জাতিসংঘে রেজওয়ানা চৌধুরী by হাসান ফেরদৌস
তারিখ: ৩০ মে, ২০১৩। স্থান: নিউইয়র্ক,
জাতিসংঘের সদর দপ্তর। উপলক্ষ: রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির নোবেল প্রাপ্তির
শতবর্ষ উদ্যাপন। উদ্যোক্তা: জাতিসংঘের গণতথ্য দপ্তর।
রবীন্দ্রনাথ
বিশ্বমানব, তাঁর রচিত গীতাঞ্জলির প্রাসঙ্গিকতা ১০০ বছর পরও বিন্দুমাত্র
হ্রাস পায়নি। বিশ্বে বিভিন্ন সভ্যতার একে অপরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা
আছে, কিন্তু তাদের মধ্যে সংঘর্ষের বদলে সংলাপ সম্ভব হলে আমাদের এই পৃথিবী
অধিকতর বসবাসযোগ্য হবে। জাতিসংঘের মূলে রয়েছে সেই সম্প্রীতির আহ্বান;
রবীন্দ্রনাথের কাব্যেও। সে কথা মাথায় রেখেই জাতিসংঘের উদ্যোগে এ
অনুষ্ঠানের আয়োজন।
অনুষ্ঠানের শুরু হলো রেজওয়ানা চৌধুরীর গলায় রবীন্দ্রনাথের চিরচেনা একটি গান দিয়ে: ‘আমারে তুমি অশেষ করেছ’। পেছনে বড় পর্দায় সেই গানের ইংরেজি তরজমা। নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরের কোনো মূল সম্মেলনকক্ষে এর আগে রবীন্দ্রনাথের গান কবে, কোথায় গীত হয়েছিল, আমার জানা নেই। অভ্যাগতদের অধিকাংশই বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি, তাঁদের মধ্যে কেউ বা রাষ্ট্রদূত, কেউ বা বিশ্ব সংস্থার কর্মী। এক মুহূর্ত আগেও যে সম্মেলনকক্ষ নানা ভাষার মানুষের কলকোলাহলে মুখরিত ছিল, অনায়াসে তা রূপান্তরিত হলো এক ধ্যানমগ্ন সমর্পণে।
মূল মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আবদুল মোমেন ও ভারতের রাষ্ট্রদূত অশোক কুমার মুখার্জি। ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ের জন্যই রবীন্দ্রনাথ সমানভাবে বন্দিত। তাঁর লেখা গান উভয় দেশের জাতীয় সংগীত হিসেবেই গীত হয়ে থাকে। দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের অন্য আরেক প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীতেও রয়েছে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব। সে দেশের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা আনন্দ সামারাকুন তিরিশের দশকের শেষ পর্যায়ে শান্তিনিকেতনে ছাত্র হিসেবে বেশ কয়েক বছর কাটান ও কবিগুরুর নিকট সংস্পর্শে আসেন। তাঁর রচিত ‘শ্রীলঙ্কা মাতা’ কবিতাটি সে দেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে গৃহীত হওয়ার পর তিনি নিজেই এ গানে কবিগুরুর প্রভাবের কথা স্বীকার করেন। কবিগুরুর ভাব ও বাণী কীভাবে উপমহাদেশের দেশগুলোকে নিকটতর করেছে, রাষ্ট্রদূত মোমেন সে কথা জানালেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে কবিগুরুর বাণী বাঙালিকে কীভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল, সে কথাও সবিস্তারে জানালেন তিনি।
জাতিসংঘের এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারিয়া ক্রিস্টিনা পারসেভাল। তিনি একসময় ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন, রবীন্দ্রনাথের কবিতা সাগ্রহে পড়েছেন। তিনি স্মরণ করলেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর দেশের বিদুষী লেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের কথা। পড়ে শোনালেন চিলির বিখ্যাত কবি পাবলো নেরুদার অনুবাদে রবীন্দ্রনাথের গান ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা’। রাষ্ট্রদূত সম্ভবত জানতেন না, এই গানটি নেরুদা একসময় নিজের লেখা কবিতা বলে তাঁর একটি জনপ্রিয় কাব্য সংকলনের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। পরে সমালোচনার মুখে পড়ে স্বীকার করতে বাধ্য হন, কবিতাটি তিনি লিখেছেন রবীন্দ্রনাথের কবিতার ছায়া অবলম্বনে।
