতা দেননি। সে সময়ে আমরা তাদের সহযোগিতা পেতে বিভিন্ন রকম চেষ্টা চালিয়েছি, সেটা পাইনি। যাঁরা এর দায়িত্বে ছিলেন, সে ক্ষেত্রে তাঁরা কিছু কিছু ভুল করে থাকতে পারেন। তাঁদের হয়তো বিচ্যুতি ঘটেছে।
প্রথম আলো: সে জন্য আপনাদের কোনো অনুশোচনা নেই। আওয়ামী লীগের কাছে কোনো ক্ষমা প্রার্থনা নেই। যদি নতুন ধারা বলতে শুভ কিছু বোঝাতে চান, তাহলে এটা বাদ দিয়ে হবে না। সমঝোতার এই পথে আসতে হবে।
মির্জা ফখরুল : সেই সমঝোতা বা রিকন্সিলিয়েশন তখনই হবে, যখন আপনি আমাকে দায়ী করবেন না। আপনি আমাদের দলের নেতাকে (তারেক রহমান) সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে তৃতীয় দফায় দেওয়া অভিযোগপত্রে অভিযুক্ত করছেন। আমাদের ভুলত্রুটি শুধরানোর সুযোগটা সৃষ্টি করবে সরকার। আমি স্বীকার করছি আমাদের কিছু ভুল ছিল। সেই ভুলগুলোকে বর্তমান সরকার দূর করা তো দূরে থাক, তাকে পুঁজি করে বিরোধী দলকে কী করে নির্মূল করা যায়, সেই কাজ তারা করছে। এ ব্যাপারে আপনাদের খুব বেশি সমালোচনা আমরা কিন্তু দেখি না।
প্রথম আলো: সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন চালানো ও জঙ্গিদের মদদ দেওয়ার সঙ্গে আপনাদের যেসব মন্ত্রী অভিযুক্ত ছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে বিএনপি কোনো শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে বলে আজও জানা যায় না। তাহলে বিএনপিকে কেন দেশি-বিদেশিরা এই প্রশ্নে ভরসা করবে?
মির্জা ফখরুল : অবশ্যই করবে। কারণ, এক হাজারের বেশি জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। জঙ্গিবাদকে আমরা কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেব না, সেই মনোভাব থেকেই তা করা হয়েছে। জঙ্গিবাদে আমরা বিশ্বাস করি না। জঙ্গিবাদ পুরোপুরি নির্মূল করতে হবে। কিছু লোক বিএনপিকে ভুলভাবে চিত্রিত করেছে, সেটা জামায়াতের সঙ্গে জোট থাকার কারণে করেছে। কিন্তু সেটা ন্যায্য নয়। বিএনপি সেই দল, যারা গণতন্ত্র ও বহুদলীয় ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করেছে। সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছে।
প্রথম আলো: আপনার যুক্তি আংশিক সত্য। কিন্তু এও সত্য যে এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক চরম কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থার নাগপাশ থেকে আমরা মুক্তি পাইনি। এক ব্যক্তির হাতে দল, মন্ত্রিসভা, সংসদ ও বিচার বিভাগের সর্বময় ক্ষমতা কুক্ষিগত হয়েছে। দুই দলের মধ্যে এসব নিয়ে কোনো কাজিয়া নেই।
মির্জা ফখরুল : অবশ্যই কাজিয়া আছে। আপনার সঙ্গে এ বিষয়ে একদম একমত নই।
প্রথম আলো: কিন্তু এটাই ধ্রুব সত্য যে চতুর্থ সংশোধনীতে বিচার বিভাগের যে স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছিল, তা সামরিক ফরমানে ফেরত আসেনি। বরং জিয়ার দুটি ডিক্রি শেখ হাসিনা এবারে নতুন করে পাস করলেন। বলুন এটা সত্য নয়?
