ফয়সালা একটা হবেই by বদিউর রহমান
সব
কিছুর নাকি একটা মৌসুম থাকে। মৌসুমে রমরমা ব্যাপার ঘটে। আমের মৌসুমে আম,
ইলিশের মৌসুমে ইলিশ, ভোটের মৌসুমে ভোট ইত্যাদির নাকি ভালো কদর হয়, কমবেশি
সবাই অল্পস্বল্প হলেও ভাগ পায়, আবার সুযোগ বুঝে কেউ কেউ দা-ও মারতে পারে।
মনে পড়ে, আমাদের এলাকায় ছোট্টকালে গাঙ-ভাঙানোর মৌসুমে আমরা ছোটরাও দু’চারটা
মাছ পেয়ে যেতাম। গ্রামীণ জনপদে গাঙের অর্থাৎ নদীর পানি কমে গেলে
চৈত্র-বৈশাখের দিকে আশপাশের কয়েক গ্রামের শত শত লোক মাছ ধরার হরেক রকম
হাতিয়ার নিয়ে একসঙ্গে পুরো নদীর বিভিন্ন অংশে একজোটে মাছ ধরায় লেগে যেত এবং
এ মহাযজ্ঞকেই গ্রামে গাঙ-ভাঙানো বলা হতো। শত শত, কখনও কখনও হাজার হাজার
লোকের একসঙ্গে বিভিন্নভাবে মাছ ধরায় লেগে যাওয়ায় বেচারা মাছরা লুকানোর
জায়গা পেত না। জালে আটকা পড়ল না তো পোলোতে পড়ে গেল, কেউবা হাতে ধরা পড়ল,
কোনোটি বা পায়ের তলায়ও। আমরা ছোটরাও তখন মেনি, বাইলা অন্তত হাতেই ধরতে
পারতাম। সেই গাঙ-ভাঙানোর মৌসুম এখন আর চোখে পড়ে না। তবে দেশে এখন রাজনীতির
একটা ভরা-মৌসুম যেন চোখের সামনে। ভোট এলো-এলো অবস্থায়। অথচ শংকাও নাকি কম
নয়। একজনের একচুলও না নড়া আর আরেকজনের নির্দলীয় সরকার ছাড়া ভোটে না-যাওয়ার
বা ভোট হতে না দেয়ার আপসহীন সংকল্পের মাঝে সে কী এক রমরমা রাজনীতির মৌসুম
এখন! এ সুযোগে অনেকেই রাজনীতির বোদ্ধা হয়ে উঠছেন, কেউ সভা-সেমিনারে, কেউবা
আবার টকশোতে, কিংবা কেউ কেউ নিদেনপক্ষে পত্রিকার কলামে। এ ভরা মৌসুমে
একটু-আধটু রাজনীতিবিদ হওয়া যেমন সহজ, তেমনি কেউ কেউ লেখক হওয়াও সহজ মনে
করছেন। কতজনের কত বুদ্ধি, কত যুক্তি, কত ফর্মুলা, কত কত আঁতলামি! দেশ নিয়ে
একেকজনের কত যে চিন্তা, কত যে আশংকা! এদের সবার ধারণা যেন হাসিনা আর
খালেদাই কেবল বেয়াকুব, এ দুজনের যেন কোনো মাথাব্যথা নেই, কোনো দুশ্চিন্তা
নেই, তারা যেন নির্বিকার! ভাবটা যেন যার বিয়ে তার খবর নেই, পাড়া-পড়শীর ঘুম
নেই। আমি ব্যক্তিগতভাবে দেশের বর্তমান অবস্থায় জ্ঞানী-গুণীদের এমনতরো
হালচাল নিয়ে, শংকা নিয়ে, আশংকা নিয়ে, অযাচিত হতাশা নিয়ে মোটেই চিন্তিত নই,
বিচলিত নই, এমনকি আগেও ছিলাম না। আশাবাদী মানুষ হিসেবে আমি বর্তমান
রাজনৈতিক অবস্থাকেও সহজভাবে গ্রহণ করি। আচ্ছা, আমাদের এখনকার অবস্থা কি
’৭৫-এর ১৫ আগস্ট থেকেও ভয়াবহ? এটা কি ’৮১-এর ৩০ মে থেকেও খারাপ? এখন কি
’৮২-এর ২৪ মার্চ থেকেও নাজুক অবস্থায় আছি আমরা? এসব মারাÍক অবস্থা কাটিয়ে
ওঠার পর আমরা ’৯০-এর ৬ ডিসেম্বর দেখেছি, ২১ আগস্ট জঘন্য গ্রেনেড হামলা
পেয়েছি, একযোগে ৬৩ জেলায় বোমাবাজি হজম করেছি, আরও কত কী! অতএব হতাশার কিছু
নেই।
