বিজেপি কি ক্ষয়িষ্ণু রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হতে চলেছে by আহমেদ জামিল
বর্তমান বিজেপির রাজনৈতিক স্বাস্থ্যের ক্রমাবনতি দেখে মনে হচ্ছে দলটি রাজনৈতিক সোয়াইন ফ্লু ভাইরাসে আক্রান্ত। আর সে জন্যই দলের অন্দরমহল এত টালমাটাল-হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি'র অভ্যন্তরীণ কোন্দলের প্রেক্ষাপটে এ মন্তব্যটি করেছেন অপর কট্টর হিন্দুত্ববাদী দল মহারাষ্ট্রভিত্তিক শিবসেনার সুপ্রিমো বালঠাকরে। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ধারক-বাহক সংঘ পরিবারভুক্ত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিজেপি হচ্ছে প্রধান রাজনৈতিক শক্তি।
সেই সঙ্গে বর্তমান সময়ে কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে প্রধান বিরোধী দল হলো বিজেপি। বেশ কয়েকবার বিজেপির নেতৃত্বে কেন্দ্রে সরকারও গঠিত হয়েছে; কিন্তু ২০০৯সহ লোকসভার নির্বাচনে পরপর দু'বার পরাজিত হওয়ার পর বিজেপিতে শুরু হয়েছে অন্তর্কলহ। নেতৃত্বের কোন্দলের পাশাপাশি চলছে আদর্শিক লড়াই। ইতোমধ্যে দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন এবং পদত্যাগ করেছেন কেন্দ্রীয় পর্যায়ের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা। যে কারণে প্রশ্ন উঠেছে, বিজেপির অস্তিত্ব কি সঙ্কটের মুখে কিংবা বিজেপি কি একটি ক্ষয়িষ্ণু রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হতে যাচ্ছে! ২০০৯ সালের নির্বাচনে প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কংগ্রেসের কাছে শোচনীয়ভাবে হেরে যাওয়ার পর বিজেপিতে নেতৃত্ব ও আদর্শিক সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করে, একপর্যায়ে তা প্রকাশ্য রূপ নেয়। একদিকে কট্টরপন্হী, অন্যদিকে উদারপন্হী ধারা গড়ে উঠেছে বিজেপি নেতৃত্বে। বলা হচ্ছে, কট্টরপন্হী ধারার প্রতিনিধিত্ব করছেন এলকে আদভানি, রাজনাথ সিং, নরেন্দ্রমোদি, সুষমাস্বরাজ, অরুণ জেটলি, অনাথকুমার এবং ভেলকেশ নাইডু। অপরদিকে উদারপন্হী ধারার প্রতিনিধিত্ব করছেন সদ্য বহিষ্কৃত যশবন্ত সিং, যশবন্ত সিন্হা, সুধীন্দ্র নাথ কুলকার্নি এবং অরুণ শৌরি। ইতোমধ্যে তাদের সবাই বিজেপি থেকে হয় বহিষ্কৃত হয়েছেন, না হয় পদত্যাগ করেছেন। আর রাজস্থানে বিজেপির ডাকসাইটে নেত্রী বসুন্ধরা সিন্ধিয়া বিরোধী দলের নেত্রীর পদ থেকে পদত্যাগে অস্বীকৃতি জানিয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে বেশ বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ফেলেছেন। বিজেপি নেতৃত্বের কোন্দল পুরোপুরিভাবে প্রকাশ্য রূপ নেয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা যশবন্ত সিংয়ের বহিষ্কারের প্রেক্ষাপটে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা কায়েদ-ই-আজম মহম্মদ আলী জিন্নাহকে প্রশংসা করে বই লেখার অজুহাতে যশবন্ত সিংকে বহিষ্কার করার কথা কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বললেও, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এর পেছনে অন্য কারণও আবিষ্কার করেছেন। তাদের মতে, সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচনে শোচনীয় ব্যর্থতার জন্য যশবন্ত সিং বিজেপি নেতৃত্ব বিশেষ করে এলকে আদভানি এবং অরুণ জেটলিকে দায়ী করে তাদের প্রকাশ্য সমালোচনা করেন। যে কারণে সিমলা বৈঠকে বিব্রতকর প্রশ্ন এড়ানোর