ভেজালের জালে বন্দি জীবন by মোঃ মাহমুদুর রহমান
জীবন
বাঁচানোর জন্য অনেক চাহিদা পূরণ করতে হয়। এর মধ্যে কিছু চাহিদাকে মৌলিক আর
অন্যান্য চাহিদাকে জীবনযাত্রার মান নির্ধারক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মধ্যে যে কোনোভাবে বেঁচে থাকার
জন্য খাদ্য ও চিকিৎসার বিকল্প নেই। প্রাচীন গুহা বা বনে-জঙ্গলে চড়ে বেড়ানো
মানুষ, যাদের কোনো নির্দিষ্ট বাসস্থান ছিল না, উলঙ্গ থাকত, শিক্ষার
প্রশ্নই আসে না, তারাও নিয়মিত খাদ্য গ্রহণ ও প্রয়োজনে চিকিৎসা নিত। চিকিৎসা
ব্যবস্থা আজকের মতো আধুনিক ছিল না, গাছপালাকে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ওষুধ
হিসেবে ব্যবহার করত। বর্তমান সভ্য সময়ের মতো ওই ওষুধে ভেজাল ছিল না। এখন
আমরা প্রতিদিনই বিষ খেয়ে বিষ হজম করছি। খাদ্যে ফরমালিনসহ বিভিন্ন ধরনের
ক্ষতিকর কেমিক্যাল মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে থাকে, যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার
কোনো উপায় দেখছে না দেশের মানুষ। গাড়ি ও কলকারখানার কালো ধোঁয়ার কারণে
বাতাসও আজ বিশুদ্ধ নয়। সত্যিকার অর্থেই আমরা আজ ভেজালের জালে বন্দি হয়ে
পড়ছি।
এসব ভেজালের প্রতিক্রিয়ায় মানব শরীর যখন আক্রান্ত হয় তখন চিকিৎসার প্রয়োজনে মানুষ আশ্রয় নেয় ডাক্তারের। আর তখনই বেশির ভাগ রোগী নিজেদের আবিষ্কার করেন আরও শক্ত ভেজালের জালে বন্দি হিসেবে। শুধু ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা হয় না। সঙ্গে নার্স, হাসপাতাল বা ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ওষুধের প্রয়োজন হয়। নির্ভেজাল ডাক্তার, নার্স, হাসপাতাল ও ওষুধের কথা চিন্তা করাও কঠিন। ভুয়া ডাক্তার ও নার্স, ভেজাল ওষুধ এবং ব্যবসায়িক ধান্ধায় নিয়োজিত হাসপাতালের কথা যেভাবে প্রচারিত হচ্ছে তা রীতিমতো আতংকের বিষয়। সাধারণ রোগীরা বলেন, ডাক্তার ভুয়া কি-না তা বোঝার উপায় নেই। এমবিবিএসের পাশে বড় বড় অক্ষরে আরও অনেক ডিগ্রির কথা লেখা থাকে। ঢাকায় এরকম ডিগ্রির বর্ণনাসহ সাইনবোর্ড টানিয়ে দীর্ঘদিন থেকে রোগীদের চিকিৎসায় নিয়োজিত অনেক ভুয়া ডাক্তার ধরা পড়েছে মিডিয়ার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে। শুধু ঢাকা নয়, একেবারে মফস্বলেও এরকম অনেক ডাক্তার রয়েছে, যাদের সাধারণ রোগীর পক্ষে শনাক্ত করা কঠিন। কোনো আসল ডাক্তার যখন ভুয়া ডাক্তারের সঙ্গে ব্যবসার পেছনে পড়ে যান, তখনই কেবল তারা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা মিডিয়াকে অবহিত করেন। এছাড়া কেউ এগুলো নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে না। রোগীর পক্ষে ডাক্তারের কাছে গিয়ে চিকিৎসা নেয়ার আগে সার্টিফিকেট দেখার সুযোগ থাকে না।