কিন্তু মৌসুমটাতে গোটা ৪০ থেকে ৫০ জন জ্ঞানী-গুণী-আঁতেল যেভাবে একই সুরে ঘ্যানর-ঘ্যানর করে চলেছেন, যেভাবে আলী-বাজাদ’র নেতারা সারাক্ষণ রাজনীতির একসুরে একতারা বাজিয়ে আমাদের বিরক্তি চরমে নিয়ে যাচ্ছেন তাতে আমরা বড় অস্বস্তিবোধ করছি। ভোট এখনও হয়নি, হবে-হবে অবস্থায়; আর এখনই কেউ বলে ফেলছেন আদৌই ভোট হবে কি না সন্দেহ। কেউ বা বলছেন এত তারিখের মধ্যে ‘এটা’ করা না হলে সরকার পতনের এক ঝড় বইবে। খালেদা জিয়া গত পৌনে পাঁচ বছর তো সরকারকে যথেষ্ট পর্যবেক্ষণ করেছেন, বছর দুয়েক পর থেকে তো গরম গরম হুংকার দিয়েই চলেছেন, বিশেষত পঞ্চদশ সংশোধনীর পর থেকে তো তার নিজের আগের অবস্থানের বিপরীতে তত্ত্বাবধায়কের জন্য উঠেপড়ে লেগেই আছেন। এখন পাগল আর শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নন এমন তিনি ভাবেন না। চতুর্দশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক প্রধান নিজেদের পছন্দের করার জন্য যে বিচারপতির বয়স বাড়ানো হল- সেটাও ভুলে গেলেন। আর হাসিনা হলেন তার উল্টো, এখন তিনি গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের রায়কে পুঁজি করে সংবিধানকে আরও কঠোর করে সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়কের বিলুপ্তি ঘটান। এর নামই নাকি রাজনীতি! এ ইস্যুতে আমাদের দুজনের বক্তব্যের প্রতিই শ্রদ্ধাশীল হতে হয়। সংবিধানের অধীনে দুজনের জেদ রক্ষা হলে আমাদের কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। যদি কারও জেদ কমে কিংবা কেউ অবস্থা বুঝে ছাড় দিতে শেষ পর্যায়ে হলেও সমঝোতায় আসেন তা তো ভালো, আমরা খুশি হব। তাও যদি শেষ পর্যন্ত না হয় তাহলেও তো একটা সমাধান হবে, নাকি? আমরা কি ২০০৭-এর ২২ জানুয়ারির নির্ধারিত নির্বাচনের আগে লগি-বৈঠা কিংবা কাস্তের হুংকারের পর কোনো সমাধান পাইনি? এবারও অবশ্যই পাব, অতএব অযথা ঘ্যানর-ঘ্যানর করে জনগণকে বিরক্ত করার কোনো মানে হয় না। আলী আর বাজাদ না হয়ে শেষ পর্যন্ত মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ে অপরপক্ষকে কাবু করার জন্য ব্যস্ত থাকবে, কিন্তু সুশীলসমাজ বা আঁতেলরা কেন এ নিয়ে টকশো, প্রেস ক্লাবের ভিআইপি কক্ষ, পত্রিকায় এ নিয়ে প্যাঁচাল পেড়েই যাচ্ছেন? হাসিনা আর খালেদা তো এ দেশে জনগণের কাছে এখনও স্বীকৃত নেতৃত্ব, গত দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে এ দু’জনই দেশের প্রকৃত নেতা, আর তাদের দু’দল আলী-বাজাদই মাত্র দুটি স্বীকৃত রাজনৈতিক দল যেন। এই-ই যখন অবস্থা, তখন এ দু’জনের গোয়ার্তুমি অপছন্দ হলে সুশীলসমাজ কিংবা আঁতেলরা এ দুজনকে আগামী নির্বাচনে ভোটে হারিয়ে দেয়ার কথা বলতে কেন সোচ্চার হচ্ছেন না? দল হিসেবে আলীও থাকুক, বাজাদও থাকুক, শুধু নেতা হিসেবে হাসিনা আর খালেদা দুই দল থেকেই নির্বাচনে পরাজিত হোন- এটা করতে পারলেও তো সুশীলসমাজ আর আঁতেলদের একটা প্রাপ্তি হতো।
