রাজনৈতিক সংস্কৃতি সংসদ সদস্যের দায়মুক্তির পরিসর কতটা ব্যাপক? by আলী ইমাম মজুমদার
জানা গেল, হঠাৎ করে সংসদ টিভি চ্যানেলের
দর্শক বেড়ে গেছে। অনেকটা অপাঙেক্তয় একটি টিভি চ্যানেলের এ জনপ্রিয়তাকে আমরা
কীভাবে দেখব? হতে পারে বিরোধী দলের লাগাতার বর্জন সংসদকে নিষ্প্রাণ করে
ফেলেছিল।
সে অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই সংসদ টিভি চ্যানেল
দেখার আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছিল প্রায় সবাই। তবে এবারের বাজেট অধিবেশনের সূচনা
থেকেই তাদের উপস্থিতি সংসদকে প্রাণবন্ত করেছে। তাই এ চ্যানেল দেখার
আকর্ষণও বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক। তবে এ বৃদ্ধির পেছনে কতিপয় সংসদ সদস্যের
বক্তব্যে কিছু নিষিদ্ধ ভাষা ব্যবহারের একটি ভূমিকাও রয়েছে বলে কেউ কেউ মনে
করেন।
এটা সবারই জানা, বর্তমান অধিবেশনে উভয় দলের কয়েকজন সাংসদ প্রতিপক্ষের প্রতি অশালীন ও অশোভন ভাষায় সুযোগ পেলেই বক্তব্য দিচ্ছেন। ব্যক্তিগত আক্রমণ করছেন কদর্য ভাষায় আর এটা যেন অনেকটা প্রতিযোগিতা করেই। নিষিদ্ধ বাক্য শ্রবণের স্পৃহাও কারও কারও মাঝে আছে। তাই এ চ্যানেলের দর্শকসংখ্যা বাড়াকে অস্বাভাবিক বলা যাবে না। এসব কথা যে নিষিদ্ধ তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। কেননা স্পিকার এগুলোকে সংসদের কার্যবিবরণী থেকে এক্সপাঞ্জ করছেন। ক্ষণে ক্ষণে এসব বক্তার মাইক বন্ধ করে তাঁদের সতর্কও করা হচ্ছে। কিন্তু সংসদ কার্যপ্রণালি বিধিমালার ১৫ নং বিধি অনুসরণে তাঁদের সেদিনের মতো তাৎক্ষণিক সংসদ থেকে বহিষ্কার করছেন না। নিচ্ছেন না অন্য কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও। অথচ উভয় পক্ষের এ ধরনের ভাষা ব্যবহারকারী কয়েকজনের বিরুদ্ধে সহজেই তিনি ব্যবস্থা নিতে পারেন। তাঁকেও তুইতোকারি করছেন কেউ কেউ। হয়তো বা তিনি সহজাত সংযমবোধ এবং বিরোধী দলের সংসদ বর্জনের আশঙ্কায় এমনটা করছেন না। তবে কার্যপ্রণালি বিধিমালা তাঁকে যে ক্ষমতা দিয়েছে, তার সময়োপযোগী প্রয়োগ না করায় এ পরিস্থিতির ক্রম অবনতি হচ্ছে। সে বিধিমালায় নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য কোনো সাংসদকে বহিষ্কারের ক্ষমতাও সংসদকে দেওয়া আছে। সংসদও এ ধরনের বিষয়ে সুবিবেচনাক্রমে পক্ষপাতহীন সিদ্ধান্ত নিলে গণতন্ত্র সমৃদ্ধ হতো। এক্সপাঞ্জ করা কথাগুলোও কিন্তু বলা হয়ে যায়। হয় প্রচারিতও। এ কদর্য রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসার পথ খুঁজতে হবে সব দলকেই। তবে বেদনাদায়কভাবে দেখা যায়, এসব ভাষা ব্যবহারকারীদের তাঁর দলের সাংসদেরা টেবিল চাপড়ে উৎসাহ জোগান। তাহলে পরিত্রাণ কোথায়। এটা ভেবে বিস্মিত হতে হয়। সংসদে এ ধরনের ভাষা ব্যবহার করেও কার্যত তাঁরা দায় মুক্তি পাচ্ছেন। কিন্তু তা কি পাওয়ার কথা? এমনটা কিন্তু কম-বেশি আগের সংসদগুলোতেও ঘটেছে।
