রাজনৈতিক অঙ্গনে সংস্কৃতিচর্চা by মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান
গত ১২-০৯-০৯ তারিখে একটি আলোচনা সভায় ডাক পড়েছিল। 'সিনেমাঅলা' নামের একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের আয়োজনে ওই সভার আলোচ্য বিষয় ছিল 'সাংস্কৃতিক অঙ্গনে রাজনীতি চর্চা'। প্রধান অতিথি ছিলেন আসাফ্উদ্দৌলা। আলোচকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন চাষী নজরুল ইসলাম এবং আহমেদ জামান চৌধুরী। তিনজনের কারও বিশদ পরিচিতি দিলাম না-কারণ আমার বিশ্বাস, সংস্কৃতি অঙ্গনের সবার কাছেই তারা স্বনামধন্য।
রাজনৈতিক অঙ্গনের সবার কাছে কিনা তা অবশ্য জানি না। কারণ রাজনীতি অঙ্গনে সংস্কৃতিবান মানুষের সংখ্যা দিন দিনই কর-গণনার মাত্রায় চলে আসছে। যা হোক, আলোচনার জন্য দাঁড়িয়ে প্রথমেই যা বললাম তা হলো, আজকের প্রস্তাবনাটা উল্টে দেয়া প্রয়োজন। এটা হওয়া উচিত 'রাজনৈতিক অঙ্গনে সংস্কৃতি চর্চা' এবং একটা প্রস্তাবও গ্রহণ করা যেতে পারে এই মর্মে যে, সংস্কৃতিবান ব্যক্তি ছাড়া রাজনৈতিক কর্মকান্ডের কোনো নৈতিক অধিকারই কারও থাকবে না। রাজনৈতিক অঙ্গন সংস্কৃতিশূন্য হয়ে যাচ্ছে বলেই-'রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই' এমন একটি অতি লজ্জাকর অনৈতিক বচন চালু হয়ে গেছে। 'ক্ষমতা দখল নীতি'তে শেষ কথা বলে কিছু নাও থাকতে পারে; কিন্তু যে কোনো মূল্যে ক্ষমতা দখলের লোভকে যদি রাজনীতি বলা হয় তাহলে 'রাজনীতি' শব্ধটির বিন্দুমাত্র সম্মানও থাকে কি? আজকাল সৎ ও নির্লোভ রাজনীতিক খোঁজার কথা প্রায়ই শোনা যায়। এর অর্থ অসৎ এবং লোভী রাজনীতিক আছে বলে স্বীকার করে নেয়া। আছে এবং সর্বত্র আছে বলেই সৎ ও নির্লোভ রাজনীতিক খুঁজতে হয়। এর বিপরীতে দেশের অঞ্চলে অঞ্চলে এমন সব ব্যক্তির নাম রাজনীতির সঙ্গে উচ্চারিত হয়, পঞ্চাশ বছর আগে হলে, এ দেশেই তাদের পরিচয় হতো চোর, ডাকাত, খুনি অথবা লম্পট নামে। এইসব কুখ্যাত সন্ত্রাসী রাজনীতির পরিচয়ে জেল থেকে মুক্ত হয়ে যাচ্ছে, মুক্ত হয়ে ফুলের মালাও পরছে। এদের দুর্দিন এলে, দেশ থেকে পালিয়ে অন্য দেশে জামাই আদরে রাজার হালে বসবাসের ব্যবস্থাও আছে। দেশটির নাম ভারত। আমেরিকা যেমন রাষ্ট্রীয় মহাঅপরাধীদের আশ্রয়স্থল-তেমনি ছ্যাঁচড়া জাতীয় সামাজিক অপরাধীদের আশ্রয়স্থল ভারত। মূল প্রস্তাবনায় ফিরি আবার। সংস্কৃতি কী? কোনো দেশ বা জাতি বা জনগোষ্ঠীর বৃহদাংশের সমগ্র জীবনচর্যাই সেই দেশ-জাতি বা জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি। ছোট একটি উদাহরণ দিই। ধরা যাক, একটি অনুষ্ঠান চলছে। হঠাৎ আজানের শব্ধ ভেসে এলো। আমরা তখন কী করি? অনুষ্ঠানটা অন্তত আজান চলাকালীন পর্যন্ত বন্ধ রাখি। আচরণে সংযত