জীবনধারার স্রোত by আতাউর রহমান
মানুষের বাসনা, কামনা ও আকাঙ্ক্ষা অনিঃশেষ, যদিও মানুষের পার্থিব অভিযাত্রায় এক সময় যতি পড়ে যায়। মানুষ অতীতকে দেখতে চায় মনশ্চক্ষে, তেমনি ভবিষ্যতে পৃথিবীর চেহারাটা কী হবে সেটার প্রতিবিম্ব দেখতে চায় হৃদয়ের আয়নায়। এমন একটি টাইম মেশিন থাকলে ভালো হতো, যাকে ফাস্ট ফরোয়ার্ড ও রিওয়াইন্ড করা যেত ইচ্ছানুযায়ী।
ইতিহাস পড়ে ও শিল্পীর আঁকা ছবি থেকে আমরা অতীত সম্পর্কে বেশকিছু জানতে পারি। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ছড়ানো-ছিটানো স্থাপনাও অতীতের পরিচয়বহ। এভাবে আমরা মিসরীয়, ব্যাবিলনীয়ান, অ্যাসেরিয়ান, মায়া, সিন্ধু সভ্যতাসহ অনেক সভ্যতার কথা জানতে পারি। সে জানা কিন্তু আমাদের সম্পূর্ণ তৃপ্ত করে না, অসম্ভব হলেও আমরা সেদিনের জীবিত মানুষের সাক্ষাত্ পেতে চাই। মমিতো জীবন্ত মানুষগুলোর আচরণ কেমন ছিল তা বলে দেয় না। ইতিহাস যা বলে তা সম্পূর্ণ সত্য নয়। ইতিহাস ৫০ বছরের খতিয়ান রাখতে হিমশিম খেয়ে যায়। কত বিকৃতি ঘটে হাজার হাজার বছরের পুরনো ইতিহাসে, সে কারণেই সঠিক প্রতিফলনের পরিবর্তে প্রতিস্মরণও ঘটে। অতীত ও ভবিষ্যেক দেখার বাসনা যেমন থাকে কবির ও শিল্পীর, তেমনি থাকে সাধারণ মানুষেরও। মানুষ অতীত ও ভবিষ্যত্ দর্শনে দূরগামী হতে চায়। সে জন্য বরিশাল, কলকাতা এবং মাত্র কয়েকদিনের জন্য দিল্লীবাসী কবি জীবনানন্দ দাস মনোলোকে পৃথিবীর পথে পথে ঘুরে বেড়ান, সিংহল সমুদ্র থেকে নিয়ে মহামতি অশোকের ও বিম্বিসারের ধূসর জগতে ঘুরে বেড়ান, মালয় সাগরে না গিয়েও মালয় সাগরে ঘুরে বেড়ান। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে দেশকে অতিক্রম করে বিদেশে পাড়ি দিতে গেয়ে ওঠেন—‘ভুবন ভ্রমিয়া শেষে আমি এসেছি নতুন দেশে, আমি অতিথি তোমারি দ্বারে ওগো বিদেশিনী।’ সাগরে কোনো কালে না ভেসেও জুলেভার্ন লিখে ফেলেন ‘টুয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সি’-এর মতো মনোরম গ্রন্থ। এ গ্রন্থের ‘নটিলস’ ডুবোজাহাজের মডেলে পরবর্তী সময়ে আণবিক শক্তিসম্পন্ন ডুবোজাহাজের ধারণাটি বিজ্ঞানীরা পান। বয়সের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে মানুষের মন পেছনে ফিরে তাকাতে চায় এবং আশ্চর্যজনকভাবে স্মৃতিও প্রখর হয়ে ওঠে। সব যেন সেদিন ঘটে গেছে, যেন স্পষ্ট দেখা যায়। যৌবনে যেমন অনাগত সুদূরের স্বপ্ন মানুষকে বিমোহিত করে, পরিপকস্ফ বয়সে অতীতের স্বপ্ন মানুষের কল্পনাকে সিক্ত করে। মনে হয় যে দিনটি গেছে, সে একেবারে যায়নি, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে। আমাদের দেশের বাড়ির চারদিকে ছোট খালের মতো জলাশয় ছিল, তখনকার দিনে অনেকের বাড়িতে তাই থাকত। নোয়াখালীর ভাষায় আমরা বলতাম গড়। সেখানে আমরা হাতছিপ ফেলে মাছ ধরতাম। সেই গড়েই আমি আমার এক ভাইয়ের সাহায্যে আবিষ্কার করলাম যে মা-শোল বা মা-টাকি মাছের সঙ্গে একঝাঁক পোনা ঘুরে বেড়ায়। টাকির পোনার রং হয় ছাই-নীল রংয়ের ওপর হলদেটে ট্রাইপ এবং শোলের পোনা হতো ছাই-কালোর উপর লালচে ট্রাইপ। এই ক্ষুদ্র