গণতন্ত্র নির্বাসিত by হায়দার আকবর খান রনো
এ বছর মার্চ মাসে যখন আমাদের দেশসহ গোটা পৃথিবীতে নারী দিবসের শতবর্ষ পালিত হয়েছে, তখন আমাদের দেশে নারী নির্যাতনের মাত্রাটা মোটেও কম ছিল না। নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে এ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রী যারা হয়ে আসছেন, তারা নারী। আমাদের দেশের দু’জন সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া।
তারা পালাক্রমে প্রধানমন্ত্রী অথবা বিরোধীদলীয় নেত্রী হয়ে আসছেন। কিন্তু এর দ্বারা সমাজে নারীর অবস্থান নির্ণয় করা যাবে না। এই সময়কালে যৌতুকের কারণে হত্যা, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ এবং দোররা মারার ঘটনাও আছে অনেক। একদিকে প্রধানমন্ত্রী নারী আর অন্যদিকে নারীর বিরুদ্ধে ফতোয়া এবং দোররা মারার ঘটনাও ঘটছে। নারী স্বাধীনতা কতটা রয়েছে তার দ্বারা গণতন্ত্রের মাত্রাও বিচার করা যায়।
সমাজে নারীর অধস্তন অবস্থা, নারী নির্যাতনের চিত্র সমাজের পশ্চাত্পদতার পরিচয় বহন করে। স্বৈরাচারের ভিত্তি এই সামাজিক অবস্থার মধ্যেই নিহিত রয়েছে। ধর্মীয় মৌলবাদ ও সামন্ত ধ্যান-ধারণা নারীর অধস্তন অবস্থার পক্ষে শক্তি জোগায়। তার বিরুদ্ধে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলা আবশ্যক। কিন্তু আমরা আরেক ধরনের নারী নির্যাতনের খবর পাচ্ছি, যা আমাদের আরও শঙ্কিত করে তোলে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ছাত্রীদের ওপর যৌন নিপীড়ন হয় এবং তাও আবার হয় রাজনৈতিক শক্তি বলে, তখন আমরা আতঙ্কিত না হয়ে পারি না। পাঠকের নিশ্চয়ই মনে আছে যে, নব্বইয়ের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে, তখনও শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, সেই সময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে জনৈক প্রভাবশালী সরকারদলীয় ছাত্রনেতার ধর্ষণের কাহিনী মুখে মুখে প্রচারিত হতো। এমনকি সেই ছাত্রনেতাটি তার শততম ধর্ষণ প্রকাশ্যে উদযাপন করেছিল। ভাবতেও ভয় লাগে। আবার ঘৃণায় ভরে ওঠে সারা দেহ ও মন। লজ্জায় যেন মরে যাই। আমরা এ কোন দেশে বাস করি? সেই সময় বিশেষ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হওয়া মানেই যেন ছিল লজ্জার বিষয়। এবার ইডেন কলেজের ছাত্রী নির্যাতন সম্পর্কে যেটুকু খবর প্রকাশিত হয়েছে, তাতেও আমরা সে রকমই শঙ্কিত ও লজ্জিত হয়ে উঠেছি। সরকারি ছাত্র সংগঠনের বাড়াবাড়ি ও ঔদ্ধত্য কী পর্যায়ে পৌঁছেছে। ভর্তিবাণিজ্য নিয়ে ইডেন কলেজের ছাত্রলীগের দুই অংশের ছাত্রীরা মারামারি করেছে। এতে অতটা অবাক হইনি। কিন্তু যখন জানলাম, শুধু ভর্তি ও সিট বণ্টনে আধিপত্যই নয়, আরও কিছু চরমভাবে অনৈতিক বিষয়ও সামনে এসেছে, তখন আমি কথাটা বিশ্বাস করতে পারিনি। এখনও বিশ্বাস করতে চাই না। কিন্তু যেভাবেই হোক, কথাটা বাজারে এসেছে। এর চেয়ে লজ্জার, এর চেয়ে ঘৃণার কথা আর কি হতে পারে?
