তালেবানের দ্বৈতনীতির পেছনে by শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া
আফগানিস্তানে ১২ বছরের রক্তক্ষয়ী
সহিংসতার অবসানে প্রস্তুত তিন পক্ষ। তারা হচ্ছে আফগান সরকারের ‘উচ্চ শান্তি
পরিষদ’, যুক্তরাষ্ট্র ও জঙ্গিগোষ্ঠী তালেবান। এখানে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা
মূলত মধ্যস্থতাকারীর।
আফগানিস্তান থেকে পাততাড়ি গোটানোর
আগে তারা চাইছে, দেশটিতে তালেবানের দৌরাত্ম্যের অবসান ঘটে স্থায়ীভাবে
শান্তি প্রতিষ্ঠা হোক। তা করতে পারলে নিজেদের সামরিক অভিযান ও এক যুগের
‘অর্থহীন’ সংঘাত-রক্তক্ষয়ের জন্য যে দুর্নাম হয়েছে, তার কিছুটা হলেও
হয়তো দূর হবে।
কিন্তু ত্রিপক্ষীয় শান্তি আলোচনার সব প্রস্তুতি যখন প্রায় চূড়ান্ত, ঠিক এই সময় গত মঙ্গলবার বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটাল তালেবান। সেদিন সকালে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ ও মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিআইএ) চৌহদ্দির কাছে দুঃসাহসী আত্মঘাতী হামলা চালায় তারা। পাঁচজন হামলাকারী তাদের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে এই হামলা চালায়। এতে অবশ্য জানমালের তেমন ক্ষতি হয়নি। হামলাকারীরা ছাড়া তিনজন মাত্র নিরাপত্তারক্ষী নিহত হয়েছেন। বোঝা গেছে, তালেবান এখনো আফগান সরকারের সবচেয়ে নিরাপদ বলে দাবি করা স্থানে হামলা চালানোর ক্ষমতা রাখে।
সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে—সমঝোতা আর শান্তিই যদি তালেবানের কাম্য, তাহলে কোনো উসকানি ছাড়াই এ হামলা কেন? এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হলো, তালেবান কিন্তু এখনো বলেনি যে তারা শান্তি আলোচনার পথ থেকে সরে গেছে। বরং বলছে, তারা সমঝোতাই চায়।
তালেবানের হঠাত্ হানার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক গ্রায়েম স্মিথ জানান, একই সঙ্গে যুদ্ধ ও আলোচনা চালিয়ে যাওয়া একটি আধুনিক কৌশল। এর মূল প্রবর্তক যুক্তরাষ্ট্র। তালেবান এখন তা অনুসরণ করছে। কোনো পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করার পরিবেশ তৈরি হওয়ার পর পর এ ধরনের হামলা চালালে প্রতিপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। এতে হামলাকারীকে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে আলোচনার টেবিলে তাদের শর্ত মেনে নেওয়ার মতো মানসিকতা তৈরি হতে পারে। তালেবান সে ধরনের কোনো কৌশল অবলম্বন করে থাকতে পারে।
আশার কথা হচ্ছে, আফগানিস্তান সরকার ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই বলেছে, এই অপ্রত্যাশিত হামলার ঘটনায় তারা শান্তি আলোচনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে না। হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জে কারনি এক বিবৃতিতে বলেছেন, তালেবানের ওই হামলার পর আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তাঁরা উভয়েই তালেবানের সঙ্গে আলোচনায় যাওয়ার বিষয়টি আবারও নিশ্চিত করেছেন।
২০১৪ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক সেনারা আফগানিস্তান থেকে পুরোপুরি বিদায় নেবে। তখন থেকে আফগানিস্তানের নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পুরো দায়িত্ব বর্তাবে আফগান সরকারের ওপর। তাদের সঙ্গে তালেবানের দ্বৈরথের মাঝখানে বিদেশি সেনা বলে আর কিছু থাকবে না। ওই পরিস্থিতিতে আফগান বাহিনীর সঙ্গে তালেবান যোদ্ধাদের যে লড়াই হবে, তা হবে ভ্রাতৃহত্যার শামিল। আফগানিস্তানে একসময় বছরের পর বছর ধরে যা চলেছে। আবার