মুম্বাই হামলা-ফাঁসিতে জীবন শেষ কাসাবের
ঘড়িতে তখন সকাল ৭টা ৪৬ মিনিট। ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রসচিব, গোয়েন্দা সংস্থা আইবি ও এনএসএর প্রধানের কাছে একযোগে একটি বার্তা পৌঁছাল, 'অপারেশন এক্স সফল হয়েছে।' অর্থাৎ মুম্বাই হামলার একমাত্র জীবিত আসামি আজমল আমির কাসাব (২৫) আর নেই।
তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে।মহারাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আর আর পাতিল সাংবাদিকদের জানান, গতকাল বুধবার সকাল ৭টা ৩০ মিনিটের দিকে পুনের ইয়েরওয়ারা জেলের ভেতর ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো হয় পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার (এলইটি) সদস্য আজমল কাসাবকে। পরে তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করেন চিকিৎসক। পরিবারের পক্ষ থেকে লাশ নিতে না চাওয়ায় তাঁকে কবরও দেওয়া হয়েছে ওই জেলের ভেতরই। এই ফাঁসি প্রক্রিয়ার সাংকেতিক নাম দেওয়া হয়েছিল 'অপারেশন এক্স'।
জেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ফাঁসিতে ঝোলানোর আগে কাসাবের কাছে শেষ ইচ্ছের কথা জানতে চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ কোনো ইচ্ছের কথা ব্যক্ত করেননি কাসাব। ফাঁসির মঞ্চে নেওয়ার সময় কাসাবকে কিছুটা নার্ভাস দেখালেও ছিলেন বেশ শান্ত।
২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাইয়ের তাজ হোটেল ও রেলস্টেশনসহ কয়েকটি স্থানে হামলা চালায় লস্কর-ই-তৈয়বার জঙ্গিরা। অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে গোটা মুম্বাই শহর। প্রায় ৫০ ঘণ্টা ধরে ভারতীয় সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী ছাড়াও বিশেষ ফোর্স অভিযান চালিয়ে এদের হাত থেকে মুম্বাই নগরীকে মুক্ত করে। এতে অন্তত ১৬৬ জন নিহত হয়। নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে কাসাব ছাড়া বাকি সব হামলাকারী অর্থাৎ ৯ জঙ্গি গুলিতে মারা যায়। আহত অবস্থায় ধরা পড়েন কাসাব। ৯ সহযোগীসহ কাসাব সমুদ্রপথে করাচি থেকে মুম্বাই এসে এ হামলা চালিয়েছিলেন।
মুম্বাই রেলস্টেশনে হামলায় অংশ নিয়ে ৫০ জনকে হত্যা, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই ছাড়াও ৮০টি অভিযোগে কাসাব দোষী সাব্যস্ত হন আদালতে। ২০১০ সালের মে মাসে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তাঁর মৃত্যু কার্যকর করার আদেশ দেন মুম্বাইয়ের বিশেষ আদালত। পরে কাসাব ন্যায়বিচার পাননি দাবি করে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন। গত আগস্ট মাসে তাঁর আবেদন খারিজ করে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট।
পরে গত ৫ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে আবেদন করেন কাসাব। কিন্তু সেই আবেদন খারিজ করে দেন রাষ্ট্রপতি। এরপর কঠোর গোপনীয়তা ও নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে মুম্বাইয়ের আর্থার রোডের জেল থেকে মহারাষ্ট্রের পুনের ইয়েরওয়ারা জেলে নেওয়া হয় কাসাবকে। সেখানেই গতকাল ফাঁসি দেওয়া হলো তাঁকে।
ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীল কুমার শিন্দে গণমাধ্যমকে জানান, কাসাবের স্বজনরা লাশ নিতে অস্বীকার করায় পুনের ইয়েরওয়ারা জেলেই তাঁকে কবর দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তান সরকারকে গোটা বিষয়টি ফ্যাঙ্ করে জানানো হয়েছে। গত চার বছরে কাসাবের পেছনে ভারত সরকারকে অন্তত ৪০ কোটি রুপি খরচ করতে হয়েছে। এসব অর্থ তার নিরাপত্তা, আইনজীবী নিয়োগ, খাওয়াদাওয়া এবং ওষুধপত্রে ব্যয় হয়েছে।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ বলেছেন, যাবতীয় সরকারি আইনবিধি মেনেই কাসাবের ফাঁসির প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে।
মহারাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আর আর পাতিল বলেন, ৭ নভেম্বর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ফাঁসির ফাইলে স্বাক্ষর করে তাঁর কাছে পাঠান। কাসাবের ফাঁসির পর পরই মহারাষ্ট্রজুড়ে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে।
এদিকে কাসাবের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পরই রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে রাজধানী দিল্লি, কলকাতা ও চেন্নাইয়েও। প্রায় সব সীমান্তেই নজরদারি বাড়িয়েছে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। কোস্টগার্ড সদস্যরাও সতর্ক রয়েছে জলসীমান্তে।
মুম্বাইয়ে হামলার এক ভিডিওতে কাসাবকে পিঠে ব্যাগ বেঁধে একে-৪৭ রাইফেল হাতে মুম্বাইয়ের প্রধান রেলস্টেশনে হাঁটতে দেখা যায়। হামলায় ওই স্টেশনে অন্তত ৬০ জন সাধারণ মানুষ নিহত হন।
হামলায় নিহত এলিটফোর্সের অফিসার বিজয় সালেসকরের স্ত্রী স্মিতা সালেসকর ও মেয়ে ববি সালেসকর গতকাল প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে জানান, কাসাবের মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা ঘরে পূজা বন্ধ রাখার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। গত চার বছর তাঁরা যোগ দেননি কোনো সামাজিক উৎসবেও। টেলিভিশনে কাসাবের মৃত্যুর খবর পেয়ে বন্ধ করে রাখা ঠাকুরঘর খুলে পূজা দিয়েছেন বলে জানান স্মিতা।
হামলায় নিহত আশরাফ হোসেনের বোন আজিরুন্নেসা বিবি জানান, সেই দিন তাঁর দাদা শিবাজি ছত্রপতি স্টেশনে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যার টিফিন করছিলেন। সেই সময় বৃষ্টির মতো গুলি লাগে তাঁর শরীরে। এ ঘটনার পর তাঁর বাবা বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছেন। কাসাবের মৃত্যু তাঁর দাদার আত্মার শান্তি আনবে।
ওই দিন গুলিবিদ্ধ হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করেছিলেন মারুতি ফড়ে। তিনি জানান, শরীরের পঙ্গুত্ব থেকে কোনো দিনই মুক্ত হব না। কিন্তু কাসাবের ফাঁসি হয়েছে শুনে মনের মধ্যে যে পঙ্গুত্ব ছিল, সেটি মুক্ত হলো আজ।
এদিকে ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর কাসাবকে 'বীর' হিসেবে আখ্যায়িত করেছে পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বা। কাসাবের মৃত্যু অন্যদের আরো হামলা চালাতে অনুপ্রাণিত করবে বলে ওই সংগঠনের জ্যেষ্ঠ কমান্ডার মন্তব্য করেন। পাকিস্তানের তালেবানের পক্ষ থেকে কাসাবের ফাঁসিকে 'দুঃখজনক' হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তালেবানের মুখপাত্র এহসানুল্লাহ বলেন, 'সন্দেহাতীতভাবে এটা খুবই দুঃখজনক খবর। ভারতের মাটিতে একজন মুসলমানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া একটা বড় ক্ষতি।'
No comments