মির্জা ফখরুল : আপনি বাকশালের নিন্দা করছেন না। বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তনকে প্রশংসা করছেন না। ভালো দিকগুলোর প্রশংসা না করলে অন্যগুলো কাজ করবে না। সামনের দিকে আরও এগোতে পারব না। আপনাকে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। ইউরোপ-ইংল্যান্ডে এক দিনে গণতন্ত্র আসেনি। ২৫০-৩০০ বছর লেগেছে। আমাদের একটা ভঙ্গুর ও অনিখুঁত গণতন্ত্র। কিন্তু তা অত্যন্ত প্রাণবন্ত, গতিময় ও ক্রিয়াশীল। সমগ্র বাংলাদেশি সমাজে একটি গণতান্ত্রিক চাহিদা আছে। একটা আকুতি আছে। তবে সব সময় সরকারি দলকেই সঠিক ভূমিকায় নেতৃত্ব দিতে হবে।
প্রথম আলো: তারেক রহমান কেন নির্বাসিত? স্বাস্থ্যগত কারণ যদি বলেন তাহলে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার কী হাল আপনারা করেছেন? বিদেশের মাটিতে রাজনীতি কেন? এত কিছুর পরও তিনি কেন অপরিহার্য?
মির্জা ফখরুল : বিশ্বের বহু দেশের নেতারা বিদেশে থেকে-
প্রথম আলো: আপনার এই বহু দেশ মানে ভালো উদাহরণের দেশ নয়, যাকে বলে তৃতীয় বিশ্বের—
মির্জা ফখরুল: আমাকে বলতে দিন, না দিলে
তো হবে না। আপনি তো মুক্তচিন্তার মানুষ, আমাকে সুযোগ দিতে হবে। তৃতীয়
বিশ্বের দেশে এটা হয়, কারণ সেখানে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হতে হয়। থাই
প্রধানমন্ত্রী থাকসিনকে দেশের বাইরে থাকতে হয়েছে। বেনজির ভুট্টোকে বাইরে
থাকতে হয়েছে। নেতাজি সুভাষ বসুকেও দেশ ছাড়তে হয়েছে। তারেক রহমানের
স্বাস্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো ন্যায়সংগত কারণ নেই। তিনি সত্যিই অসুস্থ।
এক-এগারোর পর তাঁর ওপর যে নির্যাতন চলেছে, তাতে তাঁর শরীরের যথেষ্ট ক্ষতি
হয়েছে। তিনি আমাদের সিনিয়র নেতা। তিনি তাঁর উন্নয়ন ভাবনা বিদেশে বসে বলতেই
পারেন। এর সমালোচনা করার কোনো কারণ আছে বলে আমার মনে হয় না। জয় যখন দেশে
এলেন, তখন তিনি ফুলের তোড়া পাঠিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত
গণমাধ্যমের একটি অংশ এ বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখে না। শুধু নেতিবাচক
দিকগুলো নিয়ে কথা বলা হয়।
প্রথম আলো: তারেক রহমানের নেতৃত্ব
প্রশ্নে আপনাকে অনেক সময় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখা যায়। একজন বর্ষীয়ান ও
অভিজ্ঞ রাজনীতিক হিসেবে আপনি যা বলেন, তিনি কি এর যোগ্য? অনেকে এটাকে
সুনজরে দেখেন না, এমনকি তোষামোদি ভাবেন।
মির্জা ফখরুল: আমি যা বলি তা সততার
সঙ্গেই বলি। তারেক রহমানের নেতৃত্বের সেই যোগ্যতা আছে। তাঁর প্রতি আমার এবং
আমাদের দলের গভীর আস্থা আছে। আমি কৃষক দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকার সময়ে
কৃষি ও কৃষকের প্রতি তাঁর অনুরাগ দেখেছি। এখন এ বিষয়ে তিনি আরও অভিজ্ঞ ও
চিন্তাশীল হয়ে উঠেছেন।
প্রথম আলো: ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ নির্বাচন ঠেকাতে পারেনি, বিএনপি কেন পারবে?
মির্জা ফখরুল: এটা একটা আন্দোলনের প্রক্রিয়া। এই দাবিতে বাংলাদেশের সব মানুষ এবার একমত।
প্রথম আলো: সাম্প্রতিক প্রবণতা হচ্ছে দুই
নেত্রী সরাসরি পরস্পরকে সম্বোধন করে বক্তব্য রাখছেন। একজন এক-এগারো স্মরণ
করিয়ে দিচ্ছেন। অন্যজন ভরসা দিচ্ছেন। সুতোহীন সমঝোতা?
