মানব মিলনের উৎসব by আতাউর রহমান
মানুষের জীবনে উৎসবের প্রয়োজন অপরিহার্য। তা না হলে কবেই আমাদের জীবন নিরানন্দময় হয়ে পড়ত। সমাসন্ন ঈদুল ফিতর উদ্যাপনের প্রয়োজনে রাস্তাঘাটে যানজট মাঝে মধ্যে 'তিষ্ঠ-দীর্ঘকাল' হয়ে অনড় দাঁড়িয়ে থাকে, মানুষ হেঁটেও দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে না, তবুও ঈদ করা চাই। প্রিয়জনদের সঙ্গে মিলিত হবার যে আকুতি তা ট্রেন বা বাস টিকিটের সুদীর্ঘ লাইনের ছবি পত্র-পত্রিকায় দেখলেই বোঝা যায়।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, ভয়ানক কষ্ট সাধনের পরে মানুষ সবসময় মিলনমুখী। আমার ধারণায়, ধর্মীয় বিধির পাশাপাশি উৎসব পরকে আপন করে এবং উৎসবকে কেন্দ্র করে যে সব কাছের মানুষের সঙ্গে কদাচিৎ দেখা হয় না তাদের সঙ্গেও দেখা হয়ে যায়। উৎসবের আরেকটি ভালো দিক হলো, সমাজে যে সব মানুষ আজও বিপন্ন, নিরন্ন, দরিদ্র ও অসহায় তাদেরকে উৎসব ক্ষণিকের জন্য হলেও বসত্র ও আহার যুগিয়ে সন্তুষ্ট করে। পাশ্চাত্যের অতিশয় ব্যস্ত ও যান্ত্রিক জীবনে ২৫শে ডিসেম্বরের বড়দিনে আনন্দের সুবাতাস বয়ে আনে, যার জের চলে নববর্ষ পর্যন্ত। একইভাবে দুর্গা পূজা, বুদ্ধ পূর্ণিমা এবং অন্যান্য পূজা-পার্বণ মানুষের একটি মিলনক্ষেত্র তৈরি করে এবং সবাইকে আনন্দযজ্ঞে আমন্ত্রণ জানায়। আমাদের ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহাও ধর্মীয় কর্তব্য পালনের পাশাপাশি মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনক্ষেত্র ও সমভাবের সৃষ্টি করে। অন্তত উৎসবের দিনগুলোতে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে একটা সেতুবন্ধের সৃষ্টি হয়, ধনী ও নির্ধনের মধ্যে বৈষম্যটা কমে যায়। কোনো ধর্মই শ্রেণী বৈষম্যকে প্রশ্রয় দেয় না, ইসলাম ধর্মতো নয়ই। কিন্তু আমরা ধর্মের সেই মানবিক মর্মবাণীকে মূল্য দেই না, আমরা মানুষের সঙ্গে মানুষের হিমালয়সম আর্থিক ও সামাজিক দূরত্ব গড়ে তুলেছি। তবুও ঈদ ও বিভিন্ন ধর্মীয়-সামাজিক উৎসব একদিনের জন্য হলেও সেই দূরত্ব অনেকটা কমিয়ে আনে। কালের যাত্রায় যেমন আমাদের অনেক সামাজিক আচরণের পরিবর্তন হয়েছে তেমনি ঈদ উদ্যাপনের চেহারাও পাল্টে গেছে। ঈদুল ফিতর নামে উৎসবকে আমরা চলতি ভাষায় রোজার ঈদ নামেই বেশি জানি। রোজার ঈদ মুসলমানদের সবচেয়ে বড় উৎসব। এক মাস কৃচ্ছ্রসাধনের পরে ঈদ উৎসবের মধ্য দিয়ে মানুষের রিপু ও কুপ্রবৃত্তিকে সংযত করার পালা সম্পন্ন হয়। আমাদের ছেলেবেলায় যখন স্কুলে পড়ি, এমনকি কলেজে পড়ার সময় ভোর রাতে সেহেরি খাওয়ার জন্য ঝুমুর বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে হামদ ও নাত গেয়ে মানুষকে ঘুম থেকে জাগানোর পদ্ধতি আমাদের কাছে অত্যন্ত রোমাঞ্চকর ও মোহনীয় মনে হতো। পাড়ায়-পাড়ায় এই ঘুম ভাঙানো পালা চলত। প্রত্যেক পাড়ায় এই ধরনের ঘুম-ভাঙানিয়া দল থাকত। কোনো কোনো পাড়ায় 'বস্তি ওয়ালা উঠ', বলে