ভরে গেল পুকুর, ডুবে গেলেন যুবরাজ by সানি সরকার
সাগর নয়, দেশের সবচেয়ে বড় পুকুর, যার চারপাশ বাহারি গাছগাছালিতে পরিপূর্ণ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা এই পুকুরের নাম রামসাগর। রামসাগর
শুধুমাত্র একটি পুকুর নয়। একে ঘিরে রয়েছে কিংবদন্তি উপাখ্যান। তবে
ঐতিহাসিক ও উপাখ্যান নিয়ে বিতর্ক থাকলেও রামসাগরে এলে নিশ্চিত ভ্রমণ
পিপাসুদের মন জুড়িয়ে যাবে। তাইতো দেশ-বিদেশের ভ্রমণকারীদের কাছে অন্যতম
আকর্ষণীয় স্থান রামসাগর।
পিকনিক স্পট ও বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে
ব্যবহৃত রামসাগর আজ নানা সমস্যায় জর্জরিত। খাবার পানির সংকট, নিরাপত্তার
অভাবতো রয়েছেই এখানে। পাশাপাশি স্থানীয় প্রভাবশালীদের রামরাজ্যে পরিণত
হয়েছে এই রামসাগর। সেই সঙ্গে গত ৪ বছর আগে নেওয়া উন্নয়ন পরিকল্পনা
ফাইলবন্দি অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
এক নজরে রামসাগর:
দিনাজপুর জেলা সদরের ৮ কিলোমিটার উত্তরে রামসাগর অবস্থিত। রামসাগরের মোট আয়তন ৪ লাখ ৩৭ হাজার ৩১ মিটার। দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৩১ মিটার ও প্রস্থ ৩৬৪ মিটার। রামসাগরের গভীরতা প্রায় ১০ মিটার। নিচ থেকে পাড়ের উচ্চতা ১৩.৫ মিটার।
নামকরণ:
রামসাগরের নামকরণ নিয়ে ভিন্ন মত রয়েছে। এর মধ্যে লোকমুখে প্রচলিত রয়েছে, দিনাজপুরের রাজা প্রাণনাথের একমাত্র ছেলে যুবরাজ রামনাথ যৌবনে পদার্পন করার সময় রাজ্যে শুরু হয় অনাবৃষ্টি। রোদের প্রচণ্ড তাপে ও খরায় ফসল উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। ফলে না খেয়ে মারা পড়েন অনেক প্রজা। রাজভাণ্ডার থেকে খাদ্য সরবরাহ করা হলেও দেখা দেয় পানির সংকট। রাজা প্রাণনাথ প্রজাদের দুঃখ লাঘব করতে একটি পুকুর খনন শুরু করেন। হাজার হাজার শ্রমিক ১৫ দিন পরিশ্রম করে বিশাল এক পুকুর খনন করেন। কিন্তু প্রচুর গভীরতা থাকা সত্ত্বেও পুকুরে এলোনা পানি। এমন সময় রাজা স্বপ্নাদেশ পেলেন যে তার যুবরাজ রামকে পুকুরে বলি দিলে পানি উঠবে। একথা জানতে পেরে যুবরাজ রাম প্রজাদের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ দিতে প্রস্তুত হন। যুবরাজের নির্দেশে পুকুরের মাঝখানে নির্মাণ করা হয় মন্দির। একদিন যুবরাজ হাতির পিঠে চরে পুকুরের উদ্দেশে নিজের জীবন উৎসর্গ দিতে বের হন। পুকুর পাড়ে পৌঁছে যুবরাজ রাম সিঁড়ি বেয়ে ওই মন্দিরে নেমে যান। সঙ্গে সঙ্গে নিচ থেকে পানি উঠে ভরে যায় পুকুর আর ডুবে যান যুবরাজ। অলৌকিকভাবে পানিতে ভেসে থাকলো শুধু যুবরাজের সোনার মুকুটটি। সেই থেকে পুকুরের নামকরণ করা হলো রামসাগর।
এদিকে, ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, ১৭৫০ সালে দিনাজপুরের রাজা রামনাথ পুকুরটি খনন করেন। তার নামানুসারেরই পুকুরের নামকরণ করা হয় রামসাগর।