সে রকম সংঘাত শুরু হলে দেশটিতে কখনোই শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে না। তালেবানও নাকি চায় না এই ভ্রাতৃহত্যায় তাদের হাত রঞ্জিত হোক। কিন্তু তারা নিজেদের আধিপত্য বা গোষ্ঠীগত স্বার্থও জলাঞ্জলি দিতে রাজি নয়। সবকিছু মিলিয়েই সমঝোতায় পৌঁছার বিষয়টি এখন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। আলোচনার দীর্ঘসূত্রতার কারণ মূলত তালেবানের নীতি ও মনোভাব। প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইকে তারা ঘৃণা করে। কারজাই সরকারকে মনে করে মার্কিন কর্তৃপক্ষের হাতের পুতুল।
কাবুলে হামলা চালানোর ঠিক এক সপ্তাহ আগে কাতারের রাজধানী দোহায় একটি দপ্তর খুলেছে তালেবান। তালেবানের দাবি, মূলত শান্তি আলোচনার জন্য তাদের এই দপ্তর খোলা। কিন্তু এর নামকরণ ও সেখানে ওড়ানো পতাকা নিয়ে আফগান সরকারের সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। তালেবান তাদের দপ্তরের ফটকে লিখেছে ‘ইসলামিক এমিরেট অব আফগানিস্তান’, যা কট্টরপন্থী তালেবান ক্ষমতায় থাকার সময় দেশটির নাম ছিল। কারজাই সরকার বলছে, এটা গ্রহণযোগ্য নয়। আর এ রকম দপ্তর তালেবানকে প্রবাসী সরকার গোছের একটা চেহারা (সেই সঙ্গে বৈধতা) দেয়।
কাতারে এক বছরের বেশি সময় ধরে অবস্থান করছেন ২০ জনের বেশি তালেবান প্রতিনিধি। এর আগে আফগান সরকার ও তাদের পশ্চিমা সমর্থকেরা বছরের পর বছর ধরে তালেবান নেতাদের ঠিকানা খুঁজে বেড়িয়েছে। কিন্তু কোনো হদিস মেলেনি। শান্তি আলোচনা হয়েছে সব মাধ্যম ধরে। বিভিন্ন হোটেল বা এ ধরনের কোনো পছন্দসই স্থানে হয়েছে সংলাপ। কিন্তু কোনো আলোচনাতেই শীর্ষ পর্যায়ের তালেবান নেতা ছিলেন না। কাজেই বড় কোনো সিদ্ধান্তে কখনোই পৌঁছানো যায়নি।
এ কারণেই আফগান সরকার ও তার মিত্ররা এমন এক স্থানে আলোচনায় বসতে চাইছে, যেখানে তালেবান নেতারা নির্ভাবনায় যোগ দেবেন। এ বিবেচনা থেকে তালেবানের স্থায়ী দপ্তরের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। তালেবানের কাছে প্রস্তাব রাখা হয়, তারা ইচ্ছা করলে তুরস্ক, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত বা সৌদি আরবে দপ্তর খুলতে পারে। এ প্রস্তাবে রাজি হয়ে তালেবান তাদের দপ্তর খোলার জন্য কাতারকে বেছে নেয়। কারণ তিন পক্ষই দেশটিকে নিরপেক্ষ বলে মনে করে।
ক্ষুদ্র উপসাগরীয় দেশ কাতার তেল ও প্রচুর গ্যাস সম্পদের জন্য বিপুল বিত্তের অধিকারী একটি দেশ। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বমঞ্চে তাদের রাজনৈতিক মর্যাদা বেড়েছে। বিভিন্ন দেশের সংঘাত ও রাজনৈতিক আলোচনায় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা পালন করে কাতার আলোচিত ও প্রশংসিত হয়েছে।
তবে শুরুতে কাতারে তালেবানের এই দপ্তর খোলার বিষয়ে ঘোর আপত্তি ছিল কারজাইয়ের। তাঁর আশঙ্কা, এই দপ্তরের মাধ্যমে তালেবান তহবিল ও সদস্য সংগ্রহ করবে। এমনটি ঘটবে না বলে আশ্বাস দেওয়ার পরই তিনি এ ব্যাপারে মত দেন।
আলোচনা আবার শুরু হলে তালেবানের সঙ্গে আফগান সরকারের একাধিক বিষয়ে মতভেদ দেখা দিতে পারে। তালেবান চায়, আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা সেনা সমূলে বিদায় হোক। কিন্তু ২০১৪ সালের শেষ নাগাদ সব সেনা সরিয়ে নেওয়ার পরও যুক্তরাষ্ট্র কিছু সেনা আফগানিস্তানে রাখতে চাইছে। আফগান সেনাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার নাম করে তারা থাকবে।
