আলোয় ভূবন ভরাঃ নানান দেশের পাখি by কাজী জহিরুল ইসলাম
প্রিয় পোষা পাখির মৃত্যুতে আমি খুব ভেঙে পড়তাম। পরের বছর আবার গ্রামে যেতাম। আবার আরেকটি বকের ছা জোগাড় করতাম। সেটারও একই পরিণতি হতো। বন-বাদাড়ে ঘুরে বেড়াতাম সারাদিন। পাখিদের পিছু নিতাম। ভোরবেলা তিলা ঘুঘু ডাকতো, ‘আতিথি ফু...র ফু...র’ বলে।
শেষ বর্ষায় ‘টুব টুব’ করে ডাহুকি ডাকতো কচুিরপানার দামের ভেতর থেকে অথবা পুকুরের পাড়ে গড়ে ওঠা শত বছরের পুরনো কোনো ঝোপ-জঙ্গলের ভেতর থেকে। ‘পুত পুত পুত’ করতে করতে কতবার দেখেছি পুত্রশোকে আইড়াকুপিকে আঁড়ার ভেতরে ঢুকে যেতে। দোয়েল তখন শিষ বাজাতো সিমফুলের মাচায় বসে। শালিককে আমাদের অঞ্চলে বলে বাতল খা। আর যেটার ঠোঁট বেশি হলুদ, দেখতে কিছুটা কুিসত, কাঁচা পায়খানায় বেশি দেখা যায় খুটে খুটে পোকা খেতে, ওটার নাম গুঅল খা। বাতল খা ছিল দুই রকমের। একটার নাম চটি বাতল খা। চটি বাতল খা আকারে একটু ছোট, মাথায় চমত্কার ঝুটি। এই পাখিটা পোষ মানে এবং অতি দ্রুত মানুষের মতো কথা বলা শিখে ফেলে। বালাপাড়ার দিলা সব সময় চটি বাতল খা পুষতো। কতদিন দেখেছি মাছরাঙা ওর রঙিন ঠোঁট নিয়ে ঝুপ করে পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাছ শিকার করছে। মাঝে মাঝে আমি পুঁটি মাছ দিয়ে বড়শি পাততাম শোল-বোয়াল মাছ ধরার জন্য। কতদিন যে দুষ্টু মাছরাঙা আমার বড়শির পুঁটি মাছ চুরি করে খেয়েছে। পুকুরের পাড়ে মাটির গর্তে খড়-কুটো জড় করে মাছরাঙারা গড়ে তুলতো ওদের নিবাস। বড়ুই গাছে ছোট্ট টুনটুনি গড়ে তুলতো অদ্ভুত শৈল্পিক বাসা। সুলতান মিয়ার তালগাছ থেকে ঝড়ের দিনে একটা-দুটা বাবুইয়ের বাসা খসে পড়ত। আমরা প্রতিযোগিতা করে ঝড়ের দিনে তালগাছের তলায় গিয়ে হাজির হতাম বাবুইয়ের বাসা সংগ্রহের জন্য। যে একটা বাবুইয়ের বাসা পেত আমরা তাকে বলতাম সৌভাগ্যবান। এত শৈল্পিক বাসা এত্তুটুকুন পাখি কী করে বানায় আমরা এ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করতাম। গরুর পিঠে অথবা বোয়ালিয়া বড়শির ছিপের মাথায় বসে কুচকুচে কালো ফিঙে সারাক্ষণ কী ভাবত কখনোই বুঝতে পারতাম না। আমরা ফিঙেকে বলতাম পাখির রাজা। ও মাঝে মাঝে শিকারি চিলকেও যুদ্ধে হারিয়ে দিত। একটা কাঠঠোকরা ‘পরিষ্কার’ খালার বুড়ো আমগাছের শরীরে ঠকঠক করে ঠুকরে ঠুকরে খোড়ল বানাত। আর আমার নানির ধানের খোলায় ঝাঁকে ঝাঁকে চড়ুই পড়ত দুপুরের রোদে। নানি বলতেন, বাদল চড়ুইগুলো লড়া। আমি ওদের তাড়াতাম না, যতক্ষণ না নানি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসতেন। তিনি রেগে গিয়ে বলতেন, ধুরো গোলাম, পৈখে ধান খাইয়া শেষ করলে আমরা খামু কী? হেমন্তকালে দেখতাম খুব ভোরে বাঁশবনের একেবারে চূড়ায় বসে লাউয়া ঘুঘু দম্পতি মনের সুখে ‘ঘু ঘুউউউ ঘু’ সুরে একেবারে নির্ভুল ছন্দে ডাকতো। কবিতায় আমি যে ছন্দ ব্যবহার করি। এই ছন্দ আমি পাখিদের কাছ থেকেই শিখেছি। পাখির চেয়ে বড় ছন্দের শিক্ষক আর কেউ আছে বলে আমার জানা নেই।