মির্জা ফখরুল: কীভাবে আপনাদের এমন ধারণার
মূল্যায়ন করব জানি না। শুধু বলব, আপনাদের অসাধারণ ক্ষমতা আছে এ রকমের
চিন্তাভাবনা করার। এ ধরনের কোনো বিষয় নয়। দুই নেত্রীকে এক করারও কোনো কারণ
দেখি না। দুজনের ভিন্ন চিন্তা, কার্যপ্রণালিও আলাদা।
প্রথম আলো: বিএনপির কোনো সাবেক মন্ত্রী,
বিশেষ করে খালেদা জিয়ার পরিবারের কারও চূড়ান্ত বিচার তারা করেনি। পারলে
তথ্য দিন, কতজন চূড়ান্তভাবে দোষী সাব্যস্ত হয়ে দুর্নীতির দায়ে জেল খাটছেন।
ওই একই ভরসা আসলে আপনারা আওয়ামী লীগকে দিচ্ছেন!
মির্জা ফখরুল: তার প্রয়োজন নেই। আমি প্রমাণ দিচ্ছি। তাদের মামলাগুলো তারা সব প্রত্যাহার করেছে। আমাদের কোনো মামলা তারা প্রত্যাহার করেনি।
প্রথম আলো: আপনি প্রমাণ করতে পারেননি। আপনি যেটা প্রমাণ করেছেন সেটা হলো আপনাকে হয়রানি করার উপায় তারা খোলা রেখেছে। এটাই খেলা।
মির্জা ফখরুল: না, এটাই আসল পয়েন্ট। তারা
আমাদের হয়রানি করতে চায়, বিপদে ফেলতে চায়। এক-এগারো সরকার তারেক রহমানকে
গ্রেনেড মামলায় অভিযুক্ত করেনি। আওয়ামী লীগ করেছে। সুতরাং আপনার এই
পর্যবেক্ষণ সঠিক নয়।
প্রথম আলো: মির্জা ফখরুল সাহেবকে জেলে
পুরেছি। মিথ্যা মামলা দিয়েছি। হয়রানি করেছি। কিন্তু দুর্নীতির দায়ে কাউকে
দোষী সাব্যস্ত করিনি। ফিরতিটাও সেভাবে হবে।
মির্জা ফখরুল: এ বিষয়গুলোকে আপনারা
যেভাবে দেখেন, আমরা যাঁরা রাজনীতি করি, সেভাবে দেখি না। আমরা যখন কেবল
রাজনীতি করার কারণে জেলে যাই, তখন এভাবে ভাবতে পারি না। ইলিয়াস আলীর সন্তান
প্রতিদিন এখনো দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কখন বাবা ফিরবে। এটাই
বাস্তবতা। এই রাজনীতি থেকে কি বেরিয়ে আসার কোনো পথ নেই?
প্রথম আলো: ন্যূনতম ঐক্যের ভিত্তি কী হতে পারে?
মির্জা ফখরুল: একটাই, সেটা সহনশীলতা।
কাউকে জঙ্গিবাদী বানাব না বা অমুক দেশের পক্ষে-বিপক্ষে কাজ করছেন বলব না।
আমি সহনশীল হব আপনার মতাদর্শের প্রতি। মুক্তচিন্তা ও সহনশীলতাকে বিকশিত হতে
দিন। এবার আওয়ামী লীগের প্রচণ্ড সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু তারা চালকের আসনে
বসতে পারেনি। তাদের প্রতিহিংসা বাদ দিতে হবে।
প্রথম আলো: শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগেরও অন্য কাউকে রেখে আপনারা তাহলে আপস করবেন না। নির্বাচনে যাবেন না।
মির্জা ফখরুল: না, আমরা নির্বাচনে যাব না।
প্রথম আলো: আর সংসদের ভেতরে বা বাইরে
বিএনপি আমাদের বলবেও না যে তারা সংবিধানের কী ধরনের সংশোধন চায়? কীভাবে
নির্দলীয় সরকার হবে, তার কোনো নির্দিষ্ট রূপরেখাও নয়?