রামসাগরের আকর্ষণ: রামসাগরের চারপাশের পাড়জুড়ে রয়েছে অসংখ্য গাছগাছালি। পুকুর/দীঘির চারপাশের প্রায় আড়াই কিলোমিটার সড়কের দুই ধারে লাগানো হয়েছে দেবদারু, ঝাউ ও মুছকন্দ ফুলের গাছ। পুকুরের পানি কিছুটা নীলাভ বর্ণের। পুকুরের চারপাশে চারটি ঘাট থাকলেও বর্তমানে দু’টি ঘাটই ব্যবহারযোগ্য। বাকি দু’টির মধ্যে একটির অস্তিত্ব প্রায় বিলীনের পথে।
রামসাগরে সাতটি পিকনিক স্পট, একটি মিনি চিড়িয়াখানা ও একটি আধুনিক দ্বিতল ডাকবাংলো রয়েছে। এতে চিড়িয়াখানা শুধু কয়েকটি হরিণ ও ঈগল রয়েছে।
রামসাগরের মধ্যে ২ একর জমির উপর রয়েছে একটি শিশুপার্ক। বাগানসমৃদ্ধ শিশুপার্কের ভেতরে দোলনা, নাগরদোলা রয়েছে। এছাড়া জিরাফ, বন মানুষ, ভাল্লুক, হাতি, মাছসহ প্রায় ২০টি প্রাণীর প্রমাণ সাইজ প্রতিকৃতি রয়েছে এখানে। আরও রয়েছে বেশকিছু খেলার সামগ্রী।
রামসাগরের ভেতরে রয়েছে বিভিন্ন ফুলের গাছ। পুকুরে রয়েছে শাপলা। মাঝে মধ্যে দেখা যায় পানকৌড়ি ও বেলেহাসও।
কিছুদূর পরপর রয়েছে সুদৃশ্য ছাতাবিশিষ্ট বসার স্থান আর কৃত্রিমভাবে তৈরি টিলা। সব মিলিয়ে এক নয়নাভিরাম দৃশ্য। এখানে একটি মন্দির ও নামাজ পড়ার জন্য একটি মসজিদ রয়েছে। প্রতিবছর এখানে বারুনী স্নান মেলা বসে।
মন্দির:
রামসাগরের উত্তর দিকে পাড়ের পাশে রয়েছে একটি ভাঙাচোরা মন্দির। তবে কারো কারো মতে এটি ছিল রাজ পরিবারের বিশ্রামাগার।
রামসাগর পাঠাগার:
রামসাগরের ভেতরে রয়েছে একটি পাঠাগার। যেখানে দিনাজপুরের রামসাগরসহ বিভিন্ন বিষয়ের বই রয়েছে। যে কেউ এখানে গিয়ে বই পড়তে পারেন।
প্রকল্প: ২০০৮ সালে রামসাগরের উন্নয়নের জন্য ঝুলন্ত সেতু, ডরমিটরি, পানির উপর ভাসমান ক্যাফেটেরিয়া, ছোট ট্রেন স্থাপনসহ বেশকিছু পরিকল্পনা করা হয়। ৬ কোটি টাকার এ উন্নয়ন পরিকল্পনা বর্তমানে ফাইলবন্দি অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে প্রায় ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত রাজস্ব আয় হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে, গত ২০১১ সালে জাতীয় উদ্যান ও দিনাজপুর পর্যটন প্রকল্প নামে ১৬ কোটি টাকার একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। সেটিও ফাইলবন্দি অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
জাতীয় উদ্যান: ১৯৬০ সালে রামসাগর বনবিভাগের আওতায় আনা হয়। ১৯৯৫-৯৬ সালে সরকার এটিকে আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলে। ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল তৎকালীন সরকার রামসাগরকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা দেয়।
রামসাগরে প্রবেশ ও থাকা-খাওয়া:
