আনন্দমুখর পরিবেশে শারদীয় দুর্গোৎসব শুরু
বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান শারদীয় দুর্গোৎসব আজ আনন্দমুখর পরিবেশে যথাযথ ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে শুরু হচ্ছে। ষষ্ঠী তিথিতে বোধন ও অধিবাসের মধ্য দিয়ে ৫ দিনব্যাপী চলবে দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা। সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীতে যথাবিহীত পূজা-অর্চনার পর বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে ঘটবে দুর্গোৎসবের সমাপ্তি।
বহুকাল ধরে বাংলার জনপদে যথাযথ ধর্মীয় মর্যাদা ও আড়ম্বরের সঙ্গে পালিত হয়ে আসছে শারদীয় দুর্গা পূজা । এবারও এ উপলক্ষে খুশির বন্যা বয়ে যাচ্ছে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরে ঘরে। শহর, বন্দর, গ্রাম-সর্বত্রই চলছে পূজার সাড়ম্বর আয়োজন। বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্য অনুসারে এই উৎসবের আনন্দ ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে। এবার এ আনন্দে যোগ হয়েছে একটি ভিন্নমাত্রা। মুসলমান সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান ঈদুল ফিতর উদযাপনের আমেজ শেষ না হতেই শুরু হয়েছে দুর্গাপূজা। শত সঙ্কটের মধ্যেও সেই মিলিত আনন্দধারায় অবগাহন করছে সব সম্প্রদায়ের মানুষ, আর বাংলাদেশ সেজেছে নতুন সাজে। হিন্দু পুরাণ মতে, শারদীয় দুর্গা পূজাকে বলা হয় জগজ্জননী দুর্গার অকালবোধন। আদি দুর্গা পূজা করেছিলেন রাজা সুরথ সত্যযুগে। উদ্দেশ্য ছিল আদ্যাশক্তি মহামায়াকে তুষ্ট করে হারানো রাজ্য পুনরুদ্ধার। বসন্তকালে সুরথ রাজা দুর্গা পূজা করেছিলেন। সেই থেকে বাসন্তী পূজা নামে দুর্গাপূজার প্রচলন ঘটে। বাসন্তী পূজা অনুষ্ঠিত হয় চৈত্র মাসে। ত্রেতাযুগে রামচন্দ্র অকালে, অর্থাৎ শরৎকালে দুর্গাপূজা করেছিলেন রাবণকে যুদ্ধে পরাজিত করে লঙ্কা থেকে বন্দি সীতাকে উদ্ধার করার মানসে। সে পূজাই পরবর্তীকালে শারদীয় দুর্গা পূজা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় এবং কালক্রমে লাভ করে বাঙালি হিন্দুদের প্রধানতম ধর্মীয় উৎসবের মর্যাদা। দুর্গাপূজার মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে শুভ শক্তির আরাধনা। হিন্দুদের তন্ত্রশাসত্রমতে, সৃষ্টির আদিকারণ হচ্ছেন আদ্যাশক্তি মহামায়া। তিনি দুর্গতিনাশিনী; তাই মা দুর্গা নামে সমধিক পরিচিত। তাঁর কাছে অশুভ শক্তির বিনাশ কামনা এবং সে লক্ষ্যে শুভশক্তি অর্জনের প্রার্থনাই হচ্ছে এ পূজার মূল ভাব। কালক্রমে এ পূজার সঙ্গে যোগ হয়েছে লোকজ সংস্কৃতি। এই সম্মিলন দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতাকে পরিণত করেছে অনন্য এক আনন্দানুষ্ঠানে। আর তার আবহ ধর্মীয়বলয় ছাপিয়ে রচনা করে এক সামাজিক মিলনক্ষেত্র। ফলে আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি রচনার পাশাপাশি সব সম্প্রদায়ের মধ্যে সহমর্মিতা সৃষ্টির পথও প্রশস্ত হয়। এই সহমর্মিতা বোধই দৃশ্যত ধর্মীয় উৎসবের প্রাণসপন্দন। এ মানসিক সম্পদ অর্জন করেই বহু ধর্ম-গোত্রের মিলনস্থল এ জনপদ এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। এই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির শক্তি প্রতিনিয়ত বাংলাদেশকে সুন্দর ভবিষ্যৎ রচনার প্রেরণা যুগিয়ে যাচ্ছে। এবার সেই ধারাবাহিকতায় দুর্গাপূজার শুভ সূচনা হয়েছে। সরকারি-বেসকারি নির্বিশেষে সব মহলের আন্তরিক সহযোগিতায় বরাবরের মতো পূজার শুভ সমাপ্তি ঘটবে-এ প্রত্যাশা সবার। ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মূল কথাই হচ্ছে শুভ শক্তির জয় এবং সমাজের সর্বস্তরে ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রার্থনা। অশুভ শক্তি শুধু বাইরে নয়, আমাদের ভেতরেও বিদ্যমান। এই অশুভকে পরাভূত করতে হবে আগে। সে জন্য চাই আত্মশুদ্ধি। আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে অশুভকে পরাভূত করা না গেলে নিছক আনুষ্ঠানিকতা কোনো তাৎপর্য বহন করে না। আত্মশুদ্ধি ঘটলে স্বভাবতই অধিকারবোধ জন্মায় এবং যে কোনো অশুভ শক্তিকে হটিয়ে শুভ শক্তির জয় নিশ্চিত করা যায়। এই বোধ জাগ্রত হলেই সার্থক হতে পারে শারদীয় দুর্গাপূজার আয়োজন। শারদীয় দুর্গাপূজার এ শুভলগ্নে আমার দেশ-এর পক্ষ থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের সবার জন্য রইল আমাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা।
No comments