দ্রব্যমূল্যের পারদ চড়ছে দেশে এসেশবেবরাতে বেড়েছে এক দফা, রমজানেও আশঙ্কা by রাজীব আহমেদ
গত জানুয়ারি মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে
প্রতি টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের গড় দাম ছিল এক হাজার ২০০ ডলারের কাছাকাছি।
কয়েক মাস ধরে কমতে কমতে তা এখন এক হাজার ১০০ ডলারের নিচে।
অন্য
সময়ের চেয়ে রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় এ পণ্যের চাহিদা কিছুটা বেড়ে প্রায় ৪০
হাজার টন হয়। বর্তমানে সয়াবিন তেল মজুদ আছে ৫৪ হাজার টনেরও বেশি। এ ছাড়া
আসার পথে রয়েছে আমদানি করা আরো কিছু পরিমাণ তেল।
সব মিলিয়ে এবারের রমজানে সয়াবিন তেলের মজুদ 'যথেষ্ট ভালো'। সরবরাহেও কোনো সংকট নেই। ডলারের দাম আগের বছরের চেয়ে অনেকখানি কমেছে। ব্যাংকঋণের সুদ নতুন করে বাড়েনি। এ পরিস্থিতিতে দাম বাড়ার কোনো কারণই নেই। তার পরও বাজারে খোলা সয়াবিন তেলের দাম এক দফা বেড়েছে শবেবরাতের আগে।
সয়াবিন তেলের মতো পাম তেল, চিনি, পেঁয়াজ, রসুনসহ কয়েকটি পণ্যের আন্তর্জাতিক দরও অনুকূলে। পাশাপাশি এসব পণ্যের সরবরাহ পরিস্থিতিও সন্তোষজনক। এমন পরিস্থিতিতে রমজান উপলক্ষে অনেক নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার কোনো কারণ দেখছেন না সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বরং দাম কমা উচিত বলে মনে করছেন তাঁরা। কিন্তু বাস্তব অবস্থাটা এর উল্টো। শবেবরাতের বাজার করতে গিয়ে নগরবাসী দীর্ঘদিন ধরে স্থিতিশীল থাকা বেশ কিছু পণ্যের বাড়তি দাম দেখেছে। রমজানের আগে এসব পণ্যের দাম আরো বাড়ার আশঙ্কায় আছে তারা।
জানতে চাইলে ভলান্টারি কনজ্যুমার অ্যাওয়ারনেস অ্যান্ড ট্রেনিং সোসাইটির (ভোক্তা) নির্বাহী পরিচালক খলিলুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'প্রতিবছর রমজানেই জিনিসপত্রের দাম বাড়ার একটা প্রবণতা দেখা যায়। বাজারের নিয়মে বাজার চললে দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু আমাদের বাজার রীতি অনুযায়ী আচরণ করে না।'
রমজানের আগে দাম বাড়ার কারণ সম্পর্কে খলিলুর রহমান আরো বলেন, 'রমজানের আগে ক্রেতারা সাধারণত একসঙ্গে পুরো মাসের পণ্য কিনে থাকেন। এর ফলে বাজারে চাহিদা বিপুলভাবে বেড়ে যায়। এর সুযোগ নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা সব কিছুর দাম বাড়িয়ে দেয়।' ব্যবসায়ীদের এ সুযোগ না দিতে তিনি ক্রেতাদের ভাগে ভাগে পণ্য কেনার পরামর্শ দিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সয়াবিন ও পাম তেল মিলিয়ে রমজান মাসে মোট প্রায় এক লাখ ৫০ হাজার টন ভোজ্য তেল প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের দ্রব্যমূল্য মনিটরিং সেল হিসাব করে দেখেছে, রমজান সামনে রেখে দেশে এক লাখ ৭৪ হাজার ৫৩৫ টন ভোজ্য তেল মজুদ আছে। মজুদের পরিমাণ চাহিদার তুলনায় ২৪ হাজার ৫৩৫ টন বেশি। এখন শীতকাল নয় বলে সয়াবিন তেলের চাহিদা বেড়ে গিয়ে দাম বাড়ারও কোনো কারণ নেই।
ভোজ্য তেলের আন্তর্জাতিক বাজারদরে পড়তির ধারা বেশ কয়েক মাস ধরেই। ট্যারিফ কমিশনের এক হিসাবে দেখা যায়, গত বুধবার অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের আন্তর্জাতিক বাজারদর (সিঅ্যান্ডএফ) ছিল টনপ্রতি এক হাজার ৮৮ ডলার। এক সপ্তাহ আগেও যা প্রায় এক হাজার ১৩৭ ডলার ছিল। এক বছর আগে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম ছিল টনপ্রতি এক হাজার ১৬৭ ডলার। একইভাবে দেশে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পাম তেলের দাম ব্যাপকভাবে কমেছে। এক বছর আগের এক হাজার ৯৯ ডলারের পাম তেলের দাম (সিঅ্যান্ডএফ) এখন টনপ্রতি ৭৯৬ ডলারে নেমেছে। এক সপ্তাহ আগের দাম হচ্ছে ৮৫৬ ডলার।
আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক দরপতন ও দেশে চাহিদার তুলনায় বেশি মজুদ থাকার পরও গত সপ্তাহে শবেবরাতের আগে খোলা সয়াবিন তেলের দাম লিটারে দুই টাকা বেড়েছে খুচরা বাজারে। বাজারে এখন খোলা সয়াবিন লিটারপ্রতি ১১০ থেকে ১১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে পাম তেলের দামও লিটারে দুই টাকা বেড়েছে। এখন তা খুচরা দোকানে ৭৫ থেকে ৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। শবেবরাতের পর পাইকারি বাজারে খোলা ভোজ্য তেলের দর কিছুটা কমলেও খুচরা বাজারে এর প্রভাব পড়েনি।
অপরিশোধিত চিনির দামও ব্যাপকভাবে কমেছে আন্তর্জাতিক বাজারে। এক বছর আগে যে চিনি টনপ্রতি ৫৯১ ডলারে (সিঅ্যান্ডএফ) বিক্রি হতো, এর দর বুধবার ছিল ৪৪০ ডলার। এক মাস আগে এ অপরিশোধিত চিনির দাম ছিল ৪৫১ ডলার। ট্যারিফ কমিশনের হিসাবে, রমজানে দেশে এক লাখ ৬০ হাজার টন চিনির প্রয়োজন হয়। মজুদ আছে এক লাখ ৭৩ হাজার ২৮২ টন। আরো কিছু চিনি দেশে আসার অপেক্ষায় আছে। সব মিলিয়ে মজুদ ভালোই। কিন্তু শবেবরাত উপলক্ষে প্রতি কেজি খোলা চিনির দাম দুই টাকা বেড়ে যাওয়ার পর এখন ৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আর প্যাকেটজাত চিনি প্রতি কেজি ৫৪ থেকে ৫৫ টাকায় কিনতে হচ্ছে খুচরা ক্রেতাদের। এ পণ্যের দাম গত এক বছর স্থিতিশীল ছিল।
পেঁয়াজের আন্তর্জাতিক বাজারদরও বড় ধরনের পড়তির দিকেই। এক মাস আগের তুলনায় পেঁয়াজের আন্তর্জাতিক দর প্রায় ৬ শতাংশ কমেছে। এখন প্রতি টন পেঁয়াজের দাম ২৫৯ ডলার (সিঅ্যান্ডএফ)। এক মাস আগে ছিল ২৭৫ ডলার। রমজানে দেশে তিন লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। এর বিপরীতে মজুদ আছে তিন লাখ ৬১ হাজার ৫৯৭ টন। দেশের বাজারে সম্প্রতি দেশি ও ভারতীয় পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৩২ থেকে ৩৫ টাকায়, যা আগের চেয়ে দুই থেকে তিন টাকা বেশি। কেজিপ্রতি তিন থেকে পাঁচ টাকা বেড়ে দেশি পেঁয়াজ মানভেদে ৩৮ থেকে ৪০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
রসুনের আন্তর্জাতিক বাজারদর কমছে। এক মাস আগের ২৯৩ ডলার থেকে কমে এখন প্রতি টন রসুন ২৮৩ ডলারে (সিঅ্যান্ডএফ) বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি রমজানে এর মজুদ চাহিদার তুলনায় বেশি আছে। দেশের পাইকারি বাজারেও এ মসলার দাম কমছে। কিন্তু খুচরা বিক্রেতারা বেশি দাম হাঁকছেন। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি আমদানি করা রসুনের দাম চাওয়া হচ্ছে ৯০ থেকে ১০০ টাকা, যা পাইকারি বাজারের চেয়ে কেজিপ্রতি ৩০-৩৫ টাকা বেশি।
