কুয়াশার অবগুণ্ঠন থেকে ইতিহাস মুক্ত হতে চলেছে by ড. মাহবুব উল্লাহ্
সমসাময়িককালের ইতিহাস রচনা অত্যন্ত কঠিন কাজ। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির স্বাধীনতা অর্জনের সঠিক ইতিহাস লেখার কাজটিও তাই অত্যন্ত কঠিন এবং বিপজ্জনক। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটেছিল।
সেই থেকে প্রায় ৩৯ বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের কুশীলবরা অনেকে এরই মধ্যে পরলোকগমন করেছেন। আবার অনেকে এখনও জীবিত আছেন। ইতিহাসের বিশাল ঘটনায় অংশগ্রহণকারী নায়করা এবং তাদের সহযোগীরা যতদিন জীবিত থাকেন, ততদিন চলমান ইতিহাসের ঘটনাবলী নিয়ে বিতর্ক এবং দৃষ্টিভঙ্গিগুলো প্রায়ই সংঘাতপূর্ণ হয়ে ওঠে। এর কারণ অংশত আবেগসঞ্জাত, অংশত রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের স্থূল চিন্তায় আচ্ছন্ন থাকা। তাই অনাবিল সত্য উদ্ঘাটন কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সমকালীন ইতিহাস রচনার এসব সমস্যা সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন রজনী পাম দত্ত তার Problems of Contemporary History গ্রন্থে। গ্রন্থটির ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, Contemporary history is a dangerous subject to handle. It is full of explosive material. Much essential information will not be known until many years later, as documents are released and memoirs published. Passions and partisanship can obscure objective Judgement. Anyone who attempts to write contemporary history in any more durable form than a current journalistic article is lying his head on the block for the executioner. ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পণ্ডিত প্রবর রজনী পাম দত্ত ১৯৬২ সালের মে মাসে মস্কো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি গ্রহণকালে যে পাণ্ডিত্যপূর্ণ ভাষণ দিয়েছিলেন, সেটাই পরবর্তীকালে লন্ডনের লরেন্স অ্যান্ড উইশার্ট নামক প্রকাশনা সংস্থা ১২৮ পৃষ্ঠা সংবলিত গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে। সুতরাং যে বিষয় সম্পর্কে রজনী পাম দত্তের মতো মানুষ আলোচনা করা বিপজ্জনক মনে করতেন, সেই সম্পর্কে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কথা বলার চেষ্টা করা ঔদ্ধত্য ছাড়া আর কী হতে পারে?
গত সপ্তাহে জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার কর্নেল (অব.) শওকত আলীর একটি ঐতিহাসিক উক্তি সম্পর্কে লিখেছিলাম। তার এ উক্তি ইতিহাসকে কুয়াশার চাদরের ভেতর থেকে ঝলমলে সূর্যালোকের দিকে নিয়ে আসতে প্রভূতভাবে সাহায্য করবে। যারা বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস রচনা করতে আগ্রহী তারা কিঞ্চিত্ হলেও সাহসী হয়ে উঠবেন। তিনি বলেছেন, ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মিথ্যা ছিল না।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে দেশকে পাকিস্তানিদের হাত থেকে মুক্ত করতে।’ কী ছিল সেই সশস্ত্র বিপ্লবের উদ্যোগ? একজন প্রতিবাদী ছাত্রনেতা হিসেবে তত্কালীন সময়ের রাজনীতির অন্তরালের রাজনীতি সম্পর্কে অনেক কথাই শুনতে পেতাম। ১৯৬৭ সালেই শোনা গিয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানকে হত্যার উদ্দেশ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম বিমানের একটি ফ্লাইট বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা এবং অতঃপর পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণার কথা। সে সময় এ গল্পটি নিছক গুজব বলেই মনে হয়েছিল। যখন পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রুজু করে, তখন এ রকম একটি কথাই ঢাকার রাজনৈতিক মহলে ফিসফাস করে বলা হচ্ছিল। আজ বহু বছর পর এ গুজবের যে একটি ভিত্তি ছিল তার ঐতিহাসিক সাক্ষাত্ পাওয়া যাচ্ছে। Stanley wolpert দক্ষিণ এশীয় ইতিহাসের একজন নামকরা