আমাদের সংবিধানে সংসদ সদস্যদের কতিপয় ক্ষেত্রে দায়মুক্তি দেওয়া আছে। তবে তা অতি সীমিত। শুধু সংসদ বা তাঁর কোনো কমিটির সভায় বক্তব্য নিয়ে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। তবে সে বক্তব্য হতে হবে সংসদের কার্যপ্রণালির বিধি অনুসরণে। সংসদে বক্তব্য পেশ ছাড়া এর বাইরের কার্যক্রম নিয়ে সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি সংসদ সদস্যদের গ্রেপ্তার-সংক্রান্ত বিষয়ে কিছু বিশেষ নির্দেশনা আছে। এ ছাড়া ভিন্ন কোনো ধরনের দায়মুক্তি নেই তাঁদের জন্য। আইনের বিচারে আগে আলোচিত অতি সীমিত ক্ষেত্র ব্যতীত একই কাতারে অবস্থান করছেন তাঁরা জনগণের মাঝে। কিন্তু আমরা সংসদের বাইরে কী দেখছি?
কয়েক মাস আগের খবরের কাগজ থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি। ‘আমিও এমপি—তুইও এমপি, আমার এলাকায় এসে তোর কাজ কী?’ পাঠকের অনুমান করতে কষ্ট হবে না এ বক্তব্যটি একজন এমপির। অবশ্যই সরকারি দলের, আর বক্তব্য যাঁর উদ্দেশে করা হয়েছে তিনিও সরকারি দলের একজন কেন্দ্রীয় নেতা। প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় একটি দায়িত্বে রয়েছেন। দলীয় নির্দেশেই দলের সাংগঠনিক কাজে প্রথমোক্ত এমপি নির্বাচনী এলাকায় গেলে একপর্যায়ে এভাবে লাঞ্ছিত হন। অবশ্য দলের নেতারা এটা ভুল বোঝাবুঝি বলে এড়িয়ে গেছেন। তবে অনেকের জানা যে এ সংসদ সদস্যের কাছে গত কয়েক বছরে লাঞ্ছিত হয়েছেন সড়ক ও জনপথ বিভাগের একজন নির্বাহী প্রকৌশলী, নির্বাচনে দায়িত্ব পালনরত একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবং আরও কতিপয় সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষক, মুক্তিযোদ্ধা, আইনজীবীসহ কমপক্ষে দেড় ডজন ব্যক্তি। প্রায় প্রতিটি ঘটনাই ধর্তব্য অপরাধ ও দণ্ডবিধির আওতায় আসে। একটি তো নির্বাচন-সংক্রান্ত আইনের আওতাতেই শাস্তিযোগ্য। কিন্তু কিছুই হয়নি।
অবশ্যই এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তবে এ ধরনের বিচ্ছিন্ন ঘটনার সংখ্যা প্রকাশ্যেই তো অনেক। কিছুদিন আগে সচিবালয়ের মতো সংরক্ষিত এলাকায় একজন মন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মচারীদের একজন এমপি প্রাণনাশের হুমকি দেন। ঘটনাটি ভুল বোঝাবুঝি বলে ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। তিনি তাঁর নির্বাচনী এলাকায় ক্ষুব্ধ জনগণকে পিস্তল দিয়ে তাড়া করার প্রতিবেদনটিও অনেকের নজরে এড়ায়নি। কোনো ক্ষেত্রেই দণ্ডবিধি কিংবা অস্ত্র আইন নিজ গতিতে চলেনি। আর দেশের উত্তরাঞ্চলে ভ্রাম্যমাণ আদালত কর্তৃক দণ্ডিত জনৈক আসামিকে আদালত চলাকালে স্থানীয় এমপির মদদে কিছু উচ্ছৃঙ্খল জনতা ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এটা দণ্ডনীয় অপরাধ। আর যার হুকুমে এ ঘটনাটি ঘটল আর যারা ঘটাল, তাদের বিরুদ্ধে কিন্তু দণ্ডবিধি সচল হয়নি।
