এ কলংক আমাদের জাতীয় বিবেকের by মইনুল হোসেন
ট্রান্সপারেন্সি
ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনে রাজনৈতিক দল এবং পুলিশকে দুর্নীতির শীর্ষ খাত
হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং দুর্নীতিতে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বিচার
বিভাগ। দেশের শান্তি-শৃংখলার পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি সবার জন্যই উদ্বেগজনক,
এমনকি যারা এ ব্যাপারে আত্মতৃপ্তিতে ভোগেন তাদের জন্যও। দুর্নীতির কথা বলতে
গিয়ে সরকারি দল কিংবা বিরোধী দলের রাজনীতির মধ্যে কোনোরূপ পার্থক্য করা
হয়নি। সামগ্রিকভাবে দুর্নীতির দ্বারা কলুষিত দলীয় রাজনীতির প্রতি জনগণ
অসন্তোষ প্রদর্শন করেছে। জনতার ধারণায় পুলিশ এবং রাজনীতিবিদ সমান
দুর্নীতিগ্রস্ত, এটা আমাদের সবার জন্য লজ্জার বিষয় হওয়া উচিত। বিচার
বিভাগের দুর্নীতির বিস্তৃতির যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে তাও নিঃসন্দেহে দারুণ
উদ্বেগের বিষয়। সরকার, পুলিশ এবং বিচার বিভাগ- সবাই মিলে যদি
দুর্নীতিগ্রস্ত হয় তাহলে বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয় যে, সাধারণ মানুষকে
দুর্নীতির সম্মিলিত চাপের কাছে অসহায়ভাবে নতিস্বীকার করে কী পরিমাণ
দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। রাজনীতিবিদরা নয়, অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারই
২০০৭ সালে বিচার বিভাগকে স্বাধীন করেছিল। আমাদের গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় সংকট
হচ্ছে আমাদের রাজনৈতিক নেতারা গণতন্ত্রের অর্থ কী এবং গণতন্ত্র কিভাবে কাজ
করে সেটা না বুঝে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের মোহে গণতন্ত্রের বুলি কপচান।
বিচার বিভাগ আইনগতভাবে স্বাধীন হওয়া সত্ত্বেও এর অন্তর্নিহিত দুর্বলতার
কারণে বাইরের দুর্নীতির প্রভাব থেকে বিচার বিভাগকে রক্ষা করা যাচ্ছে না।
বছরখানেক আগে প্রকাশিত বিচার বিভাগের দুর্নীতি সম্পর্কে অপর একটি
মূল্যায়নের পরিপ্রেক্ষিতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সংশ্লিষ্ট সবার কাছ
থেকে সহযোগিতা অনেকটা অসহায়ভাবে প্রত্যাশা করেছিল সুপ্রিমকোর্ট।
সব মামলার ক্ষেত্রে জামিন পাওয়ার ব্যাপারটিকে কঠিন করে তোলা উচিত নয়। কারও বিরুদ্ধে মামলা দিলেই তার বিরুদ্ধে আনীত অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে বলা যাবে না। মামলা দিলেই জামিন পাওয়া যাবে না এমন দাবি করা সুবিচারের কথা নয়। জামিন পাওয়ার অর্থ মুক্তি পাওয়া নয়। জামিন বিভিন্ন শর্তসাপেক্ষেও হতে পারে। অভিযুক্ত হলেই তার সব অধিকার হরণ করতে হবে, তাকে হাত-পা বেঁধে জেলে পুরতে হবে, এমন তো কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। সেক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে যে কোনো মামলায় জড়িত করা হলেই জামিন পাওয়া যাবে না। কোথায় কী ধরনের চাপ আছে তা বুঝতে হবে। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য সহজেই পুলিশ রিমান্ডে পাঠানোর ক্ষেত্রেও দুর্নীতির বড় ধরনের সুযোগ থাকে। তারপরও এই সহজ পন্থা অনুশীলন করার পেছনে কী যুক্তি থাকতে পারে তার সহজ ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব নয়। মনে হবে, কোর্ট-আদালতে স্বাধীন সুবিচারের চিন্তাভাবনা কাজ করছে না। তাই একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি পদে পদে দুর্নীতিমূলক কর্মকাণ্ডের অসহায় শিকার হচ্ছে। দুর্নীতির মামলাগুলোতেও অনেক অদৃশ্য দুর্নীতির কারবার চলছে। দুর্নীতির সুযোগ খুঁজতেই যেন সবাই ব্যস্ত- কে দোষী আর কে নিরপরাধ সেটা কোনো বিষয় নয়।