ফরাসি ভাষায় রবীন্দ্র কবিতার আবৃত্তি করলেন ফরাসি দূতাবাসের প্রতিনিধি গিয়ম দাবুওয়া। তাঁর নির্বাচিত কবিতাটি ছিল বিখ্যাত ফরাসি কথাসাহিত্যিক ও কবি আঁদ্রে জিদের অনুবাদে, গীতাঞ্জলির ৫৯ নম্বর কবিতা। আইরিশ কবি ইয়েটসের মতো আঁদ্রে জিদও গীতাঞ্জলির অতীন্দ্রিয় ভাবময়তায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর কাছেও রবীন্দ্রকাব্যের মূল বিষয় প্রেম নয়, ভক্তির প্রকাশ। জিদ অবশ্য এ কথাও বুঝেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর-চেতনার কেন্দ্রে রয়েছে মানুষ। ‘মানুষের ভেতর দিয়েই ঈশ্বর নিজেও তাঁর অস্তিত্ব বিষয়ে অবহিত হন’, গীতাঞ্জলির অনুবাদের ভূমিকায় লিখেছিলেন আঁদ্রে জিদ। ‘মানুষ ঈশ্বরের চেতনার প্রতীক’, রবীন্দ্রনাথের এই ধ্যানমগ্ন উচ্চারণের ভেতর দিয়ে যে কবিতার জন্ম হয়, জিদ তাকে বলেছিলেন ‘পারফেক্ট পোয়েট্রি’।
কোরীয় ভাষায়ও রবীন্দ্রনাথের একটি ক্ষুদ্র কবিতা পড়ে শোনালেন দক্ষিণ কোরিয়ার চিত্র পরিচালক সুনমিন পার্ক। রবীন্দ্রনাথ কখনো কোরিয়া যাননি, যদিও আমন্ত্রিত হয়েছিলেন অনেকবার। কোরিয়াকে এশিয়ার বাতিঘর বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তাঁর সেই আশাবাদ এখনো কোরীয়বাসীকে অনুপ্রাণিত করে, সুনমিন আমাদের জানালেন।
চীনা, ইংরেজি ও বাংলায়ও রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে পাঠ হলো। ঠিক সেদিন, অর্থাৎ ৩০ এপ্রিল ১৯১৯ সাল, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ‘নাইটহুড’ প্রত্যাখ্যান করে ইংরেজি বড় লাটকে যে চিঠিটি লেখেন, সেই চিঠি থেকেও পড়ে শোনানো হলো। বিখ্যাত ভারতীয়-মার্কিন কবি মীনা আলেকজান্ডার শোনালেন শৈশবে কেরালায় ডাকঘর নাটকে অমলের চরিত্রে অভিনয়ের কথা।
অনুষ্ঠানের শেষে রেজওয়ানা গেয়ে শোনালেন পর পর পাঁচটি গান। সেই সঙ্গে প্রতিটি গানের মর্মবাণীও শিক্ষকের নিষ্ঠায় আমাদের বুঝিয়ে বললেন। গীতাঞ্জলির অধিকাংশ গান পূজা পর্যায়ের তা ঠিক, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যে ঈশ্বরের কথা বলেছেন, তা আমাদের পরিচিত, বইয়ে পাওয়া ঈশ্বর নয়। রেজওয়ানা জানালেন, এ এমন এক ব্যক্তিগত ঈশ্বর, কবি যাঁকে বন্ধু, প্রেমিক ও প্রভু হিসেবে আহ্বান করেন। পশ্চিমের পাঠক-শ্রোতার কাছে ঈশ্বরের সে ধারণা অপরিচিত, কিন্তু উপনিষদের চৈতন্যে আলোকিত রবীন্দ্রনাথের কাছে সেটাই ছিল অধিক সত্য।
যে মঞ্চে রেজওয়ানা গান গাইলেন, তা ঠিক কোনো কনসার্ট হলো না। সংগীত ব্যবস্থাপনার সব আবশ্যকীয় শর্তই এখানে অনুপস্থিত। এখানে বিশ্ব সংস্থার নিয়মিত বৈঠক বসে, যুদ্ধ-শান্তি নিয়ে নানা প্রশ্নে তর্ক-বিতর্ক হয়। কিন্তু গানের আসর এই বোধ হয় প্রথম। এমনকি মাইক্রোফোনটি পর্যন্ত গানের উপযোগী নয়। এখানে সবাই যাঁর যাঁর ইয়ার ফোন কানে রেখে বিতর্ক শোনেন। সব অব্যবস্থা ও সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়ে গান গাইলেন রেজওয়ানা। কোনো বিরক্তি নেই, কোনো উষ্মা নেই। রবীন্দ্রনাথের গানে সঠিক পরিবেশনার জন্য শুধু গায়কি নয়, ব্যক্তিত্বও যে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, সেদিন যাঁরা বিশ্বসভার এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা প্রত্যেকে সে কথা উপলব্ধি করেছিলেন। রেজওয়ানার গান আমরা এর আগে অনেকবার শুনেছি। প্রতিবারই তাঁকে নতুন করে আবিষ্কার করেছি। প্রতিবারই মনে হয়েছে এই শিল্পী এখন আরও পরিণত, আরও সমৃদ্ধ। এ যেন রবীন্দ্রনাথকেই বারবার নতুন করে আবিষ্কার।