রামসাগরে প্রবেশ ফি ৫ টাকা। এর ভেতরে ঘুরতে আর কোনো টাকা লাগে না। তবে রামসাগরের ভেতরে শিশুপার্কে যেতে ১০ টাকা মূল্যের টিকিট কাটতে হয়।
থাকার জন্য রয়েছে একটি ডাকবাংলো। তবে ডাকবাংলোয় থাকতে হলে বনবিভাগ কিংবা জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিতে হয়। এখানে এসি রুমে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ভাড়া ৫০০ ও নন এসি ৩০০ টাকা এবং সম্পূর্ণ বিশ্রামাগারের ভাড়া ২৫০০ টাকা।
আর বেসরকারি দেশীয় পর্যটকদের জন্য এসি রুমের ভাড়া ১০০০ টাকা, ননএসি রুমের ভাড়া ৭০০ টাকা ও সম্পূর্ণ ৩৫০০ টাকা এবং বিদেশিদের জন্য এসি রুমের ভাড়া ১৫০০ টাকা, ননএসি রুমের ভাড়া ১০০০ টাকা ও সম্পূর্ণ বিশ্রামাগারের ভাড়া ৫০০০ টাকা। তবে এখানে খাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। ডাকবাংলোর সামনে রয়েছে কিছু দোকান। এগুলোতে হালকা খাবার পাওয়া যায়। তবে রামসাগরের বাইরে কিছু হোটেল রয়েছে যেগুলোতে খাওয়ার সুব্যবস্থা রয়েছে।
রামসাগরে আসার ব্যবস্থা:
ঢাকা থেকে দিনাজপুরে সড়কপথ কিংবা রেলপথে আসা যায়। ঢাকা থেকে সড়কপথে কোচ সার্ভিসে ভাড়া পড়বে ৩০০ থেকে ৪৫০ টাকা আর রেলপথে আসতে হলে আন্তtনগর ট্রেনে আসতে হবে। ভাড়া পড়বে শোভন ১৮০ টাকা, চেয়ার ২৫০ টাকা। দিনাজপুর শহর থেকে রামসাগরে যাওয়ার জন্য কোনো বাস সার্ভিস নেই। রিকশা ও লক্কর ঝক্কর টেম্পুই একমাত্র ভরসা। ভাড়া পড়বে ৩০/৪০ টাকার মতো।
সমস্যা: বরাদ্দের অভাবে দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় পিকনিক কর্নারগুলো ও বসার স্থানগুলোর অবস্থা এমনই যে সেখানে বসা সম্ভব নয়। দীর্ঘদিন ধরে টয়লেটগুলো মেরামত না করায় সেগুলো ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। ডাকবাংলোর পাশে ছাড়া রামসাগরের ভেতর নেই খাবার পানির ব্যবস্থা। পর্যটকদের জন্য রামসাগরের অভ্যন্তরে ক্যাফেটেরিয়া রয়েছে, তবে এটি ৪ বছর ধরে খোলা হয় না।
ক্যাফেটেরিয়ার ভেতরে ও পাশে চলে মাদক সেবন। গাছের ঘন ঝোপের মধ্যে চোখে পড়ে ফেনসিডিল খোরদের আড্ডা।
এছাড়া রামসাগরের পুকুর পাড় ও শিশুপার্কটি যেন প্রেমিক-প্রেমিকাদের অসামাজিক কার্যকলাপের স্থান। আর বহিরাগত প্রেমিক যুগল বা মাদক সেবীদের যেকোনো অবৈধ কাজের সুযোগ করে দেয় বখাটে ছেলেরা। বিনিময়ে তাদের দিতে হয় কাছ থেকে একশ’ থেকে দেড়শ’ টাকা।
রামসাগরের বাউন্ডারি ওয়াল নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে বাইরে থেকে অনায়াসে ভেতরে ঢোকা যায়, ভাঙা প্রাচীর ভেদ করে এখানে একটি রাস্তা তৈরি হয়েছে। যে রাস্তা দিয়ে বিভিন্ন লোকজন চলাফেরা করেন। এতে উদ্যানের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। যা জাতীয় উদ্যানের পরিপন্থি। ওই রাস্তা দিয়ে প্রবেশ করে স্থানীয়রা রামসাগরের পানিতে বাসন মাজা, গোসল, গরু-ছাগলকে গোসল করিয়ে থাকেন। এতে এর পানি নষ্ট হচ্ছে।