নারী নির্যাতন এবং সরকারি ছাত্র সংগঠনের এমন ধরনের কাজের প্রতিক্রিয়া সমাজে পড়তে বাধ্য। সেটা আর যাই হোক শুভ নয়। এর ফলে বস্তুত গণতন্ত্রই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। হ্যাঁ, এই সমস্যার সঙ্গে গণতন্ত্রের সম্পর্ক আছে। যখন সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন সিট বা অন্য কিছুর বিনিময়ে ছাত্রীদের কোনো কিছুতে, বিশেষ করে অনৈতিক কাজে বাধ্য করে, তখন গণতন্ত্র বলে আর কিছুই থাকে না। সমাজের অধঃপতন, সাংস্কৃতিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি গণতন্ত্রেরও অবশিষ্ট কিছুই থাকে না।
নারী প্রসঙ্গ আজকের মতো এ পর্যন্তই থাক। গণতন্ত্র সম্পর্কে অনেক গালভরা বাণী আমরা শুনেছি। শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়েছি। নারী নির্যাতন যে পরিমাণে থাকবে, গণতন্ত্রও সেই পরিমাণে অনুপস্থিত থাকবে। আর ইডেন কলেজ বা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ঘটনা ঘটতে থাকলে গণতন্ত্র নিয়ে বড়াই করার জায়গা থাকে না।
গণতন্ত্রের আরও কিছু মাপকাঠি আছে। বিচার ব্যবস্থা, আইনের শাসন, বিরোধী দলের প্রতি সহিষ্ণু আচরণ, বাক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা—এসবই গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। পাঁচ বছর পর পর একবার মাত্র নির্বাচনই গণতন্ত্রের সবকিছু নয়। অথচ আমাদের দেশের শাসকদের আচরণ দেখে মনে হয়, তারা একবার নির্বাচিত হতে পারলেই পাঁচ বছরের জন্য যা খুশি করার অধিকার পেয়ে যান। এবার মহাজোটের সরকার সেটা যেন আরও বেশি করে প্রমাণ করতে আগ্রহী। মাত্র সেদিন দৃকের আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে পুলিশের বাধার ঘটনা প্রমাণ করে যে, সরকার গণতান্ত্রিক রীতিনীতিতে বিশ্বাসী নয়।
সাউথ এশিয়ান মিডিয়া একাডেমীর উদ্বোধন উপলক্ষে ধানমন্ডিস্থ দৃক গ্যালারিতে একটি ব্যতিক্রমী চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। প্রতীকধর্মী আলোকচিত্র দ্বারা ক্রসফায়ারের চিত্র তুলে ধরা হয়েছিল। এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ভারতের বিখ্যাত লেখিকা মহাশ্বেতা দেবী। কিন্তু অনুষ্ঠানটি হতে দেয়নি পুলিশ। তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে দৃকের গ্যালারিতে।
যে প্রদর্শনী হওয়ার কথা ছিল, তা ছিল আর্ট হিসেবেও উন্নত, রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য। কারণ প্রতীকী হলেও আলোকচিত্রের মাধ্যমে ক্রসফায়ারের প্রতিবাদ করাই ছিল উদ্দেশ্য। সে জন্য মহাশ্বেতা দেবীর মতো লেখিকাও এসেছিলেন এ অনুষ্ঠানে। আরও উপস্থিত ছিলেন অনেক বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। ক্রসফায়ার এখন বহুল আলোচিত বিষয়। এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছেন মানবাধিকার সংগঠন ও কর্মীরা। বস্তুত যে কোনো গণতান্ত্রিক মানুষই এর প্রতিবাদ জানাবে। ক্রসফায়ারের নামে যা করা হচ্ছে তা বস্তুত ক্রসফায়ার নয়, তা হচ্ছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। একে বলা যেতে পারে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। তারই বিরুদ্ধে