আল্লামা শফীর অশালীন বচন ও ভোটের রাজনীতি by এ কে এম শাহনাওয়াজ
ছেলেবেলায় যখন স্কুলে পড়তাম, তখন
মাঝেমধ্যে রাত জেগে ওয়াজ শুনতে যেতাম। শীতের শুরুতে চাদর গায়ে প্যান্ডেলের
নিচে বসে ধর্মীয় আবেগ ও ভক্তি নিয়ে হুজুরদের বয়ান শুনতাম।
কিন্তু কলেজে ওঠার পর এক বিতৃষ্ণায় ওয়াজ শোনা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলাম।
যখন লক্ষ করলাম হুজুরদের অনেকেই তাঁদের ওয়াজের একটি বড় অংশে নারীচর্চা
করছেন, অর্থাৎ নারীদের খুব ছোট করে দেখা, পর্দার কথা বলতে গিয়ে কুৎসিত
ইঙ্গিত করা- এসব ছিল যেন তাঁদের সহজাত বিষয়। তাঁদের কথা শুনে মনে হতো
নারীরা হচ্ছে নিকৃষ্ট জীব। স্বামীর সেবা করার জন্যই তারা পৃথিবীতে এসেছে।
তাঁদের ভাষায় নারীর চালচলন একটু বেচাল হলেই তারা 'দোজখের খুঁটি'। এর শতগুণ
অন্যায় আচরণ করলেও পুরুষদের নিয়ে তেমন অভিযোগ থাকত না। এসব শুনতে গিয়ে
একসময় ওয়াজের প্রতি ভক্তি উঠে গেল। এমন হতে পারে দুর্ভাগ্যক্রমে আমি সঠিক
ইসলামী চিন্তাবিদদের বয়ান শুনতে পারিনি। কিন্তু যাঁদের ওয়াজ শুনেছি তাঁদের
বয়ান থেকে ইসলামের উদারতার কথা জানা যায়নি। ধর্মের আলোকে গভীর তাত্তি্বক
বিশেষণও উপস্থাপিত হয়নি। শুধু সস্তা কথা ও সস্তা উপমা প্রয়োগ করতে দেখেছি।
১৯৯১-এ আরেকটি সংকট হলো। এ বছর কক্সবাজারে এক ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল। এতে
অনেক সম্পদ ও জীবনহানি ঘটে। তখন আমি দেশের বাইরে ছিলাম। দেশে ফিরে আমার
পাড়ার মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে গেলাম। আমার ছেলেবেলা থেকে চেনা ইমাম সাহেব
নামাজ পড়াচ্ছিলেন। খুব সহজ-সরল মানুষ। মাদ্রাসা শিক্ষায় কতটা এগিয়ে ছিলেন
আমার জানা নেই। তিনি খুতবার আগে বয়ান করছিলেন। একসময় কক্সবাজারের বিপর্যয়ের
কথা এলো। বললেন, বান্দাকে পরীক্ষা করার জন্য এসব গজব নাজিল হয়। আমাদের
পাপের কারণে এসব দুর্যোগ নেমে আসে। আমার এই বয়ান মেনে নিতে কষ্ট হলো। কারণ
আমরা জানি, প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক কারণে প্রায় বছরই নির্দিষ্ট ঋতুতে
সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলে টর্নেডো-জলোচ্ছ্বাস হয়। এতে প্রচুর সম্পদ ও জীবনহানি
ঘটে। সুতরাং আমার মনটা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। কারণ আমার জানা ইসলাম এতটা
অমানবিক নয়, আর মহান আল্লাহকে জানি ন্যায়বিচারক হিসেবে। তাহলে আমাদের সবার
পাপের কারণে ফি বছর সমুদ্রতীরের মানুষকেই জীবন দিতে হবে কেন? ইসলাম তো
অবৈজ্ঞানিক অযৌক্তিক ধর্ম নয়। আসলে অল্প বিদ্যাধারী ইমামরা ইসলামকে
খণ্ডিতভাবে উপস্থাপন করছেন বলে বিভ্রান্ত হচ্ছে সাধারণ মুসলমান। আমরা জানি,
আল কোরআন সাহিত্যমানসমৃদ্ধ একটি মহাগ্রন্থ। কোরআন শরিফে প্রচুর উপমা
