ভিলাবারট্রানের শতবর্ষ by আন্দালিব রাশদী
‘প্রতিদিন সকালে আমি যখন জেগে উঠি, আমি আমার সেই সর্বোচ্চ আনন্দ লাভ করি—সালভাদর দালি হওয়ার আনন্দ।’
‘ছয় বছর বয়সে আমি রাঁধুনি হতে চেয়েছি। সাত বছর বয়সে আমি চেয়েছি নেপোলিয়ন হতে।
‘ছয় বছর বয়সে আমি রাঁধুনি হতে চেয়েছি। সাত বছর বয়সে আমি চেয়েছি নেপোলিয়ন হতে।
তার পর থেকে আমার আকাঙ্ক্ষা কেবল বেড়েই চলেছে।’
শিল্পীর অহংকার, যদি তিনি প্রবল আত্মবিশ্বাসী হন, তাঁকে কোথায় পৌঁছে দিতে পারে তারই সাক্ষী স্পেনীয় শিল্পী সালভাদর দালি। তাঁর জন্ম ১১ মে ১৯০৪, ক্যাতালেনিয়ার ছোট শহর ফিগারাসে, ফ্রান্স ও স্পেনের সীমান্তে। আইনজীবী বাবা চাইলেন ছেলে সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করুক, কিন্তু মা উসকে দিলেন ছেলের ছন্নছাড়া জীবনে। তাঁর বয়স যখন পাঁচ বছর, তাঁকে দেখানো হলো তাঁর ভাইয়ের কবর, তাঁকে বলা হলো সেই ভাইয়েরই পুনর্জন্ম হয়েছে তাঁর মধ্যে। তিনি বিশ্বাস করলেন। তাঁর জন্মের তিন বছর আগে সাত বছর বয়সী এই ভাই ম্যানিনজাইটিসে মারা যায়। অবিশ্বাস্য দুরন্তপনা এবং পারিবারিক আশকারায় বখে যাওয়া সালভাদর পড়াশোনার ধার ধারেননি, কিন্তু রং-তুলি যখন হাতে নিলেন, নিষ্ঠার ঘাটতি ছিল না এতটুকুও।
১৯১০, সালভাদরের বয়স তখন ছয় বছর; তিনি আঁকলেন ‘ল্যান্ডস্কেপ নিয়ার ফিগারাস’। আরও তিন বছর পর, বয়স তখন নয়, ১৯১৩ সালে তিনি আঁকলেন ‘ভিলাবারট্রান’। শৈশবে তিনি নিজে যে ল্যান্ডস্কেপের অংশ হয়ে উঠেছিলেন, তাঁর দুরন্তপনার দিনগুলোতে তিনি নিসর্গকে যেভাবে আত্মস্থ করেছিলেন, তা উঠে এসেছে বারট্রানের ভিলাতে। সবুজের ভেতর সাদা ভিলাটি দেখে কার মনে হবে এটি নয় বছরের বালকের আঁকা?
২০ X ১৫ সেন্টিমিটার আকারের ছবিটি অ্যাস্টেরিয়া, কুইনসে একটি ব্যক্তিগত সংগ্রহে রক্ষিত আছে। ঠিক ১০০ বছর আগে ১৯১৩ সালে আঁকা শ্রেষ্ঠ ছবিগুলোর অন্যতম একটির নাম ভিলাবারট্রান। সালভাদরের ছয় বছর বয়সে আঁকা ‘ল্যান্ডস্কেপ নিয়ার ফিগারাস’ কার্ভে আঁকা ১৪ সেমি-৯ সেমি মাপের ছবি, ফ্লোরিডায় সালভাদর দালি জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। এত কম বয়সী একটি বালকের ছবির ধারণা, তুলি চালানোর দক্ষতা, আলোর ব্যবহার এবং রঙের ঐশ্বর্য ফুটিয়ে তোলার পরিপক্বতা শিল্পবোদ্ধাদের বিস্মিত করেছে।
সেই ছোটবেলা থেকে নিজেকে লাইমলাইটে রাখার একটি অস্বাভাবিক প্রবণতা তাঁর মধ্যে নিহিত ছিল—হরেক রকম পোশাক পরতেন, ভেলভেটের জ্যাকেট, মেয়েদের মতো সিঁথি করা চুল, ছোট হাফ প্যান্ট, বৃষ্টির দিনে প্রায় মাটি ছোঁয়া বর্ষাতি। তিনি চাইতেন, সারা শহরের মানুষ তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকবে, তাঁকে নিয়ে র্িফসর্িফস করবে, আর তিনি তাদের মাঝখান দিয়ে সগর্বে মাথা উঁচু করে হেঁটে যাবেন। তিনি লিখেছেন, ‘যখন আমি বাইরে যেতাম কিংবা ঘরে ফিরতাম, বহু উৎসুক মানুষ জড়ো হতো, আমাকে দেখার জন্য কৌতূহলী হয়ে উঠত।’