নিরাপত্তার অভাব: রামসাগরের ভেতরে রয়েছে নিরাপত্তার যথেষ্ট অভাব। ফলে প্রায়ই এখানে দর্শনার্থীরা চুরি ও ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছেন। নিরাপত্তার দায়িত্বে কয়েকজন পুলিশ সদস্য থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
রামসাগর এলাকার দোকান মালিক ও পর্যটকদের রয়েছে শত অভিযোগ। রামসাগরের ভেতরে ছোট-বড় ১৪টি দোকান রয়েছে। এসব দোকানদারের কাছ থেকে কোনো প্রকার রশিদ ছাড়াই প্রতিদিন ২০ টাকা করে ভাড়া নেয় স্থানীয় প্রভাশালী একটি মহল।
রামসাগরে প্রবেশের জন্য টিকিট নেওয়া হলেও এলাকার কিছু বখাটে টিকিট ছাড়াই ভেতরে যাতায়াত করেন। তাদের দ্বারা রামসাগরে বেড়াতে আসা পর্যটকরা হয়রানির শিকার হন।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য:
রামসাগরের তত্ত্বাবধায়ক আব্দুস সালাম তুহিন জানান, রামসাগরের ভেতরে অসামাজিক কার্যকলাপ হলেও করার কিছুই নেই। তাদের কিছু বলতে গেলে তারা হুমকি দেন। অনেকবার এ ব্যাপারে অভিযোগ দেওয়া হলেও কোনো কাজ হয়নি।
টয়লেট ও বসার স্থানগুলো মেরামত ও সংস্কারের ব্যাপারে তিনি বলেন, রামসাগরের বিভিন্ন স্থান সংস্কারের জন্য পর্যটন মন্ত্রণালয়ে বারবার যোগাযোগ করা হয়েছে। কিন্তু কোনো ফল হয়নি।
তিনি জানান, দোকানদারদের কাছ থেকে কে কীভাবে অর্থ আদায় করে তা তার জানা নেই।
এদিকে, তিনি আরও জানান, তবে রামসাগরে দ্বৈত্য প্রশাসন কাজ করছে। রামসাগরের জল জেলা প্রশাসনের আওতায়। কিন্তু জেলা প্রশাসন তা তদারকি করে না। প্রতিদিন এখান থেকে মাছ চুরি হয়ে যাচ্ছে।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, এমন কিছু লেখেন যাতে বনবিভাগ আমাকে এখান থেকে অন্যত্র বদলি করে দেয়। এতো যন্ত্রণা সহ্য করার মতো নয়।
এক নজরে রামসাগর:
দিনাজপুর জেলা সদরের ৮ কিলোমিটার উত্তরে রামসাগর অবস্থিত। রামসাগরের মোট আয়তন ৪ লাখ ৩৭ হাজার ৩১ মিটার। দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৩১ মিটার ও প্রস্থ ৩৬৪ মিটার। রামসাগরের গভীরতা প্রায় ১০ মিটার। নিচ থেকে পাড়ের উচ্চতা ১৩.৫ মিটার।
নামকরণ:
রামসাগরের নামকরণ নিয়ে ভিন্ন মত রয়েছে। এর মধ্যে লোকমুখে প্রচলিত রয়েছে, দিনাজপুরের রাজা প্রাণনাথের একমাত্র ছেলে যুবরাজ রামনাথ যৌবনে পদার্পন করার সময় রাজ্যে শুরু হয় অনাবৃষ্টি। রোদের প্রচণ্ড তাপে ও খরায় ফসল উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। ফলে না খেয়ে মারা পড়েন অনেক প্রজা। রাজভাণ্ডার থেকে খাদ্য সরবরাহ করা হলেও দেখা দেয় পানির সংকট। রাজা প্রাণনাথ প্রজাদের দুঃখ লাঘব করতে একটি পুকুর খনন শুরু করেন। হাজার হাজার শ্রমিক ১৫ দিন পরিশ্রম করে বিশাল