বিচ্ছিন্ন বটে। তবে এরূপ ঘটনা হামেশাই ঘটে চলেছে দেশের যত্রতত্র। প্রায় ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা চেপে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ মনে করে। আর চেপে না গিয়েই বা ফল কী হয়েছে? পাবনার একজন জেলা প্রশাসক তাঁর কার্যালয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগের সময় স্থানীয় এমপির ধরিয়ে দেওয়া তালিকা মেনে নিতে অস্বীকার করে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের জন্য পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। লন্ডভন্ড করে দেওয়া হয় সে পরীক্ষাকেন্দ্রগুলো। লাঞ্ছিত হন পদস্থ সরকারি কর্মকর্তারা। দুটো মামলা হয় বটে। তবে সে মামলা শুনানিকালে সাক্ষ্যপ্রমাণ জুটল না। সে ক্ষেত্রে আদালতের আসামিদের খালাস দেওয়া ছাড়া কিছু করারও ছিল না। অনেকটা প্রকাশ্যেই যে সংসদ সদস্য এ ঘটনার মদদ জুগিয়েছেন, তিনি রইলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। এরূপ সব ক্ষেত্রেই দায়মুক্তি পান, যখন যাঁরা সরকারি দলে থাকেন সে দলের সাংসদ।
এ কথাটা বারবার বলাও অবান্তর হবে না যে আমাদের স্বাধীনতার চেতনার উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল—দেশটি জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হবে। আর গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মূল শক্তি রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল। হতাশ দু-চারজন ভিন্ন কিছু ভাবলেও বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এ চেতনা থেকে আজও বিচ্যুত হয়নি। হতাশা ও ক্ষোভ থেকে প্রশ্ন জাগে, কীভাবে আমরা এরূপ একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করলাম? কেউ কেউ হয়তো বলবেন, এরূপ বিচ্ছিন্ন দু-একটি ঘটনা দিয়ে সবাইকে বিচার করা যাবে না। কিন্তু এগুলোকে শুধু বিচ্ছিন্ন ঘটনা বললে আমরা হয়তো দেশটির প্রতি অবিচার করব। কিছু সম্মানজনক ব্যতিক্রম ছাড়া সরকারপরম্পরা অনেক ক্ষেত্রে এরূপই ঘটে চলেছে। অথচ আমাদের অতীতটা এমন ছিল না। ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইন প্রবর্তনের পর থেকেই তো আমরা সীমিত পর্যায়ে গণতন্ত্রের স্বাদ উপভোগ করে আসছিলাম। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখনকার তুলনায় সূচনাতেই অনেক উন্নত ছিল। বরং হওয়ার কথা ছিল উল্টো।
কেউ কেউ বলেন, রাজনীতি থেকে রাজনীতিকেরা ক্রমান্বয়ে নির্বাসিত হয়ে যাচ্ছেন। জাতীয় সংসদ সদস্যদের পরিচিতি ও পেশাগত পরিসংখ্যান তাই বলে। তার জন্য কাকে দায়ী করা হবে? অনেককেই দায়ী করা যায়। তবে রাজনীতিবিদেরা নিজেরা এ জন্য কম দায়ী নন। নির্বাচনের সময় রাজনীতির সঙ্গে তেমন কোনো জোরালো সম্পর্কবিহীন অরাজনৈতিক বিত্তশালী ব্যক্তিদের মনোনয়ন পেতে তো তাঁরাই সহযোগিতা করেন। এসব বিষয় নিয়ে অনেক কথা আড়ালে-আবডালে হয়। সব খুলে বলার আবশ্যকতা থাকে না। তবে দেশটিকে বিরাজনীতিকীকরণের জন্য রাজনীতিবিদদের দায় কিছুমাত্র কম নয়।