চাহিদার তুলনায় নার্সিং কোর্স পাস করা নার্স অনেক কম। এ সুযোগে সারা দেশের ক্লিনিকগুলোতে ভুয়া নার্সের রমরমা চাকরির বাজার। অনেক ক্ষেত্রে ক্লিনিকের আয়া-মাসিরা এপ্রোন পরে নার্সের কাজ করে। কে দেখবে এ অনিয়মগুলো? এর ফলে সারা দেশে ভুল চিকিৎসায় ক্ষতিগ্রস্ত রোগীর সংখ্যা সীমাহীন। সব ঘটনা খবরে আসে না। দেশের নামকরা হাসপাতালেও ভুল চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে দেদারসে। মাঝে মাঝে এগুলো আমাদের জানার সুযোগ হয়। এ মুহূর্তে ঢাকার একটি নামকরা হাসপাতালের বিরুদ্ধে রংপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ভুল চিকিৎসার জন্য ক্ষতিপূরণের মামলা করেছেন। অন্য আরেকটি হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুপথযাত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রের ক্ষতিপূরণ আদায়ের দাবিতে তার সহপাঠী ও অন্য ছাত্রছাত্রীরা হাসপাতাল অবরোধ করে রাখে। অন্যদের খবর আসে না, কারণ সবাই মেয়র কিংবা ঢাবির ছাত্রের মতো ক্ষতিপূরণ চাওয়ার ক্ষমতা রাখেন না।
ডায়াগনস্টিক সেন্টার নিয়ে মানুষের মধ্যে অনেক কৌতূহল রয়েছে। দেখা যায়, দুটি ভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে একই ব্যক্তির একই পরীক্ষা করালে বেশির ভাগ সময় ভিন্ন রিপোর্ট আসে। অন্যদিকে দেশের ওষুধের মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। যদিও আমাদের ওষুধ শিল্প দ্রুততার সঙ্গে সম্প্রসারিত হচ্ছে। দেশের অনেক ভালো ব্র্যান্ডের ওষুধ বিদেশে রফতানি হচ্ছে। কিন্তু ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ওষুধ কোম্পানিগুলোকে সঠিকভাবে তদারকির অভাবে অনেক নিুমানের ওষুধও বাজারজাত হচ্ছে। অবশেষে ওষুধ প্রশাসন অভিযান চালিয়ে ভেজাল ও অনুমতিবিহীন ওষুধ বিক্রির জন্য কিছু ফার্মেসি সিলগালা করতে বাধ্য হয়েছে। ওষুধ বিক্রেতারা সংঘবদ্ধ। তারা ফরমালিনযুক্ত মাছ, সবজি বিক্রেতার মতো অভিযানে আত্মসমর্পণ করেনি। উল্টো সবাইকে জিম্মি করে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। একদিন দেশের সব ওষুধের দোকান বন্ধ ছিল। অবস্থা এমন- এখন আর কেউ ভেজালকে ভেজাল বলতে পারবে না, যদি ভেজাল পণ্য বিক্রেতারা সংঘবদ্ধ ও শক্তিশালী হয়। তবে সরকারের উচিত একই সঙ্গে নিুমানের ওষুধ তৈরির কারখানা বন্ধ এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের শাস্তির ব্যবস্থা করা। কিন্তু তা হবে না। কারণ যাদের ওপর তদারকির দায়িত্ব, তারা নিজেরাই ভেজাল (ঘুষ) গ্রহণে অভ্যস্ত।
নির্ভেজাল ডাক্তার যারা সত্যিকারভাবে মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করে দেশী-বিদেশী উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে দেশে চিকিৎসা সেবার সঙ্গে জড়িত, তাদের দিকে তাকালে মন আরও খারাপ হয়ে যায়। মেধাবী ছাত্ররাই মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করেন। অনেক পরিশ্রম ও অর্থ ব্যয়ের মাধ্যমে একজন ছাত্র এমবিবিএস পাস করেন। এর পর রইল উচ্চতর ডিগ্রি। স্বাভাবিকভাবেই তারা সাধারণ মেধার অন্যান্য পেশার যে কোনো ব্যক্তির চেয়ে বেশি