ভবিষ্যত্ আফগান সরকারের কাঠামো নিয়েও তালেবানের সঙ্গে মতভেদ দেখা দেওয়ার আশঙ্কা প্রবল। দেশের রাজনীতিতে প্রবেশাধিকার চাইছে তালেবান। এটিও আলোচনা পণ্ড করে দেওয়ার বড় কারণ হতে পারে। দেশের নাগরিক অধিকার সংগঠন ও নারী অধিকার কর্মীরা চায় না তালেবান সে সুযোগ পাক। তাদের আশঙ্কা, তালেবান যদি আবার কখনো ক্ষমতায় আসে, তাহলে তাদের অধিকার ক্ষুণ্ন হবে। আবার বন্ধ হবে নারী প্রগতির পথ।
আলোচনায় ওবামা প্রশাসন দুটি শর্ত তুলে ধরবে বলে মনে করা হচ্ছে। একটি হচ্ছে, প্রকাশ্য বিবৃতির মাধ্যমে তালেবানের এই শান্তি-প্রক্রিয়ায় সমর্থন জানানো; অন্যটি হচ্ছে, অন্য দেশগুলোকে তারা আর হুমকি দেবে না, এ মর্মে অঙ্গীকার করা।
তালেবানের বেশির ভাগ শীর্ষ নেতা এখন জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার গ্যাঁড়াকলে বন্দী। আলোচনার বিষয়টিকে তাঁরা অজ্ঞাতবাস থেকে প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসার সুযোগ হিসেবে দেখছেন। এ কারণে বিদেশি সেনা পুরোপুরি প্রত্যাহার তো তাঁরা চাইবেনই, একই সঙ্গে গুয়ানতানামো বের মার্কিন কারাগার ও আফগান কারাগার থেকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক তালেবান বন্দীর মুক্তি দাবি করবেন। নিষেধাজ্ঞার তালিকা থেকে শীর্ষ নেতাদের নাম বাদ দেওয়ার দাবিও জানাবেন তাঁরা।
আফগান সরকার আশা করছে, পাকিস্তানের মতো ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ তৃতীয় পক্ষ ছাড়া এই প্রথমবারের মতো তালেবান নেতাদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার সুযোগ পাবে তারা। এতে অমীমাংসিত অনেক বিষয়ে খোলাখুলি মতবিনিময়ের সুযোগ থাকবে।
মার্কিন ও আফগান প্রশাসন চায়, শান্তি-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তালেবান আফগান সরকারের সঙ্গে হাত মেলাক। এতে তাদের গত এক দশকের অর্জন ধরে রাখা সহজ হবে।
যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, এই আলোচনা তখনই সফল হবে, যখন তালেবান কট্টরপন্থী সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আল-কায়েদার সঙ্গে সব বন্ধন ছিন্ন ও সহিংসতা বর্জন করে দেশের সংবিধান মেনে নেবে। নিশ্চিত করতে হবে নারী অধিকারও। এ বিষয়গুলো তালেবানকে মেনে নিতে রাজি করা সহজ হবে না, তা বলাই বাহুল্য।
কিন্তু ত্রিপক্ষীয় শান্তি আলোচনার সব প্রস্তুতি যখন প্রায় চূড়ান্ত, ঠিক এই সময় গত মঙ্গলবার বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটাল তালেবান। সেদিন সকালে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ ও মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিআইএ) চৌহদ্দির কাছে দুঃসাহসী আত্মঘাতী হামলা চালায় তারা। পাঁচজন হামলাকারী তাদের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে এই হামলা চালায়। এতে অবশ্য জানমালের তেমন ক্ষতি হয়নি। হামলাকারীরা ছাড়া তিনজন মাত্র নিরাপত্তারক্ষী নিহত হয়েছেন। বোঝা গেছে, তালেবান এখনো আফগান সরকারের সবচেয়ে নিরাপদ বলে দাবি করা স্থানে হামলা চালানোর ক্ষমতা রাখে।
সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে—সমঝোতা আর শান্তিই যদি তালেবানের কাম্য, তাহলে কোনো উসকানি ছাড়াই এ হামলা কেন? এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হলো, তালেবান কিন্তু এখনো বলেনি যে তারা শান্তি আলোচনার পথ থেকে সরে গেছে। বরং বলছে, তারা সমঝোতাই চায়।