আমাদের প্রত্যাশার সঙ্গে রাজনীতিকদের আচরণ ও কার্যকলাপ সুস্পষ্ট বিপরীতমুখী। আমরা যখন স্বল্পোন্নত দেশ থেকে একটি মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে উন্নীত হতে সক্রিয়, তখন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি দৈন্যের দ্বারপ্রান্তে। এর পরিণতি কী হতে পারে ভেবে অনেকেই পীড়িত হন। এ ধরনের বিষয়ে আজ থেকে দেড় দশক আগে স্বনামখ্যাত অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় অনেক নিবন্ধ লিখেছেন। সেগুলো থেকে বাছাই করে কিছু নিবন্ধের একটি সংকলনের নাম যেভাবে এখন চলছে বাংলাদেশ। সে সংকলনের ভূমিকা লেখেন তিনি ২০০০ সালের ১ জানুয়ারি। ভূমিকার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে তিনি লিখেছেন, ‘একটি বিষয়ে পরিষ্কার হয়ে উঠেছে যে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিদ্যমান ইনস্টিটিউশন বা প্রতিষ্ঠান এবং রাজনীতিবিদদের ওপর মানুষের আস্থা টলে যাচ্ছে। দেশের ভবিষ্যতের জন্য যা শুভ নয়। অন্যদিকে, নতুন শতকে সারা বিশ্বে প্রধান এজেন্ডা হয়ে দাঁড়াবে অর্থনৈতিক বিকল্প, নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ। বর্তমান প্রজন্ম তাতেই আগ্রহী। কিন্তু বাংলাদেশের পরিস্থিতি যদি এ রকম থাকে, তা হলে সেখানে অর্থনৈতিক এজেন্ডা প্রাধান্য পাবে না। এবং তা যদি না পায়, তাহলে ক্রমেই রাজনৈতিক নেতারা সমাজের ভার হয়ে উঠবেন। হয়ে উঠবেন অপাঙেক্তয়, যা হবে দেশের জন্য চরম দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। কারণ, আমরা তো দেশে একটি সিভিল সমাজ গড়তে চাই। আর রাজনীতিবিদেরা তো প্রতিনিধিত্ব করবেন সিভিল সমাজেরই।’
তাঁর বক্তব্যে ভিন্নমত পোষণের কোনো সুযোগ নেই। তবে এরপর নতুন শতকের প্রায় ১৩ বছর পাড়ি দিলাম। পরিস্থিতির কি কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে? বিবেচনার দায়িত্ব পাঠকের ওপর রইল।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com
এটা সবারই জানা, বর্তমান অধিবেশনে উভয় দলের কয়েকজন সাংসদ প্রতিপক্ষের প্রতি অশালীন ও অশোভন ভাষায় সুযোগ পেলেই বক্তব্য দিচ্ছেন। ব্যক্তিগত আক্রমণ করছেন কদর্য ভাষায় আর এটা যেন অনেকটা প্রতিযোগিতা করেই। নিষিদ্ধ বাক্য শ্রবণের স্পৃহাও কারও কারও মাঝে আছে। তাই এ চ্যানেলের দর্শকসংখ্যা বাড়াকে অস্বাভাবিক বলা যাবে না। এসব কথা যে নিষিদ্ধ তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। কেননা স্পিকার এগুলোকে সংসদের কার্যবিবরণী থেকে এক্সপাঞ্জ করছেন। ক্ষণে ক্ষণে এসব বক্তার মাইক বন্ধ করে তাঁদের সতর্কও করা হচ্ছে। কিন্তু সংসদ কার্যপ্রণালি বিধিমালার ১৫ নং বিধি অনুসরণে তাঁদের সেদিনের মতো তাৎক্ষণিক সংসদ থেকে বহিষ্কার করছেন না। নিচ্ছেন না অন্য কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও। অথচ উভয় পক্ষের এ ধরনের ভাষা ব্যবহারকারী কয়েকজনের বিরুদ্ধে সহজেই তিনি ব্যবস্থা নিতে পারেন। তাঁকেও তুইতোকারি করছেন কেউ কেউ। হয়তো বা তিনি সহজাত সংযমবোধ এবং বিরোধী দলের