কুকুর নিধন, ক্রসফায়ার এবং ক্রান্তিকাল by ফজলুল হক সৈকত

একদিন বিকেলের দিকে রান্নাঘর থেকে আমার গিন্নির চিত্কার শুনে এগিয়ে গেলাম। দেখি, তিনি হতভম্বের মতো বাইরের দিকে তাকিয়ে কী যেন দেখছেন। সামনের রাস্তায় চোখ রাখতেই দেখলাম—কয়েকজন মানুষ একটি কুকুরকে পিটিয়ে মেরে ফেলল। অতঃপর একটি খোলা ট্রাকে তুলল কুকুরের মৃতদেহটি।

দেখা গেল ট্রাকে মৃত কুকুরের স্তূপ জমে উঠেছে। অল্পক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারলাম, এটি সিটি করপোরেশনের কুকুরনিধন কার্যক্রমের অংশবিশেষ। আমার গিন্নি প্রায় হাহাকারের মতো আওয়াজ তুলে বললেন, এদেরকে এভাবে মেরে ফেলছে কেন? আমি বললাম, সম্ভবত কুকুরগুলো পাগল হয়ে গেছে; ক্ষ্যাপা কুকুর মানুষকে কামড়ালে জলাতঙ্ক প্রভৃতি রোগ হতে পারে, তাই নগর ভবনের দায়িত্বে, আর আমাদের ভালোর জন্যই, এ কাজ করা হচ্ছে। মনে হলো, পুরো ব্যাপারটিতে আমার গিন্নির একটা মন খারাপ ভাব তৈরি হলো।
কুকুর নিধনের মতো মানুষ নিধনের একটি প্রক্রিয়াও বাংলাদেশের মানুষ অবলোকন করছে নীরবে। ক্রসফায়ারের গল্প তো এখন বাংলাদেশে কোনো রূপকথা নয়; খুবই বাস্তব। এই বিশেষ সন্ত্রাসনিধন প্রক্রিয়ায় বিনাবিচারে প্রাণ দিতে হয়েছে কয়েক হাজার লোককে। এক ধরনের অবিশ্বাস গল্পের আড়ালে সাজানো হচ্ছে এসব মৃত্যু নাটকের কাহিনী চিত্র ও সংলাপ। আমরা অবশ্যই বিনাবিচারে প্রাণ নিধনের বিপক্ষে; তা সে কুকুর কিংবা মানুষ নামক যে কোনো প্রাণীই হোক না কেন। তবে অন্যায়ের পক্ষে আমরা নই। অন্যায়ের জন্ম এবং প্রশ্রয়-লালন আমরা হতে দিতে চাই না।
সত্যিকার অর্থে, সময় গাড়িতে ভর করা সমাজের এক অপ্রকাশ্য ক্রান্তিকালে অবস্থান করছি আমরা। মানুষের লোভ বেড়েছে সহ্যসীমার অতিরিক্ত মাত্রায়; বেড়েছে অসুস্থ-অশুভ প্রতিযোগিতা। টাকার নেশায় ক্রমাগত বুদ হয়ে পড়ছে অসংখ্য মানুষ। ক্ষমতার লোভে আটকা পড়ছে অনেকের যাবতীয় চিন্তা-দুশ্চিন্তা, স্বপ্ন আর দুঃস্বপ্ন। প্রগতিশীলতা এবং প্রতিক্রিয়াশীলতাকে আজ আর আলাদা করে চেনা যায় না। অন্যায়ভাবে, সবার চোখের সামনে কাড়ি কাড়ি টাকা আর সারি সারি বাড়ি বানিয়ে চলেছে কিছু পাগল ধরনের মানুষ। পাগলা রোগে ধরা কুকুর থেকে তাদেরকে আলাদা করার কোনো উপায় আপাতত দেখতে পাওয়া যায় না। তারাও সমাজ এবং মানুষের জন্য ভয়াবহ সঙ্কট বয়ে আনছে; জলাতঙ্ক না হোক অন্তত মহাতঙ্ক তো সৃষ্টি করছেই। তাদের দাপটে অস্থির হয়ে পড়ছে মনুষ্য সমাজ। এই ধরনের লোককে চিহ্নিত করা রাষ্ট্রের জন্য নিশ্চয়ই কোনো কঠিন কাজ হবে না। আমরা বলছি না যে, পাগলা কুকুরের মতো নির্বিচারে বা বিনাবিচারে তাদেরকে হত্যা করা হোক; কিন্তু একটি বিহিত ব্যবস্থা তো অন্তত করা যায়! আমাদের মনে হয়, দুর্নীতি চিহ্নিত করতে এবং বিতাড়িত করতে খুব বেশি গবেষণা করার প্রয়োজন পড়ে না। কেবল দরকার হয় সাহসী ও যোগ্য নেতার আর সত্-উদ্যোগের। রাষ্ট্রীয় প্রশাসন কাঠামো দাঁড় করানোটাই মূল কাজ। অপরাধ কিংবা উন্নয়ন, যা-ই বলি না কেন, প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের আওতায় না পড়লে কোনো ব্যবস্থাই কাঙ্ক্ষিত মান লাভ করতে পারে না। তাই, আগে