প্রতিবার সেই আবিষ্কারে নতুন আনন্দ, নতুন বিস্ময়।
৭ জুন, ২০১৩, নিউইয়র্ক
অনুষ্ঠানের শুরু হলো রেজওয়ানা চৌধুরীর গলায় রবীন্দ্রনাথের চিরচেনা একটি গান দিয়ে: ‘আমারে তুমি অশেষ করেছ’। পেছনে বড় পর্দায় সেই গানের ইংরেজি তরজমা। নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরের কোনো মূল সম্মেলনকক্ষে এর আগে রবীন্দ্রনাথের গান কবে, কোথায় গীত হয়েছিল, আমার জানা নেই। অভ্যাগতদের অধিকাংশই বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি, তাঁদের মধ্যে কেউ বা রাষ্ট্রদূত, কেউ বা বিশ্ব সংস্থার কর্মী। এক মুহূর্ত আগেও যে সম্মেলনকক্ষ নানা ভাষার মানুষের কলকোলাহলে মুখরিত ছিল, অনায়াসে তা রূপান্তরিত হলো এক ধ্যানমগ্ন সমর্পণে।
মূল মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আবদুল মোমেন ও ভারতের রাষ্ট্রদূত অশোক কুমার মুখার্জি। ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ের জন্যই রবীন্দ্রনাথ সমানভাবে বন্দিত। তাঁর লেখা গান উভয় দেশের জাতীয় সংগীত হিসেবেই গীত হয়ে থাকে। দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের অন্য আরেক প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীতেও রয়েছে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব। সে দেশের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা আনন্দ সামারাকুন তিরিশের দশকের শেষ পর্যায়ে শান্তিনিকেতনে ছাত্র হিসেবে বেশ কয়েক বছর কাটান ও কবিগুরুর নিকট সংস্পর্শে আসেন। তাঁর রচিত ‘শ্রীলঙ্কা মাতা’ কবিতাটি সে দেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে গৃহীত হওয়ার পর তিনি নিজেই এ গানে কবিগুরুর প্রভাবের কথা স্বীকার করেন। কবিগুরুর ভাব ও বাণী কীভাবে উপমহাদেশের দেশগুলোকে নিকটতর করেছে, রাষ্ট্রদূত মোমেন সে কথা জানালেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে কবিগুরুর বাণী বাঙালিকে কীভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল, সে কথাও সবিস্তারে জানালেন তিনি।
জাতিসংঘের এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারিয়া ক্রিস্টিনা পারসেভাল। তিনি একসময় ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন, রবীন্দ্রনাথের কবিতা সাগ্রহে পড়েছেন। তিনি স্মরণ করলেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর দেশের বিদুষী লেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের কথা। পড়ে শোনালেন চিলির বিখ্যাত কবি পাবলো নেরুদার অনুবাদে রবীন্দ্রনাথের গান ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা’। রাষ্ট্রদূত সম্ভবত জানতেন না, এই গানটি নেরুদা একসময় নিজের লেখা কবিতা বলে তাঁর একটি জনপ্রিয় কাব্য সংকলনের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। পরে সমালোচনার মুখে পড়ে স্বীকার করতে বাধ্য হন, কবিতাটি তিনি লিখেছেন রবীন্দ্রনাথের কবিতার ছায়া অবলম্বনে।
