আমাদের পররাষ্ট্রনীতি ও জাতীয় বাস্তবতা by এবনে গোলাম সামাদ
পত্রিকার খবরে প্রকাশ, বর্তমান বাংলাদেশ সরকার মধ্যম পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করতে যাচ্ছে। যা কিনা হবে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ। আর এই পররাষ্ট্রনীতির আরও একটা লক্ষ্য হবে চীনের ওপর সমরাসেত্রর সরবরাহ নির্ভরতা কমানো। বর্তমান সরকার কেন এভাবে ভাবতে যাচ্ছে আমরা তা জানি না। আমাদের মনে হয়, এ ধরনের চিন্তাধারা বর্তমান বিশ্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতিবহ নয়।
কারণ কেবল আমেরিকা ও রাশিয়া বিশ্ব রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে না। ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটা পৃথক আন্তর্জাতিক জোট হিসেবে সুগঠিত হচ্ছে। আমাদের ভাবতে হবে তার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক রচনার বিয়ষটিকে নিয়েও। এছাড়া চীনের ওপর সমরাসত্র সরবরাহের নির্ভরশীলতা কমাতে গিয়ে আমরা যাতে ভারতের ওপর এক্ষেত্রে নির্ভরশীল না হয়ে পড়ি সে জন্য থাকতে হবে সচেতন। এশিয়াতে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। যার ওপর লক্ষ্য রেখে হতে হবে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারিত। জাপানের বর্তমান নির্বাচনে হারল গণতন্ত্রী দল। ক্ষমতায় এলো উদার গণতান্ত্রিক দল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পাটি (ইংরেজিতে যাকে বলে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি)। তারা ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছে, তাদের পরারষ্ট্রনীতিতে এশিয়া পাবে বিশেষ গুরুত্ব। আর তাদের পরারষ্ট্রনীতি অনুসরণ করবে না আগের মতো মার্কিন স্বার্থকে। এশিয়াতে জাপান হলো সবচেয়ে শক্তিধর দেশ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে সে আছে সবচেয়ে এগিয়ে। সে হলো সবচেয়ে শিল্পোন্নত। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে তাই জাপান এখন বিশেষ গুরুত্ব পাওয়া উচিত। আমাদের চেষ্টা হওয়া উচিত জাপানের সঙ্গে বিশেষ সখ্য সৃষ্টি। জাপান প্রযুক্তি দিয়ে আমাদের যথেষ্ট সাহায্য করতে পারে। সেই প্রযুক্তির সাহায্যে আমরা লাভ করতে পারি অধিক সমৃদ্ধি। জাপান কেবল শিল্পসমৃদ্ধ দেশ নয়, কৃষি অর্থনীতিতে আছে বিশেষভাবে এগিয়ে। এগিয়ে আছে কুটির শিল্পেও। জাপানের কাছ থেকে আমরা পেতে পারি এসব ক্ষেত্রে সঞ্চিত অভিজ্ঞতা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পৃথিবীর রাজনীতি হয়ে পড়েছিল দ্বিমেরুভিত্তিক। একদিকে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অপরদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন। কিন্তু ১৯৯১ সালে ভেঙে পড়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন। বিশ্ব রাজনীতি হয়ে উঠতে চায় একমেরুকেন্দ্রিক। কিন্তু বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পড়েছে ক্ষতিকর অর্থনৈতিক মন্দায়। যার হাত থেকে সে সহজেই নিস্তার পাবে বলে মনে হচ্ছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেকারের সংখ্যা পৌঁঁছে গেছে শতকরা দশ ভাগের কোঠায়। সে আজ ভেতর থেকেই হতে যাচ্ছে দুর্বল। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর রাশিয়ার মধ্যে ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি রচনার চিন্তা হলো বর্তমান পরিস্থিতিতে একেবারেই অবান্তর। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দফতরের নীতিনির্ধারণী চিন্তা ত্রুটিময় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত, যা কিছুটা বহন করতে চাচ্ছে ঠান্ডা লড়াই যুগের ঐতিহ্য (ঈড়ষফ ধিৎ)। কিন্তু বিশ্ব আজ আর ঠান্ডা লড়াইয়ের যুগে পড়ে নেই। মূল প্রশ্ন যেটা উঠছে সেটা হলো বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ। আমাদের পরারষ্ট্রনীতি হতে হবে আমাদের জাতীয় স্বার্থভিত্তিক। কিন্তু আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেন চিহ্নিত করতে পারছেন না আমাদের জাতীয় স্বার্থকেই। তারা যে পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতে চাচ্ছেন তা হলো পররাষ্ট্রনির্ভর পররাষ্ট্রনীতি, স্বদেশনির্ভর পররাষ্ট্রনীতি নয়। কিন্তু এখন হতে হবে স্বদেশনির্ভর