বিবেকের কাছে আবেদন করা ছাড়া বিচার বিভাগের দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিকার পাওয়ার কোনো প্রক্রিয়াগত উপায় নেই। সবকিছু দেখে শুনে কষ্টই পেতে হয়। যাদের রক্তে দেশ স্বাধীন হয়েছে সেই সাধারণ মানুষের জন্য সুবিচার বিধানে আমরা নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছি। তাই বিচার বিভাগও দুর্নীতির শীর্ষে থাকার কলংক বহন করছে। এ কলংক আমাদের জাতীয় বিবেকের। আসলে আমাদের দরকার একটা সৎ ও অর্থবহ সাহসী সরকার, যে সরকার নিরপেক্ষ বিচারের মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং এর অর্থ উপলব্ধি করতে সক্ষম।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনে রাজনীতিতে দুর্নীতির কথা উল্লেখ করায় বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ রাজনীতিতে দুর্নীতি যে শক্ত শেকড় গেড়ে বসেছে এবং রাজনীতি যে অর্থ কামানোর ভালো ব্যবসায়ে পরিণত হয়েছে সে কথা এখন সবার মুখে মুখেই উচ্চারিত হচ্ছে। একশ্রেণীর ব্যবসায়ীর কাছে দলীয় রাজনীতি জিম্মি হয়ে পড়েছে এবং অর্থ শক্তির কাছে সত্যিকারের রাজনীতিকরা আজ অসহায়। জনসেবার নীতি-মূল্যবোধ নিয়ে যদি রাজনীতি না করা যায় তাহলে রাজনীতি করতে হবে কেন, এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন অনেকেই। নেতৃত্বের পরিবর্তন ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদদের কাছে গ্রহণীয় হতে পারে না। দুর্নীতিতে ভরা রাজনীতির ধারা যেমন চলছে, তেমনই অব্যাহত রাখাটাই এসব ব্যবসায়ী রাজনীতিকদের স্বার্থের অনুকূল। সুশাসন এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বদানের চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ ও অর্থবহ করে থাকে রাজনীতিবিদরা, ব্যবসায়ীরা নয়।
রাজনীতিতে যদি দুর্নীতির লাভজনক ব্যবসা চালু রাখতে হয় তবে তাকে তো নিরাপদও করতে হয়। যেখানে রাজনীতিবিদরা নিজেরাই দুর্নীতির পক্ষে নিমজ্জিত, সেখানে সঙ্গতকারণে পুলিশের দুর্নীতিও উপেক্ষিত হবে, এটাই স্বাভাবিক। কোনো দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি অমলিন ও স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখতে দিতে পারে না। দুর্নীতি দমন কমিশন যতই স্বাধীন হোক না কেন, সংস্থাটিকে দন্তহীন ব্যাঘ্র হিসেবে রাখা হবে যাতে করে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের বড় বড় দুর্নীতি আড়াল রাখা সম্ভব হয়।
রাজনীতি, পুলিশ এবং বিচার বিভাগকে দুর্নীতিগ্রস্ত করেই কেবল দুর্নীতির নেটওয়ার্ক সফলভাবে পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে। রাজনীতির দুর্নীতি হচ্ছে সব দুর্নীতির জননী। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বস্তুত সেই দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে। এত অবিচার, এত বেশি অন্যায়ের কাছে আমরা এত সহজে নতজানু হয়ে আÍসমর্পণ করব, একটা সুশিক্ষিত ও সচেতন জাতি হিসেবে আমাদের কাছে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তবুও সব ধরনের অন্যায়-অবিচার বিনাবাধায় চলে আসছে বহুদিন ধরে। রাজনীতির উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতি কেবল অর্থ সংক্রান্ত নয়। চরম অসহিষ্ণু এবং হিংসাপ্রবণ রাজনীতির জন্য দায়ী রাজনীতির উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতি। রাজনীতিতে অত্যধিক হিংসার বিস্তার প্রত্যেকের জীবনকে অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ ও অনিরাপদ করে তুলেছে। এ রকম অবস্থা দেশের বিকাশমান অর্থনীতির জন্য উপযোগী, কিংবা জনগণের উন্নত জীবন বিকাশের অনুকূল হতে পারে না। সরকারি ভিআইপিদের নিরাপত্তা অধিকতর নিশ্চিত করার জন্য বিশেষ পুলিশি ব্যবস্থা নিলেই তারা নিরাপদে থাকবেন এমনটি ভাবা সুবিবেচনাপ্রসূত হতে পারে না। সমগ্র জাতির নিরাপত্তা বিধানের মধ্যে নেতা-নেত্রীদের নিরাপত্তা খুঁজতে হবে।
শিক্ষিত লোকেরা স্বাধীন ভূমিকা পালন না করার কারণে আমাদের দেশে গণতন্ত্র সহজেই অবক্ষয়ের শিকার হয়ে বিশাল ধাপ্পাবাজিতে পরিণত হয়েছে। তাদের বেশিরভাগই স্বেচ্ছা বন্দিত্ববরণ করে নিয়েছেন রাজনীতিকরণের সুবিধাভোগ করার আকর্ষণে। আমাদের নির্বাচনগুলো ভালো সরকার প্রাপ্তির গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের নিশ্চয়তা দেয় না। একটি ব্যর্থ এবং দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের জায়গায় অপর একটি ব্যর্থ ও দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার আসছে এবং পৌনঃপুনিকভাবে একই ঘটনা ঘটে চলেছে। আমরা কেবল ব্যর্থতাই দেখে চলেছি, সুশাসনের জন্য কোনো স্তম্ভ তৈরি হতে দেখছি না। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে দেখা হয় জাতির নৈতিক দিগদর্শন কম্পাস হিসেবে, যার কাছ থেকে জাতি লাভ করে সৎ ও সুন্দর জীবনের নির্দেশনা। যেসব প্রতিষ্ঠান সুশাসনের জন্য অপরিহার্য ভারসাম্য রক্ষা করে থাকে, রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ আইনের শাসন তদারকি করে থাকে সেসব প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি করে একদিকে সেগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছে, অন্যদিকে আইনের প্রতি জনগণের শ্রদ্ধায় ক্ষয় ধরানো হয়েছে। এরকম পরিস্থিতি অবশ্যম্ভাবীরূপে দেশকে অরাজকতার পথেই ঠেলে দিচ্ছে এবং সামান্য অজুহাতে অনেকের মধ্যে আইন হাতে তুলে নেয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। আইনের প্রতি মানুষ তখনই শ্রদ্ধাশীল হয়, যখন তা সততার সঙ্গে পুলিশ কার্যকর করে এবং বিচার বিভাগের মাধ্যমে আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগ নিশ্চিত থাকে।
গণতান্ত্রিক সুশাসনের জন্য অপরিহার্য এমন সব প্রতিষ্ঠান, যথা রাজনীতি, বিচার ব্যবস্থা এবং পুলিশকে তাদের শ্রদ্ধা ও সম্মানের সঠিক জায়গাটিতে ফিরিয়ে আনার দায়-দায়িত্ব আমাদের পালন করতেই হবে। রাজনীতির দুর্নীতিই পুলিশ ও বিচার ব্যবস্থায় দুর্নীতি ছড়াতে সাহস জোগাচ্ছে। সে কারণে শুরুতে দলের ব্যবসাদারি রাজনীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। ব্যবসাদারি রাজনীতি চলতে দিলে দেশে দুর্নীতির রাজত্বই চলবে। জনগণের নির্বাচন ব্যবসায়ী রাজনীতির হাতে প্রহসন হয়েই থাকবে। আর একের পর এক দুর্নীতির সরকারই আমাদের ভাগ্যে জুটবে।
তাই ব্যবসায়ী রাজনীতির তৈরি দুর্নীতির রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা অবশ্যই ভাঙতে হবে। নতুন প্রজন্মের জন্য সেই সুযোগ সৃষ্টির দায়িত্ব আমাদেরও। কারণ ব্যবসায়ী রাজনীতির দুর্নীতির দুর্গ নির্মাণে আমাদেরও ভূমিকা রয়েছে।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন : আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
সব মামলার ক্ষেত্রে জামিন পাওয়ার ব্যাপারটিকে কঠিন করে তোলা উচিত নয়। কারও বিরুদ্ধে মামলা দিলেই তার বিরুদ্ধে আনীত অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে বলা যাবে না। মামলা দিলেই জামিন পাওয়া যাবে না এমন দাবি করা সুবিচারের কথা নয়। জামিন পাওয়ার অর্থ মুক্তি পাওয়া নয়। জামিন বিভিন্ন শর্তসাপেক্ষেও হতে পারে। অভিযুক্ত হলেই তার সব অধিকার হরণ করতে হবে, তাকে হাত-পা বেঁধে জেলে পুরতে হবে, এমন তো কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। সেক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে যে কোনো মামলায় জড়িত করা হলেই জামিন পাওয়া যাবে না। কোথায় কী ধরনের চাপ আছে তা বুঝতে হবে। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য সহজেই পুলিশ রিমান্ডে পাঠানোর ক্ষেত্রেও দুর্নীতির বড় ধরনের সুযোগ থাকে। তারপরও এই সহজ পন্থা অনুশীলন করার পেছনে কী যুক্তি থাকতে পারে তার সহজ ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব নয়। মনে হবে, কোর্ট-আদালতে স্বাধীন সুবিচারের চিন্তাভাবনা কাজ করছে না। তাই একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি পদে পদে দুর্নীতিমূলক কর্মকাণ্ডের অসহায় শিকার হচ্ছে। দুর্নীতির মামলাগুলোতেও অনেক অদৃশ্য দুর্নীতির কারবার চলছে। দুর্নীতির সুযোগ খুঁজতেই যেন সবাই ব্যস্ত- কে দোষী আর কে নিরপরাধ সেটা কোনো বিষয় নয়।
বিবেকের কাছে আবেদন করা ছাড়া বিচার বিভাগের দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিকার পাওয়ার কোনো প্রক্রিয়াগত উপায় নেই। সবকিছু দেখে শুনে কষ্টই পেতে হয়। যাদের রক্তে দেশ স্বাধীন হয়েছে সেই সাধারণ মানুষের জন্য সুবিচার বিধানে আমরা নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছি। তাই বিচার বিভাগও দুর্নীতির শীর্ষে থাকার কলংক বহন করছে। এ কলংক আমাদের জাতীয় বিবেকের। আসলে আমাদের দরকার একটা সৎ ও অর্থবহ সাহসী সরকার, যে সরকার নিরপেক্ষ বিচারের মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং এর অর্থ উপলব্ধি করতে সক্ষম।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনে রাজনীতিতে দুর্নীতির কথা উল্লেখ করায় বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ রাজনীতিতে দুর্নীতি যে শক্ত শেকড় গেড়ে বসেছে এবং রাজনীতি যে অর্থ কামানোর ভালো ব্যবসায়ে পরিণত হয়েছে সে কথা এখন সবার মুখে মুখেই উচ্চারিত হচ্ছে। একশ্রেণীর ব্যবসায়ীর কাছে দলীয় রাজনীতি জিম্মি হয়ে পড়েছে এবং অর্থ শক্তির কাছে সত্যিকারের রাজনীতিকরা আজ অসহায়। জনসেবার নীতি-মূল্যবোধ নিয়ে যদি রাজনীতি না করা যায় তাহলে রাজনীতি করতে হবে কেন, এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন অনেকেই। নেতৃত্বের পরিবর্তন ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদদের কাছে গ্রহণীয় হতে পারে না। দুর্নীতিতে ভরা রাজনীতির ধারা যেমন চলছে, তেমনই অব্যাহত রাখাটাই এসব ব্যবসায়ী রাজনীতিকদের স্বার্থের অনুকূল। সুশাসন এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বদানের চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ ও অর্থবহ করে থাকে রাজনীতিবিদরা, ব্যবসায়ীরা নয়।
রাজনীতিতে যদি দুর্নীতির লাভজনক ব্যবসা চালু রাখতে হয় তবে তাকে তো নিরাপদও করতে হয়। যেখানে রাজনীতিবিদরা নিজেরাই দুর্নীতির পক্ষে নিমজ্জিত, সেখানে সঙ্গতকারণে পুলিশের দুর্নীতিও উপেক্ষিত হবে, এটাই স্বাভাবিক। কোনো দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি অমলিন ও স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখতে দিতে পারে না। দুর্নীতি দমন কমিশন যতই স্বাধীন হোক না কেন, সংস্থাটিকে দন্তহীন ব্যাঘ্র হিসেবে রাখা হবে যাতে করে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের বড় বড় দুর্নীতি আড়াল রাখা সম্ভব হয়।
রাজনীতি, পুলিশ এবং বিচার বিভাগকে দুর্নীতিগ্রস্ত করেই কেবল দুর্নীতির নেটওয়ার্ক সফলভাবে পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে। রাজনীতির দুর্নীতি হচ্ছে সব দুর্নীতির জননী। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বস্তুত সেই দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে। এত অবিচার, এত বেশি অন্যায়ের কাছে আমরা এত সহজে নতজানু হয়ে আÍসমর্পণ করব, একটা সুশিক্ষিত ও সচেতন জাতি হিসেবে আমাদের কাছে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তবুও সব ধরনের অন্যায়-অবিচার বিনাবাধায় চলে আসছে বহুদিন ধরে। রাজনীতির উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতি কেবল অর্থ সংক্রান্ত নয়। চরম অসহিষ্ণু এবং হিংসাপ্রবণ রাজনীতির জন্য দায়ী রাজনীতির উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতি। রাজনীতিতে অত্যধিক হিংসার বিস্তার প্রত্যেকের জীবনকে অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ ও অনিরাপদ করে তুলেছে। এ রকম অবস্থা দেশের বিকাশমান অর্থনীতির জন্য উপযোগী, কিংবা জনগণের উন্নত জীবন বিকাশের অনুকূল হতে পারে না। সরকারি ভিআইপিদের নিরাপত্তা অধিকতর নিশ্চিত করার জন্য বিশেষ পুলিশি ব্যবস্থা নিলেই তারা নিরাপদে থাকবেন এমনটি ভাবা সুবিবেচনাপ্রসূত হতে পারে না। সমগ্র জাতির নিরাপত্তা বিধানের মধ্যে নেতা-নেত্রীদের নিরাপত্তা খুঁজতে হবে।
শিক্ষিত লোকেরা স্বাধীন ভূমিকা পালন না করার কারণে আমাদের দেশে গণতন্ত্র সহজেই অবক্ষয়ের শিকার হয়ে বিশাল ধাপ্পাবাজিতে পরিণত হয়েছে। তাদের বেশিরভাগই স্বেচ্ছা বন্দিত্ববরণ করে নিয়েছেন রাজনীতিকরণের সুবিধাভোগ করার আকর্ষণে। আমাদের নির্বাচনগুলো ভালো সরকার প্রাপ্তির গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের নিশ্চয়তা দেয় না। একটি ব্যর্থ এবং দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের জায়গায় অপর একটি ব্যর্থ ও দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার আসছে এবং পৌনঃপুনিকভাবে একই ঘটনা ঘটে চলেছে। আমরা কেবল ব্যর্থতাই দেখে চলেছি, সুশাসনের জন্য কোনো স্তম্ভ তৈরি হতে দেখছি না। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে দেখা হয় জাতির নৈতিক দিগদর্শন কম্পাস হিসেবে, যার কাছ থেকে জাতি লাভ করে সৎ ও সুন্দর জীবনের নির্দেশনা। যেসব প্রতিষ্ঠান সুশাসনের জন্য অপরিহার্য ভারসাম্য রক্ষা করে থাকে, রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ আইনের শাসন তদারকি করে থাকে সেসব প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি করে একদিকে সেগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছে, অন্যদিকে আইনের প্রতি জনগণের শ্রদ্ধায় ক্ষয় ধরানো হয়েছে। এরকম পরিস্থিতি অবশ্যম্ভাবীরূপে দেশকে অরাজকতার পথেই ঠেলে দিচ্ছে এবং সামান্য অজুহাতে অনেকের মধ্যে আইন হাতে তুলে নেয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। আইনের প্রতি মানুষ তখনই শ্রদ্ধাশীল হয়, যখন তা সততার সঙ্গে পুলিশ কার্যকর করে এবং বিচার বিভাগের মাধ্যমে আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগ নিশ্চিত থাকে।
গণতান্ত্রিক সুশাসনের জন্য অপরিহার্য এমন সব প্রতিষ্ঠান, যথা রাজনীতি, বিচার ব্যবস্থা এবং পুলিশকে তাদের শ্রদ্ধা ও সম্মানের সঠিক জায়গাটিতে ফিরিয়ে আনার দায়-দায়িত্ব আমাদের পালন করতেই হবে। রাজনীতির দুর্নীতিই পুলিশ ও বিচার ব্যবস্থায় দুর্নীতি ছড়াতে সাহস জোগাচ্ছে। সে কারণে শুরুতে দলের ব্যবসাদারি রাজনীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। ব্যবসাদারি রাজনীতি চলতে দিলে দেশে দুর্নীতির রাজত্বই চলবে। জনগণের নির্বাচন ব্যবসায়ী রাজনীতির হাতে প্রহসন হয়েই থাকবে। আর একের পর এক দুর্নীতির সরকারই আমাদের ভাগ্যে জুটবে।
তাই ব্যবসায়ী রাজনীতির তৈরি দুর্নীতির রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা অবশ্যই ভাঙতে হবে। নতুন প্রজন্মের জন্য সেই সুযোগ সৃষ্টির দায়িত্ব আমাদেরও। কারণ ব্যবসায়ী রাজনীতির দুর্নীতির দুর্গ নির্মাণে আমাদেরও ভূমিকা রয়েছে।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন : আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
No comments