চাই প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বাস্তবায়ন। তারপর সব উন্নয়ন আর শুদ্ধি অভিযান চলবে তার ছকবাঁধাগতিতে। প্রথমদিকে অবশ্য কাউকে না কাউকে কিছুটা ঝুঁকি নিতে হতেই পারে। যতদিন না নির্লোভ-জাতীয়তাবাদী-মানব ভাবনাসমৃদ্ধ জননেতার আবির্ভাব হচ্ছে, ততদিন আমাদের ধৈর্যসহকারে অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। এ কথা সহজেই অনুমেয় যে, চাকরিজীবীদের উপার্জনের হিসাব রয়েছে তার কর্মস্থলের বিবরণ খাতায়; তার পারিবারিক বা ব্যক্তিগত সম্পত্তির খোঁজ-খবর জানাটাও কঠিন হবে না। ব্যবসায়ীদের আয়-ব্যয়ের বিবরণও তাদের নিজস্ব হিসাব থেকেই সংগ্রহ করতে পারে রাষ্ট্রের কোনো দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা। তাহলে, নাগরিকের অর্থসম্পত্তি অর্জন-সংরক্ষণ-হস্তান্তর প্রভৃতিতে রাষ্ট্রযন্ত্রের তদারকি প্রতিষ্ঠা করতে তো কোনো বাধা থাকছে না; অন্তত যেখানে অনেকের অর্জিত [অথবা হাতিয়ে-নেয়া] সম্পত্তি নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে।
খেয়াল করলেই দেখা যাবে, বাংলাদেশের শিক্ষা ভুবনে বিরাজ করছে মেধাহীনতার ভয়াবহ দাপট। ছাত্ররাজনীতি এবং শিক্ষক নিয়োগ বর্তমানে ভীষণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। পড়ালেখা এবং চিন্তাচর্চা বাদ দিয়ে অন্যের বাধ্যবৃত্তির মতো লজ্জাজনক সাংস্কৃতিক পরিস্থিতিতে পতিত হয়েছে আমাদের শিক্ষার্থী সমাজ। প্রশ্নপত্র ফাঁস, টেন্ডারবাজিসহ সন্ত্রাস কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে আজকের ছাত্রসমাজ। শিক্ষকরা পড়া ও পড়ানোর চেয়ে বেশি মগ্ন হয়েছেন রাজনৈতিক নেতাদের অনুগামিতায়; কোচিং রোগেও ধরেছে তাদের একটি বিরাট অংশকে। লোভ-লাভ আর সম্পূর্ণ সাময়িক খ্যাতির মোহে আজ আটকে গেছে প্রায় পুরো শিক্ষা কাঠামো। এমন ক্রান্তিকাল আর কতদিন যাপন করতে হবে, তা ঠিক করে কে বলতে পারে!
কৃষি-অর্থনীতি কৃষকবান্ধব না হয়ে মধ্যস্বত্বভোগীদের আনন্দবাজারে পরিণত হয়েছে। সার-পানি-পরিশ্রম বিনিয়োগ করে বিনিময়ে কৃষক যে টাকা পায়, তাতে মোটা ভাত আর মোটা কাপড়ে দিনাতিপাত করাও এক প্রকার কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। জীবনের আনন্দ আর স্বস্তির মুখ দেখতে পায় না তারা। জমি থেকে বাজারে কিংবা আড়তে পণ্য পৌঁছে দিয়ে ছোট ব্যবসায়ীরা যে পরিমাণ লাভ করে, কৃষকের মোট বিক্রয়লব্ধ টাকার চেয়েও তা অনেক ক্ষেত্রে ঢের বেশি। আর তিনস্তরবিশিষ্ট বাজারগতি পার হয়ে সাধারণ ক্রেতার কাছে যখন কৃষিপণ্য হাজির হয়, তখন তার গায়ে জমে ওঠে মাঠমূল্যের চার/পাঁচগুণ দাম। এই ক্রান্তিকাল সত্যিই আমরা পার করছি, পার হচ্ছি প্রায় বিনাবাক্যব্যয়ে। ভাবতে অবাক লাগে, কৃষিনির্ভর এই দেশে, শ্রমিকদের সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তার জায়গাটি তৈরি করা যায়নি আজও। কৃষি-উত্পাদন যেমন কমছে একদিকে, অন্যদিকে তেমনি জনসংখ্যা আর শিল্পকারখানা বৃদ্ধির ফলে বাড়ছে ভূমিহীনের বহর।
