সংসদের পবিত্রতা রক্ষা করার দায়িত্ব সংসদ সদস্যদের by আবদুল মান্নান
প্রাচীন ইউরোপীয় সভ্যতা বিশ্বকে যে কটি
ভালো জিনিস উপহার দিয়েছে তার মধ্যে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা অন্যতম।
গণতন্ত্রের ইংরেজি প্রতিশব্দ democracy। এর জন্ম খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে
গ্রিসের নগররাষ্ট্র এথেন্সে।
এর আভিধানিক অর্থ 'জনগণের শাসন'। জনগণ যদি নিজেদের সমস্যা বা উন্নয়নের কথা নিজেরা বলতে পারত বা তারা তাদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে তা
শাসকদের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করত, তবে এই প্রতিনিধিরা আবার সমাজের
কুলীন শ্রেণী থেকে মনোনীত বা নির্বাচিত হতেন। ইসলামের প্রথম যুগেও সেই
ব্যবস্থা ছিল। ইসলামে রাজতন্ত্রের কোনো অবস্থান নেই। সে যুগে জনগণ সরাসরি
তাদের সুখ-দুঃখের কথা খলিফাকে জানাতে পারত এবং খলিফারা ছিলেন ন্যায়বিচারের
প্রতীক। জনগণের শাসন বিঘ্নিত হলে স্বৈরাচারের জন্ম হয়। ১৯৯৪ সালের
ফেব্রুয়ারি মাসে হিটলারের জার্মানির সংসদ ভবন বার্লিনে রাইখস্টাগ
(Reichstag) দেখতে গিয়েছিলাম। কিছুকাল আগেই বার্লিন দেয়ালের পতন হয়েছে।
অন্য আর দশটি সংসদ ভবনের মতো রাইখস্টাগও বিশাল আকৃতির একটি ভবন। ভবনজুড়ে
বিশাল বিশাল কলাম। হিটলার যেখানে দাঁড়িয়ে তাঁর অনুসারীদের উদ্দেশে ভাষণ
দিতেন, সে জায়গাটি কাচ দিয়ে ঘেরা, তবে দর্শকরা সেখানে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে
পারেন। সেখানে দাঁড়িয়ে আমার বেশ শিহরণ অনুভূত হলো। এখানে দাঁড়িয়েই হিটলার
মানবজাতির ইতিহাস পরিবর্তন করার অপচেষ্টা করেছিলেন। জন্ম দিয়েছিলেন ইহুদি
নিধন কর্মসূচি-হলোকস্টের (holocaust)। সঙ্গে থাকা বার্লিনের একটি দৈনিকের
সাংবাদিক থিলোকে প্রশ্ন করি, বিশ্বের সব সংসদ ভবনের আকার-আকৃতি এত বিশাল হয়
কেন? থিলো একটি চমৎকার জবাব দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, যেহেতু যাঁরা এই ভবনে
জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে প্রবেশ করেন তাঁরা যেন বুঝতে পারেন ওই ভবনটি
জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক এবং তা ধারণ করেন এবং ওই প্রতিনিধিদের
অবস্থান ভবনের সঙ্গে তুলনা করলে অতিক্ষুদ্র মনে হবে অর্থাৎ তাঁরা যেহেতু
জনগণের প্রতিনিধি, সেহেতু তাঁদের চেয়ে জনগণ অনেক বেশি শক্তিশালী। থিলো আরো
বলেন, শুধু যে সংসদ ভবনগুলোর আকৃতি এত বিশাল হয় তা নয়, বিশ্বের সব
প্রার্থনালয়ের আকার-আকৃতিও তেমনটি হয়। কারণ যাঁরা প্রার্থনালয়ে প্রবেশ করেন
তাঁরা ঈশ্বরের ঘরে প্রবেশ করেন এবং ঈশ্বর তাঁর সৃষ্টির চেয়ে অনেক বড় এবং
সম্মানীয়। থিলোর ব্যাখ্যায় চমৎকৃত হই। এত দিন পর থিলোর কথা ও ব্যাখ্যা মনে
পড়ার কারণ হচ্ছে, সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের কতিপয় সংসদ সদস্য
যে ভাষায় কথাবার্তা বলছেন, তা শুনে নিজেকে প্রশ্ন করছি, এই সংসদ সদস্যরা
সংসদের সদস্য না হলে জাতির এমন কী ক্ষতি হতো? তাঁদের তো জনগণের কথা বলার
কথা। তা তো তাঁরা বলেন-ই না অথবা বলার যোগ্যতা রাখেন না, কিন্তু যে ভাষায়
অন্যদের ব্যক্তিগত আক্রমণ করেন, তাতে এখন তো মনে হয় সংসদ টেলিভিশনটা
'শুধুমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের' বলে ঘোষণা করা উচিত।