সম্প্রতি রাজনৈতিক অঙ্গনে বাজাদ বেশ আত্মবিশ্বাসী যেন, ভাবটা যেন ভোট হলেই ক্ষমতা তাদের হয়ে গেল আরকি। পাঁচ সিটিতে জয়ের রেশ যেন তাদের তেমন জয়ের জানান দিয়ে গেল। জোয়ার-ভাটার এ দেশে, সেলুকাসের কী বিচিত্র এ দেশে ভোটের সময় যে জনগণের মন বদলাবে না এ নিশ্চয়তা কে দেবে? তারপরও দেখা যাচ্ছে যে, আলীর পক্ষে প্রচার তুলনামূলকভাবে দুর্বল বলা চলে, আলীর থিংক ট্যাংককে দুর্বল মনে হয়। অপরদিকে বাজাদের প্রচার তুঙ্গে, তাদের থিংক ট্যাংক বেশ চাঙ্গা। আলী বিলবোর্ডের ‘কাঁচা’ প্রচারণায় সুবিধা করতে পারেনি। তবে আলী যদি হাতের পাঁচ মানবতাবিরোধী বিচারের রায় ভোটের আগে কার্যকর করে (বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ যেগুলোর হয়ে গেল) জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারে তখন কোথাকার জল কোথায় গিয়ে গড়ায় তাও তো বিবেচনায় রাখতে হবে। এ দেশের জনগণ শেষ মুহূর্তেও ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে কখনও ভুল করেনি। পাকিস্তান আমল থেকেই আমরা দেখে আসছি যে, রাজনীতির ধুম-ধারাক্কার বেড়াজালে থেকেও জনগণ ঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাঁচ সিটির নির্বাচনে যেমন জনগণের সিদ্ধান্ত চমৎকার ছিল, বাজাদের কাছেও অপ্রত্যাশিত ছিল, সর্বোপরি ফলাফল ছিল অচিন্তনীয়, ঠিক জাতীয় নির্বাচনেও যে পাঁচ সিটির ফলাফলের ধারাবাহিকতা নস্যাৎ হতে পারবে না তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। বাজাদের জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ, দুর্নীতি, যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে দহরম-মহরম যদি একটু ঠিকমতো প্রচার-প্রসার করা যায় এবং তার সঙ্গে যদি মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের রায় কার্যকর করে আলী বিশ্বাসযোগ্যতা সৃষ্টি করতে পারে তাহলে জনমত পাল্টাতে কতক্ষণ? আলী আর বাজাদ যে ঘ্যানর-ঘ্যানর রেকর্ড বাজিয়ে যাচ্ছেন তা জনগণকে মোটেই প্রভাবিত করে না। আমি এ কথা এখনও বিশ্বাস করি, সংবিধানের অধীনেই বাজাদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে, বড়জোর মুখ রক্ষার জন্য আলীর কাছে থেকে কিছুটা ছাড় আশা করবে এবং তা হতে পারে সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন না করা কিংবা শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন না করা। আলীও সংবিধানের অধীনে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বজায় রেখে