যা ভাবছে হেফাজত by আহমেদ জামাল ও মহিউদ্দিন জুয়েল
৫ই মের ক্র্যাকডাউনের পর থেকেই নীরব
আলোচিত সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। ওই ঘটনার পর থেকে বক্তব্য-বিবৃতি ছাড়া কোন
কর্মসূচি দেয়নি সংগঠনটি। ৬ই এপ্রিল ঢাকায় লংমার্চ পরবর্তী সমাবেশে ব্যাপক
সমাগমের পর আলোচনায় আসে এই সংগঠনটি।
ওই সমাবেশ থেকেই
অবরোধের ডাক দেয়া হয়েছিল। অবরোধ পরবর্তী অবস্থানে যৌথ বাহিনীর অভিযান
আলোচিত হয় দেশ-বিদেশে। সূত্র দাবি করেছে, এ পর্যন্ত সংগঠনটির নেতারা
পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। একই সঙ্গে সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে
আসা চাপও সামাল দিচ্ছেন। নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা, গ্রেপ্তার
ও রিমান্ডের কারণে অনেকটা বিপর্যস্ত অবস্থায় আছে সংগঠনটি। তবে এ অবস্থা
থেকে উত্তরণের জন্য ভেতরে ভেতরে গোছানোর চেষ্টা করছেন নেতারা। ইতিমধ্যে
সারা দেশের নেতাদের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে মতবিনিময় করছেন সংগঠনের আমীর
আল্লামা শাহ আহমদ শফী। হেফাজতে ইসলামের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, আপাতত ধীরে
চলার কারণ হলো কওমি ধারায় পরিচালিত দেশের ৪০ হাজার মাদরাসার বার্ষিক
পরীক্ষা। সঙ্গে ৫ই মে’র ঘটনার ধকল কাটানোর চেষ্টাও চলছে।
সূত্র জানায়, প্রচলিত রাজনীতির বাইরে চলতে অভ্যস্ত এ সংগঠনের তৃণমূল নেতাকর্মীরা শাপলা অপারেশনের আকস্মিকতায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। ঘরে-বাইরে মারাত্মক প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয় তারা। সার্বিক পরিস্থিতির উত্তরণ এবং পর্যবেক্ষণের জন্য সংগঠনের শীর্ষ নেতা আল্লামা শাহ আহমদ শফী আপাতত নীরব থাকার কৌশল নিয়ে এগোচ্ছেন। ধৈর্য ধরতে বলেছেন অনুসারীদের। দেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার বিপরীত নিয়মে পরিচালিত হয় ৪০ হাজার কওমি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রতি বছর আরবি সনের শাওয়াল মাস থেকে তাদের পরীক্ষা শুরু হয়। চলে এক মাসের বেশি সময় ধরে। হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা জানান, ৬ই মে ঢাকা থেকে ফেরার পর আল্লামা শফী নেতা-কর্মীদের পরীক্ষার কারণে আন্দোলনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এই নিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন। দেখা করেছেন একাধিক ইসলামিক সংগঠনের নেতারা। তাদের মধ্যে ছিলেন খেলাফত আন্দোলন, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফতে মজলিস, জমিয়ত নেতা শাহীনূর পাশা চৌধুরীসহ ৫-৭টি সংগঠনের নেতারা। আল্লামা শফী তাদের উদ্দেশে বলেন, ‘যেহেতু বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর পরীক্ষা, তাই এখন কোন কর্মসূচিতে না যাওয়াই ভাল। মাসখানেক পর তাদের পরীক্ষা শেষ হলে আবার নতুন কৌশল ঠিক করা যাবে। এরই মধ্যে আমরা সরকারের গতিবিধিও পর্যবেক্ষণ করতে পারবো।’ হাটহাজারী মাদরাসা সূত্র জানায়, প্রতিবছর কওমি শিক্ষাবোর্ডের অধীনে দুই থেকে তিন লাখ ছাত্র পরীক্ষায় অংশ নেয়। আগামী ১১ই জুন থেকে এবারের পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদরাসা ছাড়াও ফটিকছড়ি, পটিয়া, সাতকানিয়া, ফেনী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, ঢাকার লালবাগ, সিলেটসহ ৩৩টি জায়গায় রয়েছে কওমি ধারার ৪০ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তাই নেতা-কর্মীদের পরীক্ষার কারণে এই মুহূর্তে আন্দোলন থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে হেফাজত। আল্লামা শফী মনোযোগ দিয়ে ছাত্রদের পড়ালেখা করার পরামর্শ দিয়েছেন। এ জন্য বিশেষ মোনাজাতেরও আয়োজন করেছেন তিনি। হেফাজতে ইসলামের একাধিক সিনিয়র নেতাদের কাছে ডেকে বলেছেন, ‘ওদের যেন পড়াশোনায় কোন ধরনের ক্ষতি না হয় সেদিকে নজর রেখো। সব ধরনের পুলিশি হয়রানি থেকে রক্ষা করতে হবে ছাত্রদের। কারণ ওরাই আমাদের সংগঠনের প্রাণ।’