নানা কারণে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। এর অন্যতম হচ্ছে, যৌবনে নিজে এই দেশের ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তন হতে দেখেছি এবং নিজের সাধ্য অনুযায়ী সে পরিবর্তনের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করেছি। স্বাধীন বাংলাদেশের যখন প্রথম সংসদ বসল, তখন দুবার সেই সংসদে আমার দর্শক হিসেবে উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল। তখন বর্তমান সংসদ ভবন চালু হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর এখনকার দপ্তরটায় সংসদ বসত। আমাদের পাড়ার জহুর আহম্মদ চৌধুরী তখন বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনামন্ত্রী। এই নির্লোভ মানুষটিকে বঙ্গবন্ধু খুবই পছন্দ করতেন। বাবার সঙ্গে চৌধুরী সাহেবের দীর্ঘকালের সম্পর্ক। আমরা চাচা বলে ডাকি। বাবা চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা এলে চাচার জন্য চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী বেলা বিস্কুট আনতেন। দুবারই তাঁর দেওয়া পাস নিয়ে আমার সংসদে যাওয়া এবং দুবারই বঙ্গবন্ধু সংসদে উপস্থিত ছিলেন। আমার দ্বিতীয়বারের যাওয়াটা কিছুটা ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্য গৌরবের, কারণ তখন সংসদে ১৯৭২ সালের সংবিধান উপস্থাপিত হয়েছে। তা নিয়ে সংসদ সদস্যরা আলোচনা করছেন। বঙ্গবন্ধু মনে হলো টোকা নিচ্ছেন। কারা কারা আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন, এত দিন পর তা মনে নেই, তবে সকলে যে ভদ্র ও মার্জিত ভাষায় কথা বলছিলেন, তাতে দেশের গণতন্ত্র নিয়ে বেশ আশান্বিত হয়েছিলাম। অবশ্য সেই সংসদে বিরোধী দল বলে কেউ ছিল না, তথাপি উত্থাপিত সংবিধান নিয়ে বেশ কিছুটা আলাপ-আলোচনা হয়েছিল। তবে ১৯৭২-এর সংবিধানটি এতই নিখুঁত ছিল যে তাকে নিয়ে বিতর্ক করার তেমন কোনো সুযোগ ছিল না।
যে সংসদ অধিবেশনে ৪০ বছর আগে আমার যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল, সেখানে প্রকৃত অর্থেই রাজনীতিবিদরা ছিলেন। এখন তাঁরা অনেকটা বিলুপ্ত প্রজাতি। বর্তমান সংসদে যে দু-একজন এখনো টিম টিম করে জ্বলছেন, তাঁরা অনেকটা কোণঠাসা। তাঁদের অবস্থান পেশিশক্তি আর কালো টাকাওয়ালাদের দাপটের কাছে পরাজিত। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে আমি একজন মার্জিত রুচির রাজনীতিবিদ মনে করতাম। তাঁর বাবা কফিলউদ্দীন চৌধুরী আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট গঠনে অসামান্য ভূমিকা রেখেছিলেন। নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠন করলে তিনি বিচার ও আইনমন্ত্রী হয়েছিলেন। তাঁর ছেলে ১৯৯৬ সালে বিরোধী দলের উপনেতা হিসেবে যেভাবে স্পিকারের প্রতি তেড়ে গিয়ে বিটিভির ক্যামেরা ভাঙচুরে অংশ নিয়ে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিলেন, তখন সত্যি সত্যি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হয়েছিলাম। বর্তমান সংসদের অবস্থা দেখে আমার সেই ধারণাটা আরো কিছুটা বদ্ধমূল হয়েছে।
দীর্ঘ ৮৭ কার্যদিবস অনুপস্থিত থাকার পর যখন বিরোধী দল সংসদে ফিরল, তখন জাতি কিছুটা আশান্বিত হয়েছিল এই মনে করে, হয়তো এই অধিবেশনে সবাই মিলে কিছু অমীমাংসিত সমস্যা বা প্রশ্নের সমাধান বা উত্তর খোঁজার চেষ্টা করবেন। অর্থমন্ত্রী সংসদে তাঁর এই মেয়াদের শেষ বাজেট পেশ করলেন, কিন্তু এ পর্যন্ত সেই বাজেট নিয়ে কাউকে কোনো আলোচনা করতে শুনলাম না। তার পরিবর্তে সংরক্ষিত নারী আসনের বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা অশ্রবণযোগ্য শব্দ ব্যবহার করে সংসদে এক নজিরবিহীন ন্যক্কারজনক ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। যে নারী সংসদ সদস্যটি হেলাল হাফিজের একটি কবিতা পড়ে অথবা যিনি 'চ' বর্গীয় একটি শব্দ ব্যবহার করে এই কাণ্ডকারখানার সূত্রপাত করলেন, তিনি বা তাঁরা কী জানেন, বিভিন্ন সামাজিক নেটওয়ার্কে ওই একই কবির আর একটি কবিতা তাঁদের নামের পাশে উল্লেখ করে আপলোড করা হয়েছে এবং এখন লাখ লাখ মানুষ তা পড়ছে বা দেখছে? কবিতাটি উল্লেখ করলাম না, কারণ তা আমার ব্যক্তিগত রুচির পরিপন্থী। এই সংসদ সদস্যদের এই কাণ্ডের রেশ না কাটতেই সরকারদলীয় আরেক নারী সদস্য খালেদা জিয়ার জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে একটি সম্পূর্ণ অসত্য তথ্য দিয়ে নিজের অজ্ঞতা জাহির করতে এগিয়ে এলেন। এবার বিরোধীদলীয় আরেকজন নারী সদস্য যে কাজটি করলেন, তা শুধু সম্পূর্ণ অসত্যই নয়, অরুচিকর, অপ্রত্যাশিত, অনাকাঙ্ক্ষিত, অনভিপ্রেত, অমার্জনীয় এবং চরম ধৃষ্টতাপূর্ণ। তিনি নিজের লিখিত জাতির জনকের একটি বানোয়াট জীবনবৃত্তান্ত সংসদে উত্থাপন করলেন। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, যখন এসব নারী সংসদ সদস্য পবিত্র সংসদে দাঁড়িয়ে এমন সব আচরণ করেন, তাঁরা তখন ভুলে যান তাঁদের এই বক্তব্য তাঁদের সন্তান বা আত্মীয়স্বজন বা মার্জিত বন্ধুবান্ধবও শুনছেন। আরো পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, যখন তাঁরা তাঁদের বচন দিয়ে সংসদকে কলুষিত করেন, তখন তাঁদের দলীয় সংসদ সদস্যরা টেবিল চাপড়ে তাঁদের সমর্থন জানিয়ে এসব রুচিহীন বক্তব্যের ভাগীদার হন।
ব্রিটেনের হাউস অব কমনসে কোনো সংসদ সদস্য এমন আচরণ করলে স্পিকার সার্জেন্ট অ্যাট আর্মসকে ডেকে সেই সংসদ সদস্যকে হাউস থেকে বের করে দিতে পারেন। একাধিকবার বের করে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে, তবে তা বাংলাদেশের সংসদ সদস্যদের মতো নোংরামি করার জন্য নয়। বাংলাদেশের সংসদের কার্যপ্রণালী বিধিতে এমন কোনো ধারা আছে কি না জানি না, না থাকলে তা অবিলম্বে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। তবে আমার কথা হচ্ছে, সংসদে সরকারি ও বিরোধী দলের একাধিক সংসদ সদস্য পুরো ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন এবং এ ব্যাপারে স্পিকার কোনো ব্যবস্থা নিলে তা সমর্থন করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। আশা করি, পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাওয়ার আগেই সবার শুভবুদ্ধির উদয় হবে। আর যাঁরা এ ধরনের নোংরামির সঙ্গে জড়িত হন, তাঁদের বলি, যে সংসদ ভবনে বসে আপনারা এসব খিস্তিখেউড় করেন, তার ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখুন, দেখবেন সেটির উচ্চতা মনে হবে আকাশচুম্বী, তা মনে করিয়ে দেয় গণতন্ত্রচর্চার এই ভবনে আপনারা কত ক্ষুদ্র। গণতন্ত্রের অর্থ না বুঝলে তাঁর সংসদে যাওয়া উচিত নয়।
লেখক : সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
নানা কারণে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। এর অন্যতম হচ্ছে, যৌবনে নিজে এই দেশের ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তন হতে দেখেছি এবং নিজের সাধ্য অনুযায়ী সে পরিবর্তনের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করেছি। স্বাধীন বাংলাদেশের যখন প্রথম সংসদ বসল, তখন দুবার সেই সংসদে আমার দর্শক হিসেবে উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল। তখন বর্তমান সংসদ ভবন চালু হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর এখনকার দপ্তরটায় সংসদ বসত। আমাদের পাড়ার জহুর আহম্মদ চৌধুরী তখন বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনামন্ত্রী। এই নির্লোভ মানুষটিকে বঙ্গবন্ধু খুবই পছন্দ করতেন। বাবার সঙ্গে চৌধুরী সাহেবের দীর্ঘকালের সম্পর্ক। আমরা চাচা বলে ডাকি। বাবা চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা এলে চাচার জন্য চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী বেলা বিস্কুট আনতেন। দুবারই তাঁর দেওয়া পাস নিয়ে আমার সংসদে যাওয়া এবং দুবারই বঙ্গবন্ধু সংসদে উপস্থিত ছিলেন। আমার দ্বিতীয়বারের যাওয়াটা কিছুটা ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্য গৌরবের, কারণ তখন সংসদে ১৯৭২ সালের সংবিধান উপস্থাপিত হয়েছে। তা নিয়ে সংসদ সদস্যরা আলোচনা করছেন। বঙ্গবন্ধু মনে হলো টোকা নিচ্ছেন। কারা কারা আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন, এত দিন পর তা মনে নেই, তবে সকলে যে ভদ্র ও মার্জিত ভাষায় কথা বলছিলেন, তাতে দেশের গণতন্ত্র নিয়ে বেশ আশান্বিত হয়েছিলাম। অবশ্য সেই সংসদে বিরোধী দল বলে কেউ ছিল না, তথাপি উত্থাপিত সংবিধান নিয়ে বেশ কিছুটা আলাপ-আলোচনা হয়েছিল। তবে ১৯৭২-এর সংবিধানটি এতই নিখুঁত ছিল যে তাকে নিয়ে বিতর্ক করার তেমন কোনো সুযোগ ছিল না।
যে সংসদ অধিবেশনে ৪০ বছর আগে আমার যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল, সেখানে প্রকৃত অর্থেই রাজনীতিবিদরা ছিলেন। এখন তাঁরা অনেকটা বিলুপ্ত প্রজাতি। বর্তমান সংসদে যে দু-একজন এখনো টিম টিম করে জ্বলছেন, তাঁরা অনেকটা কোণঠাসা। তাঁদের অবস্থান পেশিশক্তি আর কালো টাকাওয়ালাদের দাপটের কাছে পরাজিত। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে আমি একজন মার্জিত রুচির রাজনীতিবিদ মনে করতাম। তাঁর বাবা কফিলউদ্দীন চৌধুরী আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট গঠনে অসামান্য ভূমিকা রেখেছিলেন। নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠন করলে তিনি বিচার ও আইনমন্ত্রী হয়েছিলেন। তাঁর ছেলে ১৯৯৬ সালে বিরোধী দলের উপনেতা হিসেবে যেভাবে স্পিকারের প্রতি তেড়ে গিয়ে বিটিভির ক্যামেরা ভাঙচুরে অংশ নিয়ে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিলেন, তখন সত্যি সত্যি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হয়েছিলাম। বর্তমান সংসদের অবস্থা দেখে আমার সেই ধারণাটা আরো কিছুটা বদ্ধমূল হয়েছে।