বিশেষজ্ঞ। তিনি একসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশীয় ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন। দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসের ওপর তিনি অনেক নিবিড় গবেষণা সমৃদ্ধ প্রামাণ্য ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেছেন। গান্ধী, নেহরু, জিন্না সম্পর্কে তার রচিত গ্রন্থগুলো পণ্ডিত মহলে সমাদৃত হয়েছে। তিনি পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টো সম্পর্কেও একটি নিবিড় গবেষণাসমৃদ্ধ গ্রন্থ রচনা করেছেন। গ্রন্থটি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশ করেছে। গ্রন্থটির নাম Zulfi Bhutto of PakistanÑHis life and times. এই গ্রন্থের ১১৫ পৃষ্ঠায় আইয়ুব খানকে হত্যা চেষ্টার একটি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। উলপার্ট লিখেছেন, 'Ayub was almost kidnapped, nearly assassinated, during his presidential tour of East Pakistan in December. Zulfi wrote to 'warn' the foreign secretary at that time that India was determined to 'dismember' Pakistan. Ayub now feared that Mujibur Rahman was India's leading agent in Dacca, and that the Awami League was but an East Bengali branch of Indira Gandhi's congress Party. More of Mujib's supporters were arrested in December 1967, and thirty two Bengali members of his party were soon to be charged with helping him to 'treacherously conspire' with India against Pakistan. উলপার্টের উদ্ধৃতিতে শেখ মুজিবুর রহমানের দলের ৩২ জন বাঙালি সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়েরের কথা বলা হয়েছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় এরকম সংখ্যক অভিযুক্তই ছিল। এখন কর্নেল (অব.) শওকত আলী সাহেব যদি এ পরিকল্পনাটি সম্পর্কে কোনো আলোকপাত করেন তাহলে উলপার্ট প্রদত্ত তথ্য সম্পর্কে আরও নিশ্চিত হওয়া যেতে পারে। উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনার সরকার স্টেনলি উলপার্টকে দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর একটি প্রামাণ্য জীবনীগ্রন্থ রচনার উদ্যোগ নিয়েছিল। উলপার্ট এ ব্যাপারে আলোচনার জন্য ঢাকায় এসেছিলেনও। কিন্তু অজানা কারণে সেই প্রয়াস থেমে যায়। হয়তো উলপার্ট ফরমায়েশি কিছু লিখতে সম্মত হননি। উলপার্ট যে ধাঁচের ঐতিহাসিক তাতে তাকে দিয়ে কারও মনসই ইতিহাস লেখানো সম্ভব নয়। শোনা যায়, তত্কালীন শেখ হাসিনা সরকারের অর্থমন্ত্রী মরহুম শাহ এএমএস কিবরিয়া উলপার্টকে দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রামাণ্য জীবনীগ্রন্থ রচনা করানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে জাতীয় সংসদে যখন দুর্ভাগ্যজনক কটূ-কাটব্য চলছে, ঠিক তখনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের আলোকিত করতে কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রদান করেছেন। গত ৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ উপলক্ষে আয়োজিত এক সেমিনারে সভাপতির বক্তব্যে শেখ হাসিনা বলেছেন, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। কারণ সেটা করা হলে দেশ কোনোদিন স্বাধীন হতো না। আমাদের মুক্তির সংগ্রাম বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে পরিচিতি পেত। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আসত না। তিনি বলেন, তবে সেটা ২৫ মার্চ রাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিয়ে যান। এ নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার এই ঘোষণা ইপিআরের ওয়ারল্যাসের মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল বলে তিনি উল্লেখ করেন। ... শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু আগেই লন্ডনে বসে মুক্তিযুদ্ধের সব পরিকল্পনা ঠিক করে এসেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘নির্বাচন হবে, আমরা বিজয় অর্জন করব, আমাদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে না, মুক্তিযুদ্ধ হবে, আমরা বিজয় অর্জন করব, বাংলাদেশ স্বাধীন হবে’ [সূত্র : আমার দেশ ৬ মার্চ ২০১০]। হাতের কাছে অন্য পত্রিকা নেই বলে আমার দেশকে বাধ্য হয়ে সূত্র হিসেবে ব্যবহার করছি। অন্য কোনো পত্রিকা হাতের কাছে থাকলে সেগুলোকেই সূত্র হিসেবে উল্লেখ করতাম। কারণ, আমার দেশকে শাসকদলের লোকেরা পছন্দ করে না। তবে মনে হয় এ রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমার দেশ বিভ্রান্তিকর কোনো রিপোর্ট করেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বক্তব্যের সঙ্গে আমি অন্তত একমত। তিনি যথার্থই বলেছেন, স্বাধীনতার ঘোষণা যদি শেখ মুজিবুর রহমান আগেই দিয়ে ফেলতেন, তাহলে বিচ্ছিন্নতাবাদের দায় তার কাঁধে বর্তাতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তরকালে পৃথিবীতে বহু স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে। এর কোনোটি তার একটি অঞ্চল বিচ্ছিন্ন হয়ে যাক তা কখনোই মেনে নেয়নি এবং আজও মেনে নেয় না। নাইজেরিয়ায় বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রয়াসের পরিণতি সম্পর্কে আমরা জানি। অতি সম্প্রতি শ্রীলঙ্কায় তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদ সামরিকভাবে পরাস্ত হয়েছে। আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে পারস্পরিক ভূ-খণ্ডগত সংহতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত এবং সর্বদা অনুসরণীয় একটি নীতি। সেদিক থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য অনুযায়ী ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা না দিয়ে কৌসুলী ভূমিকা পালন করেছেন। তবে ২৫ মার্চ রাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে ইপিআরের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে তার স্বাধীনতা ঘোষণার দাবি বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকেনি। এ প্রসঙ্গে ঔ. ঘ. উরীরঃ যিনি সর্বপ্রথম ১৭ জানুয়ারি ১৯৭২ বাংলাদেশে ভারতের ডিপ্লোমেটিক মিশন চালু করেন, তিনি তার বিখ্যাত গ্রন্থ Liberation and Beyond- Indo-Bangladesh Relations-এ লিখেছেন, Mujib went under-ground some time around midnight on March 25. A pre-recorded broad-cast by him declaring East Pakistan as a newly independent Country called Bangladesh went on the air from a clandestine radio station established by the Awami League at Rangpur and Rajshahi districts in the north-western part of the country. Simultenuously the battalion commander of the East Bengal Regiment at Chittagong, Major Ziaur Rahman (who become President of Bangladesh in 1976-77), briefly captured the Chittagong radio station and broadcast a declaration announcing the establishment of free Bangladesh and appealing to all Bengali military and para-military personnel to resist the Pakistan Army. In fact, Ziaur Rahman's broadcast came a little earlier than Mujib's broadcast. He was the first Bengali military officer of the Pakistan army to declare his loyality to the new country [müÎ] J. N. Dixit, Liberation and Beyond, পৃষ্ঠা-৪২]।
