একটি প্যারোডি গানের ভূমিকা by মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান
মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী একবার পরিহাসছলেই পিজি হাসপাতালে তাকে দেখতে আসা কয়েকজন নেতাকে বলেছিলেন, 'দেশটারে একটু কম দামে বেচিস, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আবার কিনতে পারে...।' কথাগুলো তিনি বলেছিলেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রসঙ্গে আলাপ করতে করতে। আমার মতো আরও দু'তিনজন যারা নেহায়েতই মওলানা সাহেবকে দেখার জন্য গিয়েছিলাম, তার কথার প্রেক্ষাপট বোঝার মতো প্রজ্ঞা আমাদের ছিল না।
কিন্তু আজ আমরা যখন দেখি ক্ষমতার উদগ্র নেশায় দেশের স্বার্থ তুচ্ছ হয়ে যায়, তখন মওলানা ভাসানীর কথাগুলো মনে পড়ে যায়। একেবারেই জনভিত্তিহীন বিগত তত্ত্বাবধায়ক নামের অবৈধ সরকারের 'চালক শক্তিকে' আমরা দেখেছি ক্ষমতায় পোক্তভাবে অধিষ্ঠিত হওয়ার অপচেষ্টায় বিদেশি নানা অপশক্তির কাছে দেশের স্বার্থ বলি দিতে। আমেরিকা-ইসরাইল-ভারত এই ত্রিকুচক্রী এবং আমেরিকার পোষ্য কিছু ইউরোপীয় দেশের নির্দেশে এমন সব অসম চুক্তি তারা করেছে, যা দেশ বিক্রির চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। ভূমি অধিকার, সীমান্ত রক্ষা, সমুদ্রসীমা, তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ, পানিসম্পদ, করিডোর, বন্দর ব্যবহার, টাস্কফোর্স গঠন ইত্যাকার যাবতীয় বিষয়ে দাসখত লিখে দিয়েও যখন বুঝেছে যে শেষ রক্ষা হবে না, তখন তারা চেয়েছে অন্তত এমন কোনো শক্তির হাতে ক্ষমতা যাক, যারা যতটা সম্ভব দাসত্বের দায় কাঁধে নেবে এবং তাদের আমেরিকায় আশ্রয় গ্রহণকে নিষ্কণ্টক করবে। বিশ্বের যাবতীয় পরাজিত অপশক্তির শেষ ঠিকানা তো আমেরিকা। সে জন্য তাদের আগে থেকেই আমেরিকা-কানেকশন থাকে। ইরানের শাহ, পাকিস্তানের আইয়ুব খান, ফিলিপাইনের মার্কোস-এসব উদাহরণ তো আমাদের আশপাশেই আছে। যাই হোক, এদেশে সমব্যথী শক্তিকে ক্ষমতা হস্তান্তর নির্বাচন প্রহসনের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয়েছে। দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী শক্তি, কোন চাপে সেই প্রহসনে অংশ নিয়েছিল জানি না। তবে তার ফলে সেই প্রহসনকে বৈধতাদানের মতো ভয়ঙ্কর ঘটনাটা ঘটে গেছে। জনগণকে এবং জনগণের পক্ষের শুভ শক্তিকে তার খেসারত দিতে হবে বহুদিন ধরে। সম্প্রতি প্রফেসর আনু মুহাম্মদের দুই পা ভেঙে দেয়াসহ অর্ধশতাধিক মানুষকে আহত করা-সেই খেসারতেরই একটি। তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব আনু মুহাম্মদ। এই কমিটি মহাজোট বা চারদলীয় জোট, কারোরই প্রতিপক্ষ শক্তি নয়, জনস্বার্থের পক্ষের শক্তি। এই শক্তির বিরুদ্ধে যে সরকার পুলিশকে লাঠিয়াল বানিয়ে পাঠায়, সে সরকার যে জনস্বার্থ বিরোধী এবং বিদেশি স্বার্থের কাছে বিক্রীত তা বোঝাতে ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় না। আমাদের ভূখন্ডের বুক চিরে ভারত থেকে ভারতে যাওয়ার করিডোর দেয়া, বন্দর উন্মুক্ত করে