সংসদ বর্জনের আশঙ্কায় এমনটা করছেন না। তবে কার্যপ্রণালি বিধিমালা তাঁকে যে ক্ষমতা দিয়েছে, তার সময়োপযোগী প্রয়োগ না করায় এ পরিস্থিতির ক্রম অবনতি হচ্ছে। সে বিধিমালায় নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য কোনো সাংসদকে বহিষ্কারের ক্ষমতাও সংসদকে দেওয়া আছে। সংসদও এ ধরনের বিষয়ে সুবিবেচনাক্রমে পক্ষপাতহীন সিদ্ধান্ত নিলে গণতন্ত্র সমৃদ্ধ হতো। এক্সপাঞ্জ করা কথাগুলোও কিন্তু বলা হয়ে যায়। হয় প্রচারিতও। এ কদর্য রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসার পথ খুঁজতে হবে সব দলকেই। তবে বেদনাদায়কভাবে দেখা যায়, এসব ভাষা ব্যবহারকারীদের তাঁর দলের সাংসদেরা টেবিল চাপড়ে উৎসাহ জোগান। তাহলে পরিত্রাণ কোথায়। এটা ভেবে বিস্মিত হতে হয়। সংসদে এ ধরনের ভাষা ব্যবহার করেও কার্যত তাঁরা দায় মুক্তি পাচ্ছেন। কিন্তু তা কি পাওয়ার কথা? এমনটা কিন্তু কম-বেশি আগের সংসদগুলোতেও ঘটেছে।
আমাদের সংবিধানে সংসদ সদস্যদের কতিপয় ক্ষেত্রে দায়মুক্তি দেওয়া আছে। তবে তা অতি সীমিত। শুধু সংসদ বা তাঁর কোনো কমিটির সভায় বক্তব্য নিয়ে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। তবে সে বক্তব্য হতে হবে সংসদের কার্যপ্রণালির বিধি অনুসরণে। সংসদে বক্তব্য পেশ ছাড়া এর বাইরের কার্যক্রম নিয়ে সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি সংসদ সদস্যদের গ্রেপ্তার-সংক্রান্ত বিষয়ে কিছু বিশেষ নির্দেশনা আছে। এ ছাড়া ভিন্ন কোনো ধরনের দায়মুক্তি নেই তাঁদের জন্য। আইনের বিচারে আগে আলোচিত অতি সীমিত ক্ষেত্র ব্যতীত একই কাতারে অবস্থান করছেন তাঁরা জনগণের মাঝে। কিন্তু আমরা সংসদের বাইরে কী দেখছি?
কয়েক মাস আগের খবরের কাগজ থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি। ‘আমিও এমপি—তুইও এমপি, আমার এলাকায় এসে তোর কাজ কী?’ পাঠকের অনুমান করতে কষ্ট হবে না এ বক্তব্যটি একজন এমপির। অবশ্যই সরকারি দলের, আর বক্তব্য যাঁর উদ্দেশে করা হয়েছে তিনিও সরকারি দলের একজন কেন্দ্রীয় নেতা। প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় একটি দায়িত্বে রয়েছেন। দলীয় নির্দেশেই দলের সাংগঠনিক কাজে প্রথমোক্ত এমপি নির্বাচনী এলাকায় গেলে একপর্যায়ে এভাবে লাঞ্ছিত হন। অবশ্য দলের নেতারা এটা ভুল বোঝাবুঝি বলে এড়িয়ে গেছেন। তবে অনেকের জানা যে এ সংসদ সদস্যের কাছে গত কয়েক বছরে লাঞ্ছিত হয়েছেন সড়ক ও জনপথ বিভাগের একজন নির্বাহী প্রকৌশলী, নির্বাচনে দায়িত্ব পালনরত একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবং আরও কতিপয় সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষক, মুক্তিযোদ্ধা, আইনজীবীসহ কমপক্ষে দেড় ডজন ব্যক্তি। প্রায় প্রতিটি ঘটনাই ধর্তব্য অপরাধ ও দণ্ডবিধির আওতায় আসে। একটি তো নির্বাচন-সংক্রান্ত আইনের আওতাতেই শাস্তিযোগ্য। কিন্তু কিছুই হয়নি।
