বাংলাদেশ-সৌদি আরব: অভিবাসী শ্রমিক ইস্যুতে প্রতিশোধ?
বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরব শ্রমিক নেয়া
পুরোদমে শুরু করবে কিনা গত মাস থেকে তা নিয়ে বিবেচনা করছে। কিন্তু কেউ মনে
করেন না বাস্তবে তা ফের ঘটবে। মঙ্গলবার রাতে অনলাইন ইকোনমিস্টে প্রকাশিত
‘বাংলাদেশ এন্ড সৌদি এরাবিয়া; রিভেঞ্জ অব দ্য মাইগ্রান্টস এমপ্লোয়ার?’
শীর্ষক
রিপোর্টে এসব কথা বলেছে। এতে বলা হয়, ভারতের এদিক থেকে বা ওদিক থেকে যেখান
থেকেই সৌদি আরব শ্রমিক নিক না কেন তাতে শ্রমিকদের কোন আগ্রহ নেই। বিশ্ব
পেট্রোকেমিক্যাল বা কোন রকম শিল্পের দিকে এগিয়ে যাওয়ার অনেক আগেই ভারতীয়
উপমহাদেশের মানুষ কাজের সন্ধানে পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে যেতে শুরু করে।
১৭১৬ সালে এক বৃটিশ সফরকারী দেখতে পান যে, উপসাগরীয় অঞ্চলে যেসব ভারতীয়
বসবাস করছেন তাদের মধ্যে রয়েছে নরসুন্দর, পাখাওয়ালা, দোকানী, চিকিৎসক ও
কাস্টমস এজেন্ট। এখন আর পাখাওয়ালাদের অস্তিত্ব নাও থাকতে পারে। এটাও একটি
পেশা। অন্যভাবে বলা যায়, এই পেশাগুলো এখন অনেকটাই পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে।
উপসাগরীয় অঞ্চলে যেসব বিদেশী শ্রমিক রয়েছেন তার মধ্যে বেশির ভাগই সৌদি
আরবে। সৌদি আরবে প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ নাগরিকের বাস। সেখানে রয়েছেন প্রায় ৯০
লাখ নিবন্ধিত বিদেশী শ্রমিক। কমপক্ষে কয়েক লাখ রয়েছেন অবৈধ অভিবাসী। কেউ
সঠিক করে বলতে পারেন না দক্ষিণ এশিয়ার শ্রমিক রপ্তানির সবচেয়ে বড় দুটি দেশ
থেকে কি পরিমাণ মানুষ আছেন সৌদি আরবে। ভারত দাবি করে সৌদি আরবে তাদের ১৫
লাখ নাগরিক রয়েছে। পাকিস্তানের দাবি প্রায় একই রকম সংখ্যা। অন্যদিকে সৌদি
আরবে বাংলাদেশে ২৫ লাখ মানুষ কাজ করছেন বলে বাংলাদেশের দাবির কথা শোনা যায়।
পরের দু’টি দেশ হলো সৌদি আরবের সবচেয়ে বড় শ্রম বাজার। যুক্তরাষ্ট্র ও
সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে সৌদি আরবের চেয়ে শ্রমিকদের মাধ্যমে ভারত সবচেয়ে
বেশি অর্থ আয় করে। গত অর্থবছরে সৌদি আরব থেকে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ প্রায়
একই সমান রেমিটেন্স আয় করেছে। এর পরিমাণ ৩৭০ কোটি ডলার। অর্থনৈতিক দাতাদের
দেয়া সহায়তার চেয়ে এ অর্থ অনেক বেশি। সৌদি আরবের শ্রমিকরা মোট যে রেমিটেন্স
আয় করেন তা জাতীয় আয়ের শতকরা ২৯ ভাগ ও ২৮ ভাগ যথাক্রমে বাংলাদেশ ও
পাকিস্তানের ক্ষেত্রে। কিন্তু এই সমতা বদলে গেছে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানি
শ্রমিক নেয়ার ক্ষেত্রে যে জোয়ার-ভাটা চলছিল তা নিয়ন্ত্রিত হয়ে এখন স্থির
হয়ে গেছে। এর ফলে বাংলাদেশ যখন হারাচ্ছে তখন পাকিস্তান অর্জন করছে। ২০০৯
সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য ভাল সময় ছিল। এ সময়ে সৌদি আরবে যত খুশি তত
শ্রমিক পাঠাতে পারতো। তাদের সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের ডেস মোইনস, আইওয়ায়
বসবাসকারী মানুষের সমান। যে বছরটা খারাপ গেছে সে সময়ে মধ্যযুগীয় বেলজিয়ামের
রাজধানী ব্রাগস-এ যত লোক বাস করত তার সমান শ্রমিক গিয়েছেন সৌদি আরবে। তারা
গিয়েছেন চাকরির সন্ধানে এবং দেশে রেমিটেন্স পাঠানোর তাগিদে। সে অবস্থা আর
নেই। ২০০৯ সাল থেকে সৌদি আরবে বাংলাদেশ গড়ে ১৪৫০০ শ্রমিক পাঠাচ্ছে। এ
