কালান্তরের কড়চা-বাংলাদেশের আইখম্যানের বিচার ও দণ্ড by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
অবশেষে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের পালের
গোঁদা, জামায়াত নেতা গোলাম আযমের বিচারের রায় ঘোষিত হয়েছে। অবশ্যই এই অতি
বৃদ্ধ বয়সে বিচারের সম্মুখীন হওয়া ও নিজের কৃতকর্মের বিচারের রায় নিজের
কানে শুনতে হওয়ার জন্য সংবেদনশীল কিছু মানুষ অবশ্যই তাঁর প্রতি কিছুটা হলেও
সহানুভূতিশীল হবেন।
কিন্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে যে
লাখ লাখ মুক্তিযোদ্ধা আত্মাহুতি দিয়েছেন এবং হাজার হাজার নারী নির্মম
নির্যাতন ও পশুক্ষুধার শিকার হয়েছেন, তাঁদের স্বজন ও পরিজন আজ শোকাশ্রু
চোখে আল্লাহ্র কাছে দুহাত তুলে কৃতজ্ঞতা জানাবেন, মনে শান্তি পাবেন। যদিও
তাঁর মৃত্যুদণ্ডাদেশ হয়নি।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় নাৎসি আইখম্যান লাখ লাখ ইহুদি হত্যার নায়ক ছিলেন। যুদ্ধে হিটলারের পরাজয়ের পর তিনি জার্মানি থেকে কোথায় পালিয়ে যান, কেউ তা দীর্ঘকাল জানত না। ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা তাঁকে আঁতিপাঁতি করে সারা বিশ্ব খুঁজে দীর্ঘকাল পর, সম্ভবত উত্তর আমেরিকার একটি দেশে খুঁজে পায়। আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁকে সে দেশ থেকে ইসরায়েলে নিয়ে আসতে হলে নানা আইনকানুনের ফ্যাকড়ার মধ্যে পড়তে হতো, যেমন বিদেশ থেকে বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিদের দু-একজনকে বিচারের জন্য স্বদেশে ফিরিয়ে আনতে আমরা নানা অসুবিধা, ওজর-আপত্তির মুখে পড়ছি।
ইসরায়েল তাই এসব আন্তর্জাতিক আইন ও বাধ্যবাধকতার মধ্য দিয়ে হাঁটেনি। তাঁকে অন্য দেশ থেকে কিডন্যাপ করে নিয়ে এসে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তখন আইখম্যান অতি বৃদ্ধ। সে কথাও ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ বিবেচনায় নেয়নি। কোনো প্রপার ট্রায়াল বা যথাযথ বিচারও তাঁর হয়নি। তখন খবর বেরিয়েছিল, আইখম্যানকে ইসরায়েলে নিয়ে জেলে ঢোকানোর পর সামারি ট্রায়ালের সময় তিনি এক বিচারককে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, 'আমার বিরুদ্ধে লাখ লাখ ইহুদি হত্যার প্রমাণ নেই। আপনাদের কাছে আমার অপরাধের প্রমাণ কই যে আমাকে অবৈধভাবে কিডন্যাপ করে নিয়ে এসে বন্দি করা হলো?'
বিচারক জবাবে বলেছিলেন, 'আপনার অপরাধের প্রমাণ জার্মানি ও পোল্যান্ডের অসংখ্য গ্যাস চেম্বার; যে চেম্বারে হাজার হাজার ইহুদি নরনারী-শিশুকে ঢুকিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আপনার মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধের প্রমাণ আপনি নিজে। আপনি যুদ্ধাপরাধী না হলে যুদ্ধ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিরুদ্দিষ্ট হয়ে গেলেন কেন? নিজের নামধাম-পরিচয় সব মুছে ফেলে ছদ্মবেশে, ছদ্মনামে অন্য দেশে পলাতক জীবন যাপন করছিলেন কেন?'