অবশ্যই এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তবে এ ধরনের বিচ্ছিন্ন ঘটনার সংখ্যা প্রকাশ্যেই তো অনেক। কিছুদিন আগে সচিবালয়ের মতো সংরক্ষিত এলাকায় একজন মন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মচারীদের একজন এমপি প্রাণনাশের হুমকি দেন। ঘটনাটি ভুল বোঝাবুঝি বলে ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। তিনি তাঁর নির্বাচনী এলাকায় ক্ষুব্ধ জনগণকে পিস্তল দিয়ে তাড়া করার প্রতিবেদনটিও অনেকের নজরে এড়ায়নি। কোনো ক্ষেত্রেই দণ্ডবিধি কিংবা অস্ত্র আইন নিজ গতিতে চলেনি। আর দেশের উত্তরাঞ্চলে ভ্রাম্যমাণ আদালত কর্তৃক দণ্ডিত জনৈক আসামিকে আদালত চলাকালে স্থানীয় এমপির মদদে কিছু উচ্ছৃঙ্খল জনতা ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এটা দণ্ডনীয় অপরাধ। আর যার হুকুমে এ ঘটনাটি ঘটল আর যারা ঘটাল, তাদের বিরুদ্ধে কিন্তু দণ্ডবিধি সচল হয়নি।
বিচ্ছিন্ন বটে। তবে এরূপ ঘটনা হামেশাই ঘটে চলেছে দেশের যত্রতত্র। প্রায় ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা চেপে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ মনে করে। আর চেপে না গিয়েই বা ফল কী হয়েছে? পাবনার একজন জেলা প্রশাসক তাঁর কার্যালয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগের সময় স্থানীয় এমপির ধরিয়ে দেওয়া তালিকা মেনে নিতে অস্বীকার করে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের জন্য পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। লন্ডভন্ড করে দেওয়া হয় সে পরীক্ষাকেন্দ্রগুলো। লাঞ্ছিত হন পদস্থ সরকারি কর্মকর্তারা। দুটো মামলা হয় বটে। তবে সে মামলা শুনানিকালে সাক্ষ্যপ্রমাণ জুটল না। সে ক্ষেত্রে আদালতের আসামিদের খালাস দেওয়া ছাড়া কিছু করারও ছিল না। অনেকটা প্রকাশ্যেই যে সংসদ সদস্য এ ঘটনার মদদ জুগিয়েছেন, তিনি রইলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। এরূপ সব ক্ষেত্রেই দায়মুক্তি পান, যখন যাঁরা সরকারি দলে থাকেন সে দলের সাংসদ।
এ কথাটা বারবার বলাও অবান্তর হবে না যে আমাদের স্বাধীনতার চেতনার উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল—দেশটি জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হবে। আর গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মূল শক্তি রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল। হতাশ দু-চারজন ভিন্ন কিছু ভাবলেও বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এ চেতনা থেকে আজও বিচ্যুত হয়নি। হতাশা ও ক্ষোভ থেকে প্রশ্ন জাগে, কীভাবে আমরা এরূপ একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করলাম? কেউ কেউ হয়তো বলবেন, এরূপ বিচ্ছিন্ন দু-একটি ঘটনা দিয়ে সবাইকে বিচার করা যাবে না। কিন্তু এগুলোকে শুধু বিচ্ছিন্ন ঘটনা বললে আমরা হয়তো দেশটির প্রতি অবিচার করব। কিছু সম্মানজনক ব্যতিক্রম ছাড়া সরকারপরম্পরা অনেক ক্ষেত্রে এরূপই ঘটে চলেছে। অথচ আমাদের অতীতটা এমন ছিল না। ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইন প্রবর্তনের পর থেকেই তো আমরা সীমিত পর্যায়ে গণতন্ত্রের স্বাদ উপভোগ করে আসছিলাম। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখনকার তুলনায় সূচনাতেই অনেক উন্নত ছিল। বরং হওয়ার কথা ছিল উল্টো।