স্কুলপর্যায়ের চূড়ান্ত পরীক্ষার পর তিনি মাদ্রিদ একাডেমি অব আর্টে ভর্তি হতে চাইলেন, কিন্তু মা তত দিনে মৃত। বাবা পেরে উঠলেন না একগুয়ে সন্তানের কাছে। সালভাদর লিখলেন, ‘আমি কসম কাটলাম মৃত্যু ও নিয়তি থেকে আমি আমার মাকে ছিনিয়ে আনব।’
তিনি ভর্তি হলেন, কিন্তু প্রতিদিনই আর্ট স্কুল এবং তাঁর বাবার জন্য বিব্রতকর সংবাদের সৃষ্টি করতে থাকলেন। তিনি ঘোষণা করলেন, এই একাডেমিতে কেবল একজন অধ্যাপকের পেশাগত দক্ষতা রয়েছে, আর সবাই শিক্ষকতার অনুপযুক্ত। প্রফেসর পদে সাধারণ মানের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ায় তিনি একাডেমির বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন এবং ডিম ছুড়ে মারেন। তাঁকে কয়েক সপ্তাহের জন্য কারাবন্দী করেও রাখা হয়। কর্তৃপক্ষ অনুমোদন করে না এমন রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। তাঁর বাহারি পোশাক, উদ্ধত আচরণ, প্রথাবিরোধী কর্মকাণ্ড, বেয়াদবি, আইন ও কর্তৃপক্ষের অবমাননাসহ বহু ধরনের অপরাধ আমলে নেওয়া হয় এবং তাঁকে মাদ্রিদ আর্ট একাডেমি থেকে বহিষ্কার করা হয়। তাঁর বাবা ভীষণ ভেঙে পড়েন—তাঁর চেহারায় ছেলের ভাষায় ‘করুণ তিক্ততা’ ফুটে ওঠে। একাডেমি থেকে বহিষ্কারের পর তিনি ড্রইং নিয়ে দিনের পর দিন পড়ে থাকেন। ১৯২৫ সালে ২১ বছর বয়সে তিনি আবার মাদ্রিদ একাডেমিতে ভর্তি হন। পরের বছর ২০ অক্টোবর তাঁকে চিরতরে একাডেমি থেকে বিদায় করে দেওয়া হয়—এবার অবশ্য কারণ ভিন্ন। কর্তৃপক্ষ এবার স্বীকার করে বলেন, সালভাদর দালিকে শেখানোর মতো বিদ্যা এখানে আর কারও নেই। বড্ড দেরি হয়ে গেছে। তত দিনে সালভাদর দালি যে দেশখ্যাত চিত্রশিল্পী দালিতে পরিণত হয়েছেন।
তিনি ঘোষণা করলেন প্যারিসে যাবেন এবং প্যারিস বিজয় করবেন। এখানে এসে ঘনিষ্ঠ হলেন গ্রানাডার কিউবিস্ট ধারার চিত্রশিল্পী ম্যানুয়েল অ্যাঞ্জেলো ওর্তিজের সঙ্গে। তাঁর লক্ষ্য পাবলো পিকাসো। তাঁর নিজের আঁকা ‘গার্ল অব ফিগারাস’ ভালো করে কাগজে মুড়িয়ে পিকাসোর কাছে পৌঁছালেন। ছবিটা তাঁর হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘আমি ল্যুভ মিউজিয়াম দেখার আগে আপনাকে দেখতে এসেছি।’
পিকাসো ঘুরেফিরে ১৫ মিনিট ধরে সালভাদর দালির দেওয়া ছবিটা দেখলেন। কোনো কথা বললেন না।
যৌবনে নিউইয়র্কের হাঁটা পথে চলার সময় সালভাদর দালি হাতে ঘণ্টা রাখতেন। যখন তাঁর মনে হতো তাঁর দিকে পথচারীদের নজর কম, তিনি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ঘণ্টা বাজাতে শুরু করতেন।