দীক্ষিতের ভাষ্যমতে, শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষণাটি এসেছিল রংপুর ও রাজশাহী জেলার গোপন বেতার কেন্দ্র থেকে। এই বেতার কেন্দ্র স্থাপন করেছিল আওয়ামী লীগ; কিন্তু এই ভাষ্যে ইপিআরের ওয়্যারলেসের কোনো উল্লেখ নেই। দীক্ষিত এ কথাও উল্লেখ করেছেন যে মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণা দিয়েছেন। দীক্ষিত এটাও উল্লেখ করেছেন যে জিয়াউর রহমানের বেতার ঘোষণা শেখ মুজিবুর রহমানের বেতার ঘোষণার কিছু আগে এসেছিল। সুতরাং জিয়াউর রহমানকে অস্বীকার করার উপায় নেই। দীক্ষিতের বক্তব্যে বিতর্কের একটি ভিন্নমাত্রা দেখা যাচ্ছে। সেটা হলো শেখ মুজিবের ঘোষণাটি কোন মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছিল! ইপিআরের ওয়্যারলেস না রংপুর রাজশাহীতে আওয়ামী লীগ স্থাপিত গোপন বেতার কেন্দ্রে? তবে আজ পর্যন্ত রংপুর-রাজশাহীর আওয়ামী লীগ নেতাদের তরফ থেকে এ ধরনের কোনো প্রকাশ্য দাবি করা হয়নি। ইতিহাস গবেষকদের জন্য আরও একটি রহস্য উদ্ঘাটনের দায়িত্ব এসে গেল।
সম্প্রতি প্রথমা প্রকাশন কর্তৃক প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর কথোপকথন গ্রন্থে মূল ধারা-৭১ গ্রন্থের প্রণেতা মঈদুল হাসান বলেছেন, “তাজউদ্দীন আহমদের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি যখন তাঁকে বললেন, ‘মুজিব ভাই, এটা আপনাকে বলে যেতেই হবে, কেননা কালকে কী হবে, আমাদের সবাইকে যদি গ্রেফতার করে নিয়ে যায়, তাহলে কেউ জানবে না কী তাদের করতে হবে।’ এই ঘোষণা কোনো না কোনো জায়গা থেকে কপি করে আমরা জানাব। যদি বেতার মারফত কিছু করা যায়, তাহলে সেটাই করা হবে। শেখ সাহেব তখন উত্তর দিয়েছিলেন, ‘এটা আমার বিরুদ্ধে দলিল হয়ে থাকবে। এর জন্য পাকিস্তানিরা আমাকে দেশদ্রোহের জন্য বিচার করতে পারবে।’ এ কথার পিঠে তাজউদ্দীন অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে রাত ৯টার পর পরই ৩২ নম্বর ছেড়ে চলে যান।” বক্তব্য অব্যাহত রেখে তিনি আরও বলেন, ‘সিগন্যালসই কোনো বাহিনীর আত্মরক্ষার ও আক্রমণের মূল যোগাযোগ মাধ্যম। আর ইপিআর ছিল মিশ্র বাহিনী। এই বাহিনীতে অনেক অবাঙালিও ছিলেন। সেখানে তো তাঁদের বাদ দিয়ে সন্দেহের পাত্র বাঙালিদের হাতে সিগন্যালস থাকতে পারে না। কাজেই ইপিআর সিগন্যালসের মাধ্যমে শেখ সাহেব স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠিয়েছিলেন—এটা বোধহয় অবাস্তব কথা।’ একই গ্রন্থে বর্তমান পরিকল্পনামন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ কে খন্দকার বলেছেন, ‘আমি এ কথা একটু আগেও বলেছি যে, শুধু আমার ঢাকায় অবস্থানকালেই নয়, গোটা মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল ধরেই কিন্তু এ ঘোষণা নিয়ে কোনো বিভ্রান্তি বা কোনো মতবিভেদ আমরা শুনিনি। আমি আগে বলেছি যে মেজর জিয়া কীভাবে এ ঘোষণাটি ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে পড়েছিলেন। যে কথাটা এখন আমি বলতে চাই তা হচ্ছে, এ ঘোষণা নিয়ে যে বিভ্রান্তি, সেই বিভ্রান্তির খুব একটা মূল্য নেই এ জন্য যে, এ ঘোষণা কখন হয়েছিল, কে দিয়েছিল, কোথায় দিয়েছিল—সেটার অপেক্ষা না করে স্বাধীনতা যুদ্ধ কিন্তু শুরু হয়ে গিয়েছিল ২৫ মার্চ রাতেই। তবে জিয়ার ২৭ মার্চ ঘোষণা শোনার সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশে এবং বাংলাদেশের বাইরে যারা ছিল, তাদের মধ্যে যে একটা প্রচণ্ড উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়, সে সম্পর্কে কারও সন্দেহ থাকার কথা নয়।’ প্রশ্ন হলো এ কে খন্দকার সাহেবের বক্তব্য অনেকটাই উচ্চ আদালতের রায়ের পরিপন্থী। এ জন্য কি তার বিচার হবে? আলোচ্য গ্রন্থটিতে আরও অনেক চমকপ্রদ তথ্য আছে। কলেবর বড় হবে বলে এ লেখায় সেগুলো উদ্ধৃত করা হলো না। একই কারণে ড. কামাল হোসেনের লেখা থেকেও উদ্ধৃতি দিলাম না। এ কে খন্দকার, মঈদুল হাসান এবং এস আর মীর্জা এরা প্রত্যেকেই মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট। কাজেই এদের বক্তব্যের একটা মূল্য আছে বৈকি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেমনটি দাবি করেছেন যে বঙ্গবন্ধু আগেই লন্ডনে বসে মুক্তিযুদ্ধের সব পরিকল্পনা ঠিক করে এসেছিলেন—কথাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এটিকে গুরুত্বের সঙ্গেই নেয়া উচিত। এ বক্তব্য থেকে যেসব প্রশ্ন উঠে আসে তাহলো শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডনে কাদের সঙ্গে বসে মুক্তিযুদ্ধের সব পরিকল্পনা ঠিক করে এসেছিলেন। তাজউদ্দীন সাহেবরা কি তার কোনো অংশীদার? ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে তাজউদ্দীন সাহেব যখন ২৫ মার্চ রাত ৯টার দিকে বিদায় নিয়ে চলে আসেন তখন তার প্রতি শেখ মুজিবুর রহমানের কী নির্দেশ ছিল? আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দাবি উড়িয়ে দিতে চাই না। মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা হিসেবে তিনি তো তার পিতার অনেক কর্মকাণ্ডেরই সাক্ষাত্ বহন করতে পারেন। তবে লন্ডন পরিকল্পনাটি যখন অকাট্য সাক্ষ্য-প্রমাণসহ জাতির কাছে প্রকাশ পাবে তখন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অনেক অজানা তথ্য উদ্ঘাটিত হবে। এখন এগুলো নিয়ে কেবল আঁচ-অনুমান করা চলে। এটি অত্যন্ত শুভলক্ষণ যে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণিকা আকারে হলেও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সূত্রগুলো ক্রমান্বয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। একটি নতুন রাষ্ট্রের উদ্ভব প্রক্রিয়া সঠিকভাবে উদ্ঘাটন ইতিহাসের অমূল্য রত্ন উদ্ধারের মতোই মূল্যবান হবে।
লেখক : অধ্যাপক, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
গত সপ্তাহে জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার কর্নেল (অব.) শওকত আলীর একটি ঐতিহাসিক উক্তি সম্পর্কে লিখেছিলাম। তার এ উক্তি ইতিহাসকে কুয়াশার চাদরের ভেতর থেকে ঝলমলে সূর্যালোকের দিকে নিয়ে আসতে প্রভূতভাবে সাহায্য করবে। যারা বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস রচনা করতে আগ্রহী তারা কিঞ্চিত্ হলেও সাহসী হয়ে উঠবেন। তিনি বলেছেন, ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মিথ্যা ছিল না।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে দেশকে পাকিস্তানিদের হাত থেকে মুক্ত করতে।’ কী ছিল সেই সশস্ত্র বিপ্লবের উদ্যোগ? একজন প্রতিবাদী ছাত্রনেতা হিসেবে তত্কালীন সময়ের রাজনীতির অন্তরালের রাজনীতি সম্পর্কে অনেক কথাই শুনতে পেতাম। ১৯৬৭ সালেই শোনা গিয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানকে হত্যার উদ্দেশ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম বিমানের একটি ফ্লাইট বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা এবং অতঃপর পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণার কথা। সে সময় এ গল্পটি নিছক গুজব বলেই মনে হয়েছিল। যখন পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রুজু করে, তখন এ রকম একটি কথাই ঢাকার রাজনৈতিক মহলে ফিসফাস করে বলা হচ্ছিল। আজ বহু বছর পর এ গুজবের যে একটি ভিত্তি ছিল তার ঐতিহাসিক সাক্ষাত্ পাওয়া যাচ্ছে। Stanley wolpert দক্ষিণ এশীয় ইতিহাসের একজন নামকরা বিশেষজ্ঞ। তিনি একসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশীয় ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন। দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসের ওপর তিনি অনেক নিবিড় গবেষণা সমৃদ্ধ প্রামাণ্য ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেছেন। গান্ধী, নেহরু, জিন্না সম্পর্কে তার রচিত গ্রন্থগুলো পণ্ডিত মহলে সমাদৃত হয়েছে। তিনি পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টো সম্পর্কেও একটি নিবিড় গবেষণাসমৃদ্ধ গ্রন্থ রচনা করেছেন। গ্রন্থটি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশ করেছে। গ্রন্থটির নাম Zulfi Bhutto of PakistanÑHis life and times. এই গ্রন্থের ১১৫ পৃষ্ঠায় আইয়ুব খানকে হত্যা চেষ্টার একটি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। উলপার্ট লিখেছেন, 'Ayub was almost kidnapped, nearly assassinated, during his presidential tour of East Pakistan in December. Zulfi wrote to 'warn' the foreign secretary at that time that India was determined to 'dismember' Pakistan. Ayub now feared that Mujibur Rahman