আইখম্যানের সঙ্গে বাংলাদেশের গোলাম আযমের চরিত্রের চমৎকার মিল পাওয়া যায়। আইখম্যান নিজ হাতে একজন ইহুদিকেও হত্যা করেননি। কিন্তু তাঁর নির্দেশে হাজার হাজার ইহুদি নরনারী ও শিশুকে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে হত্যা করা হয়েছে। গোলাম আযমও নিজ হাতে বাংলাদেশের কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেননি। কিন্তু তাঁর নির্দেশে আলবদর, আলশামস ইত্যাদি নামে অসংখ্য ঘাতক বাহিনী তৈরি হয়েছে এবং তারা পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীকে ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যায় সহযোগিতা দেয়।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষে আইখম্যান যেমন বিদেশে পালিয়ে গিয়েছিলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে হানাদারদের পরাজয় হলে তাদের পলাতক অংশের সঙ্গে গোলাম আযমও বিদেশে পালিয়ে গিয়েছিলেন। আইখম্যান যেমন দীর্ঘকাল বিদেশি পাসপোর্ট বহন করেছেন, গোলাম আযমও তেমনি দীর্ঘ কয়েক বছর বহন করেছেন পাকিস্তানের পাসপোর্ট। আইখম্যানের সঙ্গে তাঁর একটিমাত্র ক্ষেত্রে অমিল। বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার পর আইখম্যান আর স্বদেশদ্রোহী কোনো চক্রান্তে লিপ্ত ছিলেন না। তিনি পলাতক জীবনযাপন করছিলেন। ইসরায়েলের গুপ্ত গোয়েন্দা সংস্থা তাঁকে বিদেশ থেকে কিডন্যাপ করে গোপনে ইসরাইয়েলে নিয়ে এসেছিল।
অন্যদিকে গোলাম আযম বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে পালিয়ে যাওয়ার পর সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো ঘুরে বেরিয়েছেন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে ধ্বংস করার প্রচারণার কাজে। মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরবসহ কোনো মুসলিম দেশ যাতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেয়, সে জন্য তিনি প্রকাশ্যে প্রচারণা চালান। পাকিস্তানে তখন হাজার হাজার আটকে পড়া বাঙালি রয়েছে। তারা বিভিন্ন গোপন পথে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার চেষ্টা করছিল। এই পলায়নের একটা বড় রুট ছিল পাকিস্তান সন্নিহিত আফগানিস্তান। আটক বাঙালিরা যাতে এই আফগান রুট দিয়ে ভারত হয়ে বাংলাদেশে ফিরতে না পারে, গোলাম আযম তার জন্যও আফগান সরকারের ওপর চাপ দেন। আফগানিস্তানের তখনকার সরকারের সঙ্গে পাকিস্তানের সদ্ভাব না থাকায় তারা গোলাম আযমের চাপ অগ্রাহ্য করেন।
স্বাধীনতা লাভের সাড়ে তিন বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় এবং তাঁর সরকারের পতন ঘটে। বাংলাদেশে ক্ষমতা দখল করে স্বাধীনতার শত্রুদের দ্বারা সমর্থিত ও সাহায্যপুষ্ট সরকার। গোলাম আযমের কপাল খুলে যায়। এখানেই আইখম্যানের সঙ্গে তাঁর ভাগ্যের অমিল। আইখম্যানকে বিদেশ থেকে পাকড়াও করে ইসরায়েলে নিয়ে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। আর সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এই দেশদ্রোহী, মানবতার জঘন্য শত্রুকে পাকিস্তানি পাসপোর্টসহ বাংলাদেশে এসে সামাজিক ও রাজনৈতিক পুনর্বাসনের সুযোগ দেন। তাঁর স্ত্রী খালেদা জিয়ার সরকার তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ফিরে পাওয়াসহ তাঁর দল জামায়াতকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অংশীদার হওয়ারও ব্যবস্থা করে দেয়।
বর্তমান হাসিনা সরকারের আমলে গোলাম আযমসহ একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের প্রধান অংশের বিচার শুরু এবং কারো কারো মৃত্যুদণ্ডাদেশ হওয়ায় আশা জেগেছিল, আইখম্যানের মতোই গোলাম আযমকেও ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলে তাঁর মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। গতকাল সোমবার ঘোষিত বিচারের রায়ে গোলাম আযমের ৯০ বছর কারাদণ্ড হয়েছে। তাঁকে নাকি বয়সের কথা বিবেচনা করে মৃত্যুদণ্ডাদেশ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