সংখ্যা গ্রিনল্যান্ডের রাজধানী নিউক-এ বসবাসরত মানুষের সমান। ওই সংখ্যা এখন
ডেস মোইনসে বসবাসরত মানুষের সংখ্যা থেকে কমতে কমতে নিউক-এর মানুষের সমান
এসে দাঁড়িয়েছে। এতে বছরে রেমিটেন্স আসবে ২০ কোটি ডলার। পক্ষান্তরে
পাকিস্তানের দ্রুত উন্নতি ঘটেছে এক্ষেত্রে। ২০১১ সালে সৌদি আরবে নতুন কাজ
পেয়েছেন ২ লাখ ২০ হাজারের বেশি পাকিস্তানি। দৃশ্যত সৌদি আরবের কাছে শ্রম
বাজার হিসেবে বাংলাদেশের জনপ্রিয়তা কমে গেছে। গত মাসেও বাংলাদেশ থেকে
পুরোদমে শ্রমিক নেয়া শুরু করবে কিনা তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়টি
বিবেচনা করছিল সৌদি আরব। কিন্তু কেউই মনে করেন না বাস্তবে তা ঘটবে।
জামায়াতে ইসলামী সৌদি আরবের মতাদর্শী। এ দলের নেতাদের অবিলম্বে ফাঁসি
সমর্থন করে না সৌদি আরব তা নীরবতার মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছে। ১৯৭৫ সালে
বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কেবল হত্যার
পরেই তারা বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তৎকালীন পূর্ব
পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীন করে বাংলাদেশ সৃষ্টির
জন্য দেশবাসী ভীষণ শ্রদ্ধা করেন শেখ মুজিবুর রহমানকে। তার মৃত্যুর মধ্য
দিয়ে বাংলাদেশ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের দিকে ফেরার পথ তৈরি হয়। ১৯৭২
সালের সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
রহমানের কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফিরিয়ে এনেছেন
ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান। এর অধীনে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির কোন স্থান নেই। গত ৭ই
মার্চ ঢাকায় বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে প্রেস ব্রিফিংকালে বাংলাদেশের
পররাষ্ট্রমন্ত্রী জামায়াতে ইসলামীকে, যে দলকে সৌদি আরব তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র
মনে করে, সন্ত্রাসী সংগঠন বলে আখ্যায়িত করেন। এ বিষয়টি সৌদি আরবের দৃষ্টি
এড়িয়ে যাবে না। একই দিনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের সঙ্গে এ
বিষয়ে কথা বলেন। ইতিমধ্যে শেখ হাসিনার সরকার বিবেচনা করছেন জামায়াতে
ইসলামীর সঙ্গে পুরোপুরি দূরত্ব বজায় রাখবেন নাকি তাদেরকে নিষিদ্ধ করবেন।
আরেকটি ফাঁসির ঘটনা পুরনো এই আরব সাগরীয় অঞ্চলে অভিবাসীদের পথ নির্ধারণ
করবে। ২০১১ সালে সৌদি আরব প্রকাশ্যে ৮ বাংলাদেশীরে শিরñেদ করে। তাদের
বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা ডাকাতির সঙ্গে যুক্ত। ওই ডাকাতির সময় এক মিশরীয়
নিরাপত্তা রক্ষী নিহত হয়েছিলেন। মনে কিছু করার কারণ নেই যে, ২০১২ সালে
ঢাকায় একটি দ্রুত বিচার আদালত ঢাকায় নিযুক্ত সৌদি আরবের এক কূটনীতিককে
হত্যার দায়ে ৫ বাংলাদেশীকে মৃত্যুদণ্ড দেন। চোখে চোখ রাখার নীতিতে
বাংলাদেশে ফাঁসির দেয়ার ঘটনা অনেকটা কম হবে। ব্যাপকভাবে যা প্রত্যাশা করা
হয় তা হলো চলমান যুদ্ধাপরাদের বিচারে জামায়াতের পুরো নেতৃত্বকে দোষী
সাব্যস্ত করা হয়েছে। এ বছরেই তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হতে পারে। সৌদি আরবের
সঙ্গে তাদের যে সম্পর্ক বাংলাদেশকে তার শ্রমিকদের জন্য বিকল্প ভেন্যু
খুঁজতে হবে। এ সময়ে পাকিস্তানের রেমিটেন্স যদি ফুলেফেঁপে ওঠে তা তাদের জন্য
সুখকর হবে। তাতে সৌদি আরবের অবদান উল্লেখ করার মতো।
No comments