রোজগারের প্রত্যাশা করতেই পারেন এবং বেশিরভাগ ডাক্তার তা করে থাকেন। তবে একটা প্রশ্ন থেকে যায়, এ রোজগার কতগুণ বেশি হওয়া উচিত? এর কি কোনো সীমা-পরিসীমা আছে? নীতি-নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়েও কি অধিক রোজগার করতে হবে? বাস্তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি, বেশিরভাগ ডাক্তারের অর্থের ক্ষুধার কোনো শেষ নেই। পেশাগত নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে, সব নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে টাকা রোজগারের এক লাগামহীন প্রতিযোগিতায় সবাই ব্যস্ত। এ ব্যস্ততায় তাদের আসল কাজ রোগীর চিকিৎসাই পেছনে পড়ে যাচ্ছে। রোগীর রোগের বর্ণনা শোনার সময় নেই। ডাক্তাররা কিছুটা শুনে এমনভাবে প্রেসক্রিপশন লেখা শুরু করেন যেন মনে হয় এখনই এখান থেকে বের না হলে বিল্ডিংয়ের ছাদ মাথার ওপর ভেঙে পড়বে। কারণ লাইনে অনেক রোগী অথবা ক্লিনিকে অপারেশন আছে। ডাক্তারের এ ব্যস্ততার মধ্যে রোগী তার সমস্যা জানার সুযোগই পান না, ডাক্তারও তা জানানোর প্রয়োজন বোধ করেন না। তাই ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়ে রোগ সম্পর্কে চিকিৎসক কী বলেছেন জানতে চাইলে রোগী প্রেসক্রিপশন ছাড়া অন্য কিছু দেখাতে বা বলতে পারেন না। তবে রোগীদের ভাগ্য ভালো কোনো ডাক্তারই প্রেসক্রিপশন ছাড়া রোগীকে ছাড়েন না। কারণ প্রেসক্রিপশন না লিখলে ফি নেবেন কিসের ওপর। এছাড়া প্রেসক্রিপশনে কিছু পরীক্ষার কথা লেখা থাকবে যেখান থেকে কমিশন আকারে বাড়তি কিছু টাকা আসবে। আর ওই ওষুধগুলোর নাম লেখা থাকবে যেসব কোম্পানির কাছ থেকে নগদ অর্থ, ওষুধের স্যাম্পল ও বিভিন্ন উপহার সামগ্রী অনেক আগেই গ্রহণ করা হয়েছে। কোম্পানির এ ঋণ পরিশোধের জন্য অথবা মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের চাকরি বাঁচানোর জন্য অপ্রয়োজনীয় ও নিুমানের ওষুধও লেখা হয়। এভাবে ডাক্তাররা টাকার পাহাড় গড়তে সমর্থ হন, ওষুধ কোম্পানি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ব্যবসা রমরমা হয়, শুধু বিপদগ্রস্ত থাকে রোগীর জীবন। তাই ডাক্তার সাহেবরা তাদের ডাক্তারি পেশার আয় যথেষ্ট মনে না হওয়ায় অতিরিক্ত পেশা হিসেবে ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ওষুধ কোম্পানির দালালির পেশাটাও গ্রহণ করে থাকেন। নচিকেতার ‘ও ডাক্তার’ শিরোনামের বিখ্যাত গানটিতে নীতিহীন ডাক্তারদের লোভের দুর্ভেদ্য জালে কীভাবে অসহায় রোগীরা আটকা পড়েন তার করুণ বর্ণনা রয়েছে।