কেউ কেউ বলেন, রাজনীতি থেকে রাজনীতিকেরা ক্রমান্বয়ে নির্বাসিত হয়ে যাচ্ছেন। জাতীয় সংসদ সদস্যদের পরিচিতি ও পেশাগত পরিসংখ্যান তাই বলে। তার জন্য কাকে দায়ী করা হবে? অনেককেই দায়ী করা যায়। তবে রাজনীতিবিদেরা নিজেরা এ জন্য কম দায়ী নন। নির্বাচনের সময় রাজনীতির সঙ্গে তেমন কোনো জোরালো সম্পর্কবিহীন অরাজনৈতিক বিত্তশালী ব্যক্তিদের মনোনয়ন পেতে তো তাঁরাই সহযোগিতা করেন। এসব বিষয় নিয়ে অনেক কথা আড়ালে-আবডালে হয়। সব খুলে বলার আবশ্যকতা থাকে না। তবে দেশটিকে বিরাজনীতিকীকরণের জন্য রাজনীতিবিদদের দায় কিছুমাত্র কম নয়।
আমাদের প্রত্যাশার সঙ্গে রাজনীতিকদের আচরণ ও কার্যকলাপ সুস্পষ্ট বিপরীতমুখী। আমরা যখন স্বল্পোন্নত দেশ থেকে একটি মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে উন্নীত হতে সক্রিয়, তখন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি দৈন্যের দ্বারপ্রান্তে। এর পরিণতি কী হতে পারে ভেবে অনেকেই পীড়িত হন। এ ধরনের বিষয়ে আজ থেকে দেড় দশক আগে স্বনামখ্যাত অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় অনেক নিবন্ধ লিখেছেন। সেগুলো থেকে বাছাই করে কিছু নিবন্ধের একটি সংকলনের নাম যেভাবে এখন চলছে বাংলাদেশ। সে সংকলনের ভূমিকা লেখেন তিনি ২০০০ সালের ১ জানুয়ারি। ভূমিকার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে তিনি লিখেছেন, ‘একটি বিষয়ে পরিষ্কার হয়ে উঠেছে যে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিদ্যমান ইনস্টিটিউশন বা প্রতিষ্ঠান এবং রাজনীতিবিদদের ওপর মানুষের আস্থা টলে যাচ্ছে। দেশের ভবিষ্যতের জন্য যা শুভ নয়। অন্যদিকে, নতুন শতকে সারা বিশ্বে প্রধান এজেন্ডা হয়ে দাঁড়াবে অর্থনৈতিক বিকল্প, নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ। বর্তমান প্রজন্ম তাতেই আগ্রহী। কিন্তু বাংলাদেশের পরিস্থিতি যদি এ রকম থাকে, তা হলে সেখানে অর্থনৈতিক এজেন্ডা প্রাধান্য পাবে না। এবং তা যদি না পায়, তাহলে ক্রমেই রাজনৈতিক নেতারা সমাজের ভার হয়ে উঠবেন। হয়ে উঠবেন অপাঙেক্তয়, যা হবে দেশের জন্য চরম দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। কারণ, আমরা তো দেশে একটি সিভিল সমাজ গড়তে চাই। আর রাজনীতিবিদেরা তো প্রতিনিধিত্ব করবেন সিভিল সমাজেরই।’
তাঁর বক্তব্যে ভিন্নমত পোষণের কোনো সুযোগ নেই। তবে এরপর নতুন শতকের প্রায় ১৩ বছর পাড়ি দিলাম। পরিস্থিতির কি কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে? বিবেচনার দায়িত্ব পাঠকের ওপর রইল।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com
No comments