হই। মহিলা যারা থাকেন, দেখা যায় তারা মাথায় কাপড় তুলে দিয়েছেন। এটা আমার সংস্কৃতি। এটা আমার ধর্ম নয়। ধর্ম-প্রভাবিত সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতি এ দেশের প্রায় নব্বই শতাংশ মানুষের, যাকে বাদ দিয়ে জাতি হয় না। এই জাতীয় সংস্কৃতিকে যারা অস্বীকার করেন তারা হয় মূর্খ, না হয় গণশত্রু। আমরা জুতা পায়ে দিয়ে যেমন শহীদ মিনারে উঠে যাই না, তেমনি মসজিদ-মাজারেও প্রবেশ করি না। ঈদ উৎসবে আমরা যে শুধু আনন্দ করি তা-ই নয়, পরসপরের সঙ্গে বুকে বুক মিলিয়ে সম্প্রীতি বিনিময় করি। নামাজ আদায়টা আমার ধর্মপালন-বাকিটা সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতি এ দেশের নব্বই শতাংশ মানুষের। সাধারণ মানুষ নিজের স্বভাবেই এই সংস্কৃতি পালন করে চলেছেন। তাই, বিশেষ বিশেষ দিবসে আমরা যখন সংস্কৃতির নামে তাদের অচেনা সব আচার পরিবেশন করি-তখন সেই আচারসহ পরিবেশনকারীদের তারা বিজাতীয় বলেই মনে করেন। প্রকৃতপক্ষেই ওইসব আচার পালনকারী জাতীয় বা গণমানুষের কেউ নয়-তারা ভিন্ন কোনো স্বার্থের সেবাদাস। তাদের সংস্কৃতিচর্চা কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যের লেজুড়বৃত্তি করার জন্য। কোনো কোনো সময়ে ওরা রাজনৈতিক বা সরকারি সমর্থনও পেয়ে যায়। কারণ ওইসব রাজনৈতিক শক্তিও গণমানুষের পক্ষের নয়। তার একটি ছোট্ট উদাহরণ দিয়ে শেষ করব। উদাহরণটি ছোট; কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া সার্বভৌমত্ব বিনষ্টকারী হয়ে উঠতে পারে। আমাদের চোখের সামনেই এখন চলছে 'এশিয়ান হাইওয়ে প্রতারণা'। ভারত থেকে ভারতে যাওয়ার করিডোর কোনো বিচারেই এশিয়ান হাইওয়ে হতে পারে না। এটা কেবলই দাস্যসুখে ভারতকে সুবিধাদান। এটা এ দেশের যে কোনো স্বার্থের সঙ্গে অতি নির্লজ্জ নগ্ন প্রতারণা। এর বিরোধিতাকে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ব্যঙ্গ করেছেন 'জুজুর ভয়' বলে। তিনি বলেছেন, জুজুর ভয়ে তিনি নিরস্ত হবেন না। তা ঠিক, কারণ হুজুর হুকুম দিলে জুজুর ভয় থাকবে কী করে! এডিবি, বিশ্বব্যাংক, আমেরিকা-ইসরাইলের বন্ধু ভারতের স্বার্থে এই করিডোর দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। পদ্মা সেতু নিয়ে ব্লাকমেইলিংয়ের পর্যায়েও নেমে গেছে তাদের নগ্নতা। বাংলাদেশের ক্ষমতার নিয়ন্ত্রক ওইসব শক্তির সঙ্গে ক্ষমতালোভী রাজনীতিকরা বিরোধিতা করতে পারে কি? এদের কাছে যে 'শেষ কথা বলে কিছু নেই'! এখানেই ক্ষমতালোভী রাজনীতিকের সঙ্গে সংস্কৃতিবানদের পার্থক্য। সংস্কৃতিবানদের বিবেক থাকে এবং সেই বিবেকের কাছে দায়বদ্ধতাও থাকে। এই জন্যই রাজনৈতিক অঙ্গনে গণসংস্কৃতির চর্চা এখন অতি আবশ্যক হয়ে উঠেছে।
No comments