এক পুকুর খনন করেন। কিন্তু প্রচুর গভীরতা থাকা সত্ত্বেও পুকুরে এলোনা পানি। এমন সময় রাজা স্বপ্নাদেশ পেলেন যে তার যুবরাজ রামকে পুকুরে বলি দিলে পানি উঠবে। একথা জানতে পেরে যুবরাজ রাম প্রজাদের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ দিতে প্রস্তুত হন। যুবরাজের নির্দেশে পুকুরের মাঝখানে নির্মাণ করা হয় মন্দির। একদিন যুবরাজ হাতির পিঠে চরে পুকুরের উদ্দেশে নিজের জীবন উৎসর্গ দিতে বের হন। পুকুর পাড়ে পৌঁছে যুবরাজ রাম সিঁড়ি বেয়ে ওই মন্দিরে নেমে যান। সঙ্গে সঙ্গে নিচ থেকে পানি উঠে ভরে যায় পুকুর আর ডুবে যান যুবরাজ। অলৌকিকভাবে পানিতে ভেসে থাকলো শুধু যুবরাজের সোনার মুকুটটি। সেই থেকে পুকুরের নামকরণ করা হলো রামসাগর।
এদিকে, ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, ১৭৫০ সালে দিনাজপুরের রাজা রামনাথ পুকুরটি খনন করেন। তার নামানুসারেরই পুকুরের নামকরণ করা হয় রামসাগর।
রামসাগরের আকর্ষণ: রামসাগরের চারপাশের পাড়জুড়ে রয়েছে অসংখ্য গাছগাছালি। পুকুর/দীঘির চারপাশের প্রায় আড়াই কিলোমিটার সড়কের দুই ধারে লাগানো হয়েছে দেবদারু, ঝাউ ও মুছকন্দ ফুলের গাছ। পুকুরের পানি কিছুটা নীলাভ বর্ণের। পুকুরের চারপাশে চারটি ঘাট থাকলেও বর্তমানে দু’টি ঘাটই ব্যবহারযোগ্য। বাকি দু’টির মধ্যে একটির অস্তিত্ব প্রায় বিলীনের পথে।
রামসাগরে সাতটি পিকনিক স্পট, একটি মিনি চিড়িয়াখানা ও একটি আধুনিক দ্বিতল ডাকবাংলো রয়েছে। এতে চিড়িয়াখানা শুধু কয়েকটি হরিণ ও ঈগল রয়েছে।
রামসাগরের মধ্যে ২ একর জমির উপর রয়েছে একটি শিশুপার্ক। বাগানসমৃদ্ধ শিশুপার্কের ভেতরে দোলনা, নাগরদোলা রয়েছে। এছাড়া জিরাফ, বন মানুষ, ভাল্লুক, হাতি, মাছসহ প্রায় ২০টি প্রাণীর প্রমাণ সাইজ প্রতিকৃতি রয়েছে এখানে। আরও রয়েছে বেশকিছু খেলার সামগ্রী।
রামসাগরের ভেতরে রয়েছে বিভিন্ন ফুলের গাছ। পুকুরে রয়েছে শাপলা। মাঝে মধ্যে দেখা যায় পানকৌড়ি ও বেলেহাসও।
কিছুদূর পরপর রয়েছে সুদৃশ্য ছাতাবিশিষ্ট বসার স্থান আর কৃত্রিমভাবে তৈরি টিলা। সব মিলিয়ে এক নয়নাভিরাম দৃশ্য। এখানে একটি মন্দির ও নামাজ পড়ার জন্য একটি মসজিদ রয়েছে। প্রতিবছর এখানে বারুনী স্নান মেলা বসে।
মন্দির:
রামসাগরের উত্তর দিকে পাড়ের পাশে রয়েছে একটি ভাঙাচোরা মন্দির। তবে কারো কারো মতে এটি ছিল রাজ পরিবারের বিশ্রামাগার।
রামসাগর পাঠাগার:
রামসাগরের ভেতরে রয়েছে একটি পাঠাগার। যেখানে দিনাজপুরের রামসাগরসহ বিভিন্ন বিষয়ের বই রয়েছে। যে কেউ এখানে গিয়ে বই পড়তে পারেন।