গোলাম আযমের বিচারের রায় ঘোষিত হয়েছে- এ কথাটা দিয়েই এ লেখাটা শুরু করেছিলাম। তাঁর মতো মানবতার শত্রুর দণ্ড হয়েছে, তাতে আমি খুশি। কিন্তু বিচারে যেখানে তাঁর সব অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে এবং তাঁর কোনো কোনো সহ-অপরাধী আরো কম অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ডাদেশ পেয়েছেন, সেখানে গোলাম আযমের ৯০ দিনের কারাদণ্ড আমার কাছে গুরু পাপে লঘু দণ্ড বলে মনে হয়েছে। বয়সের বিবেচনার কথা এখানে তোলা নিরর্থক। পশ্চিমা জগতেও ফ্রান্সের মার্শাল পেঁতা এবং আইখম্যানের বিচারে এই বয়সের বিবেচনার অজুহাত তোলা হয়নি। এ রায়ের পেছনে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত কোনো ধরনের রাজনৈতিক বিবেচনা কাজ করেছে কি না আমি জানি না।
আমি ব্যক্তিগতভাবে মৃত্যুদণ্ডদানের বিরোধী। কিন্তু যখনই গোলাম আযমকৃত নারীঘাতী শিশুঘাতী বর্বরতার কথা মনে পড়ে বা ১৯৭১ সালের বধ্যভূমিগুলোর দৃশ্যগুলো চোখে ভাসে, তখন মনে হয়, গোলাম আযমের জন্য মৃত্যুদণ্ডও লঘু শাস্তি। তবু একটিই সান্ত্বনা, বিচারে তাঁর অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। জীবনসায়াহ্নে পৌঁছে ৯০ বছরের কারাদণ্ড মৃত্যুদণ্ডাদেশতুল্য। মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে তাঁর শাস্তি এক দিনেই শেষ হয়ে যেত। এখন কারাগারে বসে মৃত্যুর প্রহর গোনা ছাড়া তাঁর আর কী করার থাকবে?
শেষ মুহূর্তে খবর পেয়েছি, বাংলাদেশের সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট এবং প্রগতিশীল ছাত্র ও যুব সংগঠনগুলো এই রায় প্রত্যাখ্যান করে আজ মঙ্গলবার সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে। আমি এই দণ্ডদানে খুশি, কিন্তু সর্বোচ্চ শাস্তিবিধান না হওয়ায় এই বিচার সম্পর্কে আশাবাদী হইনি। এই রায়কে আওয়ামী লীগের সাম্প্রতিক পরাজিত মনোভাবের বহিঃপ্রকাশও বলা চলে। যাঁরা এই রায় প্রত্যাখ্যান করেছেন, তাঁদের প্রতি আমার সমর্থন জানাতে দ্বিধা নেই।
লন্ডন, ১৫ জুলাই, সোমবার, ২০১৩
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় নাৎসি আইখম্যান লাখ লাখ ইহুদি হত্যার নায়ক ছিলেন। যুদ্ধে হিটলারের পরাজয়ের পর তিনি জার্মানি থেকে কোথায় পালিয়ে যান, কেউ তা দীর্ঘকাল জানত না। ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা তাঁকে আঁতিপাঁতি করে সারা বিশ্ব খুঁজে দীর্ঘকাল পর, সম্ভবত উত্তর আমেরিকার একটি দেশে খুঁজে পায়। আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁকে সে দেশ থেকে ইসরায়েলে নিয়ে আসতে হলে নানা আইনকানুনের ফ্যাকড়ার মধ্যে পড়তে হতো, যেমন বিদেশ থেকে বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিদের দু-একজনকে বিচারের জন্য স্বদেশে ফিরিয়ে আনতে আমরা নানা অসুবিধা, ওজর-আপত্তির মুখে পড়ছি।
ইসরায়েল তাই এসব আন্তর্জাতিক আইন ও বাধ্যবাধকতার মধ্য দিয়ে হাঁটেনি। তাঁকে অন্য দেশ থেকে কিডন্যাপ করে নিয়ে এসে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তখন আইখম্যান অতি বৃদ্ধ। সে কথাও ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ বিবেচনায় নেয়নি। কোনো প্রপার ট্রায়াল বা যথাযথ বিচারও তাঁর হয়নি। তখন খবর বেরিয়েছিল, আইখম্যানকে ইসরায়েলে নিয়ে জেলে ঢোকানোর পর সামারি ট্রায়ালের সময় তিনি এক বিচারককে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, 'আমার বিরুদ্ধে লাখ লাখ ইহুদি হত্যার প্রমাণ নেই। আপনাদের কাছে আমার অপরাধের প্রমাণ কই যে আমাকে অবৈধভাবে কিডন্যাপ করে নিয়ে এসে বন্দি করা হলো?'