নির্দলীয় বা তত্ত্বাবধায়কে ফিরে না গিয়েই নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারবে। দু’দলের কেউই তাদের মৌরসী-পাট্টা দেশটাকে তাদের দু’দলের বাইরে যেতে দিতে চাইবে না। মাঠে-ময়দানে কিংবা গলাবাজিতে যে রেকর্ড বাজাচ্ছে দু’দল তা হচ্ছে একান্তই স্নায়ু-দুর্বলের কৌশলমাত্র। দু’দলের একসুরো ঘ্যানর ঘ্যানর বক্তব্য থেকে ‘সার’ কিছু পাওয়া যাবে না। অবস্থাটা দাঁড়িয়েছে এমন, অশিক্ষিত জনগণের গ্রামে এক গণ্ডমূর্খ ‘হুজুর’ বাচ্চাদের প্রত্যেক দিনই একই তালিম দিয়ে যাচ্ছেন- তালিমালি যাক দিন। তার দিনগুজরান প্রয়োজন। মাসকে মাস একই পড়া পড়েই যাচ্ছে বাচ্চারা। একদিন ‘হুজুর’ পান খেতে গেলে আরেক লোক প্রত্যেক দিনের এ তালিম শুনে বাচ্চাদের নতুন তালিম দিয়ে গেলেন- এইতান করি খাবি কদিন। ‘হুজুর’ পান খেয়ে এসে বাচ্চাদের মুখে নতুন তালিম শুনে তো হতবাক। বুঝলেন, তার জাড়িজুড়ি এ গ্রামে আর চলবে না। রাতে তিনি কেটে পড়লেন। আলী-বাজাদের ‘তালিমালি যাক দিন’-এর জবাব তো ভোটের সময়ে ঠিকই এসে যাবে ‘এইতান করি খাবি কদিন’। আমরা অপেক্ষায় থাকলাম। জনগণকে মূর্খ ভাবার কোনো কারণ নেই। আলী-বাজাদ এবং সুশীলরা এটা বুঝলে আমরা কৃতার্থ হব।
বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
কিন্তু মৌসুমটাতে গোটা ৪০ থেকে ৫০ জন জ্ঞানী-গুণী-আঁতেল যেভাবে একই সুরে ঘ্যানর-ঘ্যানর করে চলেছেন, যেভাবে আলী-বাজাদ’র নেতারা সারাক্ষণ রাজনীতির একসুরে একতারা বাজিয়ে আমাদের বিরক্তি চরমে নিয়ে যাচ্ছেন তাতে আমরা বড় অস্বস্তিবোধ করছি। ভোট এখনও হয়নি, হবে-হবে অবস্থায়; আর এখনই কেউ বলে ফেলছেন আদৌই ভোট হবে কি না সন্দেহ। কেউ বা বলছেন এত তারিখের মধ্যে ‘এটা’ করা না হলে সরকার পতনের এক ঝড় বইবে। খালেদা জিয়া গত পৌনে পাঁচ বছর তো সরকারকে যথেষ্ট পর্যবেক্ষণ করেছেন, বছর দুয়েক পর থেকে তো গরম গরম হুংকার দিয়েই চলেছেন, বিশেষত পঞ্চদশ সংশোধনীর পর থেকে তো তার নিজের আগের অবস্থানের বিপরীতে তত্ত্বাবধায়কের জন্য উঠেপড়ে লেগেই আছেন। এখন পাগল আর শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নন এমন তিনি ভাবেন না। চতুর্দশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক প্রধান নিজেদের পছন্দের করার জন্য যে বিচারপতির বয়স বাড়ানো হল- সেটাও ভুলে গেলেন। আর হাসিনা হলেন তার উল্টো, এখন তিনি গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের রায়কে পুঁজি করে সংবিধানকে আরও কঠোর করে সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়কের বিলুপ্তি ঘটান। এর নামই নাকি রাজনীতি! এ ইস্যুতে আমাদের দুজনের বক্তব্যের প্রতিই শ্রদ্ধাশীল হতে হয়। সংবিধানের অধীনে দুজনের জেদ রক্ষা হলে আমাদের কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। যদি কারও জেদ কমে কিংবা কেউ অবস্থা বুঝে ছাড় দিতে শেষ পর্যায়ে হলেও সমঝোতায় আসেন তা তো ভালো, আমরা খুশি হব। তাও যদি শেষ পর্যন্ত না হয় তাহলেও তো একটা সমাধান হবে, নাকি? আমরা কি ২০০৭-এর ২২ জানুয়ারির নির্ধারিত নির্বাচনের আগে লগি-বৈঠা কিংবা কাস্তের হুংকারের পর কোনো সমাধান পাইনি? এবারও অবশ্যই পাব, অতএব অযথা ঘ্যানর-ঘ্যানর করে জনগণকে বিরক্ত করার কোনো মানে হয় না। আলী আর বাজাদ না হয়ে শেষ পর্যন্ত মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ে অপরপক্ষকে কাবু করার জন্য ব্যস্ত থাকবে, কিন্তু সুশীলসমাজ বা আঁতেলরা কেন এ নিয়ে টকশো, প্রেস ক্লাবের ভিআইপি কক্ষ, পত্রিকায় এ নিয়ে প্যাঁচাল পেড়েই যাচ্ছেন? হাসিনা আর খালেদা তো এ দেশে জনগণের কাছে এখনও স্বীকৃত নেতৃত্ব, গত দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে এ দু’জনই দেশের প্রকৃত নেতা, আর তাদের দু’দল আলী-বাজাদই মাত্র দুটি স্বীকৃত রাজনৈতিক দল যেন। এই-ই যখন অবস্থা, তখন এ দু’জনের গোয়ার্তুমি অপছন্দ হলে সুশীলসমাজ কিংবা আঁতেলরা এ দুজনকে আগামী নির্বাচনে ভোটে হারিয়ে দেয়ার কথা বলতে কেন সোচ্চার হচ্ছেন না? দল হিসেবে আলীও থাকুক, বাজাদও থাকুক, শুধু নেতা হিসেবে হাসিনা আর খালেদা দুই দল থেকেই নির্বাচনে পরাজিত হোন- এটা করতে পারলেও তো সুশীলসমাজ আর আঁতেলদের একটা প্রাপ্তি হতো।
সম্প্রতি রাজনৈতিক অঙ্গনে বাজাদ বেশ আত্মবিশ্বাসী যেন, ভাবটা যেন ভোট হলেই ক্ষমতা তাদের হয়ে গেল আরকি। পাঁচ সিটিতে জয়ের রেশ যেন তাদের তেমন জয়ের জানান দিয়ে গেল। জোয়ার-ভাটার এ দেশে, সেলুকাসের কী বিচিত্র এ দেশে ভোটের সময় যে জনগণের মন বদলাবে না এ নিশ্চয়তা কে দেবে? তারপরও দেখা যাচ্ছে যে, আলীর পক্ষে প্রচার তুলনামূলকভাবে দুর্বল বলা চলে, আলীর থিংক ট্যাংককে দুর্বল মনে হয়। অপরদিকে বাজাদের প্রচার তুঙ্গে, তাদের থিংক ট্যাংক বেশ চাঙ্গা। আলী বিলবোর্ডের ‘কাঁচা’ প্রচারণায় সুবিধা করতে পারেনি। তবে আলী যদি হাতের পাঁচ মানবতাবিরোধী বিচারের রায় ভোটের আগে কার্যকর করে (বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ যেগুলোর হয়ে গেল) জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারে তখন কোথাকার জল কোথায় গিয়ে গড়ায় তাও তো বিবেচনায় রাখতে হবে। এ দেশের জনগণ শেষ মুহূর্তেও ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে কখনও ভুল করেনি। পাকিস্তান আমল থেকেই আমরা দেখে আসছি যে, রাজনীতির ধুম-ধারাক্কার বেড়াজালে থেকেও জনগণ ঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাঁচ সিটির নির্বাচনে যেমন জনগণের সিদ্ধান্ত চমৎকার ছিল, বাজাদের কাছেও অপ্রত্যাশিত ছিল, সর্বোপরি ফলাফল ছিল অচিন্তনীয়, ঠিক জাতীয় নির্বাচনেও যে পাঁচ সিটির ফলাফলের ধারাবাহিকতা নস্যাৎ হতে পারবে না তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। বাজাদের জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ, দুর্নীতি, যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে দহরম-মহরম যদি একটু ঠিকমতো প্রচার-প্রসার করা যায় এবং তার সঙ্গে যদি মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের রায় কার্যকর করে আলী বিশ্বাসযোগ্যতা সৃষ্টি করতে পারে তাহলে জনমত পাল্টাতে কতক্ষণ? আলী আর বাজাদ যে ঘ্যানর-ঘ্যানর রেকর্ড বাজিয়ে যাচ্ছেন তা জনগণকে মোটেই প্রভাবিত করে না। আমি এ কথা এখনও বিশ্বাস করি, সংবিধানের অধীনেই বাজাদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে, বড়জোর মুখ রক্ষার জন্য আলীর কাছে থেকে কিছুটা ছাড় আশা করবে এবং তা হতে পারে সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন না করা কিংবা শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন না করা। আলীও সংবিধানের অধীনে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বজায় রেখে নির্দলীয় বা তত্ত্বাবধায়কে ফিরে না গিয়েই নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারবে। দু’দলের কেউই তাদের মৌরসী-পাট্টা দেশটাকে তাদের দু’দলের বাইরে যেতে দিতে চাইবে না। মাঠে-ময়দানে কিংবা গলাবাজিতে যে রেকর্ড বাজাচ্ছে দু’দল তা হচ্ছে একান্তই স্নায়ু-দুর্বলের কৌশলমাত্র। দু’দলের একসুরো ঘ্যানর ঘ্যানর বক্তব্য থেকে ‘সার’ কিছু পাওয়া যাবে না। অবস্থাটা দাঁড়িয়েছে এমন, অশিক্ষিত জনগণের গ্রামে এক গণ্ডমূর্খ ‘হুজুর’ বাচ্চাদের প্রত্যেক দিনই একই তালিম দিয়ে যাচ্ছেন- তালিমালি যাক দিন। তার দিনগুজরান প্রয়োজন। মাসকে মাস একই পড়া পড়েই যাচ্ছে বাচ্চারা। একদিন ‘হুজুর’ পান খেতে গেলে আরেক লোক প্রত্যেক দিনের এ তালিম শুনে বাচ্চাদের নতুন তালিম দিয়ে গেলেন- এইতান করি খাবি কদিন। ‘হুজুর’ পান খেয়ে এসে বাচ্চাদের মুখে নতুন তালিম শুনে তো হতবাক। বুঝলেন, তার জাড়িজুড়ি এ গ্রামে আর চলবে না। রাতে তিনি কেটে পড়লেন। আলী-বাজাদের ‘তালিমালি যাক দিন’-এর জবাব তো ভোটের সময়ে ঠিকই এসে যাবে ‘এইতান করি খাবি কদিন’। আমরা অপেক্ষায় থাকলাম। জনগণকে মূর্খ ভাবার কোনো কারণ নেই। আলী-বাজাদ এবং সুশীলরা এটা বুঝলে আমরা কৃতার্থ হব।
বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
No comments