তালেবানের হঠাত্ হানার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক গ্রায়েম স্মিথ জানান, একই সঙ্গে যুদ্ধ ও আলোচনা চালিয়ে যাওয়া একটি আধুনিক কৌশল। এর মূল প্রবর্তক যুক্তরাষ্ট্র। তালেবান এখন তা অনুসরণ করছে। কোনো পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করার পরিবেশ তৈরি হওয়ার পর পর এ ধরনের হামলা চালালে প্রতিপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। এতে হামলাকারীকে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে আলোচনার টেবিলে তাদের শর্ত মেনে নেওয়ার মতো মানসিকতা তৈরি হতে পারে। তালেবান সে ধরনের কোনো কৌশল অবলম্বন করে থাকতে পারে।
আশার কথা হচ্ছে, আফগানিস্তান সরকার ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই বলেছে, এই অপ্রত্যাশিত হামলার ঘটনায় তারা শান্তি আলোচনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে না। হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জে কারনি এক বিবৃতিতে বলেছেন, তালেবানের ওই হামলার পর আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তাঁরা উভয়েই তালেবানের সঙ্গে আলোচনায় যাওয়ার বিষয়টি আবারও নিশ্চিত করেছেন।
২০১৪ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক সেনারা আফগানিস্তান থেকে পুরোপুরি বিদায় নেবে। তখন থেকে আফগানিস্তানের নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পুরো দায়িত্ব বর্তাবে আফগান সরকারের ওপর। তাদের সঙ্গে তালেবানের দ্বৈরথের মাঝখানে বিদেশি সেনা বলে আর কিছু থাকবে না। ওই পরিস্থিতিতে আফগান বাহিনীর সঙ্গে তালেবান যোদ্ধাদের যে লড়াই হবে, তা হবে ভ্রাতৃহত্যার শামিল। আফগানিস্তানে একসময় বছরের পর বছর ধরে যা চলেছে। আবার সে রকম সংঘাত শুরু হলে দেশটিতে কখনোই শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে না। তালেবানও নাকি চায় না এই ভ্রাতৃহত্যায় তাদের হাত রঞ্জিত হোক। কিন্তু তারা নিজেদের আধিপত্য বা গোষ্ঠীগত স্বার্থও জলাঞ্জলি দিতে রাজি নয়। সবকিছু মিলিয়েই সমঝোতায় পৌঁছার বিষয়টি এখন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। আলোচনার দীর্ঘসূত্রতার কারণ মূলত তালেবানের নীতি ও মনোভাব। প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইকে তারা ঘৃণা করে। কারজাই সরকারকে মনে করে মার্কিন কর্তৃপক্ষের হাতের পুতুল।
কাবুলে হামলা চালানোর ঠিক এক সপ্তাহ আগে কাতারের রাজধানী দোহায় একটি দপ্তর খুলেছে তালেবান। তালেবানের দাবি, মূলত শান্তি আলোচনার জন্য তাদের এই দপ্তর খোলা। কিন্তু এর নামকরণ ও সেখানে ওড়ানো পতাকা নিয়ে আফগান সরকারের সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। তালেবান তাদের দপ্তরের ফটকে লিখেছে ‘ইসলামিক এমিরেট অব আফগানিস্তান’, যা কট্টরপন্থী তালেবান ক্ষমতায় থাকার সময় দেশটির নাম ছিল। কারজাই সরকার বলছে, এটা গ্রহণযোগ্য নয়। আর এ রকম দপ্তর তালেবানকে প্রবাসী সরকার গোছের একটা চেহারা (সেই সঙ্গে বৈধতা) দেয়।
কাতারে এক বছরের বেশি সময় ধরে অবস্থান করছেন ২০ জনের বেশি তালেবান প্রতিনিধি। এর আগে আফগান সরকার ও তাদের পশ্চিমা সমর্থকেরা বছরের পর বছর ধরে তালেবান নেতাদের ঠিকানা খুঁজে বেড়িয়েছে। কিন্তু কোনো হদিস মেলেনি। শান্তি আলোচনা হয়েছে সব মাধ্যম ধরে। বিভিন্ন হোটেল বা এ ধরনের কোনো পছন্দসই স্থানে হয়েছে সংলাপ। কিন্তু কোনো আলোচনাতেই শীর্ষ পর্যায়ের তালেবান নেতা ছিলেন না। কাজেই বড় কোনো সিদ্ধান্তে কখনোই পৌঁছানো যায়নি।
এ কারণেই আফগান সরকার ও তার মিত্ররা এমন এক স্থানে আলোচনায় বসতে চাইছে, যেখানে তালেবান নেতারা নির্ভাবনায় যোগ দেবেন। এ বিবেচনা থেকে তালেবানের স্থায়ী দপ্তরের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। তালেবানের কাছে প্রস্তাব রাখা হয়, তারা ইচ্ছা করলে তুরস্ক, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত বা সৌদি আরবে দপ্তর খুলতে পারে। এ প্রস্তাবে রাজি হয়ে তালেবান তাদের দপ্তর খোলার জন্য কাতারকে বেছে নেয়। কারণ তিন পক্ষই দেশটিকে নিরপেক্ষ বলে মনে করে।