প্রতিবাদের একটি ফর্ম ছিল দৃকের আলোকচিত্র প্রদর্শনী। সরকার তা সহ্য করতে পারেনি। তাই পুলিশ দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে প্রদর্শনী। এতে সরকারের গণতন্ত্রবিরোধী চরিত্রই কেবল ফুটে ওঠে না, সরকারের দুর্বলতাও প্রকাশিত হয়। আমার দেশ-এর ২৪ মার্চ সংখ্যায় সম্পাদকীয়তে তাই যথার্থভাবেই বলা হয়েছে, ‘ভয় পাওয়া মানুষ তার চারদিকেই বিপদের গন্ধ পায়। ফলে সে নিজের অজান্তেই বিপদ বাড়িয়ে তোলে। ক্ষমতা গ্রহণের ১৪ মাস হতে না হতেই আওয়ামী মহাজোট সরকার ভয় পাওয়া মানুষের মতো আচরণ শুরু করেছে। ক্রসফায়ার নিয়ে রাজধানীতে এক আলোকচিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পুলিশ পাঠিয়ে বন্ধ করে দেয়া থেকে এমনটি মনে হওয়া মোটেই অস্বাভাবিক নয়।’
ক্রসফায়ারের বিষয়টি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, এক সময় হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ পত্রিকায় ক্রসফায়ারের খবর প্রকাশিত হলে নিজ উদ্যোগে (আইনের ভাষায় যাকে বলে সুয়োমোটো) সরকারের কাছে কারণ দর্শাও নোটিশ দিয়েছিল। এই ঘটনা নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমী ঘটনা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এই যে, সরকারের ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য শুনানির আগেই ওই বেঞ্চটি ভেঙে দেয়া হয়েছিল। এতে বোঝা যায় যে, সরকার ক্রসফায়ার বন্ধ করতে আগ্রহী নয়।
ক্রসফায়ার মানে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। বর্তমানের মহাজোট সরকারের আমলে ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যা ভয়াবহরূপে বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্রসফায়ারের শব্দার্থ যাই-ই হোক না কেন, আমরা বাংলাদেশের নাগরিকরা জানি, ক্রসফায়ার মানে কি। র্যাব, পুলিশ বা যৌথবাহিনী কাউকে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করলে সেটাকেই ক্রসফায়ার বলে চালানো হয়। বিষয়টি বিদেশিদেরও নজরে পড়েছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা প্রতিবাদ করেছে। হাইকোর্ট পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করতে চেয়েছি। কিন্তু ক্রসফায়ার বন্ধ হয়নি। এছাড়াও আছে পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু। রিমান্ড মানেই হচ্ছে বন্দি অবস্থায় দৈহিক নির্যাতন। আর কখনও কখনও দৈহিক নির্যাতনের মাত্রা এতটা বেড়ে যায় যে, বন্দির মৃত্যু ঘটে। এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। এ সবই হচ্ছে বিচারবহির্ভূত হত্যা। অধিকার এবং আইন ও শালিস কেন্দ্রসহ বিভিন্ন সংস্থার রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ২০০৯ সালেই অর্থাত্ মহাজোট সরকারের প্রথম বছরেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ২২৯টি। এ সময়ে তিনজন সাংবাদিক খুন হয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন ১৭৫ জন।