was India's leading agent in Dacca, and that the Awami League was but an East Bengali branch of Indira Gandhi's congress Party. More of Mujib's supporters were arrested in December 1967, and thirty two Bengali members of his party were soon to be charged with helping him to 'treacherously conspire' with India against Pakistan. উলপার্টের উদ্ধৃতিতে শেখ মুজিবুর রহমানের দলের ৩২ জন বাঙালি সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়েরের কথা বলা হয়েছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় এরকম সংখ্যক অভিযুক্তই ছিল। এখন কর্নেল (অব.) শওকত আলী সাহেব যদি এ পরিকল্পনাটি সম্পর্কে কোনো আলোকপাত করেন তাহলে উলপার্ট প্রদত্ত তথ্য সম্পর্কে আরও নিশ্চিত হওয়া যেতে পারে। উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনার সরকার স্টেনলি উলপার্টকে দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর একটি প্রামাণ্য জীবনীগ্রন্থ রচনার উদ্যোগ নিয়েছিল। উলপার্ট এ ব্যাপারে আলোচনার জন্য ঢাকায় এসেছিলেনও। কিন্তু অজানা কারণে সেই প্রয়াস থেমে যায়। হয়তো উলপার্ট ফরমায়েশি কিছু লিখতে সম্মত হননি। উলপার্ট যে ধাঁচের ঐতিহাসিক তাতে তাকে দিয়ে কারও মনসই ইতিহাস লেখানো সম্ভব নয়। শোনা যায়, তত্কালীন শেখ হাসিনা সরকারের অর্থমন্ত্রী মরহুম শাহ এএমএস কিবরিয়া উলপার্টকে দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রামাণ্য জীবনীগ্রন্থ রচনা করানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে জাতীয় সংসদে যখন দুর্ভাগ্যজনক কটূ-কাটব্য চলছে, ঠিক তখনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের আলোকিত করতে কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রদান করেছেন। গত ৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ উপলক্ষে আয়োজিত এক সেমিনারে সভাপতির বক্তব্যে শেখ হাসিনা বলেছেন, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। কারণ সেটা করা হলে দেশ কোনোদিন স্বাধীন হতো না। আমাদের মুক্তির সংগ্রাম বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে পরিচিতি পেত। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আসত না। তিনি বলেন, তবে সেটা ২৫ মার্চ রাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিয়ে যান। এ নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার এই ঘোষণা ইপিআরের ওয়ারল্যাসের মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল বলে তিনি উল্লেখ করেন। ... শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু আগেই লন্ডনে বসে মুক্তিযুদ্ধের সব পরিকল্পনা ঠিক করে এসেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘নির্বাচন হবে, আমরা বিজয় অর্জন করব, আমাদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে না, মুক্তিযুদ্ধ হবে, আমরা বিজয় অর্জন করব, বাংলাদেশ স্বাধীন হবে’ [সূত্র : আমার দেশ ৬ মার্চ ২০১০]। হাতের কাছে অন্য পত্রিকা নেই বলে আমার দেশকে বাধ্য হয়ে সূত্র হিসেবে ব্যবহার করছি। অন্য কোনো পত্রিকা হাতের কাছে থাকলে সেগুলোকেই সূত্র হিসেবে উল্লেখ করতাম। কারণ, আমার দেশকে শাসকদলের লোকেরা পছন্দ করে না। তবে মনে হয় এ রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমার দেশ বিভ্রান্তিকর কোনো রিপোর্ট করেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বক্তব্যের সঙ্গে আমি অন্তত একমত। তিনি যথার্থই বলেছেন, স্বাধীনতার ঘোষণা যদি শেখ মুজিবুর রহমান আগেই দিয়ে ফেলতেন, তাহলে বিচ্ছিন্নতাবাদের দায় তার কাঁধে বর্তাতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তরকালে পৃথিবীতে বহু স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে। এর কোনোটি তার একটি অঞ্চল বিচ্ছিন্ন হয়ে যাক তা কখনোই মেনে নেয়নি এবং আজও মেনে নেয় না। নাইজেরিয়ায় বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রয়াসের