মির্জা ফখরুল: না, সেটা নয়। সরকার যদি আমাদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হয়, তাহলেই আমরা সেটা বিবেচনা করব। তার আগে নয়। কারণ, তা হবে অর্থহীন।
------------------------
জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নির্বাচন ও আন্দোলনগত জোট
নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রশ্নে বিএনপির
রাজনৈতিক অবস্থান নিয়েও বিতর্ক আছে। প্রথম আলোকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জামায়াতের রাজনীতি,
যুদ্ধাপরাধের বিচারসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকারটির দ্বিতীয় ও
শেষ কিস্তি...
প্রথম আলো: এর আগে আপনারা দুই জামায়াতিকে মন্ত্রী করেছিলেন, এবার কতজনকে করবেন? হেফাজতকেও কি মন্ত্রিত্ব দেবেন?
মির্জা ফখরুল: রাজনীতিকদের পক্ষে আগাম অনুমাননির্ভর উত্তর দেওয়া কঠিন। ২০০১ সালে জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনী জোট ছিল। এখনকার ১৮-দলীয় মোর্চা মূলত আন্দোলনের জোট।
প্রথম আলো: নির্বাচনগত জোট, আন্দোলনগত জোট, ’৯১-এ কি সরকারগত জোট ছিল?
মির্জা ফখরুল: ১৯৯১-এ তাদের নিয়ে সরকার করিনি। আপনি ভুল বলছেন।
প্রথম আলো: জামায়াতের সমর্থনেই আপনারা সরকার করেছিলেন। একে ছাড়া আপনাদের চলে না।
মির্জা ফখরুল: সমর্থন তো আরও অনেকেই পেয়েছে। তাদের সমর্থনে আওয়ামী লীগ আমাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। রাজনীতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন মেরুকরণ ঘটে। হেফাজত রাজনৈতিক দল নয়। তাদের সঙ্গে জোটের প্রশ্নই নেই। অন্য কিছু ইসলামি দলের সঙ্গে বিভিন্ন সময় জোট হয়েছে। এর আগে আওয়ামী লীগও তা করেছে। তারা চুক্তি পর্যন্ত করেছিল। তবে এ ধরনের জোট ভারতে, পাশ্চাত্য ও ইউরোপে আপনি দেখবেন।
প্রথম আলো: একটি যুদ্ধাপরাধী সংগঠনের সঙ্গে আপনারা কৌশলগত ঐক্য করেই চলবেন, নাকি একে ঠেকাতে একটি নীতিগত অবস্থান নেবেন?
মির্জা ফখরুল: এর সাদামাটা উত্তর দেওয়া সহজ নয়। প্রধানমন্ত্রী নিজেই যুক্তরাষ্ট্রে এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, আমি একটি রাজনৈতিক দল হয়ে আরেকটি রাজনৈতিক দলকে কীভাবে নিষিদ্ধ করব? একাত্তরের ভূমিকায় তারা আছে কি না। আজকের জামায়াতে যুদ্ধাপরাধীরাই আছেন, নাকি অন্যরাও আছেন। তাদের সঙ্গে যখন আমাদের ঐক্য হবে, তখন তা শুধুই মতাদর্শগত হবে, সে ধারণা তো ঠিক নয়। হাসিনা-এরশাদ বা দিলীপ বড়ুয়ার সাম্যবাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কি আদর্শগত ঐক্য চলে? ভারতেও দেখবেন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে মুসলিম লিগের জোট হচ্ছে।
মির্জা ফখরুল: রাজনীতিকদের পক্ষে আগাম অনুমাননির্ভর উত্তর দেওয়া কঠিন। ২০০১ সালে জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনী জোট ছিল। এখনকার ১৮-দলীয় মোর্চা মূলত আন্দোলনের জোট।
প্রথম আলো: নির্বাচনগত জোট, আন্দোলনগত জোট, ’৯১-এ কি সরকারগত জোট ছিল?