বিচারবহির্ভূত হত্যা তো নিন্দনীয় বটেই, এমনকি বিচার ব্যবস্থাও যে নড়বড়ে তা অনেক বিশিষ্টজনের বক্তব্য থেকেও পাওয়া যায়। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেছেন, এখনও ওয়ান-ইলেভেনের ভূত চেপে বসে আছে। বহু ঢাকঢোল পিটিয়ে বিচার বিভাগকে প্রশাসন থেকে পৃথক করা হলেও বস্তুত জরুরি আমলে যে বিচার বিভাগকে রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে পরিচালনা করা হয়েছিল, তা কারও অজানা নয়। তার ভূত নির্বাচিত সরকারের আমলেও রয়েছে। তাই ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ব্যঙ্গাত্মক ভাষায় বলেছেন যে, ভূত তাড়ানোর জন্য মিলাদের ব্যবস্থা করতে হবে।
বিচার বিভাগে হস্তক্ষেপ, রিমান্ড ও পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন আর ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড—সব মিলিয়ে যে পরিস্থিতি তাকে আর যা-ই হোক গণতান্ত্রিক বলা যাবে না। সরকারি ছাত্র সংগঠনের অবৈধ দাপট, শিক্ষাঙ্গনে খুনাখুনি, নারী নির্যাতন, ক্রসফায়ার এবং বিচার বিভাগের নড়বড়ে অবস্থা জনগণকে বড় অসহায় করে তুলেছে। নির্বাচন সত্ত্বেও গণতন্ত্র আজ নির্বাসিত। এ অবস্থায় গণতন্ত্রকামী মানুষকে ভাবতে হবে, গণতন্ত্রের জন্য নতুন করে সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে হবে। পরিস্থিতিই আমাদের এমন জায়গায় ঠেলে নিয়ে গেছে।
সমাজে নারীর অধস্তন অবস্থা, নারী নির্যাতনের চিত্র সমাজের পশ্চাত্পদতার পরিচয় বহন করে। স্বৈরাচারের ভিত্তি এই সামাজিক অবস্থার মধ্যেই নিহিত রয়েছে। ধর্মীয় মৌলবাদ ও সামন্ত ধ্যান-ধারণা নারীর অধস্তন অবস্থার পক্ষে শক্তি জোগায়। তার বিরুদ্ধে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলা আবশ্যক। কিন্তু আমরা আরেক ধরনের নারী নির্যাতনের খবর পাচ্ছি, যা আমাদের আরও শঙ্কিত করে তোলে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ছাত্রীদের ওপর যৌন নিপীড়ন হয় এবং তাও আবার হয় রাজনৈতিক শক্তি বলে, তখন আমরা আতঙ্কিত না হয়ে পারি না। পাঠকের নিশ্চয়ই মনে আছে যে, নব্বইয়ের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে, তখনও শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, সেই সময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে জনৈক প্রভাবশালী সরকারদলীয় ছাত্রনেতার ধর্ষণের কাহিনী মুখে মুখে প্রচারিত হতো। এমনকি সেই ছাত্রনেতাটি তার শততম ধর্ষণ প্রকাশ্যে উদযাপন করেছিল। ভাবতেও ভয় লাগে। আবার ঘৃণায় ভরে ওঠে সারা দেহ ও মন। লজ্জায় যেন মরে যাই। আমরা এ কোন দেশে বাস করি? সেই সময় বিশেষ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হওয়া মানেই যেন ছিল লজ্জার বিষয়। এবার ইডেন কলেজের ছাত্রী নির্যাতন সম্পর্কে যেটুকু খবর প্রকাশিত হয়েছে, তাতেও আমরা সে রকমই শঙ্কিত ও লজ্জিত হয়ে উঠেছি। সরকারি ছাত্র সংগঠনের বাড়াবাড়ি ও ঔদ্ধত্য কী পর্যায়ে পৌঁছেছে। ভর্তিবাণিজ্য নিয়ে ইডেন কলেজের ছাত্রলীগের দুই অংশের ছাত্রীরা মারামারি করেছে। এতে অতটা অবাক হইনি। কিন্তু যখন জানলাম, শুধু ভর্তি ও সিট বণ্টনে আধিপত্যই নয়, আরও কিছু চরমভাবে অনৈতিক বিষয়ও সামনে এসেছে, তখন আমি কথাটা বিশ্বাস করতে পারিনি। এখনও বিশ্বাস করতে চাই না। কিন্তু যেভাবেই হোক, কথাটা বাজারে এসেছে। এর চেয়ে লজ্জার, এর চেয়ে ঘৃণার কথা আর কি হতে পারে?