ঘুম-ভাঙানিয়ারা হায়দারী হাঁক দিত। কোনো কোনো পাড়ায় লাঠির আগায় ঝুমঝুমি বেঁধে ছন্দে ছন্দে কবিতার মতো করে আবৃত্তি করে পাড়া-পড়শিদের ঘুম ভাঙানো হতো। কৈশোর ও যৌবনকালে সেহেরি খাওয়ার মধ্যে একটি আনন্দ ছিল। আনন্দের প্রধান কারণ সেহেরিতে বেশিরভাগ বাড়িতে গরু বা খাসির মাংসের আয়োজন থাকত, মাছ খাওয়া হতো না বললেই চলে। মাংস খাওয়ার প্রতি লোভ সবারই ছিল। তখন অত্যধিক গোস্ত ভক্ষণ করার কুফল সম্পর্কে আমরা অবগত ছিলাম না। শরপড়া ঘন গরুর দুধে ডুবিয়ে সবরি কলামিশ্রিত ভাতের মন্ডও আমাদের প্রিয় খাদ্য ছিল। মনে পড়ে, জুন-জুলাই মাসের গরমে দীর্ঘদিনের রোজা রাখতে খুব কষ্ট হতো। আমি নোয়াখালীতে নানার বাড়ির কাছে মাষ্টার দীঘিতে গোছল করতে নেমে পানিতে ডুব দিতে গিয়ে অনিচ্ছাকৃতভাবে দু'একবার পানি খেয়ে ফেলেছি এবং ভয়ে ও লজ্জায় বাবা, মা বা মুরুব্বিদের কাউকে বলিনি। কিন্তু প্রচন্ড অপরাধবোধে ভুগেছি। সারা দিন উপবাসের পর কখন ইফ্তারের সময় হবে, চাতক পাখির মতো সেই মাহেন্দ্রক্ষণটির দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আজানের ধ্বনি শোনার জন্য কান পেতে রাখতাম। তখন মসজিদে মসজিদে মাইক্রোফোন সিসেটম ছিল না। শৈশবে দেখেছি, সবাই ইফতার করে তারাবির নামাজ পড়ে রাতের খাবার খেতেন। তবে ব্যতিক্রম ছিল আমার নানার বাড়িতে মকবুল খাঁর ক্ষেত্রে। যিনি গৃহকাজ করতেন। তিনি মাটির সান্কিভর্তি কোরানো নারকেলমিশ্রিত ভিজা চাল ভাজা খেয়ে কোন বিরতি না দিয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রোজার দিনে রাতের খাবার সেরে নিতেন। উনি মনে করতেন, সেহেরি খাবার জন্য পেটকে দীর্ঘ সময় হজমের জন্য বিরতি দেয়া প্রয়োজন। রোজার ঈদে আমাদের সবচেয়ে আনন্দের বিষয় ছিল নতুন পরিধেয় বসত্র লাভ এবং অনেক সময় নতুন জুতাও। ঈদের দিনে নতুন জুতা পরে পা কেটে যেত, যার ফলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হতো। আমরা অনেকেই জুতোর ভেতরে তুলোর পট্টি লাগিয়ে পা ছিলে যাওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করতাম। আমার মনে আছে, এক ঈদে আমি ঈদের আগের দিন কেনা নতুন জুতা রাতে কোলবালিশের মতো জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছিলাম। আমার পরবর্তী ছোটভাই ঈদুল আজহা বা কোরবানি ঈদে বাসার জন্য গরু বা ছাগল চরাতে খুব ভালোবাসত। রোজার ঈদে ছাগল বা গরু কেনার প্রশ্নই ওঠে না। আমার ছোটভাই হতাশ না হয়ে ঈদের জন্য কেনা মুরগির পা রশি দিয়ে উঠানে চরাবার চেষ্টা করত। কিন্তু পিচ্ছিল মাটির উঠানে মুরগি বা মোরগ হাঁটতে পারত না, পিছলে পড়ে যেত। এমনিভাবে অনেক সুখের ও দুঃখের সমৃতি আমাকে মাঝে মাঝে আন্দোলিত ও বিচলিত করে। আমার শুধু একটি কাম্য, তা হলো উৎসবকে কেন্দ্র করে মানব মিলনের ক্ষেত্রটি যেন বিস্তৃত হয়, এবারের ঈদ যেন নিজের দেশকে ও দেশের মানুষদেরকে ভালোবাসার নতুন প্রেরণা হয়ে ওঠে। লেখক : অভিনেতা ও নাট্যনির্দেশক
No comments