দালি নিশ্চিত ছিলেন, মানুষ তাঁর আঁকা ছবি পছন্দ করে। কারণ ‘মানুষ রহস্য ভালোবাসে’। সে জন্যই সজ্ঞানে নিজের জীবনটাকে রহস্যময় করে রেখেছেন সালভাদর দালি।
শিল্পীর অহংকার, যদি তিনি প্রবল আত্মবিশ্বাসী হন, তাঁকে কোথায় পৌঁছে দিতে পারে তারই সাক্ষী স্পেনীয় শিল্পী সালভাদর দালি। তাঁর জন্ম ১১ মে ১৯০৪, ক্যাতালেনিয়ার ছোট শহর ফিগারাসে, ফ্রান্স ও স্পেনের সীমান্তে। আইনজীবী বাবা চাইলেন ছেলে সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করুক, কিন্তু মা উসকে দিলেন ছেলের ছন্নছাড়া জীবনে। তাঁর বয়স যখন পাঁচ বছর, তাঁকে দেখানো হলো তাঁর ভাইয়ের কবর, তাঁকে বলা হলো সেই ভাইয়েরই পুনর্জন্ম হয়েছে তাঁর মধ্যে। তিনি বিশ্বাস করলেন। তাঁর জন্মের তিন বছর আগে সাত বছর বয়সী এই ভাই ম্যানিনজাইটিসে মারা যায়। অবিশ্বাস্য দুরন্তপনা এবং পারিবারিক আশকারায় বখে যাওয়া সালভাদর পড়াশোনার ধার ধারেননি, কিন্তু রং-তুলি যখন হাতে নিলেন, নিষ্ঠার ঘাটতি ছিল না এতটুকুও।
১৯১০, সালভাদরের বয়স তখন ছয় বছর; তিনি আঁকলেন ‘ল্যান্ডস্কেপ নিয়ার ফিগারাস’। আরও তিন বছর পর, বয়স তখন নয়, ১৯১৩ সালে তিনি আঁকলেন ‘ভিলাবারট্রান’। শৈশবে তিনি নিজে যে ল্যান্ডস্কেপের অংশ হয়ে উঠেছিলেন, তাঁর দুরন্তপনার দিনগুলোতে তিনি নিসর্গকে যেভাবে আত্মস্থ করেছিলেন, তা উঠে এসেছে বারট্রানের ভিলাতে। সবুজের ভেতর সাদা ভিলাটি দেখে কার মনে হবে এটি নয় বছরের বালকের আঁকা?
২০ X ১৫ সেন্টিমিটার আকারের ছবিটি অ্যাস্টেরিয়া, কুইনসে একটি ব্যক্তিগত সংগ্রহে রক্ষিত আছে। ঠিক ১০০ বছর আগে ১৯১৩ সালে আঁকা শ্রেষ্ঠ ছবিগুলোর অন্যতম একটির নাম ভিলাবারট্রান। সালভাদরের ছয় বছর বয়সে আঁকা ‘ল্যান্ডস্কেপ নিয়ার ফিগারাস’ কার্ভে আঁকা ১৪ সেমি-৯ সেমি মাপের ছবি, ফ্লোরিডায় সালভাদর দালি জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। এত কম বয়সী একটি বালকের ছবির ধারণা, তুলি চালানোর দক্ষতা, আলোর ব্যবহার এবং রঙের ঐশ্বর্য ফুটিয়ে তোলার পরিপক্বতা শিল্পবোদ্ধাদের বিস্মিত করেছে।
সেই ছোটবেলা থেকে নিজেকে লাইমলাইটে রাখার একটি অস্বাভাবিক প্রবণতা তাঁর মধ্যে নিহিত ছিল—হরেক রকম পোশাক পরতেন, ভেলভেটের জ্যাকেট, মেয়েদের মতো সিঁথি করা চুল, ছোট হাফ প্যান্ট, বৃষ্টির দিনে প্রায় মাটি ছোঁয়া বর্ষাতি। তিনি চাইতেন, সারা শহরের মানুষ তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকবে, তাঁকে নিয়ে র্িফসর্িফস করবে, আর তিনি তাদের মাঝখান দিয়ে সগর্বে মাথা উঁচু করে হেঁটে যাবেন। তিনি লিখেছেন, ‘যখন আমি বাইরে যেতাম কিংবা ঘরে ফিরতাম, বহু উৎসুক মানুষ জড়ো হতো, আমাকে দেখার জন্য কৌতূহলী হয়ে উঠত।’