নারী নির্যাতন এবং সরকারি ছাত্র সংগঠনের এমন ধরনের কাজের প্রতিক্রিয়া সমাজে পড়তে বাধ্য। সেটা আর যাই হোক শুভ নয়। এর ফলে বস্তুত গণতন্ত্রই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। হ্যাঁ, এই সমস্যার সঙ্গে গণতন্ত্রের সম্পর্ক আছে। যখন সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন সিট বা অন্য কিছুর বিনিময়ে ছাত্রীদের কোনো কিছুতে, বিশেষ করে অনৈতিক কাজে বাধ্য করে, তখন গণতন্ত্র বলে আর কিছুই থাকে না। সমাজের অধঃপতন, সাংস্কৃতিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি গণতন্ত্রেরও অবশিষ্ট কিছুই থাকে না।
নারী প্রসঙ্গ আজকের মতো এ পর্যন্তই থাক। গণতন্ত্র সম্পর্কে অনেক গালভরা বাণী আমরা শুনেছি। শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়েছি। নারী নির্যাতন যে পরিমাণে থাকবে, গণতন্ত্রও সেই পরিমাণে অনুপস্থিত থাকবে। আর ইডেন কলেজ বা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ঘটনা ঘটতে থাকলে গণতন্ত্র নিয়ে বড়াই করার জায়গা থাকে না।
গণতন্ত্রের আরও কিছু মাপকাঠি আছে। বিচার ব্যবস্থা, আইনের শাসন, বিরোধী দলের প্রতি সহিষ্ণু আচরণ, বাক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা—এসবই গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। পাঁচ বছর পর পর একবার মাত্র নির্বাচনই গণতন্ত্রের সবকিছু নয়। অথচ আমাদের দেশের শাসকদের আচরণ দেখে মনে হয়, তারা একবার নির্বাচিত হতে পারলেই পাঁচ বছরের জন্য যা খুশি করার অধিকার পেয়ে যান। এবার মহাজোটের সরকার সেটা যেন আরও বেশি করে প্রমাণ করতে আগ্রহী। মাত্র সেদিন দৃকের আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে পুলিশের বাধার ঘটনা প্রমাণ করে যে, সরকার গণতান্ত্রিক রীতিনীতিতে বিশ্বাসী নয়।
সাউথ এশিয়ান মিডিয়া একাডেমীর উদ্বোধন উপলক্ষে ধানমন্ডিস্থ দৃক গ্যালারিতে একটি ব্যতিক্রমী চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। প্রতীকধর্মী আলোকচিত্র দ্বারা ক্রসফায়ারের চিত্র তুলে ধরা হয়েছিল। এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ভারতের বিখ্যাত লেখিকা মহাশ্বেতা দেবী। কিন্তু অনুষ্ঠানটি হতে দেয়নি পুলিশ। তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে দৃকের গ্যালারিতে।
যে প্রদর্শনী হওয়ার কথা ছিল, তা ছিল আর্ট হিসেবেও উন্নত, রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য। কারণ প্রতীকী হলেও আলোকচিত্রের মাধ্যমে ক্রসফায়ারের প্রতিবাদ করাই ছিল উদ্দেশ্য। সে জন্য মহাশ্বেতা দেবীর মতো লেখিকাও এসেছিলেন এ অনুষ্ঠানে। আরও উপস্থিত ছিলেন অনেক বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। ক্রসফায়ার এখন বহুল আলোচিত বিষয়। এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছেন মানবাধিকার সংগঠন ও কর্মীরা। বস্তুত যে কোনো গণতান্ত্রিক মানুষই এর প্রতিবাদ জানাবে। ক্রসফায়ারের নামে যা করা হচ্ছে তা বস্তুত ক্রসফায়ার নয়, তা হচ্ছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। একে বলা যেতে পারে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। তারই বিরুদ্ধে প্রতিবাদের একটি ফর্ম ছিল দৃকের আলোকচিত্র প্রদর্শনী। সরকার তা সহ্য করতে পারেনি। তাই পুলিশ দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে প্রদর্শনী। এতে সরকারের গণতন্ত্রবিরোধী চরিত্রই কেবল ফুটে ওঠে না, সরকারের দুর্বলতাও প্রকাশিত হয়। আমার দেশ-এর ২৪ মার্চ সংখ্যায় সম্পাদকীয়তে তাই যথার্থভাবেই বলা হয়েছে, ‘ভয় পাওয়া মানুষ তার চারদিকেই বিপদের গন্ধ পায়। ফলে সে নিজের অজান্তেই বিপদ বাড়িয়ে তোলে। ক্ষমতা গ্রহণের ১৪ মাস হতে না হতেই আওয়ামী মহাজোট সরকার ভয় পাওয়া মানুষের মতো আচরণ শুরু করেছে। ক্রসফায়ার নিয়ে রাজধানীতে এক আলোকচিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পুলিশ পাঠিয়ে বন্ধ করে দেয়া থেকে এমনটি মনে হওয়া মোটেই অস্বাভাবিক নয়।’