দীর্ঘ ৮৭ কার্যদিবস অনুপস্থিত থাকার পর যখন বিরোধী দল সংসদে ফিরল, তখন জাতি কিছুটা আশান্বিত হয়েছিল এই মনে করে, হয়তো এই অধিবেশনে সবাই মিলে কিছু অমীমাংসিত সমস্যা বা প্রশ্নের সমাধান বা উত্তর খোঁজার চেষ্টা করবেন। অর্থমন্ত্রী সংসদে তাঁর এই মেয়াদের শেষ বাজেট পেশ করলেন, কিন্তু এ পর্যন্ত সেই বাজেট নিয়ে কাউকে কোনো আলোচনা করতে শুনলাম না। তার পরিবর্তে সংরক্ষিত নারী আসনের বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা অশ্রবণযোগ্য শব্দ ব্যবহার করে সংসদে এক নজিরবিহীন ন্যক্কারজনক ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। যে নারী সংসদ সদস্যটি হেলাল হাফিজের একটি কবিতা পড়ে অথবা যিনি 'চ' বর্গীয় একটি শব্দ ব্যবহার করে এই কাণ্ডকারখানার সূত্রপাত করলেন, তিনি বা তাঁরা কী জানেন, বিভিন্ন সামাজিক নেটওয়ার্কে ওই একই কবির আর একটি কবিতা তাঁদের নামের পাশে উল্লেখ করে আপলোড করা হয়েছে এবং এখন লাখ লাখ মানুষ তা পড়ছে বা দেখছে? কবিতাটি উল্লেখ করলাম না, কারণ তা আমার ব্যক্তিগত রুচির পরিপন্থী। এই সংসদ সদস্যদের এই কাণ্ডের রেশ না কাটতেই সরকারদলীয় আরেক নারী সদস্য খালেদা জিয়ার জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে একটি সম্পূর্ণ অসত্য তথ্য দিয়ে নিজের অজ্ঞতা জাহির করতে এগিয়ে এলেন। এবার বিরোধীদলীয় আরেকজন নারী সদস্য যে কাজটি করলেন, তা শুধু সম্পূর্ণ অসত্যই নয়, অরুচিকর, অপ্রত্যাশিত, অনাকাঙ্ক্ষিত, অনভিপ্রেত, অমার্জনীয় এবং চরম ধৃষ্টতাপূর্ণ। তিনি নিজের লিখিত জাতির জনকের একটি বানোয়াট জীবনবৃত্তান্ত সংসদে উত্থাপন করলেন। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, যখন এসব নারী সংসদ সদস্য পবিত্র সংসদে দাঁড়িয়ে এমন সব আচরণ করেন, তাঁরা তখন ভুলে যান তাঁদের এই বক্তব্য তাঁদের সন্তান বা আত্মীয়স্বজন বা মার্জিত বন্ধুবান্ধবও শুনছেন। আরো পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, যখন তাঁরা তাঁদের বচন দিয়ে সংসদকে কলুষিত করেন, তখন তাঁদের দলীয় সংসদ সদস্যরা টেবিল চাপড়ে তাঁদের সমর্থন জানিয়ে এসব রুচিহীন বক্তব্যের ভাগীদার হন।
ব্রিটেনের হাউস অব কমনসে কোনো সংসদ সদস্য এমন আচরণ করলে স্পিকার সার্জেন্ট অ্যাট আর্মসকে ডেকে সেই সংসদ সদস্যকে হাউস থেকে বের করে দিতে পারেন। একাধিকবার বের করে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে, তবে তা বাংলাদেশের সংসদ সদস্যদের মতো নোংরামি করার জন্য নয়। বাংলাদেশের সংসদের কার্যপ্রণালী বিধিতে এমন কোনো ধারা আছে কি না জানি না, না থাকলে তা অবিলম্বে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। তবে আমার কথা হচ্ছে, সংসদে সরকারি ও বিরোধী দলের একাধিক সংসদ সদস্য পুরো ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন এবং এ ব্যাপারে স্পিকার কোনো ব্যবস্থা নিলে তা সমর্থন করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। আশা করি, পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাওয়ার আগেই সবার শুভবুদ্ধির উদয় হবে। আর যাঁরা এ ধরনের নোংরামির সঙ্গে জড়িত হন, তাঁদের বলি, যে সংসদ ভবনে বসে আপনারা এসব খিস্তিখেউড় করেন, তার ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখুন, দেখবেন সেটির উচ্চতা মনে হবে আকাশচুম্বী, তা মনে করিয়ে দেয় গণতন্ত্রচর্চার এই ভবনে আপনারা কত ক্ষুদ্র। গণতন্ত্রের অর্থ না বুঝলে তাঁর সংসদে যাওয়া উচিত নয়।
লেখক : সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
No comments