মির্জা ফখরুল: ১৯৯১-এ তাদের নিয়ে সরকার করিনি। আপনি ভুল বলছেন।
প্রথম আলো: জামায়াতের সমর্থনেই আপনারা সরকার করেছিলেন। একে ছাড়া আপনাদের চলে না।
মির্জা ফখরুল: সমর্থন তো আরও অনেকেই পেয়েছে। তাদের সমর্থনে আওয়ামী লীগ আমাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। রাজনীতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন মেরুকরণ ঘটে। হেফাজত রাজনৈতিক দল নয়। তাদের সঙ্গে জোটের প্রশ্নই নেই। অন্য কিছু ইসলামি দলের সঙ্গে বিভিন্ন সময় জোট হয়েছে। এর আগে আওয়ামী লীগও তা করেছে। তারা চুক্তি পর্যন্ত করেছিল। তবে এ ধরনের জোট ভারতে, পাশ্চাত্য ও ইউরোপে আপনি দেখবেন।
প্রথম আলো: একটি যুদ্ধাপরাধী সংগঠনের সঙ্গে আপনারা কৌশলগত ঐক্য করেই চলবেন, নাকি একে ঠেকাতে একটি নীতিগত অবস্থান নেবেন?
মির্জা ফখরুল: এর সাদামাটা উত্তর দেওয়া সহজ নয়। প্রধানমন্ত্রী নিজেই যুক্তরাষ্ট্রে এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, আমি একটি রাজনৈতিক দল হয়ে আরেকটি রাজনৈতিক দলকে কীভাবে নিষিদ্ধ করব? একাত্তরের ভূমিকায় তারা আছে কি না। আজকের জামায়াতে যুদ্ধাপরাধীরাই আছেন, নাকি অন্যরাও আছেন। তাদের সঙ্গে যখন আমাদের ঐক্য হবে, তখন তা শুধুই মতাদর্শগত হবে, সে ধারণা তো ঠিক নয়। হাসিনা-এরশাদ বা দিলীপ বড়ুয়ার সাম্যবাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কি আদর্শগত ঐক্য চলে? ভারতেও দেখবেন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে মুসলিম লিগের জোট হচ্ছে।
প্রথম আলো: জেনারেল এরশাদের সঙ্গে জোট গঠনের সম্ভাবনা কতটুকু?
মির্জা ফখরুল: যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। আন্দোলনে তাদের শামিল হতে বলছি। এখানে পার্থক্যটা বুঝতে হবে। আমরা কেবল আন্দোলনের কথা বলছি।
প্রথম আলো: খালেদা-এরশাদ বৈঠক আসন্ন?
মির্জা ফখরুল: এটা তো এখন বলা সম্ভব নয়। যখন বাস্তবে রূপ নেবে তখন জানবেন।
প্রথম আলো: দুই দলের মধ্যে শাসনগত তফাত দেখি না।
মির্জা ফখরুল: আমরা যারা উদারনৈতিক
সংসদীয় গণতান্ত্রিক দল, তাদের মধ্যে আপনি যথেষ্ট মতাদর্শগত তফাত পাবেন না।
যেটা থাকে নীতিনির্ধারণী বিষয়। কংগ্রেস ও বিজেপি তাদের নিজ নিজ ইশতেহার
নিয়েই রাজনীতি করছে।
প্রথম আলো: তবে বিএনপি নেতৃত্বের হাল এখন এমনই যে দলটির চেহারা যেন জামায়াতি জঙ্গিত্ব ঢেকে ফেলেছে।
মির্জা ফখরুল: এখানে বোধ হয় আপনার
মন্তব্য একটু একপেশে হয়ে যাবে। কারণ, জামায়াত যে জঙ্গিত্ব দেখিয়েছে তা তার
কর্মসূচিতে দেখিয়েছে। ১৮ দলের কর্মসূচিতে ওই ধরনের কোনো জঙ্গিত্ব দেখানো
হয়নি।
প্রথম আলো: বিএনপি জামায়াতি সহিংসতার নিন্দা করতে ব্যর্থ হয়েছে।
মির্জা ফখরুল: আমরা ইচ্ছা করেই নিন্দা
করিনি। দেখতে হবে জামায়াত কখন ওই পথে গেছে। যখন জামায়াতের অধিকারগুলোকে
আপনি খর্ব করেছেন, তাকে অফিসে যেতে দেননি, অফিসে তালা দিয়েছেন, সভা-মিছিল
করতে দেননি। জামায়াতের কথা বাদ দিন। বিএনপির অফিসের সামনে থেকে প্রতিদিন
লোক ধরে নিয়ে যাচ্ছে। বিএনপির মিছিলের ওপর গুলি চলেছে। এটা কোন ধরনের
গণতন্ত্র?