ক্রসফায়ারের বিষয়টি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, এক সময় হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ পত্রিকায় ক্রসফায়ারের খবর প্রকাশিত হলে নিজ উদ্যোগে (আইনের ভাষায় যাকে বলে সুয়োমোটো) সরকারের কাছে কারণ দর্শাও নোটিশ দিয়েছিল। এই ঘটনা নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমী ঘটনা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এই যে, সরকারের ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য শুনানির আগেই ওই বেঞ্চটি ভেঙে দেয়া হয়েছিল। এতে বোঝা যায় যে, সরকার ক্রসফায়ার বন্ধ করতে আগ্রহী নয়।
ক্রসফায়ার মানে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। বর্তমানের মহাজোট সরকারের আমলে ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যা ভয়াবহরূপে বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্রসফায়ারের শব্দার্থ যাই-ই হোক না কেন, আমরা বাংলাদেশের নাগরিকরা জানি, ক্রসফায়ার মানে কি। র্যাব, পুলিশ বা যৌথবাহিনী কাউকে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করলে সেটাকেই ক্রসফায়ার বলে চালানো হয়। বিষয়টি বিদেশিদেরও নজরে পড়েছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা প্রতিবাদ করেছে। হাইকোর্ট পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করতে চেয়েছি। কিন্তু ক্রসফায়ার বন্ধ হয়নি। এছাড়াও আছে পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু। রিমান্ড মানেই হচ্ছে বন্দি অবস্থায় দৈহিক নির্যাতন। আর কখনও কখনও দৈহিক নির্যাতনের মাত্রা এতটা বেড়ে যায় যে, বন্দির মৃত্যু ঘটে। এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। এ সবই হচ্ছে বিচারবহির্ভূত হত্যা। অধিকার এবং আইন ও শালিস কেন্দ্রসহ বিভিন্ন সংস্থার রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ২০০৯ সালেই অর্থাত্ মহাজোট সরকারের প্রথম বছরেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ২২৯টি। এ সময়ে তিনজন সাংবাদিক খুন হয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন ১৭৫ জন।
বিচারবহির্ভূত হত্যা তো নিন্দনীয় বটেই, এমনকি বিচার ব্যবস্থাও যে নড়বড়ে তা অনেক বিশিষ্টজনের বক্তব্য থেকেও পাওয়া যায়। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেছেন, এখনও ওয়ান-ইলেভেনের ভূত চেপে বসে আছে। বহু ঢাকঢোল পিটিয়ে বিচার বিভাগকে প্রশাসন থেকে পৃথক করা হলেও বস্তুত জরুরি আমলে যে বিচার বিভাগকে রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে পরিচালনা করা হয়েছিল, তা কারও অজানা নয়। তার ভূত নির্বাচিত সরকারের আমলেও রয়েছে। তাই ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ব্যঙ্গাত্মক ভাষায় বলেছেন যে, ভূত তাড়ানোর জন্য মিলাদের ব্যবস্থা করতে হবে।
বিচার বিভাগে হস্তক্ষেপ, রিমান্ড ও পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন আর ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড—সব মিলিয়ে যে পরিস্থিতি তাকে আর যা-ই হোক গণতান্ত্রিক বলা যাবে না। সরকারি ছাত্র সংগঠনের অবৈধ দাপট, শিক্ষাঙ্গনে খুনাখুনি, নারী নির্যাতন, ক্রসফায়ার এবং বিচার বিভাগের নড়বড়ে অবস্থা জনগণকে বড় অসহায় করে তুলেছে। নির্বাচন সত্ত্বেও গণতন্ত্র আজ নির্বাসিত। এ অবস্থায় গণতন্ত্রকামী মানুষকে ভাবতে হবে, গণতন্ত্রের জন্য নতুন করে সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে হবে। পরিস্থিতিই আমাদের এমন জায়গায় ঠেলে নিয়ে গেছে।
No comments