বিচারক জবাবে বলেছিলেন, 'আপনার অপরাধের প্রমাণ জার্মানি ও পোল্যান্ডের অসংখ্য গ্যাস চেম্বার; যে চেম্বারে হাজার হাজার ইহুদি নরনারী-শিশুকে ঢুকিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আপনার মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধের প্রমাণ আপনি নিজে। আপনি যুদ্ধাপরাধী না হলে যুদ্ধ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিরুদ্দিষ্ট হয়ে গেলেন কেন? নিজের নামধাম-পরিচয় সব মুছে ফেলে ছদ্মবেশে, ছদ্মনামে অন্য দেশে পলাতক জীবন যাপন করছিলেন কেন?'
আইখম্যানের সঙ্গে বাংলাদেশের গোলাম আযমের চরিত্রের চমৎকার মিল পাওয়া যায়। আইখম্যান নিজ হাতে একজন ইহুদিকেও হত্যা করেননি। কিন্তু তাঁর নির্দেশে হাজার হাজার ইহুদি নরনারী ও শিশুকে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে হত্যা করা হয়েছে। গোলাম আযমও নিজ হাতে বাংলাদেশের কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেননি। কিন্তু তাঁর নির্দেশে আলবদর, আলশামস ইত্যাদি নামে অসংখ্য ঘাতক বাহিনী তৈরি হয়েছে এবং তারা পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীকে ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যায় সহযোগিতা দেয়।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষে আইখম্যান যেমন বিদেশে পালিয়ে গিয়েছিলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে হানাদারদের পরাজয় হলে তাদের পলাতক অংশের সঙ্গে গোলাম আযমও বিদেশে পালিয়ে গিয়েছিলেন। আইখম্যান যেমন দীর্ঘকাল বিদেশি পাসপোর্ট বহন করেছেন, গোলাম আযমও তেমনি দীর্ঘ কয়েক বছর বহন করেছেন পাকিস্তানের পাসপোর্ট। আইখম্যানের সঙ্গে তাঁর একটিমাত্র ক্ষেত্রে অমিল। বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার পর আইখম্যান আর স্বদেশদ্রোহী কোনো চক্রান্তে লিপ্ত ছিলেন না। তিনি পলাতক জীবনযাপন করছিলেন। ইসরায়েলের গুপ্ত গোয়েন্দা সংস্থা তাঁকে বিদেশ থেকে কিডন্যাপ করে গোপনে ইসরাইয়েলে নিয়ে এসেছিল।
অন্যদিকে গোলাম আযম বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে পালিয়ে যাওয়ার পর সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো ঘুরে বেরিয়েছেন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে ধ্বংস করার প্রচারণার কাজে। মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরবসহ কোনো মুসলিম দেশ যাতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেয়, সে জন্য তিনি প্রকাশ্যে প্রচারণা চালান। পাকিস্তানে তখন হাজার হাজার আটকে পড়া বাঙালি রয়েছে। তারা বিভিন্ন গোপন পথে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার চেষ্টা করছিল। এই পলায়নের একটা বড় রুট ছিল পাকিস্তান সন্নিহিত আফগানিস্তান। আটক বাঙালিরা যাতে এই আফগান রুট দিয়ে ভারত হয়ে বাংলাদেশে ফিরতে না পারে, গোলাম আযম তার জন্যও আফগান সরকারের ওপর চাপ দেন। আফগানিস্তানের তখনকার সরকারের সঙ্গে পাকিস্তানের সদ্ভাব না থাকায় তারা গোলাম আযমের চাপ অগ্রাহ্য করেন।