অনুপ্রাস রয়েছে, রয়েছে ইতিহাসের উদাহরণ। আর শৈল্পিক দিক থেকে ভীষণভাবে
শিল্পমানসমৃদ্ধ। শাব্দিক অনুবাদে কোরআনের গভীর বক্তব্য অনুধাবন করা কঠিন। এ
কারণে কোরআন বুঝতে হলে তাফসির পড়তে হয়। তাফসির চর্চা করেও কোরআনের বক্তব্য
এবং বক্তব্যের তাৎপর্য স্পষ্ট করা সহজ নয়। তাই পাশাপাশি অন্যান্য
ধর্মগ্রন্থ পড়ে তুলনামূলক ধারণার স্বচ্ছতা তৈরি করতে হয়। অর্থাৎ কোরআন
সঠিকভাবে বুঝতে পারা রীতিমতো গবেষণার বিষয়। যেখানে এই দায়িত্ব না নিয়ে
কোরআনের বক্তব্য ব্যাখ্যা করা হয়, সেখানে ধর্মের সৌন্দর্য ক্ষতিগ্রস্ত
হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
কিন্তু একুশ শতকের এই আলোকিত সময়ে এসে একজন বড় আলেম হিসেবে পরিচিত আল্লামা শফী ওয়াজ করার সময় ভীষণ অশালীন শব্দ প্রয়োগে যখন নারী, পুরুষ ও ইসলামের সৌন্দর্যকে অপমান করলেন তখন তাঁর জ্ঞানের গভীরতা ও মানসিক সুস্থতা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠল। একজন প্রবীণ মানুষকে শর্তহীনভাবে শ্রদ্ধা করার কথা শিখেছি ছেলেবেলা থেকে। আজ তাই আল্লামা শফীকে সমালোচনা করে লিখতে খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু একজন আলেম- যাঁর পেছনে লাখ লাখ অনুসারী আছে বলা হয়, তিনি যখন তাঁর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে দেশ ও সমাজের মানুষকে বিভ্রান্ত করেন; আর সবার সামনে ধর্মের সৌন্দর্যকে কালিমালিপ্ত করেন তখন এর প্রতিবাদ করা কর্তব্যজ্ঞান করি।
এই আল্লামা শফীকে আমি বিশেষ জানতাম না। কিন্তু গত তিন-চার মাসে হেফাজতে ইসলামের বড় বড় কর্মসূচির সূত্রে তাঁর সম্পর্কে কিছুটা ধারণা হয়। জানলাম তিনি হেফাজতে ইসলাম নামের সংগঠনটির আমির। এ ছাড়া সরকার কর্তৃক গঠিত কওমি মাদ্রাসা বোর্ডেরও প্রধান তিনি। এতে ধারণা হয়েছিল, তিনি নিশ্চয় একজন বুজুর্গ আলেম। গত এপ্রিলে হেফাজতে ইসলাম ঢাকায় লংমার্চ করে। শাপলা চত্বরে তারা সমাবেশ করেছিল। এ সময় এক পক্ষের ধারণা ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এরা শাপলা চত্বর থেকে অবরোধ উঠাবে না। কিন্তু কথা রাখলেন আল্লামা শফী। তাঁর নির্দেশে অবরোধ উঠিয়ে চলে যায় হেফাজতে ইসলামের সদস্যরা। এ কারণে আমার ধারণা হয়েছিল, হেফাজতের সত্যিই বোধ হয় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই। জামায়াত-বিএনপি ব্যবহার করতে চাইছে শুধু। এরা সৎ নির্ভেজাল ধর্ম পালনকারী আর প্রচারকারী দল।