এদিকে তল্লাশি, নজরদারি ও গ্রেপ্তার আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন কওমি মাদরাসার বহু ছাত্র-শিক্ষক। ৫ই মে ঢাকা অবরোধ ও অবস্থান কর্মসূচির আগে ও পরে সৃষ্ট ঘটনায় ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, নারায়ণগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও বাগেরহাটে ৪৫টি মামলা হয়। এসব মামলায় হেফাজত, বিএনপি ও জামায়াতের পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ ছাড়াও দেড় লাখ লোককে অজ্ঞাত আসামি করা হয়। যাদের বেশির ভাগই কওমি মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক। কওমি মাদরাসার পরিচালনা কমিটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, হেফাজতের আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে কওমি মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের প্রতিনিয়ত হয়রানি করা হচ্ছে। এতে খানিকটা উদ্বিগ্ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ। রোববার কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা কমিটির এক বৈঠকে এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে অবিলম্বে হয়রানি বন্ধের দাবি জানানো হয়েছে। এ নিয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট শামসুল হক টুকুর সঙ্গে দু’দফা বৈঠক করেছেন কওমি শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা। কোন হয়রানি করা হবে না মর্মে তিনি কওমি শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তাদের আশ্বাস দিলেও এর দৃশ্যমান কোন আলামত দেখা যাচ্ছে না। প্রায় প্রতিদিনই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কোন না কোন মাদরাসায় হানা দিচ্ছে। এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট শামসুল হক টুকু সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, যারা পরীক্ষার্থী তারা পরীক্ষা দিতে পারবে। অনর্থক কাউকে হয়রানি করা হচ্ছে না। যাদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে, তাদের গ্রেপ্তারের জন্যই সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে মাদরাসাগুলোতে অভিযান চালাচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। তবে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ শাপলা অপারেশনের পর মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরীসহ হেফাজতের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরা সবাই কওমী মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক। এদের মধ্যে আছেন খুলনা থেকে গ্রেপ্তার শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকের ছেলে মাওলানা মামুনুল হক। আছেন লালবাগ শাহী মসজিদের খতিব ও মিরপুরের জামেয়া আরাবিয়া খাদেমুল ইসলাম মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা ইমরান মাজহারী, মিরপুর জামিয়া উলুম মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আবুল বাশার ও কাফরুল থানা হেফাজতের আহ্বায়ক মাওলানা মিজানুর রহমান। এছাড়া, সারা দেশে শতাধিক ছাত্র-শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে হেফাজত নেতারা দাবি করেন। ওদিকে বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড মহাসচিব মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল জব্বারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় পরীক্ষা বাস্তবায়ন কমিটির বৈঠকে বলা হয়, হামলা, মামলা ও গ্রেপ্তার আতঙ্কের কারণে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাই তটস্থ। এমন অবস্থা থাকলে ১১ই জুন থেকে কেন্দ্রীয় পরীক্ষা নেয়া কঠিন হয়ে পড়বে। বৈঠকে বলা হয়, হেফাজতের আন্দোলন ছিল ঈমানি ও অহিংস। কওমি মাদরাসার কোন ছাত্র-শিক্ষক কখনই কোরআন পোড়াতে পারে না। তারা কোরআন পড়ে, পড়ায় এবং কোরআনের আলো প্রচার করে মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখায়। তাদের বিরুদ্ধে কোরআন পোড়ানোর অপবাদ পাগলেও বিশ্বাস করবে না। কওমি মাদরাসা ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি ডা. এসএম আবদুল আজিজ বলেন, হেফাজতের আন্দোলন সম্পূর্ণ অহিংস। পরিকল্পিতভাবে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালিয়ে দুষ্কৃতকারীরা তার দায়ভার কওমি মাদরাসার নিরীহ ছাত্র-শিক্ষকদের ওপর চাপিয়ে হয়রানির পথ বেছে নেয়া হয়েছে। হেফাজতের ঢাকা