প্রথম আলো: এর পরও হয়তো বলা যায় বিএনপি ঠিক জামায়াতের পথে যায়নি।
মির্জা ফখরুল: জামায়াতের সঙ্গে যদি
বিএনপিকে সব সময় তুলনা করেন তাহলে কিন্তু ভুল করা হবে। বিএনপির গঠন ও
জামায়াতের গঠন এক নয়। জামায়াতের মতাদর্শগত অবস্থানের সঙ্গেও বিএনপির মিল
নেই। আমরা একটি উদারনৈতিক রাজনৈতিক দল। আমরা কোনো বিপ্লবী দলও নই।
প্রথম আলো: যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার হওয়া উচিত কি না?
মির্জা ফখরুল: যে জামায়াত একাত্তর সালে
যখন স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, যারা করেছে আপনি সেটাকে বলতে পারেন।
কিন্তু সেই জামায়াত আর এই জামায়াত তো এক নয়। জামায়াতকে আপনি এ দেশে রাজনীতি
করতে দিয়েছেন। তাহলে তার রাজনৈতিক অধিকারগুলো সমর্থন করবেন না? তাহলে তো
জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে দিতে হবে।
প্রথম আলো: জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা তাহলে আপনি সমর্থন করেন?
মির্জা ফখরুল: না, এটা সমর্থন করার
প্রশ্ন নয়। সরকার যদি মনে করে এখানে জামায়াতের রাজনীতি করার প্রয়োজন নেই,
তাহলে নিষিদ্ধ করে দিক, তারা কেন করছে না? কারণ, এটা গণতন্ত্রের মৌলিকত্বের
পরিপন্থী।
প্রথম আলো: জামায়াতের অন্যদের বাদ দিয়ে
সেই বুদ্ধিজীবী ঘাতক বাহিনীর প্রধানকেই তো মন্ত্রী করেছেন। তাহলে সেই
জামায়াত ও এই জামায়াতের যুক্তি দিয়ে লাভ কী? আপনার অবস্থান স্ববিরোধী নয়
কি?
মির্জা ফখরুল: আপনি রাজনীতি করলে
বাস্তবতা মেনে রাজনীতি করতে হবে। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় আপনাকে আসতে হবে।
তারা একটি নিবন্ধিত দল। জামায়াতের সংসদে ধারাবাহিক প্রতিনিধিত্ব রয়েছে।
আওয়ামী লীগ তাদের নিয়ে রাজনীতি করেছে। সব রাজনীতিকই তাদের পক্ষে বা বিপক্ষ
নিয়ে রাজনীতি করেছেন। জামায়াত বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন একটি বাস্তবতা। তাই
তাদের সঙ্গে রাজনীতি করাটাকে একেবারেই নেতিবাচক দেখাটাকে আমি যুক্তিসংগত
মনি করি না। রাশেদ খান মেনন ও হাসানুল হক ইনু, নিজামী ও মুজাহিদকে নিয়ে
রাজনীতি করেছেন। শেখ হাসিনা করেছেন। সেসবের অনেক ছবি আছে। আমরা সবাই সেই
বাস্তবতা মেনে নিয়ে রাজনীতি করছি। আমি বিষয়টিকে সেভাবে দেখতে চাই।
গণতন্ত্রকে বিভিন্ন ধরনের মতবাদের মধ্য দিয়ে চলতে হবে।
প্রথম আলো: তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার
এগিয়ে নেওয়াসংক্রান্ত বিএনপির বক্তব্য শুধুই কথার কথা। কোনো আদর্শগত বিষয়
বলে কিছু থাকবে না? এটা এমনই একটা ফেলনা বিষয়?