কিন্তু আমার ভুল ভাঙল ৫ মে ঢাকা অবরোধের সময়। তারা নানা জায়গায় বিপক্ষ দলের ওপর হামলা চালিয়ে নিজেদের জঙ্গি রূপ প্রকাশ করল। সরকারি ও সাধারণ মানুষদের সম্পত্তিতে আগুন লাগাল। জামায়াতে ইসলামী দলের জঙ্গিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বায়তুল মোকাররমে পবিত্র কোরআনসহ ধর্মীয় কিতাবের দোকানগুলো পুড়িয়ে দিয়ে অনেক গরিব দোকানিকে সর্বস্বান্ত করল। এর জন্য অনুশোচনা না করে দিল রাজনৈতিক বক্তব্য। অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে শাপলা চত্বরে অবরোধ বজায় রাখল। পুলিশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তি ছিল সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে শাপলা চত্বর ছেড়ে দেবে। কিন্তু তা ভঙ্গ করল। এটি ইসলামের দৃষ্টিতে মোনাফেকি হলো কি না, সে প্রশ্ন আল্লামা শফীদের কাছে করাই যায়।
আমরা জানি, মহানবী যুদ্ধের সময় নারী, বৃদ্ধ ও শিশুদের আঘাত করতে নিষেধ করেছেন। বৃক্ষ সম্পদ ধ্বংস না করার হেদায়েত করেছেন। কিন্তু হেফাজতের নেতা-কর্মীরা দায়িত্ব পালনরত নারী সাংবাদিককে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে। রাস্তার আইল্যান্ডের গাছ কেটে ফেলে। মধ্যযুগের ইউরোপে ধর্মযুদ্ধে জয় পেতে 'শিশু ক্রুসেডে'র আয়োজন করেছিল খ্রিস্টান ক্রুসেডাররা। তারা হাজার হাজার শিশুকে ঢাল হিসেবে জাহাজের সামনে রেখে দেয়। পথযাত্রার দুর্যোগে শিশুদের অনেকের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। রোমান পোপের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য ধর্মের নাম ভাঙিয়ে অমন অমানবিক হতে তাদের বুক এতটুকু কাঁপেনি। একইভাবে একুশ শতকের বাংলাদেশি হেফাজতিরা হাজার হাজার এতিম গরিব শিশু ছাত্রদের মিছিলের অগ্রভাগে রেখে বিপদের মুখে অবলীলায় ঠেলে দিয়েছিল।
এসব কর্মকাণ্ডের একটিও কি ইসলামসম্মত? এ ধরনের ইসলামের লেবাসধারীরা নিজেদের রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ে যুগ যুগ ধরে পবিত্র ইসলাম ধর্মকে লাঞ্ছিত করেছে। আমরা বিশ্বাস করি, আল্লামা শফীর অশালীন বয়ানে কিছুসংখ্যক সুবিধাবাদী হেফাজতি নেতা ছাড়া হেফাজতে ইসলামের অনুসারী লাখ লাখ ছাত্র-শিক্ষক লজ্জিত। প্রকৃত ধার্মিক মুসলমান ঘৃণা ও নিন্দা প্রকাশ করবে এসব অশ্রাব্য বয়ানের বিরুদ্ধে।
ইসলামে সত্য নিশ্চিত না হয়ে অনুমানে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তাহলে আমি কি বিনীতভাবে আল্লামা শফীকে প্রশ্ন করতে পারি গার্মেন্টে কাজ করা মেয়েরা 'জেনা করে টাকা উপার্জন করে' এ বিষয়টি তিনি নিশ্চিত হলেন কেমন করে? প্রমাণ ছাড়া এমন জঘন্য অভিযোগ একটি ইসলামী জলসায় আলেম নামধারী কেউ কি করতে পারেন? মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে গরিব মেয়েরা দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে আর সে টাকার পরোক্ষ শক্তিতে আল্লামা হুজুররা হেলিকপ্টারে চড়ে আন্দোলন করেন। সেই হুজুররা দেশের অর্থনীতিতে দৃশ্যমান অবদান না রেখেও যদি শ্রমজীবী নারীদের এভাবে লাঞ্ছিত করেন, তবে সচেতন দেশবাসীর সঙ্গে নারীদের রুদ্র রোষের মুখেই তাঁদের পড়তে