আবিষ্কারের কথা মনে হলে এখনও পুলকিত বোধ করি। পুকুরে হাতছিপ ফেলেও আমরা মাছ ধরতাম। পুঁটি মাছ প্রচুর ধরা পড়ত। তার মধ্যে ক্ষুদ্রতম পুঁটি, যা তিতিল পুঁটি নামে পরিচিত, সেটাই বেশি ধরা পড়ত। লেজের ওপর ছোট ছেলে বা মেয়ের কপালের কাছের কোনাটিতে মায়ের হাতে আঁকা কালো টিপের মতো একটি টিপ আছে। আজকের দিনের মায়েরাও এভাবে শিশু পুত্র-কন্যার কপাল কোনায় কালো টিপ দিয়ে তাদের কুদৃষ্টি থেকে রক্ষায় প্রবৃত্ত হন। এসবই আমাকে আন্দোলিত করে। বাজারে সেই তিতিল পুঁটি মাছ দেখলে থমকে দাঁড়াই। বড় কাজল টিপ দিয়ে শিশুকে মায়ের কোলে দেখলে ভালো করে দেখার চেষ্টা করি। আমার কাছে এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জিনিসই জীবন রসের সঞ্জীবনী সুধা বলে মনে হয়। মনে মনে বলি, ‘অসংখ্যবন্ধন মাঝে মহানন্দময় লভিব মুক্তির স্বাদ।’ অনেক সময় সামান্য কথা, সামান্য ঘটনা জীবনের বড় পুরস্কার মনে হয়। আমার নাতি সাঁতার কাটা শিখছিল। ওর মা বলে দিয়েছে ও বাসায় গিয়ে খাবে। আমি ভাবলাম সাঁতার শিক্ষারত অবস্থায় ওকে একটু দেখে আসি। তখন বেলা ১১টা। আমাকে দেখেই খাওয়ার অর্ডার দিতে বলল। বাসায় ওর মা জিজ্ঞেস করল নাস্তা খেয়ে সাঁতার কাটতে গেছ, এত তাড়াতাড়ি তোমার ক্ষিধে পেল কেন। উত্তর, সংক্ষিপ্ত। নানাকে দেখে ক্ষিধে পেয়ে গেল। স্যামুয়েল বেকেটের ‘ওয়েটিং ফর গডো’ নাটকের কথা মনে পড়ে গেল। নাটকের চরিত্র ডিডি বলে, মি. গডো আসছেন, তিনি তার ঘোড়ার উদ্দেশে হাঁক ছাড়ছেন। আরেক চরিত্র গগো বলল, আমার ক্ষিধে পেয়েছে। শুনে হাতা-মাথা কিছুই বোঝা যায় না। ইংরেজিতে একটি প্রবচন আছে—টু ইট লাইক হর্স। ঘোড়ার সঙ্গে ক্ষিধের সম্পর্কটা এভাবে স্থাপিত হলো। আমার নাতি হয়তো অবচেতন মনে আমাকে ‘ঘোড়া’ হিসেবেই দেখেছে। ১৭৪৪ সালে প্রয়াত কবি আলেকজান্ডার পোপকে আমার চেনার কথা নয়, কারণ আমি সাহিত্যের ছাত্র ছিলাম না। আমার এক মামা ইংরেজি ভাষায় খুব ভালো বলতে ও লিখতে পারতেন। তাকে বন্ধু-বান্ধবরা দেশীয় আলেকজান্ডার পোপ বলে ডাকতেন। অন্তর্গত ভাবনার জগতে মানুষে মানুষে কোনো বিভেদ নেই। যখন রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা। সেখানে আলেকজান্ডার পোপ বলছেন—
Happy the man, whose wish and care
A few paternal acres bound
Content to breathe his native air
In his own ground.
অতীতের স্মৃতি, বর্তমানের জীবনযাপন ও ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়েই আমাদের জীবন ধারার স্রোত প্রবাহিত। তাই ধন্য আমাদের ক্ষণস্থায়ী জীবন। এভাবেই মৃত্যু জীবনের কাছে হেরে যায়।
লেখক : অভিনেতা, নাট্যনির্দেশক
Happy the man, whose wish and care
A few paternal acres bound
Content to breathe his native air
In his own ground.
অতীতের স্মৃতি, বর্তমানের জীবনযাপন ও ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়েই আমাদের জীবন ধারার স্রোত প্রবাহিত। তাই ধন্য আমাদের ক্ষণস্থায়ী জীবন। এভাবেই মৃত্যু জীবনের কাছে হেরে যায়।
লেখক : অভিনেতা, নাট্যনির্দেশক
No comments