মসুর ডালের আন্তর্জাতিক বাজারদর অবশ্য কিছুটা বাড়তির দিকে। তবে দেশে নতুন মৌসুমের ডাল বাজারে আসায় এ পণ্যেরও দাম বাড়ার কোনো কারণ দেখছেন না সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বর্তমানে দেশে ৫০ হাজার টনের চাহিদার বিপরীতে এক লাখ দুই হাজার ৬০৮ টন মসুর ডাল মজুদ আছে।
কাস্টমসের আমদানির তথ্য অনুযায়ী ছোলা, আদা, হলুদ, মরিচসহ কোনো পণ্যেরই ঘাটতি নেই। সার্বিক সরবরাহ পরিস্থিতি সম্পর্কে ট্যারিফ কমিশনের পর্যবেক্ষণ হলো, যেসব পণ্য দেশে আসার অপেক্ষায় আছে তা হিসাবে যোগ করলে মজুদের পরিমাণ আরো বাড়বে। ফলে রমজানে পণ্যের কোনো ঘাটতি হবে না।
রমজানের অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য ছোলায় অতিরিক্ত মুনাফার চিত্র উঠে এসেছে ট্যারিফ কমিশনের আরেকটি হিসাবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া ওই হিসাবে দেখা যায়, এবারের রমজান উপলক্ষে মে থেকে জুনের প্রথম চার দিন পর্যন্ত যে পরিমাণ ছোলা আমদানি করা হয়েছে তার আমদানি মূল্য ছিল প্রতি টনে ৫৮৭ ডলার থেকে ৬৯৬ ডলার পর্যন্ত। এর সঙ্গে অন্যান্য খরচ ও বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যবসায়ীদের মুনাফা যোগ করলে প্রতি কেজি ছোলার গড় দাম দাঁড়ায় ৫৮ টাকা ৭৯ পয়সা। পাইকারি বাজারে ছোলা ৫৫ টাকার নিচে বিক্রি হলেও খুচরা বাজারে পৌঁছতেই এর দাম কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়ে যাচ্ছে।
চাহিদা ও জোগানে ভারসাম্য এবং পড়তি দরের পরিপ্রেক্ষিতেও বাজারে পণ্যের দাম কেন বাড়ে জানতে চাইলে পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারের এক পাইকারি ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'রোজায় বাড়তি চাহিদার সুযোগে কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ীর উদ্ভব হয়। যারা বেশি টাকা নিয়ে এসে পণ্য মজুদ করে। এ ছাড়া খুচরা বিক্রেতাদের মধ্যেও বেশি মুনাফার প্রবণতা দেখা যায়। এসব কারণেই দাম বেড়ে যায়।'
খুচরা বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে অবস্থা বুঝে বেশি মুনাফার অভিযোগ সম্পর্কে রাজধানীর কাজীপাড়া বাজারের মনিহারি পণ্যের দোকান মায়ের দোয়া স্টোরের একজন বিক্রেতা জানান, তাঁরা এক বস্তা পণ্য কিনে সারা মাস ধরে বিক্রি করেন। খুচরা বিক্রি করতে গেলে পণ্যের ঘাটতি বেশি হয়। ফলে দাম একটু বেশি না নিলে তাঁদের পোষায় না।
ওই বিক্রেতা বলেন, 'এক বস্তা (৫০ কেজি) ছোলা বিক্রি করলে এক কেজি ঘাটতি হয়। কিন্তু পাইকারি ব্যবসায়ীদের কোনো ঘাটতি নেই। ফলে তাদের লাভ কম করলেও চলে।'
বাসাবো এলাকায় বসবাসকারী ব্যাংক কর্মকর্তা খোরশেদ আলম বলেন, 'শবেবরাতেই যেভাবে কিছু জিনিসের দাম বেড়েছে, তাতে রোজার সময় বাজারের অবস্থা কী দাঁড়াবে তা ভেবে পাচ্ছি না। সরকারের এখন থেকেই বাজারের ওপর নজরদারি করা উচিত।'
এ বিষয় নিয়ে বাজার-সংশ্লিষ্ট বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রমজান শুরুর আগে প্রায় সবাই একসঙ্গে পুরো মাসের জন্য নির্দিষ্ট কিছু পণ্য কিনে ফেলেন বলে বাজারে সেগুলোর বিপুল চাহিদা সৃষ্টি হয়। ফলে প্রচুর মজুদ থাকার পরও এ সময় ওই সব পণ্যের সাময়িক বা কৃত্রিম সংকট দেখা দেয়। এ ছাড়া সুযোগ পেলেই পণ্যের দাম বাড়ানোটা এ দেশে এক ধরনের রেওয়াজ হয়ে দেখা দিয়েছে।