এই হচ্ছে জীবন বাঁচানোর জন্য গৃহীত খাদ্য ও চিকিৎসার সাধারণ চিত্র। তবে এর ব্যতিক্রমও রয়েছে। মাঝে মাঝে যেমন ফরমালিনমুক্ত খাবার পাওয়া যায়, তেমনি কিছু ভালো ডাক্তারও পাওয়া যায়। তবে ভালো ডাক্তারের সংখ্যাটা অতি নগণ্য। বর্তমানে দেশের বেশিরভাগ পেশাজীবীর অবস্থাও প্রায় একই রকম। কিন্তু মানুষ চিকিৎসকদের কাছ থেকে আরও উন্নত ও মানবিক ব্যবহার আশা করে। কারণ রোগ-ব্যাধিতে বিধ্বস্ত হয়ে মানুষ বড় অসহায় অবস্থায় চিকিৎসকদের কাছে আসে। সামান্য সময় দিয়ে রোগীর সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার করলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোগী অর্ধেক ভালো হয়ে যান। এজন্য শুধু অর্থ নয়, সেবার মানসিকতা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসতে হবে। তখন হয়তো ভেজালের জাল ছিন্ন করে মানুষ সঠিক সেবা পাবে। আমরাও দেশের চিকিৎসা সেবার মান নিয়ে গর্ববোধ করতে পারব।
মোঃ মাহমুদুর রহমান : ব্যাংকার ও কলামিস্ট
এসব ভেজালের প্রতিক্রিয়ায় মানব শরীর যখন আক্রান্ত হয় তখন চিকিৎসার প্রয়োজনে মানুষ আশ্রয় নেয় ডাক্তারের। আর তখনই বেশির ভাগ রোগী নিজেদের আবিষ্কার করেন আরও শক্ত ভেজালের জালে বন্দি হিসেবে। শুধু ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা হয় না। সঙ্গে নার্স, হাসপাতাল বা ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ওষুধের প্রয়োজন হয়। নির্ভেজাল ডাক্তার, নার্স, হাসপাতাল ও ওষুধের কথা চিন্তা করাও কঠিন। ভুয়া ডাক্তার ও নার্স, ভেজাল ওষুধ এবং ব্যবসায়িক ধান্ধায় নিয়োজিত হাসপাতালের কথা যেভাবে প্রচারিত হচ্ছে তা রীতিমতো আতংকের বিষয়। সাধারণ রোগীরা বলেন, ডাক্তার ভুয়া কি-না তা বোঝার উপায় নেই। এমবিবিএসের পাশে বড় বড় অক্ষরে আরও অনেক ডিগ্রির কথা লেখা থাকে। ঢাকায় এরকম ডিগ্রির বর্ণনাসহ সাইনবোর্ড টানিয়ে দীর্ঘদিন থেকে রোগীদের চিকিৎসায় নিয়োজিত অনেক ভুয়া ডাক্তার ধরা পড়েছে মিডিয়ার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে। শুধু ঢাকা নয়, একেবারে মফস্বলেও এরকম অনেক ডাক্তার রয়েছে, যাদের সাধারণ রোগীর পক্ষে শনাক্ত করা কঠিন। কোনো আসল ডাক্তার যখন ভুয়া ডাক্তারের সঙ্গে ব্যবসার পেছনে পড়ে যান, তখনই কেবল তারা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা মিডিয়াকে অবহিত করেন। এছাড়া কেউ এগুলো নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে না। রোগীর পক্ষে ডাক্তারের কাছে গিয়ে চিকিৎসা নেয়ার আগে সার্টিফিকেট দেখার সুযোগ থাকে না।
চাহিদার তুলনায় নার্সিং কোর্স পাস করা নার্স অনেক কম। এ সুযোগে সারা দেশের ক্লিনিকগুলোতে ভুয়া নার্সের রমরমা চাকরির বাজার। অনেক ক্ষেত্রে ক্লিনিকের আয়া-মাসিরা এপ্রোন পরে নার্সের কাজ করে। কে দেখবে এ অনিয়মগুলো? এর ফলে সারা দেশে ভুল চিকিৎসায় ক্ষতিগ্রস্ত রোগীর সংখ্যা সীমাহীন। সব ঘটনা খবরে আসে না। দেশের নামকরা হাসপাতালেও ভুল চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে দেদারসে। মাঝে মাঝে এগুলো আমাদের জানার সুযোগ হয়। এ মুহূর্তে ঢাকার একটি নামকরা হাসপাতালের বিরুদ্ধে রংপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ভুল চিকিৎসার জন্য ক্ষতিপূরণের মামলা করেছেন। অন্য আরেকটি হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুপথযাত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রের ক্ষতিপূরণ আদায়ের দাবিতে তার সহপাঠী ও অন্য ছাত্রছাত্রীরা হাসপাতাল অবরোধ করে রাখে। অন্যদের খবর আসে না, কারণ সবাই মেয়র কিংবা ঢাবির ছাত্রের মতো ক্ষতিপূরণ চাওয়ার ক্ষমতা রাখেন না।