দেয়া, ফারাক্কার অশুভ ফল চোখে দেখেও টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের পক্ষে গীত গাওয়া, সমুদ্রসীমা নির্ধারণে ব্যবস্থা না নেয়া, সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর তাঁবেদার করে বিডিআর পুনর্গঠনের চেষ্টা, কয়লা একবারে তুলে বেচেকিনে ফতুর হওয়ার পাঁয়তারা-এ সবই জনস্বার্থবিরোধী, এমনকি সার্বভৌমত্ববিরোধী প্রয়াস। সমুদ্রে তেল-গ্যাস উত্তোলনের বিষয়টি তো আরও জটিল। কারণ, প্রাথমিকভাবে সমুদ্রে গ্যাসক্ষেত্র হিসেবে ২৮টি ব্লকের কথা জানা গিয়েছিল। কিন্তু, সমুদ্রসীমা নিয়ে গায়ের জোরে বিরোধ সৃষ্টি করে প্রধানত ভারত এবং কিছু ক্ষেত্রে মিয়ানমার। আন্তর্জাতিক আইনানুযায়ী এসব দাবি অযৌক্তিক। এই দাবির অসারতা প্রমাণে জাতিসংঘে যাওয়ার কোনো আয়োজনই সরকারের নেই। এমনিতেই তেল-গ্যাস উত্তোলনে এযাবৎ বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে যত চুক্তি হয়েছে তার কোনোটিই জাতীয় স্বার্থের অনুকূল নয়। ফলে ১৯৯৮ সালে হাইকোর্ট বিদেশি কোম্পানি দ্বারা তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ২০০৭-০৮ এর অবৈধ সরকার সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের চেষ্টা চালায় এবং সমুদ্রসীমার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করাতে সমর্থ হয়। তারা প্রভুপদলেহনে অধৈর্য হয়ে ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে গোপনে গ্যাস ব্লক ইজারার ব্যবস্থা করে ফেলে। তবে ভারত-মিয়ানমারের অবৈধ দাবিকৃত অঞ্চল বাদ দিয়ে তারা নেমে আসে ২৮টির বদলে ১০টি ব্লকে। তারা যে উৎপাদন-বণ্টন চুক্তি প্রণয়ন করে তা চরমভাবে জাতীয় স্বার্থবিরোধী। এর শর্ত অনুযায়ী বিদেশি কোম্পানি ৮০ শতাংশ গ্যাস রফতানির সুযোগ পাবে। এই চুক্তি তারা চূড়ান্ত করতে পারেনি তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির প্রতিবাদের কারণে। তাদের সেই অপকর্মের দায়ভার বহনে সম্মত হয়ে ক্ষমতা লাভকারী বর্তমান সরকার সেই চুক্তিই চূড়ান্ত করতে উদ্যোগ নিয়েছে। তবে তারা ১০টি ব্লকেও নয়, নেমে এসেছে তিনটিতে। একদিকে বিদেশি কোম্পনির স্বার্থে প্রায় সমুদয় গ্যাস রফতানির সুযোগ করে দেয়া, অপরদিকে নিজের জলসীমার অধিকার সঙ্কুচিত করে আনা আর যাই হোক দেশের স্বার্থে নয়, বরং উদার প্রভুস্বার্থ প্রেমে। আমরা এখন বোধ হয় রবীন্দ্র সঙ্গীতের সুরে গেয়ে উঠতে পারি সমবেত কণ্ঠে-'আমার যে সব দিতে হবে সেতো আমি জানি/ আমার যত বিত্ত, প্রভু, আমার নদীর পানি/ সব দিতে হবে।/আমার সাগর সীমারেখা, আমার গ্যাসের জমা/ আমার তেলের মজুত যত-না দিলে নাই ক্ষমা/সব দিতে হবে।/ আমার আপন আসন লুপ্ত আমার বন্দরেতে/ গোপন থেকে তোমার হানা বসবে আসন পেতে।/ এখন ভূমি আমার আছে পাহাড়ি অঞ্চলে/পূর্ব তিমুর গড়ার ঢঙে কাড়বে তোমার বলে/ সব দিতে হবে/ তোমারই আনন্দে আমার বক্ষে গুলি করে/ আমার সীমা থেকে তুমি নাও যে আমায় ধরে।/ আমার মাটি চিরে কোন অলুক্ষুণে ভোরে/তোমার দাবি করিডোরও নেবে গায়ের জোরে/ সব দিতে হবে।'
No comments