পররাষ্ট্রনীতি। জাপানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইউকিও হাতোয়ামা বলেছেন, এতদিন জাপান পরারষ্ট্রনীতিতে নির্ভরশীল ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর। কিন্তু এখন আর সে তা থাকতে চাচ্ছে না। ঘরোয়া রাজনীতিতে তার সরকার গ্রহণ করবে সামাজিক প্রয়োজন বিশ্লেষণ করে বিশেষ কর্মসূচি। তার রাজনীতি হবে সামাজিক প্রয়োজন পূরণের রাজনীতি। জাপানের প্রধানমন্ত্রীর কথার মধ্যেই ফুটে উঠছে কিছুটা বাম রাজনীতির সুর। আমাদের রাজনীতিতে ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু আওয়ামী লীগের মধ্যে এখন নীতিনির্ধারণে দেখা দিয়েছে প্রচন্ড বিশৃঙ্খলা। আওয়ামী লীগের একাংশ পররাষ্ট্রনীতিতে হতে চাচ্ছে ভারত-মার্কিন অক্ষনির্ভর। এই অংশে আছেন প্রধানমন্ত্রী নিজেও। অপর অংশ চাচ্ছে না অতটা ভারত-মার্কিন অক্ষ নির্ভরতা। ক'দিন আগে আমরা দেখলাম দেশের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদের নেতৃত্বে পরিচালিত মিছিলে পুলিশকে লাঠিচার্জ করতে। এমনকি আনু মুহাম্মদের মতো একজন সর্বজনশ্রদ্ধেয় অধ্যাপককে প্রহার করতে বাধল না পুলিশের। আনু মুহাম্মদ ও তার অনুসারীদের অপরাধ দেশের মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ নামমাত্র মূল্যে তারা বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দিতে চাচ্ছেন না। ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগে এখন দেখা দিচ্ছে প্রচন্ড বিভক্তি এবং নীতিনির্ধারণী চিন্তায় বিরাট বিশৃঙ্খলা। তাই প্রশ্ন উঠেছে, এরকম একটি দল কি আর পারে না দেশকে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত করতে? বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার পার্লামেন্টকে অকার্যকর করে তুলেছে। তারা পার্লামেন্টে আলোচনা করছে না তাদের গৃহীত পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে। আলোচনা করছে না দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের সদ্ব্যবহার নিয়ে। অথচ দেশের জনগণ ভেবেছিল, আওয়ামী লীগ সরকার হবে অনেক বেশি গণতন্ত্রী। আর সে তাই পার্লামেন্টে মুক্ত আলোচনার মাধ্যমে গ্রহণ করবে পররাষ্ট্র বিষয়ে এবং দেশের অভ্যন্তরীণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তার নীতি। কিন্তু বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার এই দুই ক্ষেত্রেই করে চলেছে দেশবাসীর সঙ্গে লুকোচিুর খেলা, যা দেশবাসীকে ফেলে দিতে পারে রক্তঝরা সংগ্রামেরই পথে। কিন্তু আমরা চাই না এরকম কিছু ঘটুক। দেশে সংঘাতময় পরিস্থিতি যাতে সৃষ্টি না হয় সে জন্য দরকার আশু আগাম নির্বাচন। যাতে যাচাই হতে পারবে আওয়ামী লীগের জনসমর্থন আছে কিনা। আর নির্ধারিত হতে পারবে কোন দল অথবা জোট জনগণের প্রকৃত আস্থাভাজন। আনু মুহাম্মদকে নির্মমভাবে প্রহার করা হয়েছে। অথচ তিনি যা করেছেন, তাকে বলতে হবে সত্যিকার দেশপ্রেমিকের কাজ। আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদককে বলতে শোনা গেল, যেসব পুলিশ আনু মুহাম্মদকে পিটিয়েছে তারা জামায়াতে ইসলামীর লোক। এটা একটা গুরুতর অভিযোগ। এই অভিযোগের পক্ষে প্রমাণ সরকারকে অবশ্যই দিতে হবে। জামায়াতের ওপর সব দোষ চাপিয়ে রেহাই পাওয়া যাবে না। তাছাড়া পুলিশ, বিডিআর, সেনাবাহিনী সর্বত্রই যদি ঘটে থাকে জামায়াতের অনুপ্রবেশ, তবে তারা তো ইচ্ছা করলে দেশে একটা মারাত্মক অভ্যুত্থান ঘটাতেই পারে। জামায়াতের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে বর্তমান সরকার কি টেনে নিয়ে যেতে যাচ্ছে দেশকে একদলীয় শাসনের দিকে? শেখ মুজিব গঠন করেছিলেন বাকশাল। তার কন্যাও কি ধরবেন পিতার পথ? আমরা চাই না বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত পরিণত হোক একটা সোমালিয়াতে। সোমালিয়াতে মুসলিম মৌলবাদ দমনের নামে এখন চলছে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ। আমরা এরকম কোনো যুদ্ধ দেখতে চাই না আমাদের দেশে। আওয়ামী লীগের একটা অংশ বলছে, বর্তমান সরকারের নীতি হয়ে উঠেছে বড় বেশি মার্কিন-ভারতমুখী। তাদের এই অভিযোগকে মনে হচ্ছে বাস্তবতাভিত্তিক। ভারত-মার্কিন নীতি বাংলাদেশকে একটা সোমালিয়া করে তুলতেই পারে। এ বিষয়ে সাবধান হতে হবে। জামায়াতকে টেনে আনা হচ্ছে একটা ভয়ঙ্কর দুরভিসন্ধিরই পূর্বাভাস।
No comments