এদিকে আগামী রবিবার ভোজ্য তেল ও চিনি ব্যবসায়ীদের নিয়ে একটি জরুরি মতবিনিময় সভার আয়োজন করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ওই সভায় এ দুটি পণ্যের সরবরাহ ও দাম নিয়ে আলোচনা হবে বলে জানা গেছে।
সব মিলিয়ে এবারের রমজানে সয়াবিন তেলের মজুদ 'যথেষ্ট ভালো'। সরবরাহেও কোনো সংকট নেই। ডলারের দাম আগের বছরের চেয়ে অনেকখানি কমেছে। ব্যাংকঋণের সুদ নতুন করে বাড়েনি। এ পরিস্থিতিতে দাম বাড়ার কোনো কারণই নেই। তার পরও বাজারে খোলা সয়াবিন তেলের দাম এক দফা বেড়েছে শবেবরাতের আগে।
সয়াবিন তেলের মতো পাম তেল, চিনি, পেঁয়াজ, রসুনসহ কয়েকটি পণ্যের আন্তর্জাতিক দরও অনুকূলে। পাশাপাশি এসব পণ্যের সরবরাহ পরিস্থিতিও সন্তোষজনক। এমন পরিস্থিতিতে রমজান উপলক্ষে অনেক নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার কোনো কারণ দেখছেন না সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বরং দাম কমা উচিত বলে মনে করছেন তাঁরা। কিন্তু বাস্তব অবস্থাটা এর উল্টো। শবেবরাতের বাজার করতে গিয়ে নগরবাসী দীর্ঘদিন ধরে স্থিতিশীল থাকা বেশ কিছু পণ্যের বাড়তি দাম দেখেছে। রমজানের আগে এসব পণ্যের দাম আরো বাড়ার আশঙ্কায় আছে তারা।
জানতে চাইলে ভলান্টারি কনজ্যুমার অ্যাওয়ারনেস অ্যান্ড ট্রেনিং সোসাইটির (ভোক্তা) নির্বাহী পরিচালক খলিলুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'প্রতিবছর রমজানেই জিনিসপত্রের দাম বাড়ার একটা প্রবণতা দেখা যায়। বাজারের নিয়মে বাজার চললে দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু আমাদের বাজার রীতি অনুযায়ী আচরণ করে না।'
রমজানের আগে দাম বাড়ার কারণ সম্পর্কে খলিলুর রহমান আরো বলেন, 'রমজানের আগে ক্রেতারা সাধারণত একসঙ্গে পুরো মাসের পণ্য কিনে থাকেন। এর ফলে বাজারে চাহিদা বিপুলভাবে বেড়ে যায়। এর সুযোগ নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা সব কিছুর দাম বাড়িয়ে দেয়।' ব্যবসায়ীদের এ সুযোগ না দিতে তিনি ক্রেতাদের ভাগে ভাগে পণ্য কেনার পরামর্শ দিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সয়াবিন ও পাম তেল মিলিয়ে রমজান মাসে মোট প্রায় এক লাখ ৫০ হাজার টন ভোজ্য তেল প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের দ্রব্যমূল্য মনিটরিং সেল হিসাব করে দেখেছে, রমজান সামনে রেখে দেশে এক লাখ ৭৪ হাজার ৫৩৫ টন ভোজ্য তেল মজুদ আছে। মজুদের পরিমাণ চাহিদার তুলনায় ২৪ হাজার ৫৩৫ টন বেশি। এখন শীতকাল নয় বলে সয়াবিন তেলের চাহিদা বেড়ে গিয়ে দাম বাড়ারও কোনো কারণ নেই।
ভোজ্য তেলের আন্তর্জাতিক বাজারদরে পড়তির ধারা বেশ কয়েক মাস ধরেই। ট্যারিফ কমিশনের এক হিসাবে দেখা যায়, গত বুধবার অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের আন্তর্জাতিক বাজারদর (সিঅ্যান্ডএফ) ছিল টনপ্রতি এক হাজার ৮৮ ডলার। এক সপ্তাহ আগেও যা প্রায় এক হাজার ১৩৭ ডলার ছিল। এক বছর আগে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম ছিল টনপ্রতি এক হাজার ১৬৭ ডলার। একইভাবে দেশে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পাম তেলের দাম ব্যাপকভাবে কমেছে। এক বছর আগের এক হাজার ৯৯ ডলারের পাম তেলের দাম (সিঅ্যান্ডএফ) এখন টনপ্রতি ৭৯৬ ডলারে নেমেছে। এক সপ্তাহ আগের দাম হচ্ছে ৮৫৬ ডলার।
আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক দরপতন ও দেশে চাহিদার তুলনায় বেশি মজুদ থাকার পরও গত সপ্তাহে শবেবরাতের আগে খোলা সয়াবিন তেলের দাম লিটারে দুই টাকা বেড়েছে খুচরা বাজারে। বাজারে এখন খোলা সয়াবিন লিটারপ্রতি ১১০ থেকে ১১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে পাম তেলের দামও লিটারে দুই টাকা বেড়েছে। এখন তা খুচরা দোকানে ৭৫ থেকে ৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। শবেবরাতের পর পাইকারি বাজারে খোলা ভোজ্য তেলের দর কিছুটা কমলেও খুচরা বাজারে এর প্রভাব পড়েনি।
অপরিশোধিত চিনির দামও ব্যাপকভাবে কমেছে আন্তর্জাতিক বাজারে। এক বছর আগে যে চিনি টনপ্রতি ৫৯১ ডলারে (সিঅ্যান্ডএফ) বিক্রি হতো, এর দর বুধবার ছিল ৪৪০ ডলার। এক মাস আগে এ অপরিশোধিত চিনির দাম ছিল ৪৫১ ডলার। ট্যারিফ কমিশনের হিসাবে, রমজানে দেশে এক লাখ ৬০ হাজার টন চিনির প্রয়োজন হয়। মজুদ আছে এক লাখ ৭৩ হাজার ২৮২ টন। আরো কিছু চিনি দেশে আসার অপেক্ষায় আছে। সব মিলিয়ে মজুদ ভালোই। কিন্তু শবেবরাত উপলক্ষে প্রতি কেজি খোলা চিনির দাম দুই টাকা বেড়ে যাওয়ার পর এখন ৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আর প্যাকেটজাত চিনি প্রতি কেজি ৫৪ থেকে ৫৫ টাকায় কিনতে হচ্ছে খুচরা ক্রেতাদের। এ পণ্যের দাম গত এক বছর স্থিতিশীল ছিল।
পেঁয়াজের আন্তর্জাতিক বাজারদরও বড় ধরনের পড়তির দিকেই। এক মাস আগের তুলনায় পেঁয়াজের আন্তর্জাতিক দর প্রায় ৬ শতাংশ কমেছে। এখন প্রতি টন পেঁয়াজের দাম ২৫৯ ডলার (সিঅ্যান্ডএফ)। এক মাস আগে ছিল ২৭৫ ডলার। রমজানে দেশে তিন লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। এর বিপরীতে মজুদ আছে তিন লাখ ৬১ হাজার ৫৯৭ টন। দেশের বাজারে সম্প্রতি দেশি ও ভারতীয় পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৩২ থেকে ৩৫ টাকায়, যা আগের চেয়ে দুই থেকে তিন টাকা বেশি। কেজিপ্রতি তিন থেকে পাঁচ টাকা বেড়ে দেশি পেঁয়াজ মানভেদে ৩৮ থেকে ৪০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
রসুনের আন্তর্জাতিক বাজারদর কমছে। এক মাস আগের ২৯৩ ডলার থেকে কমে এখন প্রতি টন রসুন ২৮৩ ডলারে (সিঅ্যান্ডএফ) বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি রমজানে এর মজুদ চাহিদার তুলনায় বেশি আছে। দেশের পাইকারি বাজারেও এ মসলার দাম কমছে। কিন্তু খুচরা বিক্রেতারা বেশি দাম হাঁকছেন। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি আমদানি করা রসুনের দাম চাওয়া হচ্ছে ৯০ থেকে ১০০ টাকা, যা পাইকারি বাজারের চেয়ে কেজিপ্রতি ৩০-৩৫ টাকা বেশি।
মসুর ডালের আন্তর্জাতিক বাজারদর অবশ্য কিছুটা বাড়তির দিকে। তবে দেশে নতুন মৌসুমের ডাল বাজারে আসায় এ পণ্যেরও দাম বাড়ার কোনো কারণ দেখছেন না সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বর্তমানে দেশে ৫০ হাজার টনের চাহিদার বিপরীতে এক লাখ দুই হাজার ৬০৮ টন মসুর ডাল মজুদ আছে।
