সিটি নির্বাচনে কিছু ভিন্ন পর্যবেক্ষণ by হাসান মামুন
দেশের চারটি বড় সিটি করপোরেশন নির্বাচনে
সম্প্রতি যা ঘটে গেল, তার তাৎপর্য রয়েছে নিশ্চয়ই; তবে এর ঢালাও প্রশংসা করা
যাবে না। প্রথমত, সংবিধান অনুযায়ী যেভাবে আমরা (সিটিসহ) স্থানীয় সরকার
নির্বাচনগুলো করতে চাইছি (অর্থাৎ নির্দলীয়ভাবে),
সেটি বলা
যায় একেবারেই ঘটেনি চার সিটির নির্বাচনে। যাঁরা এতে বিশেষত মেয়র পদে
লড়েছেন, তাঁদের পেছনে প্রকাশ্য ও জোরালোভাবেই ছিল জাতীয় রাজনৈতিক দল ও
জোটগুলো। নির্দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার পরিষদ গঠন ও এর পরিচালনার যে বিধান
রয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে অবশ্য; থাকতে পারে এর বিরুদ্ধে জোরালো
মতও। কেউ কেউ এমনো বলতে পারেন, যেহেতু ঠিকমতো কাজ করছে না, তাই বিধানটি রদ
করাই ভালো। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত রয়েছে, এটি তো অনুসরণ বা অন্তত এ লক্ষ্যে
প্রচেষ্টা নিতে হবে। আইন ও আচরণবিধি কঠোরভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে এটি
নিশ্চিত করার দায়িত্ব ছিল নির্বাচন কমিশনের (ইসি)। শান্তিপূর্ণভাবে চার
সিটির নির্বাচন অনুষ্ঠানে সফল হলেও ওই শর্ত পূরণে ইসি কিন্তু ব্যর্থই
হয়েছে। এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে একটি দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে। তারা
এটি সুষ্ঠুভাবে হতে দিয়েছে সন্দেহ নেই, তবে নির্দলীয়ভাবে নির্বাচন
অনুষ্ঠানে তাদেরও কোনো সদিচ্ছা দেখা যায়নি। এ কারণেও সদিচ্ছা দেখাতে পারত
যে সিটি নির্বাচনে স্থানীয় ইস্যুর বদলে জাতীয় ইস্যু প্রাধান্য পেলে তো
তাদেরই অসুবিধা। চার বছরেরও বেশি সময় ক্ষমতায় আছে বলে তাদের সাফল্যের চেয়ে
ব্যর্থতা নিয়ে নিন্দামন্দই এখন বেশি। যা হোক, খতিয়ে দেখা বা বুঝে ওঠার
অবকাশ এ দেশের ক্ষমতাসীনদের কমই থাকে বোধহয়। তারা ব্যস্ত থাকে অন্যান্য
বিষয় নিয়ে।
দ্বিতীয় যে কারণে এ নির্বাচনের খুব প্রশংসা করা যায় না, তা হলো জাতীয় ইস্যুর চাপে স্থানীয় ইস্যুগুলো একেবারে আড়াল হয়ে যাওয়া। জাতীয় নির্বাচনের আর বেশি দেরি নেই তো কী হয়েছে? আফটার অল, এগুলো তো স্থানীয় পরিষদ নির্বাচন। এতে শুধু সিটি মেয়র নন, একদল কাউন্সিলরও নির্বাচিত হয়ে এসেছেন। আদর্শ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কিন্তু আগে নির্বাচিত হন কাউন্সিলররা। তাঁরাই অতঃপর বানান একজন মেয়র। সংসদীয় ব্যবস্থায় যেভাবে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি বেছে নেওয়া হয়, অনেকটা সেভাবে। এ দেশে স্থানীয় নির্বাচনগুলোও যে রাজনৈতিক আবহে অনুষ্ঠিত হয়, তাতে অবশ্য সাধারণ ভোটারদের সেভাবে দোষ দেওয়া যায় না। প্রশ্ন উঠবে, মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরাও কি এলাকার উন্নয়নে এবং ওসব এলাকার মানুষের সেবার মান