ক্ষুদ্র উপসাগরীয় দেশ কাতার তেল ও প্রচুর গ্যাস সম্পদের জন্য বিপুল বিত্তের অধিকারী একটি দেশ। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বমঞ্চে তাদের রাজনৈতিক মর্যাদা বেড়েছে। বিভিন্ন দেশের সংঘাত ও রাজনৈতিক আলোচনায় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা পালন করে কাতার আলোচিত ও প্রশংসিত হয়েছে।
তবে শুরুতে কাতারে তালেবানের এই দপ্তর খোলার বিষয়ে ঘোর আপত্তি ছিল কারজাইয়ের। তাঁর আশঙ্কা, এই দপ্তরের মাধ্যমে তালেবান তহবিল ও সদস্য সংগ্রহ করবে। এমনটি ঘটবে না বলে আশ্বাস দেওয়ার পরই তিনি এ ব্যাপারে মত দেন।
আলোচনা আবার শুরু হলে তালেবানের সঙ্গে আফগান সরকারের একাধিক বিষয়ে মতভেদ দেখা দিতে পারে। তালেবান চায়, আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা সেনা সমূলে বিদায় হোক। কিন্তু ২০১৪ সালের শেষ নাগাদ সব সেনা সরিয়ে নেওয়ার পরও যুক্তরাষ্ট্র কিছু সেনা আফগানিস্তানে রাখতে চাইছে। আফগান সেনাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার নাম করে তারা থাকবে।
ভবিষ্যত্ আফগান সরকারের কাঠামো নিয়েও তালেবানের সঙ্গে মতভেদ দেখা দেওয়ার আশঙ্কা প্রবল। দেশের রাজনীতিতে প্রবেশাধিকার চাইছে তালেবান। এটিও আলোচনা পণ্ড করে দেওয়ার বড় কারণ হতে পারে। দেশের নাগরিক অধিকার সংগঠন ও নারী অধিকার কর্মীরা চায় না তালেবান সে সুযোগ পাক। তাদের আশঙ্কা, তালেবান যদি আবার কখনো ক্ষমতায় আসে, তাহলে তাদের অধিকার ক্ষুণ্ন হবে। আবার বন্ধ হবে নারী প্রগতির পথ।
আলোচনায় ওবামা প্রশাসন দুটি শর্ত তুলে ধরবে বলে মনে করা হচ্ছে। একটি হচ্ছে, প্রকাশ্য বিবৃতির মাধ্যমে তালেবানের এই শান্তি-প্রক্রিয়ায় সমর্থন জানানো; অন্যটি হচ্ছে, অন্য দেশগুলোকে তারা আর হুমকি দেবে না, এ মর্মে অঙ্গীকার করা।
তালেবানের বেশির ভাগ শীর্ষ নেতা এখন জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার গ্যাঁড়াকলে বন্দী। আলোচনার বিষয়টিকে তাঁরা অজ্ঞাতবাস থেকে প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসার সুযোগ হিসেবে দেখছেন। এ কারণে বিদেশি সেনা পুরোপুরি প্রত্যাহার তো তাঁরা চাইবেনই, একই সঙ্গে গুয়ানতানামো বের মার্কিন কারাগার ও আফগান কারাগার থেকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক তালেবান বন্দীর মুক্তি দাবি করবেন। নিষেধাজ্ঞার তালিকা থেকে শীর্ষ নেতাদের নাম বাদ দেওয়ার দাবিও জানাবেন তাঁরা।
আফগান সরকার আশা করছে, পাকিস্তানের মতো ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ তৃতীয় পক্ষ ছাড়া এই প্রথমবারের মতো তালেবান নেতাদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার সুযোগ পাবে তারা। এতে অমীমাংসিত অনেক বিষয়ে খোলাখুলি মতবিনিময়ের সুযোগ থাকবে।
মার্কিন ও আফগান প্রশাসন চায়, শান্তি-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তালেবান আফগান সরকারের সঙ্গে হাত মেলাক। এতে তাদের গত এক দশকের অর্জন ধরে রাখা সহজ হবে।
যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, এই আলোচনা তখনই সফল হবে, যখন তালেবান কট্টরপন্থী সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আল-কায়েদার সঙ্গে সব বন্ধন ছিন্ন ও সহিংসতা বর্জন করে দেশের সংবিধান মেনে নেবে। নিশ্চিত করতে হবে নারী অধিকারও। এ বিষয়গুলো তালেবানকে মেনে নিতে রাজি করা সহজ হবে না, তা বলাই বাহুল্য।
No comments