চিকিত্সাসেবায় রয়েছে ভয়ঙ্কর অনিয়ম ও অন্যায়। এখানে কোনো সেবা বা নীতির চিহ্নমাত্র আজ আর অবশিষ্ট দেখা যায় না। চিকিত্সা-শিক্ষাকে আধুনিক এবং উপযোগী করতে পারিনি আমরা। আজ পর্যন্ত স্থাপিত হয়নি পরিপূর্ণ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। সেবার চেয়ে চিকিত্সকরা বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছেন বাণিজ্যের প্রতি; কর্মক্ষেত্রের চেয়ে ব্যক্তিগত পরামর্শ কেন্দ্রের দিকে তাদের মনোযোগ অবিশ্বাস্য রকমভাবে বেড়ে চলেছে। সামাজিক দায় আর দায়িত্বের জায়গাটি থেকে ডাক্তার সম্প্রদায় সরে পড়েছেন অনেকটা পথ।
যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুক্ত হয়েছে অপ্রতিরোধ্য অব্যবস্থাপনা। বিশেষ করে ঢাকা এবং চট্টগ্রাম নগর দুটি বসবাসের [বরং চলাচলের বলা বোধ হয় ভালো] অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। অথচ, সাধারণ বিবেচনায়, গাড়িক্রয় এবং চলাচলের ওপর নীতিমালা তৈরি করে অতি স্বল্পসময়ে দূর করা যায় যানজটের মতো জেঁকে-বসা জটিল রোগ। সিটিতে প্রধান প্রধান সড়কে কেবল সরকার নিয়ন্ত্রিত বড়-আকারের গাড়ির প্রচলন, প্রাইভেট গাড়ি ব্যবহারের জন্য সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা নির্ধারণ, ফুটপাতকে বাজারমুক্তকরণ, রিংরোড ও রিংনৌপথ নির্মাণ করে সিটির সব প্রবেশ পথকে চালু এবং অফিস-আদালত-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্থান ও কার্যকাল নির্ধারণ করার কৌশল প্রবর্তন করে নগরীকে আধুনিক ও উপযোগী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব।
সভ্যতার বিকাশ আর জাতিগত মনন ও অগ্রগতি অর্জনে প্রচার মাধ্যমের ভূমিকা অনস্বীকার্য; দিনে দিনে বাংলাদেশে এ মাধ্যমটি উত্কর্ষ অর্জন করেছে। তবে পাশাপাশি কিছু নেতিবাচক প্রভাবও দেখা দিয়েছে অতিসম্প্রতিকালে। দুঃখজনকভাবে, প্রচার মাধ্যমে শুরু হয়েছে ভাষাকে আর আপন সংস্কৃতির মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করার হীন প্রচেষ্টা। বানান রীতির অসমতা আর উচ্চারণকৌশলে কৃত্রিমতার মাধ্যমে কোনো কোনো সংবাদপত্র বা রেডিও-টেলিভিশন চ্যানেল তৈরি করছে মানসিক বিকৃতির বিচিত্র খোরাক। এ জাতীয় ক্লান্তি আর ক্রান্তির মোহজাল থেকে আমাদেরকে কে দেবে মুক্তির পথনির্দেশ!
কুকুরকে মরতে দেখে, সবকিছু হারিয়ে জীবন-অন্বেষায় ক্লান্ত [সর্বহারা বলতে কি এরকম কিছুকে বোঝায়?] লুঙ্গি পরিহিত মানুষগুলোর মরা দেহ দেখে আমাদের মনে হয়তো মায়া জাগে; ভয়ও যে কিছুটা জাগে না, সে কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। চারপাশে চোখের সামনে নীরবে ও সরবে বাড়তে থাকা লোভ দেখে, লোভজনিত অসম্ভব সাফল্য [অন্তত টাকা-পয়সার দিক থেকে] অনুভব করে আমরা কি মায়ার মোহে জড়িয়ে পড়ছি? না কি ভয়ে কাতর হচ্ছি দিন দিন কিংবা হয়তো ক্ষোভ আর প্রতিবাদের ভার জড়ো করছি, আমাদেরই অজান্তে? একদিন হয়তো বেরিয়ে পড়বে, পথে পথে, সব বঞ্চনার সব অপমানের আর সমূহ নির্বাকতার সঞ্চিত শক্তি; আর তখনই হয়তো তৈরি হবে সভ্যতার আরেক ধাপের নতুন ভিত। সে দিন বেশি দূরে না হলেই ভালো।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
snue90@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.