স্কুলপর্যায়ের চূড়ান্ত পরীক্ষার পর তিনি মাদ্রিদ একাডেমি অব আর্টে ভর্তি হতে চাইলেন, কিন্তু মা তত দিনে মৃত। বাবা পেরে উঠলেন না একগুয়ে সন্তানের কাছে। সালভাদর লিখলেন, ‘আমি কসম কাটলাম মৃত্যু ও নিয়তি থেকে আমি আমার মাকে ছিনিয়ে আনব।’
তিনি ভর্তি হলেন, কিন্তু প্রতিদিনই আর্ট স্কুল এবং তাঁর বাবার জন্য বিব্রতকর সংবাদের সৃষ্টি করতে থাকলেন। তিনি ঘোষণা করলেন, এই একাডেমিতে কেবল একজন অধ্যাপকের পেশাগত দক্ষতা রয়েছে, আর সবাই শিক্ষকতার অনুপযুক্ত। প্রফেসর পদে সাধারণ মানের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ায় তিনি একাডেমির বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন এবং ডিম ছুড়ে মারেন। তাঁকে কয়েক সপ্তাহের জন্য কারাবন্দী করেও রাখা হয়। কর্তৃপক্ষ অনুমোদন করে না এমন রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। তাঁর বাহারি পোশাক, উদ্ধত আচরণ, প্রথাবিরোধী কর্মকাণ্ড, বেয়াদবি, আইন ও কর্তৃপক্ষের অবমাননাসহ বহু ধরনের অপরাধ আমলে নেওয়া হয় এবং তাঁকে মাদ্রিদ আর্ট একাডেমি থেকে বহিষ্কার করা হয়। তাঁর বাবা ভীষণ ভেঙে পড়েন—তাঁর চেহারায় ছেলের ভাষায় ‘করুণ তিক্ততা’ ফুটে ওঠে। একাডেমি থেকে বহিষ্কারের পর তিনি ড্রইং নিয়ে দিনের পর দিন পড়ে থাকেন। ১৯২৫ সালে ২১ বছর বয়সে তিনি আবার মাদ্রিদ একাডেমিতে ভর্তি হন। পরের বছর ২০ অক্টোবর তাঁকে চিরতরে একাডেমি থেকে বিদায় করে দেওয়া হয়—এবার অবশ্য কারণ ভিন্ন। কর্তৃপক্ষ এবার স্বীকার করে বলেন, সালভাদর দালিকে শেখানোর মতো বিদ্যা এখানে আর কারও নেই। বড্ড দেরি হয়ে গেছে। তত দিনে সালভাদর দালি যে দেশখ্যাত চিত্রশিল্পী দালিতে পরিণত হয়েছেন।
তিনি ঘোষণা করলেন প্যারিসে যাবেন এবং প্যারিস বিজয় করবেন। এখানে এসে ঘনিষ্ঠ হলেন গ্রানাডার কিউবিস্ট ধারার চিত্রশিল্পী ম্যানুয়েল অ্যাঞ্জেলো ওর্তিজের সঙ্গে। তাঁর লক্ষ্য পাবলো পিকাসো। তাঁর নিজের আঁকা ‘গার্ল অব ফিগারাস’ ভালো করে কাগজে মুড়িয়ে পিকাসোর কাছে পৌঁছালেন। ছবিটা তাঁর হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘আমি ল্যুভ মিউজিয়াম দেখার আগে আপনাকে দেখতে এসেছি।’
পিকাসো ঘুরেফিরে ১৫ মিনিট ধরে সালভাদর দালির দেওয়া ছবিটা দেখলেন। কোনো কথা বললেন না।
যৌবনে নিউইয়র্কের হাঁটা পথে চলার সময় সালভাদর দালি হাতে ঘণ্টা রাখতেন। যখন তাঁর মনে হতো তাঁর দিকে পথচারীদের নজর কম, তিনি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ঘণ্টা বাজাতে শুরু করতেন।
দালি নিশ্চিত ছিলেন, মানুষ তাঁর আঁকা ছবি পছন্দ করে। কারণ ‘মানুষ রহস্য ভালোবাসে’। সে জন্যই সজ্ঞানে নিজের জীবনটাকে রহস্যময় করে রেখেছেন সালভাদর দালি।
No comments