ঘুঘুর ডাকের মধ্যে আমি সব সময় একটা বিরহের সুর শুনি। ২০০০ সালের এপ্রিল মাসে যখন সাত সমুদ্দুর তের নদী পেরিয়ে মেসিডোনিয়ার রাজধানী স্কোপিয়ে গিয়ে হাজির হই। তখন দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়েছে। ঝাউগাছের ছায়াগুলো ক্রমেই লম্বা হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে ফসলের মাঠে। তখনও ঘুঘুর ডাক শুনেছি, অবিকল সুরে। আবিদজানেও মাঝে মাঝে ঘুঘু ডাকে। সেই একই সুর, একই ছন্দ। আর একই বিরহের আর্তি। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই কাক আছে। তবে সব দেশের কাকের রং এবং চরিত্র একরকম নয়। কসোভোর আকাশে যে কাক উড়ে বেড়ায় ওরা আকারে অনেক ছোট এবং গায়ের রং শুভ্র-ধূসর। ওরা কখনও একা একা উড়ে না। উড়ে দলবেঁধে। যেমন আমাদের দেশে পরিযায়ী পাখিরা শীতকালে দলবেঁধে উড়ে আসে ঠিক সেই রকম। কসোভোর আকাশে বিকালের সোনারোদে ডানা মেলে উড়ে বেড়ায় হাজারো কাকের ঝাঁক। কখনও মালার মতো, কখনও মেঘের মতো, আবার কখনও রঙধনুর মতো অর্ধবৃত্ত তৈরি করে উড়ে বেড়ায় ওরা। সাধারণত বিকালের দিকেই ওদেরকে এরকম দলবেঁধে উড়তে দেখা যায়। কসোভোর কাকদের শরীরও খুব মসৃণ এবং কাকগুলো মোটেও নোংরায় নামে না। ওরা কা কা শব্দেও ডাকে না। ওরা ডাকে চিঁহিঁ চিঁহিঁ ধরনের শব্দ করে। আইভরিকোস্টের কাকগুলো আকারে বড়। দাঁড়কাকের সমান। তবে গায়ের রং কালো নয়। এখানকার কাকগুলো অবিকল পেঙ্গুইনের মতো। বুক এবং গলা সাদা। ডানা এবং পিঠ কালো। কোট পরা ভদ্রলোকের মতো, ওরাও দলবেঁধে চলাফেরা করে। আইভরিকোস্টের কাকদেরও আমি কখনোই ময়লার বিনে নামতে দেখিনি। বরং এখানকার ধবল বকগুলো সারাদিন শহরের ময়লার বিনগুলোয় পড়ে থাকে। আমার কাছে মনে হয় কালো মানুষের দেশ আইভরিকোস্টের প্রকৃতি সাদাদের তৈরি বর্ণবৈষম্যের শোধ নিচ্ছে এখানে। সাদা বকদের দিয়ে সাফ করাচ্ছে শহরের নোংরা আবর্জনা।
শুধু আমাদের পোষা টিয়া পিয়াকার ডাক নয়, বারান্দার গোলাপের ডালে, গন্ধরাজের ডালে বসে আরও অনেক পাখি ডাকে। ওপাশের বাড়িতে একটি কাজু বাদাম গাছ। ওর ডাল থেকে রোজ বিকালে ভেসে আসে ঘুঘুর ডাক। পান্থনিবাসের বিশাল পাতার ওপরও বসে বসে নাম না জানা কত পাখি ডাকে। অগ্নির সে সুযোগ কোথায়? আটপৌরে ঢাকা শহরের চার দেয়ালে বন্দি ওদের জীবন। প্রকৃতির মধ্যে উড়ে বেড়ানো মুক্ত স্বাধীন পাখির ডানায় যে স্বতঃস্ফূর্ততার আনন্দ তা ওরা দেখতে পায় না। তাই ওরা বন্দি পাখির খাঁচার দিকে তাকিয়ে থেকে কল্পনা করে বিস্তৃত ডানার উড়াল। এই প্রজন্মের শিশুরাও তাই নিজেদের ক্রমেই বন্দি করে ফেলছে কম্পিউটারের বাক্সে। অগ্নি হয়ত শুনে কিছুটা মনক্ষুণ্ন হবে, কিন্তু আমি কিছুতেই পিয়াকাকে খাঁচার ভেতরে আটকে রেখে পাখির ওপর কিছু একটা লিখতে পারছি না।
বিকালে বাসায় ফিরে দেখি খাঁচার চারপাশে ঘুরঘুর করছে পিয়াকা, সঙ্গে ওর এক নতুন সঙ্গী। নতুন সঙ্গীটি বেশ হৃষ্ট-পুষ্ট, তবে ভিতু। আমাকে দেখেই উড়ে পালাল।
লেখক : কবি, জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক কর্মকর্তা