ডায়াগনস্টিক সেন্টার নিয়ে মানুষের মধ্যে অনেক কৌতূহল রয়েছে। দেখা যায়, দুটি ভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে একই ব্যক্তির একই পরীক্ষা করালে বেশির ভাগ সময় ভিন্ন রিপোর্ট আসে। অন্যদিকে দেশের ওষুধের মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। যদিও আমাদের ওষুধ শিল্প দ্রুততার সঙ্গে সম্প্রসারিত হচ্ছে। দেশের অনেক ভালো ব্র্যান্ডের ওষুধ বিদেশে রফতানি হচ্ছে। কিন্তু ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ওষুধ কোম্পানিগুলোকে সঠিকভাবে তদারকির অভাবে অনেক নিুমানের ওষুধও বাজারজাত হচ্ছে। অবশেষে ওষুধ প্রশাসন অভিযান চালিয়ে ভেজাল ও অনুমতিবিহীন ওষুধ বিক্রির জন্য কিছু ফার্মেসি সিলগালা করতে বাধ্য হয়েছে। ওষুধ বিক্রেতারা সংঘবদ্ধ। তারা ফরমালিনযুক্ত মাছ, সবজি বিক্রেতার মতো অভিযানে আত্মসমর্পণ করেনি। উল্টো সবাইকে জিম্মি করে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। একদিন দেশের সব ওষুধের দোকান বন্ধ ছিল। অবস্থা এমন- এখন আর কেউ ভেজালকে ভেজাল বলতে পারবে না, যদি ভেজাল পণ্য বিক্রেতারা সংঘবদ্ধ ও শক্তিশালী হয়। তবে সরকারের উচিত একই সঙ্গে নিুমানের ওষুধ তৈরির কারখানা বন্ধ এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের শাস্তির ব্যবস্থা করা। কিন্তু তা হবে না। কারণ যাদের ওপর তদারকির দায়িত্ব, তারা নিজেরাই ভেজাল (ঘুষ) গ্রহণে অভ্যস্ত।
নির্ভেজাল ডাক্তার যারা সত্যিকারভাবে মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করে দেশী-বিদেশী উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে দেশে চিকিৎসা সেবার সঙ্গে জড়িত, তাদের দিকে তাকালে মন আরও খারাপ হয়ে যায়। মেধাবী ছাত্ররাই মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করেন। অনেক পরিশ্রম ও অর্থ ব্যয়ের মাধ্যমে একজন ছাত্র এমবিবিএস পাস করেন। এর পর রইল উচ্চতর ডিগ্রি। স্বাভাবিকভাবেই তারা সাধারণ মেধার অন্যান্য পেশার যে কোনো ব্যক্তির চেয়ে বেশি রোজগারের প্রত্যাশা করতেই পারেন এবং বেশিরভাগ ডাক্তার তা করে থাকেন। তবে একটা প্রশ্ন থেকে যায়, এ রোজগার কতগুণ বেশি হওয়া উচিত? এর কি কোনো সীমা-পরিসীমা আছে? নীতি-নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়েও কি অধিক রোজগার করতে হবে? বাস্তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি, বেশিরভাগ ডাক্তারের অর্থের ক্ষুধার কোনো শেষ নেই। পেশাগত নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে, সব নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে টাকা রোজগারের এক লাগামহীন