মহানগর কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ও খেলাফত আন্দোলনের সহকারী মহাসচিব মাওলানা মজিবুর রহমান হামিদী বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ভিডিও ফুটেজ দেখে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে উল্টোটা। এতেই প্রমাণিত হয়, হেফাজতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো ছিল ষড়যন্ত্রমূলক। ৫ই মে মতিঝিলে যখন হেফাজতের সমাবেশ হয়, তখন আশপাশের সব এলাকা ছিল নিরাপদ। সেখানে কোন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ হয়নি। যেখানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ হয়েছে সেখানে হেফাজতের কোন নেতাকর্মী ও সমর্থক ছিল না। অথচ গণহারে হেফাজতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার কারণে কওমি মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এদেশে কওমি শিক্ষাকে বাধাগ্রস্ত করতেই এটা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, যারা ইসলাম ও কোরআনের হেফাজতে জীবন দিতে পারে, তারা কখনই নৈরাজ্যকর কোন কাজে জড়িত হতে পারে না। অপরদিকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দায়ের করা মামলাগুলোতে দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরীসহ হেফাজতের পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ করে এ পর্যন্ত ৪৫টি মামলা দায়ের করা হয়। এসব মামলায় অজ্ঞাত আসামি করা হয় আরও দেড় লক্ষাধিক ব্যক্তিকে। এদের মধ্যে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের নামও রয়েছে। পুলিশ জানায়, রাজধানীর পল্টন, মতিঝিল, শ্যামপুর, যাত্রাবাড়ী ও শাহবাগ থানায় ২১টি মামলায় হেফাজত, বিএনপি ও জামায়াতের তিন শতাধিক নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ করে লক্ষাধিক অজ্ঞাত আসামি করা হয়। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ১০টি ও সোনারগাঁয়ে ছয়টি মামলায় হেফাজত, বিএনপি ও জামায়াতের শতাধিক ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে ১০ হাজার অজ্ঞাত আসামি করা হয়। হাটহাজারী থানার মামলায় ৫৩ জনের নাম উল্লেখ করে পাঁচ হাজার স্থানীয় বাসিন্দাকে আসামি করা হয়। বাগেরহাটের ফকিরহাট থানায় ৮৬ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ১২ হাজার গ্রামবাসীকে আসামি করা হয়। অগ্নিসংযোগ, সরকারি-বেসরকারি সম্পদ নষ্ট, হত্যা, লুটপাট ও পুলিশের ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয় এসব মামলায়। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় কিশোরগঞ্জে একটি মামলা হয় হেফাজতের বিরুদ্ধে। এসব মামলার গতিপ্রকৃতি দেখেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে এমন তথ্য জানান সংশ্লিষ্টরা।
সূত্র জানায়, প্রচলিত রাজনীতির বাইরে চলতে অভ্যস্ত এ সংগঠনের তৃণমূল নেতাকর্মীরা শাপলা অপারেশনের আকস্মিকতায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। ঘরে-বাইরে মারাত্মক প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয় তারা। সার্বিক পরিস্থিতির উত্তরণ এবং পর্যবেক্ষণের জন্য সংগঠনের শীর্ষ নেতা আল্লামা শাহ আহমদ শফী আপাতত নীরব থাকার কৌশল নিয়ে এগোচ্ছেন। ধৈর্য ধরতে বলেছেন অনুসারীদের। দেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার বিপরীত নিয়মে পরিচালিত হয় ৪০ হাজার কওমি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রতি বছর আরবি সনের শাওয়াল মাস থেকে তাদের পরীক্ষা শুরু হয়। চলে এক মাসের বেশি সময় ধরে। হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা জানান, ৬ই মে ঢাকা থেকে ফেরার পর আল্লামা শফী নেতা-কর্মীদের পরীক্ষার কারণে আন্দোলনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এই নিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন। দেখা করেছেন একাধিক ইসলামিক সংগঠনের নেতারা। তাদের মধ্যে ছিলেন খেলাফত আন্দোলন, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফতে মজলিস, জমিয়ত নেতা শাহীনূর পাশা চৌধুরীসহ ৫-৭টি সংগঠনের নেতারা। আল্লামা শফী তাদের উদ্দেশে বলেন, ‘যেহেতু বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর পরীক্ষা, তাই এখন কোন কর্মসূচিতে না যাওয়াই ভাল। মাসখানেক পর তাদের পরীক্ষা শেষ হলে আবার নতুন কৌশল ঠিক করা যাবে। এরই মধ্যে আমরা সরকারের গতিবিধিও পর্যবেক্ষণ করতে পারবো।’ হাটহাজারী মাদরাসা সূত্র জানায়, প্রতিবছর কওমি শিক্ষাবোর্ডের অধীনে দুই থেকে তিন লাখ ছাত্র পরীক্ষায় অংশ নেয়। আগামী ১১ই জুন থেকে এবারের পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদরাসা ছাড়াও ফটিকছড়ি, পটিয়া, সাতকানিয়া, ফেনী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, ঢাকার লালবাগ, সিলেটসহ ৩৩টি জায়গায় রয়েছে কওমি ধারার ৪০ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তাই নেতা-কর্মীদের পরীক্ষার কারণে এই মুহূর্তে আন্দোলন থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে হেফাজত। আল্লামা শফী মনোযোগ দিয়ে ছাত্রদের পড়ালেখা করার পরামর্শ দিয়েছেন। এ জন্য বিশেষ মোনাজাতেরও আয়োজন করেছেন তিনি। হেফাজতে ইসলামের একাধিক সিনিয়র নেতাদের কাছে ডেকে বলেছেন, ‘ওদের যেন পড়াশোনায় কোন ধরনের ক্ষতি না হয় সেদিকে নজর রেখো। সব ধরনের পুলিশি হয়রানি থেকে রক্ষা করতে হবে ছাত্রদের। কারণ ওরাই আমাদের সংগঠনের প্রাণ।’
এদিকে তল্লাশি, নজরদারি ও গ্রেপ্তার আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন কওমি মাদরাসার বহু ছাত্র-শিক্ষক। ৫ই মে ঢাকা অবরোধ ও অবস্থান কর্মসূচির আগে ও পরে সৃষ্ট ঘটনায় ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, নারায়ণগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও বাগেরহাটে ৪৫টি মামলা হয়। এসব মামলায় হেফাজত, বিএনপি ও জামায়াতের পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ ছাড়াও দেড় লাখ লোককে অজ্ঞাত আসামি করা হয়। যাদের বেশির ভাগই কওমি মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক। কওমি মাদরাসার পরিচালনা কমিটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, হেফাজতের আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে কওমি মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের প্রতিনিয়ত হয়রানি করা হচ্ছে। এতে খানিকটা উদ্বিগ্ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ। রোববার কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা কমিটির এক বৈঠকে এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে অবিলম্বে হয়রানি বন্ধের দাবি জানানো হয়েছে। এ নিয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট শামসুল হক টুকুর সঙ্গে দু’দফা বৈঠক করেছেন কওমি শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা। কোন হয়রানি করা হবে না মর্মে তিনি কওমি শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তাদের আশ্বাস দিলেও এর দৃশ্যমান কোন আলামত দেখা যাচ্ছে না। প্রায় প্রতিদিনই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কোন না কোন মাদরাসায় হানা দিচ্ছে। এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট শামসুল হক টুকু সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, যারা পরীক্ষার্থী তারা পরীক্ষা দিতে পারবে। অনর্থক কাউকে হয়রানি করা হচ্ছে না। যাদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে, তাদের গ্রেপ্তারের জন্যই সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে মাদরাসাগুলোতে অভিযান চালাচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। তবে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ শাপলা অপারেশনের পর মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরীসহ হেফাজতের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরা সবাই কওমী মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক। এদের মধ্যে আছেন খুলনা থেকে গ্রেপ্তার শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকের ছেলে মাওলানা মামুনুল হক। আছেন লালবাগ শাহী মসজিদের খতিব ও মিরপুরের জামেয়া আরাবিয়া খাদেমুল ইসলাম মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা ইমরান মাজহারী, মিরপুর জামিয়া উলুম মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আবুল