ফরাসি ভাষায় রবীন্দ্র কবিতার আবৃত্তি করলেন ফরাসি দূতাবাসের প্রতিনিধি গিয়ম দাবুওয়া। তাঁর নির্বাচিত কবিতাটি ছিল বিখ্যাত ফরাসি কথাসাহিত্যিক ও কবি আঁদ্রে জিদের অনুবাদে, গীতাঞ্জলির ৫৯ নম্বর কবিতা। আইরিশ কবি ইয়েটসের মতো আঁদ্রে জিদও গীতাঞ্জলির অতীন্দ্রিয় ভাবময়তায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর কাছেও রবীন্দ্রকাব্যের মূল বিষয় প্রেম নয়, ভক্তির প্রকাশ। জিদ অবশ্য এ কথাও বুঝেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর-চেতনার কেন্দ্রে রয়েছে মানুষ। ‘মানুষের ভেতর দিয়েই ঈশ্বর নিজেও তাঁর অস্তিত্ব বিষয়ে অবহিত হন’, গীতাঞ্জলির অনুবাদের ভূমিকায় লিখেছিলেন আঁদ্রে জিদ। ‘মানুষ ঈশ্বরের চেতনার প্রতীক’, রবীন্দ্রনাথের এই ধ্যানমগ্ন উচ্চারণের ভেতর দিয়ে যে কবিতার জন্ম হয়, জিদ তাকে বলেছিলেন ‘পারফেক্ট পোয়েট্রি’।
কোরীয় ভাষায়ও রবীন্দ্রনাথের একটি ক্ষুদ্র কবিতা পড়ে শোনালেন দক্ষিণ কোরিয়ার চিত্র পরিচালক সুনমিন পার্ক। রবীন্দ্রনাথ কখনো কোরিয়া যাননি, যদিও আমন্ত্রিত হয়েছিলেন অনেকবার। কোরিয়াকে এশিয়ার বাতিঘর বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তাঁর সেই আশাবাদ এখনো কোরীয়বাসীকে অনুপ্রাণিত করে, সুনমিন আমাদের জানালেন।
চীনা, ইংরেজি ও বাংলায়ও রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে পাঠ হলো। ঠিক সেদিন, অর্থাৎ ৩০ এপ্রিল ১৯১৯ সাল, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ‘নাইটহুড’ প্রত্যাখ্যান করে ইংরেজি বড় লাটকে যে চিঠিটি লেখেন, সেই চিঠি থেকেও পড়ে শোনানো হলো। বিখ্যাত ভারতীয়-মার্কিন কবি মীনা আলেকজান্ডার শোনালেন শৈশবে কেরালায় ডাকঘর নাটকে অমলের চরিত্রে অভিনয়ের কথা।
অনুষ্ঠানের শেষে রেজওয়ানা গেয়ে শোনালেন পর পর পাঁচটি গান। সেই সঙ্গে প্রতিটি গানের মর্মবাণীও শিক্ষকের নিষ্ঠায় আমাদের বুঝিয়ে বললেন। গীতাঞ্জলির অধিকাংশ গান পূজা পর্যায়ের তা ঠিক, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যে ঈশ্বরের কথা বলেছেন, তা আমাদের পরিচিত, বইয়ে পাওয়া ঈশ্বর নয়। রেজওয়ানা জানালেন, এ এমন এক ব্যক্তিগত ঈশ্বর, কবি যাঁকে বন্ধু, প্রেমিক ও প্রভু হিসেবে আহ্বান করেন। পশ্চিমের পাঠক-শ্রোতার কাছে ঈশ্বরের সে ধারণা অপরিচিত, কিন্তু উপনিষদের চৈতন্যে আলোকিত রবীন্দ্রনাথের কাছে সেটাই ছিল অধিক সত্য।
যে মঞ্চে রেজওয়ানা গান গাইলেন, তা ঠিক কোনো কনসার্ট হলো না। সংগীত ব্যবস্থাপনার সব আবশ্যকীয় শর্তই এখানে অনুপস্থিত। এখানে বিশ্ব সংস্থার নিয়মিত বৈঠক বসে, যুদ্ধ-শান্তি নিয়ে নানা প্রশ্নে তর্ক-বিতর্ক হয়। কিন্তু গানের আসর এই বোধ হয় প্রথম। এমনকি মাইক্রোফোনটি পর্যন্ত গানের উপযোগী নয়। এখানে সবাই যাঁর যাঁর ইয়ার ফোন কানে রেখে বিতর্ক শোনেন। সব অব্যবস্থা ও সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়ে গান গাইলেন রেজওয়ানা। কোনো বিরক্তি নেই, কোনো উষ্মা নেই। রবীন্দ্রনাথের গানে সঠিক পরিবেশনার জন্য শুধু গায়কি নয়, ব্যক্তিত্বও যে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, সেদিন যাঁরা বিশ্বসভার এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা প্রত্যেকে সে কথা উপলব্ধি করেছিলেন। রেজওয়ানার গান আমরা এর আগে অনেকবার শুনেছি। প্রতিবারই তাঁকে নতুন করে আবিষ্কার করেছি। প্রতিবারই মনে হয়েছে এই শিল্পী এখন আরও পরিণত, আরও সমৃদ্ধ। এ যেন রবীন্দ্রনাথকেই বারবার নতুন করে আবিষ্কার।
প্রতিবার সেই আবিষ্কারে নতুন আনন্দ, নতুন বিস্ময়।
৭ জুন, ২০১৩, নিউইয়র্ক
No comments