মির্জা ফখরুল: এতটা আবেগপ্রবণ হয়ে
কিন্তু বিষয়গুলো বিচার করা যাবে না। রাজনীতি ক্রূর, একটি কঠিন বাস্তবতা। আর
আমরা যদি এখন সারাক্ষণই এই ইস্যু নিয়ে থাকি, তাহলে তো কাজের কাজ কিছু করা
যাবে না। অতীত-ক্লিষ্টতা থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারি।
প্রথম আলো: শাহবাগের পরেও এ কথা?
মির্জা ফখরুল: সাধারণ মানুষের মধ্যে
শাহবাগ তেমন প্রভাব ফেলেনি, এটাই বাস্তবতা। আপনি আজকের ভিয়েতনামের দিকে
তাকান। নয় বছর ধরে ভিয়েতনামে যুদ্ধ করেছে আমেরিকা। কিন্তু আজ সেখানে
আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলছে না। বরং আমেরিকাকে সঙ্গে নিয়ে তারা দেশকে
এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আজ দারিদ্র্য ও অনুন্নয়নকে অগ্রাধিকারের
জায়গায় রাখতে হবে। কিন্তু অতীতকাতর থাকলে এই বিষয় অগ্রাধিকার পাবে না।
মনোযোগের বাইরে চলে যাবে। শুধু তাত্ত্বিক হলে চলবে না, আপনাকে বাস্তবসম্মত
হতে হবে। গান্ধীজিকে যারা হত্যা করেছিল, তাদের দল কিন্তু অনেক সময় ভারতে
সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছে। তার মানে কি এই যে তারা কেউ ভারতের
পক্ষে নয়, বিপক্ষে?
প্রথম আলো: যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বিএনপির ওয়াদা তাহলে বাস্তবতা নয়?
মির্জা ফখরুল: আমরা কিন্তু অস্বীকার করি না যে ওই সময় যাঁরা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছেন, তাঁদের বিচার আমরা করব না।
প্রথম আলো: নিজামীরা না হলে তাঁরা কারা?
মির্জা ফখরুল: তাঁরা যাঁরাই হোক,
ন্যায়বিচার করা হবে। কারণ, সবারই ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। আজকে যে
তরুণ জামায়াত করছে, তাকে কি আপনি যুদ্ধাপরাধী বলবেন?
প্রথম আলো: নিশ্চয় না। কিন্তু এটা কি
বলা সম্ভব এখন যাঁদের ফাঁসির রায় হয়েছে, তাঁরা কি মার্জনা পাবেন? কারণ,
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলই ফাঁসির আসামিকে খালাস দিতে সিদ্ধহস্ত।
মির্জা ফখরুল: এ কথা আমাদের ওপর চাপিয়ে
দিচ্ছেন কেন? এ কথা তো আমরা কখনোই বলিনি। আমরা সব সময় বলেছি, যারা মানবতার
বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে, তাদের বিচার আমরা চাই। কোনটা চাই? ন্যায়বিচার চাই।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক নয়। যে প্রক্রিয়ায় বিচার করা হচ্ছে, যা নিয়ে বিদেশেও
প্রশ্ন উঠেছে, আমরা সেই প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছি। অনেক নিম্নমানের
বিচার হচ্ছে।
প্রথম আলো: বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে বিচ্ছিন্নতায় মদদ বা ১০ ট্রাক অস্ত্রের মতো ঘটনায় ভারতের নিরাপত্তা-উদ্বেগ ছিল। এবার?
মির্জা ফখরুল: ভারতের বিরুদ্ধে কখনোই
বিএনপির কোনো বিদ্বেষ ছিল না। উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদ কিংবা ১০
ট্রাক অস্ত্রের যে কথা বললেন, তার সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পর্ক নেই। হতে
পারে অন্যের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক আছে। কিন্তু বিএনপির কোনো সম্পর্ক নেই।
আমরা সমস্যার কথা বলেছি। তিস্তা নদীর পানি চেয়েছি। টিপাইমুখ বাঁধ হলে ভয়ের
কথা বলেছি। ট্রানজিট দিলে কী পাব, সেটা বলেছি। তবে প্রতিদিন সীমান্তে লোক
মরবে, আমরা কিছু বলব না, সেটা কিন্তু হতে পারে না। পারস্পরিক সমস্যার
সমাধান করা দরকার।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
মির্জা ফখরুল: ধন্যবাদ।
No comments