কাস্টমসের আমদানির তথ্য অনুযায়ী ছোলা, আদা, হলুদ, মরিচসহ কোনো পণ্যেরই ঘাটতি নেই। সার্বিক সরবরাহ পরিস্থিতি সম্পর্কে ট্যারিফ কমিশনের পর্যবেক্ষণ হলো, যেসব পণ্য দেশে আসার অপেক্ষায় আছে তা হিসাবে যোগ করলে মজুদের পরিমাণ আরো বাড়বে। ফলে রমজানে পণ্যের কোনো ঘাটতি হবে না।
রমজানের অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য ছোলায় অতিরিক্ত মুনাফার চিত্র উঠে এসেছে ট্যারিফ কমিশনের আরেকটি হিসাবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া ওই হিসাবে দেখা যায়, এবারের রমজান উপলক্ষে মে থেকে জুনের প্রথম চার দিন পর্যন্ত যে পরিমাণ ছোলা আমদানি করা হয়েছে তার আমদানি মূল্য ছিল প্রতি টনে ৫৮৭ ডলার থেকে ৬৯৬ ডলার পর্যন্ত। এর সঙ্গে অন্যান্য খরচ ও বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যবসায়ীদের মুনাফা যোগ করলে প্রতি কেজি ছোলার গড় দাম দাঁড়ায় ৫৮ টাকা ৭৯ পয়সা। পাইকারি বাজারে ছোলা ৫৫ টাকার নিচে বিক্রি হলেও খুচরা বাজারে পৌঁছতেই এর দাম কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়ে যাচ্ছে।
চাহিদা ও জোগানে ভারসাম্য এবং পড়তি দরের পরিপ্রেক্ষিতেও বাজারে পণ্যের দাম কেন বাড়ে জানতে চাইলে পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারের এক পাইকারি ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'রোজায় বাড়তি চাহিদার সুযোগে কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ীর উদ্ভব হয়। যারা বেশি টাকা নিয়ে এসে পণ্য মজুদ করে। এ ছাড়া খুচরা বিক্রেতাদের মধ্যেও বেশি মুনাফার প্রবণতা দেখা যায়। এসব কারণেই দাম বেড়ে যায়।'
খুচরা বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে অবস্থা বুঝে বেশি মুনাফার অভিযোগ সম্পর্কে রাজধানীর কাজীপাড়া বাজারের মনিহারি পণ্যের দোকান মায়ের দোয়া স্টোরের একজন বিক্রেতা জানান, তাঁরা এক বস্তা পণ্য কিনে সারা মাস ধরে বিক্রি করেন। খুচরা বিক্রি করতে গেলে পণ্যের ঘাটতি বেশি হয়। ফলে দাম একটু বেশি না নিলে তাঁদের পোষায় না।
ওই বিক্রেতা বলেন, 'এক বস্তা (৫০ কেজি) ছোলা বিক্রি করলে এক কেজি ঘাটতি হয়। কিন্তু পাইকারি ব্যবসায়ীদের কোনো ঘাটতি নেই। ফলে তাদের লাভ কম করলেও চলে।'
বাসাবো এলাকায় বসবাসকারী ব্যাংক কর্মকর্তা খোরশেদ আলম বলেন, 'শবেবরাতেই যেভাবে কিছু জিনিসের দাম বেড়েছে, তাতে রোজার সময় বাজারের অবস্থা কী দাঁড়াবে তা ভেবে পাচ্ছি না। সরকারের এখন থেকেই বাজারের ওপর নজরদারি করা উচিত।'
এ বিষয় নিয়ে বাজার-সংশ্লিষ্ট বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রমজান শুরুর আগে প্রায় সবাই একসঙ্গে পুরো মাসের জন্য নির্দিষ্ট কিছু পণ্য কিনে ফেলেন বলে বাজারে সেগুলোর বিপুল চাহিদা সৃষ্টি হয়। ফলে প্রচুর মজুদ থাকার পরও এ সময় ওই সব পণ্যের সাময়িক বা কৃত্রিম সংকট দেখা দেয়। এ ছাড়া সুযোগ পেলেই পণ্যের দাম বাড়ানোটা এ দেশে এক ধরনের রেওয়াজ হয়ে দেখা দিয়েছে।
এদিকে আগামী রবিবার ভোজ্য তেল ও চিনি ব্যবসায়ীদের নিয়ে একটি জরুরি মতবিনিময় সভার আয়োজন করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ওই সভায় এ দুটি পণ্যের সরবরাহ ও দাম নিয়ে আলোচনা হবে বলে জানা গেছে।
No comments