পরিণতি সম্পর্কে আমরা জানি। অতি সম্প্রতি শ্রীলঙ্কায় তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদ সামরিকভাবে পরাস্ত হয়েছে। আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে পারস্পরিক ভূ-খণ্ডগত সংহতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত এবং সর্বদা অনুসরণীয় একটি নীতি। সেদিক থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য অনুযায়ী ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা না দিয়ে কৌসুলী ভূমিকা পালন করেছেন। তবে ২৫ মার্চ রাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে ইপিআরের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে তার স্বাধীনতা ঘোষণার দাবি বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকেনি। এ প্রসঙ্গে ঔ. ঘ. উরীরঃ যিনি সর্বপ্রথম ১৭ জানুয়ারি ১৯৭২ বাংলাদেশে ভারতের ডিপ্লোমেটিক মিশন চালু করেন, তিনি তার বিখ্যাত গ্রন্থ Liberation and Beyond- Indo-Bangladesh Relations-এ লিখেছেন, Mujib went under-ground some time around midnight on March 25. A pre-recorded broad-cast by him declaring East Pakistan as a newly independent Country called Bangladesh went on the air from a clandestine radio station established by the Awami League at Rangpur and Rajshahi districts in the north-western part of the country. Simultenuously the battalion commander of the East Bengal Regiment at Chittagong, Major Ziaur Rahman (who become President of Bangladesh in 1976-77), briefly captured the Chittagong radio station and broadcast a declaration announcing the establishment of free Bangladesh and appealing to all Bengali military and para-military personnel to resist the Pakistan Army. In fact, Ziaur Rahman's broadcast came a little earlier than Mujib's broadcast. He was the first Bengali military officer of the Pakistan army to declare his loyality to the new country [müÎ] J. N. Dixit, Liberation and Beyond, পৃষ্ঠা-৪২]।
দীক্ষিতের ভাষ্যমতে, শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষণাটি এসেছিল রংপুর ও রাজশাহী জেলার গোপন বেতার কেন্দ্র থেকে। এই বেতার কেন্দ্র স্থাপন করেছিল আওয়ামী লীগ; কিন্তু এই ভাষ্যে ইপিআরের ওয়্যারলেসের কোনো উল্লেখ নেই। দীক্ষিত এ কথাও উল্লেখ করেছেন যে মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণা দিয়েছেন। দীক্ষিত এটাও উল্লেখ করেছেন যে জিয়াউর রহমানের বেতার ঘোষণা শেখ মুজিবুর রহমানের বেতার ঘোষণার কিছু আগে এসেছিল। সুতরাং জিয়াউর রহমানকে অস্বীকার করার উপায় নেই। দীক্ষিতের বক্তব্যে বিতর্কের একটি ভিন্নমাত্রা দেখা যাচ্ছে। সেটা হলো শেখ মুজিবের ঘোষণাটি কোন মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছিল! ইপিআরের ওয়্যারলেস না রংপুর রাজশাহীতে আওয়ামী লীগ স্থাপিত গোপন বেতার কেন্দ্রে? তবে আজ পর্যন্ত রংপুর-রাজশাহীর আওয়ামী লীগ নেতাদের তরফ থেকে এ ধরনের কোনো প্রকাশ্য দাবি করা হয়নি। ইতিহাস গবেষকদের জন্য আরও একটি রহস্য উদ্ঘাটনের দায়িত্ব এসে গেল।
সম্প্রতি প্রথমা প্রকাশন কর্তৃক প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর কথোপকথন গ্রন্থে মূল ধারা-৭১ গ্রন্থের প্রণেতা মঈদুল হাসান বলেছেন, “তাজউদ্দীন আহমদের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি যখন তাঁকে বললেন, ‘মুজিব ভাই, এটা আপনাকে বলে যেতেই হবে, কেননা কালকে কী হবে, আমাদের সবাইকে যদি গ্রেফতার করে নিয়ে যায়, তাহলে কেউ জানবে না কী তাদের করতে হবে।’ এই ঘোষণা কোনো না কোনো জায়গা থেকে কপি করে আমরা জানাব। যদি বেতার মারফত কিছু করা যায়, তাহলে সেটাই করা হবে। শেখ সাহেব তখন উত্তর দিয়েছিলেন, ‘এটা আমার বিরুদ্ধে দলিল হয়ে থাকবে। এর জন্য পাকিস্তানিরা আমাকে দেশদ্রোহের জন্য বিচার করতে পারবে।’ এ কথার পিঠে তাজউদ্দীন অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে রাত ৯টার পর পরই ৩২ নম্বর ছেড়ে চলে যান।” বক্তব্য অব্যাহত রেখে তিনি আরও বলেন, ‘সিগন্যালসই কোনো বাহিনীর আত্মরক্ষার ও আক্রমণের মূল যোগাযোগ মাধ্যম। আর ইপিআর ছিল মিশ্র বাহিনী। এই বাহিনীতে অনেক অবাঙালিও ছিলেন। সেখানে তো তাঁদের বাদ দিয়ে সন্দেহের পাত্র বাঙালিদের হাতে সিগন্যালস থাকতে পারে না। কাজেই ইপিআর সিগন্যালসের মাধ্যমে শেখ সাহেব স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠিয়েছিলেন—এটা বোধহয় অবাস্তব কথা।’ একই গ্রন্থে বর্তমান পরিকল্পনামন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ কে খন্দকার বলেছেন, ‘আমি এ কথা একটু আগেও বলেছি যে, শুধু আমার ঢাকায় অবস্থানকালেই নয়, গোটা মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল ধরেই কিন্তু এ ঘোষণা নিয়ে কোনো বিভ্রান্তি বা কোনো মতবিভেদ আমরা শুনিনি। আমি আগে বলেছি যে মেজর জিয়া কীভাবে এ ঘোষণাটি ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে পড়েছিলেন। যে কথাটা এখন আমি বলতে চাই তা হচ্ছে, এ ঘোষণা নিয়ে যে বিভ্রান্তি, সেই বিভ্রান্তির খুব একটা মূল্য নেই এ জন্য যে, এ ঘোষণা কখন হয়েছিল, কে দিয়েছিল, কোথায় দিয়েছিল—সেটার অপেক্ষা না করে স্বাধীনতা যুদ্ধ কিন্তু শুরু হয়ে গিয়েছিল ২৫ মার্চ রাতেই। তবে জিয়ার ২৭ মার্চ ঘোষণা শোনার সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশে এবং বাংলাদেশের বাইরে যারা ছিল, তাদের মধ্যে যে একটা প্রচণ্ড উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়, সে সম্পর্কে কারও সন্দেহ থাকার কথা নয়।’ প্রশ্ন হলো এ কে খন্দকার সাহেবের বক্তব্য অনেকটাই উচ্চ আদালতের রায়ের পরিপন্থী। এ জন্য কি তার বিচার হবে? আলোচ্য গ্রন্থটিতে আরও অনেক চমকপ্রদ তথ্য আছে। কলেবর বড় হবে বলে এ লেখায় সেগুলো উদ্ধৃত করা হলো না। একই কারণে ড. কামাল হোসেনের লেখা থেকেও উদ্ধৃতি দিলাম না। এ কে খন্দকার, মঈদুল হাসান এবং এস আর মীর্জা এরা প্রত্যেকেই মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট। কাজেই এদের বক্তব্যের একটা মূল্য আছে বৈকি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেমনটি দাবি করেছেন যে বঙ্গবন্ধু আগেই লন্ডনে বসে মুক্তিযুদ্ধের সব পরিকল্পনা ঠিক করে এসেছিলেন—কথাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এটিকে গুরুত্বের সঙ্গেই নেয়া উচিত। এ বক্তব্য থেকে যেসব প্রশ্ন উঠে আসে তাহলো শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডনে কাদের সঙ্গে বসে মুক্তিযুদ্ধের সব পরিকল্পনা ঠিক করে এসেছিলেন। তাজউদ্দীন সাহেবরা কি তার কোনো অংশীদার? ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে তাজউদ্দীন সাহেব যখন ২৫ মার্চ রাত ৯টার দিকে বিদায় নিয়ে চলে আসেন তখন তার প্রতি শেখ মুজিবুর রহমানের কী নির্দেশ ছিল? আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দাবি উড়িয়ে দিতে চাই না। মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা হিসেবে তিনি তো তার পিতার অনেক কর্মকাণ্ডেরই সাক্ষাত্ বহন করতে পারেন। তবে লন্ডন পরিকল্পনাটি যখন অকাট্য সাক্ষ্য-প্রমাণসহ জাতির কাছে প্রকাশ পাবে তখন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অনেক অজানা তথ্য উদ্ঘাটিত হবে। এখন এগুলো নিয়ে কেবল আঁচ-অনুমান করা চলে। এটি অত্যন্ত শুভলক্ষণ যে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণিকা আকারে হলেও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সূত্রগুলো ক্রমান্বয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। একটি নতুন রাষ্ট্রের উদ্ভব প্রক্রিয়া সঠিকভাবে উদ্ঘাটন ইতিহাসের অমূল্য রত্ন উদ্ধারের মতোই মূল্যবান হবে।
লেখক : অধ্যাপক, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments