দুর্গোৎসব- নবপত্রিকায় কলাগাছ by কান্তা রায় রিমি
আজ দুর্গাপূজার নবমী। পরিবারে, সমাজে,
দেশে, বিশ্বে চলছে দুর্গতি। দেবী দুর্গা দুর্গতিনাশিনী। তিনি শক্তিরূপে,
মাতৃরূপে বিরাজমান। জগতের কল্যাণময়ীরূপ, মাতৃরূপ।
তিনি
পশু-পাখি, বৃক্ষ-লতা, স্থাবর-জঙ্গল—সব কিছুতেই মাতৃরূপে বিরাজমান।
নবপত্রিকার কতিপয় বৃক্ষের চারাগাছের মধ্যে মাতৃত্বের দর্শন আর্য-ঋষিগণের
গভীর দার্শনিকতার নিদর্শন।
নবপত্রিকা হলো অশোকগাছ, কলাগাছ, ধানগাছ, বেলগাছ, জয়ন্তীগাছ, হলুদগাছ, মানকচুগাছ, ডালিমগাছ, অপরাজিতা-গাছের ডাল দিয়ে তৈরি। মহাদেবীর পূজায় তাকে সাড়ম্বরে প্রতিষ্ঠা করা হয়। শারদীয়া সপ্তমীতে শাড়ি, মুকুট দিয়ে আবৃত করে মাতৃরূপে পূজা করা হয় গণেশ মূর্তির ডান পাশে স্থাপন করে।
নবপত্রিকার শক্তিকে এভাবে বর্ণনা করা হয়: কদলী ব্রহ্মাণী, কচুগাছে কালিকা, হরিদ্রে পত্রিকিয়ে দুর্গা, জয়ন্তীবৃক্ষে জয়ন্তিকা, বিল্ববৃক্ষে শিবানী দেবী, ডালিমে রক্তদন্তিকা, অশোকগাছে শোকহারিণী, মান্যবৃক্ষে চামুন্ডা, ধান্যে মহালক্ষ্মীদেবী। নয়দেবীর শক্তি নিয়ে নবপত্রিকাবাসিনী দেবী দুর্গা। নবপত্রিকায় কলাগাছকে পূজার সময় বলা হয়, ‘তুমি সর্বত্র শান্তি বিধান করো।’
নবপত্রিকা মা দুর্গার প্রতীক, আবার উদ্ভিদজগতেরও প্রতিনিধি। উদ্ভিদজগৎ আমাদের নৈমিত্তিক জীবনধারণে মায়ের মতোই সস্নেহে আবৃত করে রেখেছে। কলাগাছের পাতার অপরূপ সবুজ রং এবং কাণ্ডের অপরূপ শোভা বাগানের সৌন্দর্য বর্ধনে অতুলনীয়। কলাগাছের কাণ্ডের একেবারে ভেতরের অংশটি ‘থোর’ নামে পরিচিত, এটি তরকারি হিসেবে ব্যবহূত হয়। কাঁচা কলা তরকারিতে বিভিন্নভাবে রান্না করা হয়। কলার মোচার তরকারি অত্যন্ত জনপ্রিয় খাদ্য। পাকা কলা ফল হিসেবে সর্বাধিক ব্যবহূত। এ ছাড়া বন্যা, বর্ষায় কলাগাছের কাণ্ড ভেলা হিসেবে বিপদের বন্ধু। পুরাণে আছে, বেহুলা-লখিন্দরের সাপেকাটা দেহটি কলার ভেলায় ভাসিয়েছিল। গ্রামগঞ্জে অগ্নিদগ্ধ রোগীকে হাসপাতালে বহনের জন্য কলার পাতা ব্যবহার করা হয়, এতে রোগীর অগ্নিদগ্ধ শরীরের ক্ষত কম হয়। এ ছাড়া কলার পাতায় খাবারও পরিবেশন করা হয়ে থাকে। আর মাত্র কদিন পর ঈদ। ঈদের মাংস কাটার সময় কলার পাতা বহুলভাবে ব্যবহূত হচ্ছে, হবে।
হিন্দুধর্মের যেকোনো শুভ কাজের প্রবেশদ্বার এবং বিয়ের আসর কলাগাছ রেখে সাজানো হয়। কথিত আছে, কলাগাছের অভিবাদন সবচেয়ে শুভ। পূজাকার্যে ব্যবহূত ঘটে কলার ছড়ি ভীষণ প্রয়োজনীয় দ্রব্য। এ ছাড়া বিশ্বাস করা হয় কলার পাতা নিবেদনে গণেশ দেবতা খুব সন্তুষ্ট হন। কলা ছাড়া প্রসাদ অসম্পূর্ণ। কলাগাছের কাণ্ড দিয়ে ঢোঙা বানিয়ে সেসবে প্রসাদ নিবেদন করা হয়। বিশ্বাস আছে, পৌষ মাসে শুক্লপক্ষের একাদশী দিনে ভগবান বিষ্ণু এবং দেবী লক্ষ্মীকে এবং কার্তিক মাসে শুক্লপক্ষের ষষ্ঠ দিনে সূর্যদেবতাকে কলা প্রসাদ হিসেবে নিবেদন করলে দেবতারা সন্তুষ্ট হন।
শুধু দেবতার মন্দিরে নয়, আমাদের বাস্তব জীবনেও কলাগাছ এবং ফল হিসেবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কলার বৈজ্ঞানিক নাম Musa x paradisiaca. সবচেয়ে জনপ্রিয় নতুন উদ্ভাবন করা বিচিবিহীন কলা এসেছে দুই প্রজাতি থেকে—Musa acuminata, Musa balbisiana. কলার বহু প্রজাতি রয়েছে, এর মধ্যে ‘Cavendish’ সবচেয়ে সহজলভ্য। এ দেশে নানা ধরনের কলা পাওয়া যায়; যেমন—মালভোগ, সাগর, সবরি, চিনিচম্পা, আঠিয়া ইত্যাদি। কাঁচা অবস্থায় কলা সবুজ থাকলেও পাকলে কলার রং হয় বেশির ভাগই হলুদ। এ ছাড়া খয়েরি রঙের কলা হয়ে থাকে।
কলা প্রায় বিশ্বের সব কটি দেশে পাওয়া যায়। কলার উৎপত্তি ১০ হাজার বছর আগে। বিজ্ঞানীরা বলেন, এটি বিশ্বের প্রথম ফল। প্রথমে কলার উৎপত্তি মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনে। এখান থেকে কলা ভ্রমণকারীর মাধ্যমে ভারত, আফ্রিকায় যায়। কথিত আছে, যখন আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট ভারতে যান, তখন সেখানে কলার অপূর্ব স্বাদে মোহিত হয়ে কলা বহন করলেন আমেরিকায়।
কলা সবচেয়ে পুষ্টিকর ফল। কলায় প্রচুর পুষ্টিকর উপাদান আছে। প্রতি ১০০ গ্রাম কলায় আছে ৮৯ ক্যালরি। এর মধ্যে শর্করা ২৩ গ্রাম, ডায়াটারি আঁশ ২ দশমিক ৬ গ্রাম, চিনি ১২ গ্রাম, আমিষ ১ দশমিক ১ গ্রাম, স্যাচুরেটেড চর্বি শূন্য দশমিক ১ গ্রাম। পলিস্যাচুরেটেড চর্বি শূন্য দশমিক ১ গ্রাম, ভিটামিন-এ, বি-৬, সি এবং ম্যাগনেসিয়াম, সোডিয়াম, পটাসিয়াম ও আয়রন আছে। খুশির খবর হলো, কলায় কোনো কোলেস্টেরল, মনোস্যাচুরেটেড চর্বি নেই। কাঁচা কলায় প্রচুর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট আছে। পাকা কলা ডায়রিয়া, আমাশয়, ইন্টেসটাইনাল কোলাইটিস রোগে ব্যবহূত হয়।
সারা বছর কলা চাষ করা হয়। কলা ফলনশীলও বটে। এ দেশের মাটি কলা চাষের ভীষণ উপযোগী। এসব কারণে দেশের মানুষের পুষ্টিহীনতা দূর করতে, সুস্বাস্থ্য রক্ষার্থে কৃষকদের কলা চাষে বিশদভাবে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
ডা. কান্তা রায় রিমি: অধ্যাপক, দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ, দিনাজপুর।
No comments