হবে। চিন্তাভাবনা ও রুচিতে কতটা নিম্নস্তরের হলে নারীকে তেঁতুলের সঙ্গে তুলনা করে তাদের ভোগ্যপণ্য হিসেবে দেখাতে চান। নারী দেখলেই আল্লামা শফীদের মতো পুরুষদেরই শুধু 'দিলে লালা ঝরে'। কই দেশের সুস্থ পুরুষদের তো এমন মনোবৈকল্য ঘটে না। আমরা পুরুষ শিক্ষকরা ছাত্রীদেরও ক্লাস নিই। সেখানে তো পারস্পরিকভাবে শ্রদ্ধা ও স্নেহের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কর্মজীবী পুরুষদের সঙ্গে নারী সহকর্মীর মধ্যে গড়ে ওঠে শ্রদ্ধা, স্নেহ ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক। তাদের সবার 'দিলে যদি লালা ঝরত' তবে কি সমাজ ভারসাম্য রক্ষা করে এগিয়ে যেতে পারত? আল্লামা শফী এভাবে বলে শুধু নারী সমাজকেই অপমানিত করেননি, তাবৎ পুরুষ সমাজকেও অপমান করেছেন। সবাকেই নারীলিপ্সু চরিত্রহীন সাব্যস্ত করেছেন। সুতরাং এর প্রতিবাদ দেশে সব শ্রেণীর মানুষেরই করা উচিত।
আমি আল্লামা শফীর এই কুরুচিপূর্ণ বয়ানের কারণ নিয়ে একজন মনোবিজ্ঞানীর সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি টেলিভিশনের পর্দায় আল্লামা শফীর অশালীন বক্তব্যগুলো শুনেছেন। তাঁর মতে, মনস্তত্ত্বের বিচারে এটি একটি রোগ। যার নাম 'সাইকো সেক্সচুয়াল ডিজফাংশন'। নানা যৌন অবদমন ও বিকৃতি থেকে এমন সংকট সৃষ্টি হয়। যদি সত্যিই তেমনটি ঘটে থাকে তবে অবশ্যই আল্লামা হুজুরের চিকিৎসা প্রয়োজন।
মধ্যযুগে বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারিত হয়েছিল সুফি-সাধকদের মাধ্যমে। শাহ সুলতান রুমি, সুফি শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা, রুকনউদ্দিন আল সমরখন্দি, শাহজালাল তাব্রেজি এমন সুফিদের হাতে ইসলাম সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তাঁদের চরিত্র বিভায় ও মানবিক আচরণে মুগ্ধ হয়ে মানুষ ছুটে এসেছিল ইসলামের ছায়াতলে। একুশ শতকের তথাকথিত ইসলামী চিন্তাবিদরা অন্ধকার তৈরি করতে পারলেও চৌদ্দ-পনেরো শতকে ধর্মচর্চায় সুপণ্ডিত সুফিরা ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য তুলে ধরে মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিতে পেরেছিলেন।
আমাদের দুর্ভাগ্য, এসব অসংস্কৃত অশোভন ধর্ম বিকৃতকারীরা সমাজে দাপটে চলেন ভোটের রাজনীতির পথে হাঁটা স্বার্থপর রাজনীতিকদের প্রশ্রয়ে। রাজনৈতিক স্বার্থে বিএনপি-জামায়াত হেফাজতদের কাঁধে তুলেছে। এরশাদ সমর্থন দিয়েছেন না হয় নিজ চরিত্রের সঙ্গে এ ধরনের আল্লামাদের চরিত্রের মিল খুঁজে পেয়েছেন বলে। এ ধারার অন্য খুচরো নেতা-নেত্রীদের কথা বলে লাভ নেই। তবে আল্লামা শফীর অমন বয়ানের পর বড় দলের যাঁরা রাষ্ট্রক্ষমতায় আসা-যাওয়া করেন, তাঁদের ভোটের মোহে নিশ্চুপ থাকা মানাচ্ছে না। দেশের ফুঁসে ওঠা মানুষ কিন্তু জবাবদিহিতা চাইবে। একুশ শতকের আধুনিক যুগে সব আবর্জনার দায় যদি নিকৃষ্ট রাজনীতি গ্রহণ করে; তবে এর কঠিন প্রতিক্রিয়ার মোকাবিলা অবশ্যই করতে হবে। তাই অমন বিষকাঁটা উপড়ে ফেলার জন্য আজ দল-মত-নির্বিশেষে সবার ঐকবদ্ধ হওয়া জরুরি।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
