তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা-বিকল্প নিয়েও সংলাপে রাজি বিএনপি by শফিক সাফি
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে বিএনপি সর্বাত্মক আন্দোলনের প্রস্তুতি নিলেও বিকল্প কোনো পদ্ধতি নিয়ে আলোচনার সম্ভাবনাও নাকচ করে দিচ্ছেন না দলটির নেতারা। তাঁরা বলছেন, নির্বাচনকালীন একদলীয় বা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছাড়াও সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে না এমন কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব পেলে তাতে সাড়া দিতে প্রস্তুত বিএনপি।
তবে বিএনপির পক্ষ থেকে আগ বাড়িয়ে কোনো প্রস্তাব দেওয়া হবে না।প্রধান বিরোধী দলের বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা জানান, বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব পেলে তা সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করবে বিএনপি। একজন নেতা বলেন, 'অনেকেই আগামী নির্বাচন নিয়ে বিকল্প প্রস্তাবের কথা বলছেন। আমরা বলব, সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো পদ্ধতি যদি আনা হয়, সে ক্ষেত্রে বিএনপির তাতে কোনো আপত্তি থাকবে না।'
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আগেও বলেছি, এখনো বলছি, আলোচনা ছাড়া কোনো সমস্যার সমাধান হয় না। সরকার যে সমস্যার সৃষ্টি করেছে, এর সমাধান তাদেরই করতে হবে। সে ক্ষেত্রে যদি তাদের জেনারেল সেক্রেটারি বা সিনিয়র কোনো নেতা আমাদের নেতাদের সঙ্গে বসে এ বিষয়ে আলোচনা করেন, তাহলে সমাধানের একটি পথ বেরিয়ে আসবে।'
মাহবুবুর রহমান আরো বলেন, 'সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে না এমন কোনো পদ্ধতি নিয়ে আমরা আলোচনায় প্রস্তুত। সে ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনর্বহাল না করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার বা অন্তর্বর্তী সরকার, যে নামেই হোক, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু সরকারকে আগেই নিশ্চিত করতে হবে তাদের অধীনে নয়, নিরপেক্ষ মানুষের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।'
বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, 'অনেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প প্রস্তাব দিচ্ছেন। অনেকে আবার বলেন, বিএনপি কেন তাদের প্রস্তাব দেয় না। সরকার চাইলে বিএনপি নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের প্রস্তাব দিতে পারে। কিন্তু তাতে লাভ কী? তারা যদি সে প্রস্তাব গ্রহণ না করে? সে জন্য আমরা বলেছি, তাদের দুই-তৃতীয়াংশ মেজরিটি রয়েছে, তারা যেকোনো বিষয় সংসদে পাস করতে পারবে।'
কঠিন চ্যালেঞ্জ : খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটাতে হিমশিম খাচ্ছে বিএনপি। এ ছাড়া বিভিন্ন মামলায় দলের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার সাজা হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। এ পরিস্থিতির মধ্যেও আন্দোলনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবি আদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে প্রধান বিরোধী দল।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ের আন্দোলনকে চূড়ান্ত রূপ দিতে হবে এক বছরের মধ্যেই। না হলে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের (অন্তর্বর্তী) অধীনেই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাওয়া বা না যাওয়ার ফাঁদে পড়তে হবে বিএনপিকে। এরই মধ্যে সরকারকে দুই দফা আলটিমেটাম দিয়ে এখন শিথিল কর্মসূচিতেই রয়েছে দলটি। একই সঙ্গে মামলার জালে রয়েছেন দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, তাঁর বড় ছেলে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোসহ দলের বিপুলসংখ্যক নেতা। সাজাপ্রাপ্ত হয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে আগামী নির্বাচন থেকে দূরে থাকতে হতে পারে।
এ পরিস্থিতিতে নানা কৌশল নিয়ে এগোচ্ছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। এসবের মধ্যে আছে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন জোরদার করা এবং এ নিয়ে আলোচনার পথও খোলা রাখা, বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশকে পক্ষে টেনে তাদের দিয়ে সরকারের ওপর চাপ দেওয়ানো, সেই সঙ্গে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া। দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা জনমুখী একটি রাজনৈতিক দল। তাই আমাদের যেমন আন্দোলনের প্রস্তুতি রয়েছে, তেমনি নির্বাচনেরও প্রস্তুতি রয়েছে। একই সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতাও থাকবে।' এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচনে কারা দলের মনোনয়ন পাবেন, তাঁদের তালিকা চূড়ান্ত করার কাজ চলছে। এরই মধ্যে এ নিয়ে বৈঠক করেছেন দলের কয়েকজন নেতা।
সাংগঠনিক দুর্বলতা ও কোন্দলের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান বলেন, 'দলের ভেতরে কোন্দল রয়েছে; কিন্তু তা আন্দোলনে প্রভাব ফেলবে না।' সরকার বিএনপির দাবি মেনে আলোচনার প্রস্তাব দেবে এবং তা সফল হবে বলে তিনি মনে করেন।
মামলা নিয়ে শঙ্কা : মামলা-মোকদ্দমা নিয়েও শঙ্কিত বিএনপির হাই কমান্ড। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং বর্তমান সরকারের আমলে খালেদা জিয়াসহ তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা হয় ২৫টি। এগুলোর মধ্যে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে পাঁচটি, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ১৪টি, কোকোর বিরুদ্ধে পাঁচটি এবং তারেকের স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমানের বিরুদ্ধে একটি মামলা রয়েছে। খালেদা জিয়া তাঁর বিরুদ্ধে করা পাঁচটি মামলায়ই জামিনে আছেন। চারটি মামলা হাইকোর্টের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে।
এদিকে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধ, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, দশ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান, কিবরিয়া হত্যা, অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর ঘটনার মামলায় কারাগারে আছেন বিএনপির কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা। তাঁরা হলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, বিএনপি নেতা ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, দলের ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, নাসির উদ্দিন আহম্মেদ পিন্টু প্রমুখ।
ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, সরকার কৌশলে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে আগামী নির্বাচনে অযোগ্য করার পাঁয়তারা করছে।
No comments