বৃদ্ধিতে কোনো পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছিলেন ভোটারদের সামনে? কিছু কাগুজে পরিকল্পনা পেশ করা হলেও সেগুলো কি গুরুত্বের সঙ্গে আনা হয়েছিল প্রচারণায়? স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীদের অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় লম্বা-চওড়া প্রতিশ্রুতি দিতে। এটাও বলতে হবে জাতীয় নির্বাচনের সুস্পষ্ট প্রভাব। পরীক্ষা করলে দেখা যাবে, ওসব প্রতিশ্রুতির সিংহভাগ বাস্তবায়নের আইনগত ক্ষমতাই নেই তাঁদের, অর্থাৎ দেওয়া হয়নি। ক্ষমতা থাকলেও ব্যয়ের ক্ষেত্রে আবার দেখা যাবে, তাঁরা আছেন কেন্দ্র তথা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে। জনপ্রতিনিধিত্বের জোরে নিজ নিজ এলাকার উপযুক্ত খাত থেকে কর আহরণ করে নিজ কর্তৃত্বে তা ব্যয়ের মাধ্যমে স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠার কোনো প্রবণতাই দেখা যাচ্ছে না স্থানীয় সরকারের মধ্যে। মেয়র নির্বাচনে সব প্রার্থীরই একটি প্রিয় বিষয় করের হার না বাড়ানো ও নতুন কর না বসানো। জনসাধারণও এটা পছন্দ করছে মনে হয়। কর দেব না; কিন্তু বেশি করে সেবা চাইব আর সে জন্য বরাদ্দ জোগাতে হবে কেন্দ্র তথা সরকারকে! হায়, সম্প্রতি হয়ে যাওয়া চার সিটি নির্বাচনে এসব আলোচনা জমতেই পারল না। এখন আবার শোনা যাচ্ছে, কী সব আইনগত জটিলতায় নবনির্বাচিতদের দায়িত্ব গ্রহণে বেশ কিছুটা সময় লাগবে। এ নিয়ে বিজয়ী পক্ষ তথা বিরোধী দলকেও তেমন ক্ষিপ্ত দেখা যাচ্ছে না। অর্থপূর্ণভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠান বা এ ব্যবস্থাটি কার্যকর হওয়া নিয়ে তো চিন্তিত নয় তারা। বিরোধী দল ও জোট আপাতত আনন্দে আছে চার সিটিতে তাদের মনোনীতদের বিরাট বিজয় নিয়ে; নিজেরাও যা ঠিক এভাবে বা এতটা চিন্তা করে উঠতে পারেনি।
চার সিটিতে নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর আমরা জেনে উদ্বিগ্ন হচ্ছি যে সরকারপক্ষের প্রার্থীদের 'ধর্মবিরোধী' আখ্যা দিয়ে চালানো প্রচারণার সামনে তাঁরা নাকি নিজ সুকর্মগুলো নিয়েও দাঁড়াতে পারেননি। এটি বেদনাদায়ক। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার জন্যও বিষয়টি দুর্ভাগ্যজনক এ জন্য যে এতে যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে নেতৃত্ব গঠনের প্রশ্ন জরুরি। এ ক্ষেত্রে চার সিটির সরকার পক্ষীয় মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের কোনো সার্টিফিকেট অবশ্য কেউ দেবে না। মিডিয়ায় বরং দেখতে পাচ্ছি দায়িত্ব পালনকালে তাঁদের প্রায় সবার সম্পদ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ার খবর। সমস্যা হলো, এগুলোও নাকি সিংহভাগ ভোটারের কাছে গুরুত্ব পায়নি। গুরুত্ব পেয়েছে আস্তিক-নাস্তিক ইস্যু, গণজাগরণ মঞ্চ, হেফাজতে ইসলাম, শাপলা চত্বরে পুলিশি অভিযান, হতাহতের সংখ্যা নিয়ে গুজব, এমনকি যুদ্ধাপরাধের বিচার, সাঈদী প্রসঙ্গ।
সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকারকে বলা হয় জনগণের 'হাতের কাছের সরকার'। এ ধরনের সরকার বা পরিষদ গঠনে (বাংলাদেশের বাস্তবতায়) দলবাজির ঊধর্ে্ব উঠতে বলার পাশাপাশি স্থানীয় ইস্যুতে জোর দেওয়ার কথাই বেশি করে বলা হয়। এ ক্ষেত্রে তাই এমনটি ঘটাই স্বাভাবিক যে জাতীয় নির্বাচনে যেসব ইস্যু গুরুত্ব পাবে, স্থানীয় নির্বাচনে পাবে অন্যগুলো। জাতীয় নির্বাচনে ভোটার যে আচরণ করবে, স্থানীয় নির্বাচনে তা করবে ভিন্নভাবে। এতে শাসন বা সরকারব্যবস্থায় একটা ভারসাম্যও বিরাজ করবে, যা বহুদলীয় ব্যবস্থা সফল হওয়ার বড় পূর্বশর্ত। এসব কথা পরাজিত সরকারপক্ষও বলবে না; কারণ এ দেশে নির্বাচন করেই তাদের পথ চলতে হবে। এসব বলতে হবে তাঁদের, যাঁরা কখনো নির্বাচন করবেন না, কিন্তু সব সময়ই যাঁদের অবস্থান নিতে হবে আপ্তবাক্য আওড়ানোর বদলে সত্যের পক্ষে।
লেখক : সাংবাদিক
hmamun67@gmail.com
দ্বিতীয় যে কারণে এ নির্বাচনের খুব প্রশংসা করা যায় না, তা হলো জাতীয় ইস্যুর চাপে স্থানীয় ইস্যুগুলো একেবারে আড়াল হয়ে যাওয়া। জাতীয় নির্বাচনের আর বেশি দেরি নেই তো কী হয়েছে? আফটার অল, এগুলো তো স্থানীয় পরিষদ নির্বাচন। এতে শুধু সিটি মেয়র নন, একদল কাউন্সিলরও নির্বাচিত হয়ে এসেছেন। আদর্শ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কিন্তু আগে নির্বাচিত হন কাউন্সিলররা। তাঁরাই অতঃপর বানান একজন মেয়র। সংসদীয় ব্যবস্থায় যেভাবে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি বেছে নেওয়া হয়, অনেকটা সেভাবে। এ দেশে স্থানীয় নির্বাচনগুলোও যে রাজনৈতিক আবহে অনুষ্ঠিত হয়, তাতে অবশ্য সাধারণ ভোটারদের সেভাবে দোষ দেওয়া যায় না। প্রশ্ন উঠবে, মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরাও কি এলাকার উন্নয়নে এবং ওসব এলাকার মানুষের সেবার মান বৃদ্ধিতে কোনো পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছিলেন ভোটারদের সামনে? কিছু কাগুজে পরিকল্পনা পেশ করা হলেও সেগুলো কি গুরুত্বের সঙ্গে আনা হয়েছিল প্রচারণায়? স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীদের অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় লম্বা-চওড়া প্রতিশ্রুতি দিতে। এটাও বলতে হবে জাতীয় নির্বাচনের সুস্পষ্ট প্রভাব। পরীক্ষা করলে দেখা যাবে, ওসব প্রতিশ্রুতির সিংহভাগ বাস্তবায়নের আইনগত ক্ষমতাই নেই তাঁদের, অর্থাৎ দেওয়া হয়নি। ক্ষমতা থাকলেও ব্যয়ের ক্ষেত্রে আবার দেখা যাবে, তাঁরা আছেন কেন্দ্র তথা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে। জনপ্রতিনিধিত্বের জোরে নিজ নিজ এলাকার উপযুক্ত খাত থেকে কর আহরণ করে নিজ কর্তৃত্বে তা ব্যয়ের মাধ্যমে স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠার কোনো প্রবণতাই দেখা যাচ্ছে না স্থানীয় সরকারের মধ্যে। মেয়র