বাশার ও কাফরুল থানা হেফাজতের আহ্বায়ক মাওলানা মিজানুর রহমান। এছাড়া, সারা দেশে শতাধিক ছাত্র-শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে হেফাজত নেতারা দাবি করেন। ওদিকে বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড মহাসচিব মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল জব্বারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় পরীক্ষা বাস্তবায়ন কমিটির বৈঠকে বলা হয়, হামলা, মামলা ও গ্রেপ্তার আতঙ্কের কারণে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাই তটস্থ। এমন অবস্থা থাকলে ১১ই জুন থেকে কেন্দ্রীয় পরীক্ষা নেয়া কঠিন হয়ে পড়বে। বৈঠকে বলা হয়, হেফাজতের আন্দোলন ছিল ঈমানি ও অহিংস। কওমি মাদরাসার কোন ছাত্র-শিক্ষক কখনই কোরআন পোড়াতে পারে না। তারা কোরআন পড়ে, পড়ায় এবং কোরআনের আলো প্রচার করে মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখায়। তাদের বিরুদ্ধে কোরআন পোড়ানোর অপবাদ পাগলেও বিশ্বাস করবে না। কওমি মাদরাসা ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি ডা. এসএম আবদুল আজিজ বলেন, হেফাজতের আন্দোলন সম্পূর্ণ অহিংস। পরিকল্পিতভাবে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালিয়ে দুষ্কৃতকারীরা তার দায়ভার কওমি মাদরাসার নিরীহ ছাত্র-শিক্ষকদের ওপর চাপিয়ে হয়রানির পথ বেছে নেয়া হয়েছে। হেফাজতের ঢাকা মহানগর কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ও খেলাফত আন্দোলনের সহকারী মহাসচিব মাওলানা মজিবুর রহমান হামিদী বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ভিডিও ফুটেজ দেখে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে উল্টোটা। এতেই প্রমাণিত হয়, হেফাজতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো ছিল ষড়যন্ত্রমূলক। ৫ই মে মতিঝিলে যখন হেফাজতের সমাবেশ হয়, তখন আশপাশের সব এলাকা ছিল নিরাপদ। সেখানে কোন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ হয়নি। যেখানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ হয়েছে সেখানে হেফাজতের কোন নেতাকর্মী ও সমর্থক ছিল না। অথচ গণহারে হেফাজতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার কারণে কওমি মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এদেশে কওমি শিক্ষাকে বাধাগ্রস্ত করতেই এটা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, যারা ইসলাম ও কোরআনের হেফাজতে জীবন দিতে পারে, তারা কখনই নৈরাজ্যকর কোন কাজে জড়িত হতে পারে না। অপরদিকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দায়ের করা মামলাগুলোতে দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরীসহ হেফাজতের পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ করে এ পর্যন্ত ৪৫টি মামলা দায়ের করা হয়। এসব মামলায় অজ্ঞাত আসামি করা হয় আরও দেড় লক্ষাধিক ব্যক্তিকে। এদের মধ্যে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের নামও রয়েছে। পুলিশ জানায়, রাজধানীর পল্টন, মতিঝিল, শ্যামপুর, যাত্রাবাড়ী ও শাহবাগ থানায় ২১টি মামলায় হেফাজত, বিএনপি ও জামায়াতের তিন শতাধিক নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ করে লক্ষাধিক অজ্ঞাত আসামি করা হয়। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ১০টি ও সোনারগাঁয়ে ছয়টি মামলায় হেফাজত, বিএনপি ও জামায়াতের শতাধিক ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে ১০ হাজার অজ্ঞাত আসামি করা হয়। হাটহাজারী থানার মামলায় ৫৩ জনের নাম উল্লেখ করে পাঁচ হাজার স্থানীয় বাসিন্দাকে আসামি করা হয়। বাগেরহাটের ফকিরহাট থানায় ৮৬ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ১২ হাজার গ্রামবাসীকে আসামি করা হয়। অগ্নিসংযোগ, সরকারি-বেসরকারি সম্পদ নষ্ট, হত্যা, লুটপাট ও পুলিশের ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয় এসব মামলায়। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় কিশোরগঞ্জে একটি মামলা হয় হেফাজতের বিরুদ্ধে। এসব মামলার গতিপ্রকৃতি দেখেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে এমন তথ্য জানান সংশ্লিষ্টরা।
No comments