shahnawaz7b@gmail.com
কিন্তু একুশ শতকের এই আলোকিত সময়ে এসে একজন বড় আলেম হিসেবে পরিচিত আল্লামা শফী ওয়াজ করার সময় ভীষণ অশালীন শব্দ প্রয়োগে যখন নারী, পুরুষ ও ইসলামের সৌন্দর্যকে অপমান করলেন তখন তাঁর জ্ঞানের গভীরতা ও মানসিক সুস্থতা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠল। একজন প্রবীণ মানুষকে শর্তহীনভাবে শ্রদ্ধা করার কথা শিখেছি ছেলেবেলা থেকে। আজ তাই আল্লামা শফীকে সমালোচনা করে লিখতে খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু একজন আলেম- যাঁর পেছনে লাখ লাখ অনুসারী আছে বলা হয়, তিনি যখন তাঁর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে দেশ ও সমাজের মানুষকে বিভ্রান্ত করেন; আর সবার সামনে ধর্মের সৌন্দর্যকে কালিমালিপ্ত করেন তখন এর প্রতিবাদ করা কর্তব্যজ্ঞান করি।
এই আল্লামা শফীকে আমি বিশেষ জানতাম না। কিন্তু গত তিন-চার মাসে হেফাজতে ইসলামের বড় বড় কর্মসূচির সূত্রে তাঁর সম্পর্কে কিছুটা ধারণা হয়। জানলাম তিনি হেফাজতে ইসলাম নামের সংগঠনটির আমির। এ ছাড়া সরকার কর্তৃক গঠিত কওমি মাদ্রাসা বোর্ডেরও প্রধান তিনি। এতে ধারণা হয়েছিল, তিনি নিশ্চয় একজন বুজুর্গ আলেম। গত এপ্রিলে হেফাজতে ইসলাম ঢাকায় লংমার্চ করে। শাপলা চত্বরে তারা সমাবেশ করেছিল। এ সময় এক পক্ষের ধারণা ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এরা শাপলা চত্বর থেকে অবরোধ উঠাবে না। কিন্তু কথা রাখলেন আল্লামা শফী। তাঁর নির্দেশে অবরোধ উঠিয়ে চলে যায় হেফাজতে ইসলামের সদস্যরা। এ কারণে আমার ধারণা হয়েছিল, হেফাজতের সত্যিই বোধ হয় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই। জামায়াত-বিএনপি ব্যবহার করতে চাইছে শুধু। এরা সৎ নির্ভেজাল ধর্ম পালনকারী আর প্রচারকারী দল।
কিন্তু আমার ভুল ভাঙল ৫ মে ঢাকা অবরোধের সময়। তারা নানা জায়গায় বিপক্ষ দলের ওপর হামলা চালিয়ে নিজেদের জঙ্গি রূপ প্রকাশ করল। সরকারি ও সাধারণ মানুষদের সম্পত্তিতে আগুন লাগাল। জামায়াতে ইসলামী দলের জঙ্গিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বায়তুল মোকাররমে পবিত্র কোরআনসহ ধর্মীয় কিতাবের দোকানগুলো পুড়িয়ে দিয়ে অনেক গরিব দোকানিকে সর্বস্বান্ত করল। এর জন্য অনুশোচনা না করে দিল রাজনৈতিক বক্তব্য। অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে শাপলা চত্বরে অবরোধ বজায় রাখল। পুলিশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তি ছিল সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে শাপলা চত্বর ছেড়ে দেবে। কিন্তু তা ভঙ্গ করল। এটি ইসলামের দৃষ্টিতে মোনাফেকি হলো কি না, সে প্রশ্ন আল্লামা শফীদের কাছে করাই যায়।