প্রকল্প: ২০০৮ সালে রামসাগরের উন্নয়নের জন্য ঝুলন্ত সেতু, ডরমিটরি, পানির উপর ভাসমান ক্যাফেটেরিয়া, ছোট ট্রেন স্থাপনসহ বেশকিছু পরিকল্পনা করা হয়। ৬ কোটি টাকার এ উন্নয়ন পরিকল্পনা বর্তমানে ফাইলবন্দি অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে প্রায় ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত রাজস্ব আয় হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে, গত ২০১১ সালে জাতীয় উদ্যান ও দিনাজপুর পর্যটন প্রকল্প নামে ১৬ কোটি টাকার একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। সেটিও ফাইলবন্দি অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
জাতীয় উদ্যান: ১৯৬০ সালে রামসাগর বনবিভাগের আওতায় আনা হয়। ১৯৯৫-৯৬ সালে সরকার এটিকে আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলে। ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল তৎকালীন সরকার রামসাগরকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা দেয়।
রামসাগরে প্রবেশ ও থাকা-খাওয়া:
রামসাগরে প্রবেশ ফি ৫ টাকা। এর ভেতরে ঘুরতে আর কোনো টাকা লাগে না। তবে রামসাগরের ভেতরে শিশুপার্কে যেতে ১০ টাকা মূল্যের টিকিট কাটতে হয়।
থাকার জন্য রয়েছে একটি ডাকবাংলো। তবে ডাকবাংলোয় থাকতে হলে বনবিভাগ কিংবা জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিতে হয়। এখানে এসি রুমে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ভাড়া ৫০০ ও নন এসি ৩০০ টাকা এবং সম্পূর্ণ বিশ্রামাগারের ভাড়া ২৫০০ টাকা।
আর বেসরকারি দেশীয় পর্যটকদের জন্য এসি রুমের ভাড়া ১০০০ টাকা, ননএসি রুমের ভাড়া ৭০০ টাকা ও সম্পূর্ণ ৩৫০০ টাকা এবং বিদেশিদের জন্য এসি রুমের ভাড়া ১৫০০ টাকা, ননএসি রুমের ভাড়া ১০০০ টাকা ও সম্পূর্ণ বিশ্রামাগারের ভাড়া ৫০০০ টাকা। তবে এখানে খাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। ডাকবাংলোর সামনে রয়েছে কিছু দোকান। এগুলোতে হালকা খাবার পাওয়া যায়। তবে রামসাগরের বাইরে কিছু হোটেল রয়েছে যেগুলোতে খাওয়ার সুব্যবস্থা রয়েছে।
রামসাগরে আসার ব্যবস্থা:
ঢাকা থেকে দিনাজপুরে সড়কপথ কিংবা রেলপথে আসা যায়। ঢাকা থেকে সড়কপথে কোচ সার্ভিসে ভাড়া পড়বে ৩০০ থেকে ৪৫০ টাকা আর রেলপথে আসতে হলে আন্তtনগর ট্রেনে আসতে হবে। ভাড়া পড়বে শোভন ১৮০ টাকা, চেয়ার ২৫০ টাকা। দিনাজপুর শহর থেকে রামসাগরে যাওয়ার জন্য কোনো বাস সার্ভিস নেই। রিকশা ও লক্কর ঝক্কর টেম্পুই একমাত্র ভরসা। ভাড়া পড়বে ৩০/৪০ টাকার মতো।
সমস্যা: বরাদ্দের অভাবে দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় পিকনিক কর্নারগুলো ও বসার স্থানগুলোর অবস্থা এমনই যে সেখানে বসা সম্ভব নয়। দীর্ঘদিন ধরে টয়লেটগুলো মেরামত না করায় সেগুলো ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। ডাকবাংলোর পাশে ছাড়া রামসাগরের ভেতর নেই খাবার পানির ব্যবস্থা। পর্যটকদের জন্য রামসাগরের অভ্যন্তরে ক্যাফেটেরিয়া রয়েছে, তবে এটি ৪ বছর ধরে খোলা হয় না।
ক্যাফেটেরিয়ার ভেতরে ও পাশে চলে মাদক সেবন। গাছের ঘন ঝোপের মধ্যে চোখে পড়ে ফেনসিডিল খোরদের আড্ডা।
এছাড়া রামসাগরের পুকুর পাড় ও শিশুপার্কটি যেন প্রেমিক-প্রেমিকাদের অসামাজিক কার্যকলাপের স্থান। আর বহিরাগত প্রেমিক যুগল বা মাদক সেবীদের যেকোনো অবৈধ কাজের সুযোগ করে দেয় বখাটে ছেলেরা। বিনিময়ে তাদের দিতে হয় কাছ থেকে একশ’ থেকে দেড়শ’ টাকা।
রামসাগরের বাউন্ডারি ওয়াল নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে বাইরে থেকে অনায়াসে ভেতরে ঢোকা যায়, ভাঙা প্রাচীর ভেদ করে এখানে একটি রাস্তা তৈরি হয়েছে। যে রাস্তা দিয়ে বিভিন্ন লোকজন চলাফেরা করেন। এতে উদ্যানের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। যা জাতীয় উদ্যানের পরিপন্থি। ওই রাস্তা দিয়ে প্রবেশ করে স্থানীয়রা রামসাগরের পানিতে বাসন মাজা, গোসল, গরু-ছাগলকে গোসল করিয়ে থাকেন। এতে এর পানি নষ্ট হচ্ছে।
নিরাপত্তার অভাব: রামসাগরের ভেতরে রয়েছে নিরাপত্তার যথেষ্ট অভাব। ফলে প্রায়ই এখানে দর্শনার্থীরা চুরি ও ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছেন। নিরাপত্তার দায়িত্বে কয়েকজন পুলিশ সদস্য থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
রামসাগর এলাকার দোকান মালিক ও পর্যটকদের রয়েছে শত অভিযোগ। রামসাগরের ভেতরে ছোট-বড় ১৪টি দোকান রয়েছে। এসব দোকানদারের কাছ থেকে কোনো প্রকার রশিদ ছাড়াই প্রতিদিন ২০ টাকা করে ভাড়া নেয় স্থানীয় প্রভাশালী একটি মহল।
রামসাগরে প্রবেশের জন্য টিকিট নেওয়া হলেও এলাকার কিছু বখাটে টিকিট ছাড়াই ভেতরে যাতায়াত করেন। তাদের দ্বারা রামসাগরে বেড়াতে আসা পর্যটকরা হয়রানির শিকার হন।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য:
রামসাগরের তত্ত্বাবধায়ক আব্দুস সালাম তুহিন জানান, রামসাগরের ভেতরে অসামাজিক কার্যকলাপ হলেও করার কিছুই নেই। তাদের কিছু বলতে গেলে তারা হুমকি দেন। অনেকবার এ ব্যাপারে অভিযোগ দেওয়া হলেও কোনো কাজ হয়নি।
টয়লেট ও বসার স্থানগুলো মেরামত ও সংস্কারের ব্যাপারে তিনি বলেন, রামসাগরের বিভিন্ন স্থান সংস্কারের জন্য পর্যটন মন্ত্রণালয়ে বারবার যোগাযোগ করা হয়েছে। কিন্তু কোনো ফল হয়নি।
তিনি জানান, দোকানদারদের কাছ থেকে কে কীভাবে অর্থ আদায় করে তা তার জানা নেই।
এদিকে, তিনি আরও জানান, তবে রামসাগরে দ্বৈত্য প্রশাসন কাজ করছে। রামসাগরের জল জেলা প্রশাসনের আওতায়। কিন্তু জেলা প্রশাসন তা তদারকি করে না। প্রতিদিন এখান থেকে মাছ চুরি হয়ে যাচ্ছে।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, এমন কিছু লেখেন যাতে বনবিভাগ আমাকে এখান থেকে অন্যত্র বদলি করে দেয়। এতো যন্ত্রণা সহ্য করার মতো নয়।
No comments