নির্বাচনে সব প্রার্থীরই একটি প্রিয় বিষয় করের হার না বাড়ানো ও নতুন কর না বসানো। জনসাধারণও এটা পছন্দ করছে মনে হয়। কর দেব না; কিন্তু বেশি করে সেবা চাইব আর সে জন্য বরাদ্দ জোগাতে হবে কেন্দ্র তথা সরকারকে! হায়, সম্প্রতি হয়ে যাওয়া চার সিটি নির্বাচনে এসব আলোচনা জমতেই পারল না। এখন আবার শোনা যাচ্ছে, কী সব আইনগত জটিলতায় নবনির্বাচিতদের দায়িত্ব গ্রহণে বেশ কিছুটা সময় লাগবে। এ নিয়ে বিজয়ী পক্ষ তথা বিরোধী দলকেও তেমন ক্ষিপ্ত দেখা যাচ্ছে না। অর্থপূর্ণভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠান বা এ ব্যবস্থাটি কার্যকর হওয়া নিয়ে তো চিন্তিত নয় তারা। বিরোধী দল ও জোট আপাতত আনন্দে আছে চার সিটিতে তাদের মনোনীতদের বিরাট বিজয় নিয়ে; নিজেরাও যা ঠিক এভাবে বা এতটা চিন্তা করে উঠতে পারেনি।
চার সিটিতে নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর আমরা জেনে উদ্বিগ্ন হচ্ছি যে সরকারপক্ষের প্রার্থীদের 'ধর্মবিরোধী' আখ্যা দিয়ে চালানো প্রচারণার সামনে তাঁরা নাকি নিজ সুকর্মগুলো নিয়েও দাঁড়াতে পারেননি। এটি বেদনাদায়ক। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার জন্যও বিষয়টি দুর্ভাগ্যজনক এ জন্য যে এতে যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে নেতৃত্ব গঠনের প্রশ্ন জরুরি। এ ক্ষেত্রে চার সিটির সরকার পক্ষীয় মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের কোনো সার্টিফিকেট অবশ্য কেউ দেবে না। মিডিয়ায় বরং দেখতে পাচ্ছি দায়িত্ব পালনকালে তাঁদের প্রায় সবার সম্পদ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ার খবর। সমস্যা হলো, এগুলোও নাকি সিংহভাগ ভোটারের কাছে গুরুত্ব পায়নি। গুরুত্ব পেয়েছে আস্তিক-নাস্তিক ইস্যু, গণজাগরণ মঞ্চ, হেফাজতে ইসলাম, শাপলা চত্বরে পুলিশি অভিযান, হতাহতের সংখ্যা নিয়ে গুজব, এমনকি যুদ্ধাপরাধের বিচার, সাঈদী প্রসঙ্গ।
সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকারকে বলা হয় জনগণের 'হাতের কাছের সরকার'। এ ধরনের সরকার বা পরিষদ গঠনে (বাংলাদেশের বাস্তবতায়) দলবাজির ঊধর্ে্ব উঠতে বলার পাশাপাশি স্থানীয় ইস্যুতে জোর দেওয়ার কথাই বেশি করে বলা হয়। এ ক্ষেত্রে তাই এমনটি ঘটাই স্বাভাবিক যে জাতীয় নির্বাচনে যেসব ইস্যু গুরুত্ব পাবে, স্থানীয় নির্বাচনে পাবে অন্যগুলো। জাতীয় নির্বাচনে ভোটার যে আচরণ করবে, স্থানীয় নির্বাচনে তা করবে ভিন্নভাবে। এতে শাসন বা সরকারব্যবস্থায় একটা ভারসাম্যও বিরাজ করবে, যা বহুদলীয় ব্যবস্থা সফল হওয়ার বড় পূর্বশর্ত। এসব কথা পরাজিত সরকারপক্ষও বলবে না; কারণ এ দেশে নির্বাচন করেই তাদের পথ চলতে হবে। এসব বলতে হবে তাঁদের, যাঁরা কখনো নির্বাচন করবেন না, কিন্তু সব সময়ই যাঁদের অবস্থান নিতে হবে আপ্তবাক্য আওড়ানোর বদলে সত্যের পক্ষে।
লেখক : সাংবাদিক
hmamun67@gmail.com
No comments