আমরা জানি, মহানবী যুদ্ধের সময় নারী, বৃদ্ধ ও শিশুদের আঘাত করতে নিষেধ করেছেন। বৃক্ষ সম্পদ ধ্বংস না করার হেদায়েত করেছেন। কিন্তু হেফাজতের নেতা-কর্মীরা দায়িত্ব পালনরত নারী সাংবাদিককে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে। রাস্তার আইল্যান্ডের গাছ কেটে ফেলে। মধ্যযুগের ইউরোপে ধর্মযুদ্ধে জয় পেতে 'শিশু ক্রুসেডে'র আয়োজন করেছিল খ্রিস্টান ক্রুসেডাররা। তারা হাজার হাজার শিশুকে ঢাল হিসেবে জাহাজের সামনে রেখে দেয়। পথযাত্রার দুর্যোগে শিশুদের অনেকের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। রোমান পোপের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য ধর্মের নাম ভাঙিয়ে অমন অমানবিক হতে তাদের বুক এতটুকু কাঁপেনি। একইভাবে একুশ শতকের বাংলাদেশি হেফাজতিরা হাজার হাজার এতিম গরিব শিশু ছাত্রদের মিছিলের অগ্রভাগে রেখে বিপদের মুখে অবলীলায় ঠেলে দিয়েছিল।
এসব কর্মকাণ্ডের একটিও কি ইসলামসম্মত? এ ধরনের ইসলামের লেবাসধারীরা নিজেদের রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ে যুগ যুগ ধরে পবিত্র ইসলাম ধর্মকে লাঞ্ছিত করেছে। আমরা বিশ্বাস করি, আল্লামা শফীর অশালীন বয়ানে কিছুসংখ্যক সুবিধাবাদী হেফাজতি নেতা ছাড়া হেফাজতে ইসলামের অনুসারী লাখ লাখ ছাত্র-শিক্ষক লজ্জিত। প্রকৃত ধার্মিক মুসলমান ঘৃণা ও নিন্দা প্রকাশ করবে এসব অশ্রাব্য বয়ানের বিরুদ্ধে।
ইসলামে সত্য নিশ্চিত না হয়ে অনুমানে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তাহলে আমি কি বিনীতভাবে আল্লামা শফীকে প্রশ্ন করতে পারি গার্মেন্টে কাজ করা মেয়েরা 'জেনা করে টাকা উপার্জন করে' এ বিষয়টি তিনি নিশ্চিত হলেন কেমন করে? প্রমাণ ছাড়া এমন জঘন্য অভিযোগ একটি ইসলামী জলসায় আলেম নামধারী কেউ কি করতে পারেন? মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে গরিব মেয়েরা দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে আর সে টাকার পরোক্ষ শক্তিতে আল্লামা হুজুররা হেলিকপ্টারে চড়ে আন্দোলন করেন। সেই হুজুররা দেশের অর্থনীতিতে দৃশ্যমান অবদান না রেখেও যদি শ্রমজীবী নারীদের এভাবে লাঞ্ছিত করেন, তবে সচেতন দেশবাসীর সঙ্গে নারীদের রুদ্র রোষের মুখেই তাঁদের পড়তে হবে। চিন্তাভাবনা ও রুচিতে কতটা নিম্নস্তরের হলে নারীকে তেঁতুলের সঙ্গে তুলনা করে তাদের ভোগ্যপণ্য হিসেবে দেখাতে চান। নারী দেখলেই আল্লামা শফীদের মতো পুরুষদেরই শুধু 'দিলে লালা ঝরে'। কই দেশের সুস্থ পুরুষদের তো এমন মনোবৈকল্য ঘটে না। আমরা পুরুষ শিক্ষকরা ছাত্রীদেরও ক্লাস নিই। সেখানে