প্রতিযোগিতায় সবাই ব্যস্ত। এ ব্যস্ততায় তাদের আসল কাজ রোগীর চিকিৎসাই পেছনে পড়ে যাচ্ছে। রোগীর রোগের বর্ণনা শোনার সময় নেই। ডাক্তাররা কিছুটা শুনে এমনভাবে প্রেসক্রিপশন লেখা শুরু করেন যেন মনে হয় এখনই এখান থেকে বের না হলে বিল্ডিংয়ের ছাদ মাথার ওপর ভেঙে পড়বে। কারণ লাইনে অনেক রোগী অথবা ক্লিনিকে অপারেশন আছে। ডাক্তারের এ ব্যস্ততার মধ্যে রোগী তার সমস্যা জানার সুযোগই পান না, ডাক্তারও তা জানানোর প্রয়োজন বোধ করেন না। তাই ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়ে রোগ সম্পর্কে চিকিৎসক কী বলেছেন জানতে চাইলে রোগী প্রেসক্রিপশন ছাড়া অন্য কিছু দেখাতে বা বলতে পারেন না। তবে রোগীদের ভাগ্য ভালো কোনো ডাক্তারই প্রেসক্রিপশন ছাড়া রোগীকে ছাড়েন না। কারণ প্রেসক্রিপশন না লিখলে ফি নেবেন কিসের ওপর। এছাড়া প্রেসক্রিপশনে কিছু পরীক্ষার কথা লেখা থাকবে যেখান থেকে কমিশন আকারে বাড়তি কিছু টাকা আসবে। আর ওই ওষুধগুলোর নাম লেখা থাকবে যেসব কোম্পানির কাছ থেকে নগদ অর্থ, ওষুধের স্যাম্পল ও বিভিন্ন উপহার সামগ্রী অনেক আগেই গ্রহণ করা হয়েছে। কোম্পানির এ ঋণ পরিশোধের জন্য অথবা মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের চাকরি বাঁচানোর জন্য অপ্রয়োজনীয় ও নিুমানের ওষুধও লেখা হয়। এভাবে ডাক্তাররা টাকার পাহাড় গড়তে সমর্থ হন, ওষুধ কোম্পানি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ব্যবসা রমরমা হয়, শুধু বিপদগ্রস্ত থাকে রোগীর জীবন। তাই ডাক্তার সাহেবরা তাদের ডাক্তারি পেশার আয় যথেষ্ট মনে না হওয়ায় অতিরিক্ত পেশা হিসেবে ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ওষুধ কোম্পানির দালালির পেশাটাও গ্রহণ করে থাকেন। নচিকেতার ‘ও ডাক্তার’ শিরোনামের বিখ্যাত গানটিতে নীতিহীন ডাক্তারদের লোভের দুর্ভেদ্য জালে কীভাবে অসহায় রোগীরা আটকা পড়েন তার করুণ বর্ণনা রয়েছে।
এই হচ্ছে জীবন বাঁচানোর জন্য গৃহীত খাদ্য ও চিকিৎসার সাধারণ চিত্র। তবে এর ব্যতিক্রমও রয়েছে। মাঝে মাঝে যেমন ফরমালিনমুক্ত খাবার পাওয়া যায়, তেমনি কিছু ভালো ডাক্তারও পাওয়া যায়। তবে ভালো ডাক্তারের সংখ্যাটা অতি নগণ্য। বর্তমানে দেশের বেশিরভাগ পেশাজীবীর অবস্থাও প্রায় একই রকম। কিন্তু মানুষ চিকিৎসকদের কাছ থেকে আরও উন্নত ও মানবিক ব্যবহার আশা করে। কারণ রোগ-ব্যাধিতে বিধ্বস্ত হয়ে মানুষ বড় অসহায় অবস্থায় চিকিৎসকদের কাছে আসে। সামান্য সময় দিয়ে রোগীর সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার করলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোগী অর্ধেক ভালো হয়ে যান। এজন্য শুধু অর্থ নয়, সেবার মানসিকতা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসতে হবে। তখন হয়তো ভেজালের জাল ছিন্ন করে মানুষ সঠিক সেবা পাবে। আমরাও দেশের চিকিৎসা সেবার মান নিয়ে গর্ববোধ করতে পারব।
মোঃ মাহমুদুর রহমান : ব্যাংকার ও কলামিস্ট
No comments