জন্য বিজেপি নেতৃত্ব দ্রুত যশবন্ত সিংকে দল থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা কার্যকর করেন। আর যশবন্ত সিংকে দল থেকে বহিষ্কারের পর বিজেপিতে ভাঙন প্রক্রিয়াও দ্রুতগতিতে শুরু হয়েছে। উদারপন্হী নেতারা যশবন্ত সিংয়ের বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত মেনে নেননি। এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি। যশবন্তের পক্ষে বাজপেয়ি বিবৃতি দেয়ার পরই তার অন্যতম ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত সুধীন্দ্রনাথ কুলকার্নি 'আদর্শগত কারণে' বিজেপি থেকে পদত্যাগ করেন। তার পদাঙ্ক অনুসরণ করেন বিজেপি'র বিশিষ্ট নেতা এবং ইন্ডিয়া টু-ডে'র সাবেক সম্পাদক অরুণ শৌরি। পদত্যাগের ঘোষণা দেয়ার পর তিনি সাংবাদিকদের জানান, বিজেপি এখন 'সুতাবিহীন ঘুড়িতে' পরিণত হয়েছে। তিনি আরএসএসকে বিজেপি'র নেতৃত্ব নেয়ারও আহ্বান জানান। আর এ থেকে একটা বিষয় সপষ্ট যে, সংঘ পরিবারের সবচেয়ে প্রভাবশালী সংগঠন আরএসএসের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে বিজেপির অভ্যন্তরে টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্লেষকদের কারও কারও অভিমত হলো, বিজেপি নেতা এলকে আদভানি ও রাজনাথ সিংয়ের বিরুদ্ধবাদীদের নেপথ্যে মদত দিচ্ছে আরএসএস। আরএসএস নেতা মোহন ভগবত সম্প্রতি বিজেপি নেতাদের বেশি বয়স হয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, তুলনামূলকভাবে কম বয়সী নতুন নেতা বিজেপির জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। বলা বাহুল্য, এই নতুন নেতৃত্ব হবেন আরও কট্টর হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ধারক-বাহক। অন্যদিকে যশবন্ত সিং এবং সুধীন্দ্রনাথ কুলকার্নি বিজেপিকে আরএসএসের রাহু থেকে মুক্ত করতে চেয়েছেন। তারা ভারতের চলমান রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপট উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে, হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির আদর্শ নিয়ে বিজেপি বেশি দূর এগোতে পারবে না। গুজরাটে মুসলিম নিধনযজ্ঞের নায়ক নরেন্দ্রমোদিকে ভবিষ্যৎ নেতা হিসেবে তুলে ধরে বিজেপি সর্বশেষ লোকসভা নির্বাচনে যে সাফল্য প্রত্যাশা করেছিল তা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। গুজরাটের বাইরে সর্বভারতীয় পর্যায়ে নরেন্দ্রমোদির কোনো জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা যে নেই সেটিও প্রমাণিত হয়েছে সর্বশেষ লোকসভা নির্বাচনে। এ নির্বাচনে বিজেপি ও তার সংঘ পরিবারভুক্ত মিত্ররা রামকে রোল মডেল হিসেবে দেখিয়ে যে ফায়দা লুটতে চেয়েছিল, সেটিও ভোটাররা প্রত্যাখ্যান করেছে। নির্বাচনের দিন লোকসভার উত্তর প্রদেশের বাবরি মসজিদের কাছে দাঁড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক তরুণী ভোটার বিবিসিকে বলেছিলেন, রাম তো কোনো ঐতিহাসিক চরিত্র নন, তিনি কীভাবে আমাদের তরুণ প্রজন্মের কাছে আদর্শ পুরুষ হবেন, এ বাস্তব জগতেই আমাদের আদর্শ নেতৃত্বের সন্ধান করতে হবে। সর্বোপরি গুজরাট এবং উড়িষ্যায় মুসলিম ও খ্রিষ্টানবিরোধী দাঙ্গার সঙ্গে বিজেপি ও তার সংঘ পরিবারের মিত্র আরএসএস, বজরং এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদের জড়িত থাকার তথ্য ফাঁস হয়ে গেলে সংখ্যালঘু ভোটাররা বিজেপি'র দিক থেকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে মুখ ফিরিয়ে নেয়। লোকসভা নির্বাচনে তাদের শোচনীয় ভরাডুবি নিশ্চিত হয় এ কারণে। এদিকে গত জুলাই মাসে ১৭ বছর ধরে তদন্ত কাজ শেষ করে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের যে তদন্ত প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের কাছে জমা দেয়া হয়েছে তাতে এলকে আদভানিকে সরাসরি দায়ী না করা হলেও তাতে উমাভারতী এবং প্রবীণ নেতা মুরলি মনোহর যোশিসহ আরও কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ বিজেপি নেতাকে সরাসরি দায়ী করা হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে বলা হচ্ছে, ইতোমধ্যে এলাহাবাদ হাইকোর্ট বাবরি মসজিদ ধ্বংসকান্ডের অভিযোগ থেকে এলকে আদভানিকে অব্যাহতি দিলেও এখনও রায়বেলি এবং লক্ষ্মৌয়ের নিম্নআদালতে তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা জারি রয়েছে। যা হোক, বাবরি মসজিদ ধ্বংসকান্ডের তদন্ত প্রতিবেদন নিঃসন্দেহে বিজেপি নেতৃবৃন্দের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। নেতৃত্বে কারও কারও মধ্যে নতুন উপলব্ধিরও সঞ্চার করেছে। যে কারণে বিজেপিতে শুরু হয়েছে ক্ষমতার পাশাপাশি আদর্শিক লড়াই। উদারপন্হী ও বাস্তববাদী বিজেপি নেতাদের অনেকেই এখন এ সত্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন, সংখ্যালঘু বিশেষ করে বৃহৎ সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের ভোট ছাড়া কোনোভাবেই নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া সম্ভব নয়। যে কারণে বিজেপি'র সদ্য পদত্যাগী নেতা সুধীন্দ্রনাথ কুলকার্নি কোনো রাখঢাক না করে মুসলিম ভোটারদের দল থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার জন্য দলের কট্টরপন্হীদের সরাসরি দায়ী করেছেন। আর হাটে হাঁড়ি ভেঙে যশবন্ত সিং বলেছেন, ২০০২ সালে গুজরাটে মুসলিমবিরোধী দাঙ্গায় ইন্ধনদানের অভিযোগে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্রমোদির বিরুদ্ধে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ী ব্যবস্থা নিতে গেলে তাতে প্রবলভাবে বাধা দিয়েছিলেন এলকে আদভানি। এই উদারপন্হীরা বিজেপিকে সর্বধর্মের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য কট্টর হিন্দুত্ববাদী লাইন পরিহার করে দলের নমনীয় এবং ধর্মনিরপেক্ষ ধাঁচের ইমেজ তৈরির জন্য তৎপর হয়েছে। আর এ উদ্যোগের প্রতি প্রবলভাবে বাধ সেধেছে দলের কট্টরপন্হী অংশ। এ নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বিজেপিতে ক্ষমতা ও আদর্শের লড়াই। এ লড়াইয়ে আপাতত উদারপন্হীরা পর্যুদস্ত হয়েছেন। তবে দল হিসেবে বিজেপি'র শক্তি ও প্রভাব বহুলাংশে খর্ব হয়েছে, যা তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকে আরও অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিহারের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী এবং আরজেডি সুপ্রিমো লালপ্রসাদের মন্তব্যটি যথেষ্ট প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, 'বিজেপি'র বর্তমান সঙ্কট শীর্ষ নেতাদের পাপের ফল। কেননা, বিজেপি নেতাদের উস্কানিতেই বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং গুজরাটে সংঘটিত দাঙ্গায় অনেক নিরপরাধী মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।' লেখক : কলেজ শিক্ষক ও কলাম লেখক
No comments