তো পারস্পরিকভাবে শ্রদ্ধা ও স্নেহের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কর্মজীবী পুরুষদের সঙ্গে নারী সহকর্মীর মধ্যে গড়ে ওঠে শ্রদ্ধা, স্নেহ ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক। তাদের সবার 'দিলে যদি লালা ঝরত' তবে কি সমাজ ভারসাম্য রক্ষা করে এগিয়ে যেতে পারত? আল্লামা শফী এভাবে বলে শুধু নারী সমাজকেই অপমানিত করেননি, তাবৎ পুরুষ সমাজকেও অপমান করেছেন। সবাকেই নারীলিপ্সু চরিত্রহীন সাব্যস্ত করেছেন। সুতরাং এর প্রতিবাদ দেশে সব শ্রেণীর মানুষেরই করা উচিত।
আমি আল্লামা শফীর এই কুরুচিপূর্ণ বয়ানের কারণ নিয়ে একজন মনোবিজ্ঞানীর সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি টেলিভিশনের পর্দায় আল্লামা শফীর অশালীন বক্তব্যগুলো শুনেছেন। তাঁর মতে, মনস্তত্ত্বের বিচারে এটি একটি রোগ। যার নাম 'সাইকো সেক্সচুয়াল ডিজফাংশন'। নানা যৌন অবদমন ও বিকৃতি থেকে এমন সংকট সৃষ্টি হয়। যদি সত্যিই তেমনটি ঘটে থাকে তবে অবশ্যই আল্লামা হুজুরের চিকিৎসা প্রয়োজন।
মধ্যযুগে বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারিত হয়েছিল সুফি-সাধকদের মাধ্যমে। শাহ সুলতান রুমি, সুফি শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা, রুকনউদ্দিন আল সমরখন্দি, শাহজালাল তাব্রেজি এমন সুফিদের হাতে ইসলাম সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তাঁদের চরিত্র বিভায় ও মানবিক আচরণে মুগ্ধ হয়ে মানুষ ছুটে এসেছিল ইসলামের ছায়াতলে। একুশ শতকের তথাকথিত ইসলামী চিন্তাবিদরা অন্ধকার তৈরি করতে পারলেও চৌদ্দ-পনেরো শতকে ধর্মচর্চায় সুপণ্ডিত সুফিরা ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য তুলে ধরে মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিতে পেরেছিলেন।
আমাদের দুর্ভাগ্য, এসব অসংস্কৃত অশোভন ধর্ম বিকৃতকারীরা সমাজে দাপটে চলেন ভোটের রাজনীতির পথে হাঁটা স্বার্থপর রাজনীতিকদের প্রশ্রয়ে। রাজনৈতিক স্বার্থে বিএনপি-জামায়াত হেফাজতদের কাঁধে তুলেছে। এরশাদ সমর্থন দিয়েছেন না হয় নিজ চরিত্রের সঙ্গে এ ধরনের আল্লামাদের চরিত্রের মিল খুঁজে পেয়েছেন বলে। এ ধারার অন্য খুচরো নেতা-নেত্রীদের কথা বলে লাভ নেই। তবে আল্লামা শফীর অমন বয়ানের পর বড় দলের যাঁরা রাষ্ট্রক্ষমতায় আসা-যাওয়া করেন, তাঁদের ভোটের মোহে নিশ্চুপ থাকা মানাচ্ছে না। দেশের ফুঁসে ওঠা মানুষ কিন্তু জবাবদিহিতা চাইবে। একুশ শতকের আধুনিক যুগে সব আবর্জনার দায় যদি নিকৃষ্ট রাজনীতি গ্রহণ করে; তবে এর কঠিন প্রতিক্রিয়ার মোকাবিলা অবশ্যই করতে হবে। তাই অমন বিষকাঁটা উপড়ে ফেলার জন্য আজ দল-মত-নির্বিশেষে সবার ঐকবদ্ধ হওয়া জরুরি।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
shahnawaz7b@gmail.com
No comments