ঘুঘুর ডাকের মধ্যে আমি সব সময় একটা বিরহের সুর শুনি। ২০০০ সালের এপ্রিল মাসে যখন সাত সমুদ্দুর তের নদী পেরিয়ে মেসিডোনিয়ার রাজধানী স্কোপিয়ে গিয়ে হাজির হই। তখন দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়েছে। ঝাউগাছের ছায়াগুলো ক্রমেই লম্বা হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে ফসলের মাঠে। তখনও ঘুঘুর ডাক শুনেছি, অবিকল সুরে। আবিদজানেও মাঝে মাঝে ঘুঘু ডাকে। সেই একই সুর, একই ছন্দ। আর একই বিরহের আর্তি। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই কাক আছে। তবে সব দেশের কাকের রং এবং চরিত্র একরকম নয়। কসোভোর আকাশে যে কাক উড়ে বেড়ায় ওরা আকারে অনেক ছোট এবং গায়ের রং শুভ্র-ধূসর। ওরা কখনও একা একা উড়ে না। উড়ে দলবেঁধে। যেমন আমাদের দেশে পরিযায়ী পাখিরা শীতকালে দলবেঁধে উড়ে আসে ঠিক সেই রকম। কসোভোর আকাশে বিকালের সোনারোদে ডানা মেলে উড়ে বেড়ায় হাজারো কাকের ঝাঁক। কখনও মালার মতো, কখনও মেঘের মতো, আবার কখনও রঙধনুর মতো অর্ধবৃত্ত তৈরি করে উড়ে বেড়ায় ওরা। সাধারণত বিকালের দিকেই ওদেরকে এরকম দলবেঁধে উড়তে দেখা যায়। কসোভোর কাকদের শরীরও খুব মসৃণ এবং কাকগুলো মোটেও নোংরায় নামে না। ওরা কা কা শব্দেও ডাকে না। ওরা ডাকে চিঁহিঁ চিঁহিঁ ধরনের শব্দ করে। আইভরিকোস্টের কাকগুলো আকারে বড়। দাঁড়কাকের সমান। তবে গায়ের রং কালো নয়। এখানকার কাকগুলো অবিকল পেঙ্গুইনের মতো। বুক এবং গলা সাদা। ডানা এবং পিঠ কালো। কোট পরা ভদ্রলোকের মতো, ওরাও দলবেঁধে চলাফেরা করে। আইভরিকোস্টের কাকদেরও আমি কখনোই ময়লার বিনে নামতে দেখিনি। বরং এখানকার ধবল বকগুলো সারাদিন শহরের ময়লার বিনগুলোয় পড়ে থাকে। আমার কাছে মনে হয় কালো মানুষের দেশ আইভরিকোস্টের প্রকৃতি সাদাদের তৈরি বর্ণবৈষম্যের শোধ নিচ্ছে এখানে। সাদা বকদের দিয়ে সাফ করাচ্ছে শহরের নোংরা আবর্জনা।
শুধু আমাদের পোষা টিয়া পিয়াকার ডাক নয়, বারান্দার গোলাপের ডালে, গন্ধরাজের ডালে বসে আরও অনেক পাখি ডাকে। ওপাশের বাড়িতে একটি কাজু বাদাম গাছ। ওর ডাল থেকে রোজ বিকালে ভেসে আসে ঘুঘুর ডাক। পান্থনিবাসের বিশাল পাতার ওপরও বসে বসে নাম না জানা কত পাখি ডাকে। অগ্নির সে সুযোগ কোথায়? আটপৌরে ঢাকা শহরের চার দেয়ালে বন্দি ওদের জীবন। প্রকৃতির মধ্যে উড়ে বেড়ানো মুক্ত স্বাধীন পাখির ডানায় যে স্বতঃস্ফূর্ততার আনন্দ তা ওরা দেখতে পায় না। তাই ওরা বন্দি পাখির খাঁচার দিকে তাকিয়ে থেকে কল্পনা করে বিস্তৃত ডানার উড়াল। এই প্রজন্মের শিশুরাও তাই নিজেদের ক্রমেই বন্দি করে ফেলছে কম্পিউটারের বাক্সে। অগ্নি হয়ত শুনে কিছুটা মনক্ষুণ্ন হবে, কিন্তু আমি কিছুতেই পিয়াকাকে খাঁচার ভেতরে আটকে রেখে পাখির ওপর কিছু একটা লিখতে পারছি না।
বিকালে বাসায় ফিরে দেখি খাঁচার চারপাশে ঘুরঘুর করছে পিয়াকা, সঙ্গে ওর এক নতুন সঙ্গী। নতুন সঙ্গীটি বেশ হৃষ্ট-পুষ্ট, তবে ভিতু। আমাকে দেখেই উড়ে পালাল।
লেখক : কবি, জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক কর্মকর্তা
No comments