স্বাধীনতা লাভের সাড়ে তিন বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় এবং তাঁর সরকারের পতন ঘটে। বাংলাদেশে ক্ষমতা দখল করে স্বাধীনতার শত্রুদের দ্বারা সমর্থিত ও সাহায্যপুষ্ট সরকার। গোলাম আযমের কপাল খুলে যায়। এখানেই আইখম্যানের সঙ্গে তাঁর ভাগ্যের অমিল। আইখম্যানকে বিদেশ থেকে পাকড়াও করে ইসরায়েলে নিয়ে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। আর সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এই দেশদ্রোহী, মানবতার জঘন্য শত্রুকে পাকিস্তানি পাসপোর্টসহ বাংলাদেশে এসে সামাজিক ও রাজনৈতিক পুনর্বাসনের সুযোগ দেন। তাঁর স্ত্রী খালেদা জিয়ার সরকার তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ফিরে পাওয়াসহ তাঁর দল জামায়াতকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অংশীদার হওয়ারও ব্যবস্থা করে দেয়।
বর্তমান হাসিনা সরকারের আমলে গোলাম আযমসহ একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের প্রধান অংশের বিচার শুরু এবং কারো কারো মৃত্যুদণ্ডাদেশ হওয়ায় আশা জেগেছিল, আইখম্যানের মতোই গোলাম আযমকেও ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলে তাঁর মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। গতকাল সোমবার ঘোষিত বিচারের রায়ে গোলাম আযমের ৯০ বছর কারাদণ্ড হয়েছে। তাঁকে নাকি বয়সের কথা বিবেচনা করে মৃত্যুদণ্ডাদেশ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
গোলাম আযমের বিচারের রায় ঘোষিত হয়েছে- এ কথাটা দিয়েই এ লেখাটা শুরু করেছিলাম। তাঁর মতো মানবতার শত্রুর দণ্ড হয়েছে, তাতে আমি খুশি। কিন্তু বিচারে যেখানে তাঁর সব অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে এবং তাঁর কোনো কোনো সহ-অপরাধী আরো কম অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ডাদেশ পেয়েছেন, সেখানে গোলাম আযমের ৯০ দিনের কারাদণ্ড আমার কাছে গুরু পাপে লঘু দণ্ড বলে মনে হয়েছে। বয়সের বিবেচনার কথা এখানে তোলা নিরর্থক। পশ্চিমা জগতেও ফ্রান্সের মার্শাল পেঁতা এবং আইখম্যানের বিচারে এই বয়সের বিবেচনার অজুহাত তোলা হয়নি। এ রায়ের পেছনে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত কোনো ধরনের রাজনৈতিক বিবেচনা কাজ করেছে কি না আমি জানি না।
আমি ব্যক্তিগতভাবে মৃত্যুদণ্ডদানের বিরোধী। কিন্তু যখনই গোলাম আযমকৃত নারীঘাতী শিশুঘাতী বর্বরতার কথা মনে পড়ে বা ১৯৭১ সালের বধ্যভূমিগুলোর দৃশ্যগুলো চোখে ভাসে, তখন মনে হয়, গোলাম আযমের জন্য মৃত্যুদণ্ডও লঘু শাস্তি। তবু একটিই সান্ত্বনা, বিচারে তাঁর অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। জীবনসায়াহ্নে পৌঁছে ৯০ বছরের কারাদণ্ড মৃত্যুদণ্ডাদেশতুল্য। মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে তাঁর শাস্তি এক দিনেই শেষ হয়ে যেত। এখন কারাগারে বসে মৃত্যুর প্রহর গোনা ছাড়া তাঁর আর কী করার থাকবে?
শেষ মুহূর্তে খবর পেয়েছি, বাংলাদেশের সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট এবং প্রগতিশীল ছাত্র ও যুব সংগঠনগুলো এই রায় প্রত্যাখ্যান করে আজ মঙ্গলবার সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে। আমি এই দণ্ডদানে খুশি, কিন্তু সর্বোচ্চ শাস্তিবিধান না হওয়ায় এই বিচার সম্পর্কে আশাবাদী হইনি। এই রায়কে আওয়ামী লীগের সাম্প্রতিক পরাজিত মনোভাবের বহিঃপ্রকাশও বলা চলে। যাঁরা এই রায় প্রত্যাখ্যান করেছেন, তাঁদের প্রতি আমার সমর্থন জানাতে দ্বিধা নেই।
লন্ডন, ১৫ জুলাই, সোমবার, ২০১৩
No comments