আমার বন্ধু মিশুক by ম. তামিম
যে কজন মানুষের সান্নিধ্যে আমার আজকের ‘আমি’র বুনিয়াদ বা ভিত্তি তৈরি হয়েছিল, আশফাক মুনীর মিশুক ছিল তার অন্যতম। আজ থেকে ৪৬ বছর আগে ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে আমাদের জীবনের যাত্রা শুরু। আজ এই ২০১১ সালে এসে মিশুকের মৃত্যুতে আমার পরিণত এই দেহ ও মনের একটি গাঁথুনি যেন ভেঙে পড়ে গেল!
ছোটবেলার টুকরো টুকরো বেশ কিছু স্মৃতি হঠাৎ মনের কোণে উঁকি দিয়ে যায়—খেলার কথা, ক্লাস পালিয়ে মুহসীন হলের লিফটে ওঠানামা করা, নাটক, কবিতা, দেয়ালপত্রিকার প্রকাশনা ইত্যাদি। একটু বড় হওয়ার পর থেকেই ওর ছবি তোলা এবং ক্যামেরার প্রতি ঝোঁক মোটামুটি ওর পরিচয়ে পরিণত হয়। প্রথম থেকেই প্রথাগত লেখাপড়ার প্রতি ওর একটা অনাগ্রহ ছিল, যে কারণে ক্লাসের ভালো ছাত্র ওকে কখনোই বলা যেত না। কিন্তু তার পরও ওর সহজাত সৃষ্টিশীল প্রতিভাকে অস্বীকার করার উপায় ছিল না। ভালো ছাত্র না হয়েও বন্ধু ও শিক্ষকদের কাছে মিশুক ছিল অত্যন্ত প্রিয়। ওর সঙ্গের ছোটবেলার কোনো ঘটনা বা স্মৃতির বিস্তারিত বর্ণনা আমার মনে নেই, কিন্তু যেটি রক্তে-মাংসে-অস্থিতে প্রোথিত হয়ে আছে, সেটি হলো ওর ব্যক্তিত্ব; আর সেই সঙ্গে একটা প্রচণ্ড ভালো লাগার, ভালোবাসার ও বন্ধুতার অনুভূতি।
পৃথিবীতে সত্যিকার অর্থে চোখ ও মনখোলা উদারচিত্তের মানুষের খুবই অভাব। আর আমাদের দেশে তো সে রকম মানুষ পাওয়া এককথায় বিরল। মিশুক ছিল এ দেশের সেই সব বিরল মানুষের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সদা হাস্য, জ্ঞান, বুদ্ধি, প্রতিভায় উদ্ভাসিত মিশুককে কখনো রাগ করতে দেখিনি। নিরহংকার, সহজ ও সত্যভাষী ছেলেটি প্রতিটি মানুষকে মানুষ হিসেবে প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে কথা বলত—তার সামাজিক অবস্থান বা পদ দেখে নয়। যে কারণে মুহূর্তেই সবাই তাকে বন্ধু হিসেবে বরণ করে নিত। ওর নামের সার্থকতা জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত সবাইকে বুঝিয়ে দিয়ে গেছে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। ওর বাবা শহীদ মুনীর চৌধুরীকে আমরা বন্ধুর বাবা হিসেবেই দেখেছি। তাঁর মৃত্যুতে কিশোর মিশুকের মানসিক যন্ত্রণা, পারিবারিক সংগ্রাম—আমরা কিছুই বুঝতে পারিনি। শুধু ওর পছন্দের কাজের একাগ্রতাকে আরও শাণিত হতে দেখেছি। স্কুল-কলেজ পেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে যখন ভর্তি হলো, তখন ওর জীবনের দিকনির্দেশনা ঠিক হয়ে গেছে। সেই ছোটবেলায় ক্যামেরা খুলে দেখার মধ্যে কারিগরি অনুসন্ধিৎসার যে অঙ্কুরের জন্ম, সেটা ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হয়েছে গণমাধ্যমে প্রযুক্তির ব্যবহারের ব্যুৎপত্তি লাভের মধ্য দিয়ে। এই প্রযুক্তির জ্ঞান কিন্তু ওর স্বশিক্ষা আর অন্বেষার ফল; কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সাহায্য ছাড়াই। সাত বছর জাতীয় জাদুঘরে আর ১০ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পর ওর সব অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান প্রয়োগের সুযোগ আসে একুশে টেলিভিশনের সংবাদ বিভাগের দায়িত্ব লাভের মাধ্যমে। প্রচারবিমুখ ক্যামেরার পেছনের মানুষটি শুরু করে নতুন প্রজন্মের ক্যামেরার সামনের সৈনিক তৈরিতে।
মিশুক ২০০১ সালে ব্যক্তিগত কারণে কানাডায় পাড়ি দেয়। ১০ বছর পর গত বছর এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব নিয়ে ঘরের ছেলে আবার ঘরে ফিরে আসে। প্রায় ১০ বছর পর, এই বছরের শুরুতে মুন্নী সাহার অফিসে ওর সঙ্গে আমার আবার দেখা। চলন, বলন, আচরণ, হূদ্যতা, আন্তরিকতা, বুদ্ধির দীপ্তিতে আমি ফিরে পেলাম আমার সেই বালকবেলার মিশুককে। আনন্দ-উচ্ছ্বাসে দুজনই উদ্বেলিত হলাম। দেখলাম, আরও পরিণত, দায়িত্বশীল, অভিজ্ঞ এবং সর্বোপরি কাজ-পাগল, কিছুটা নতুন মিশুককে। ১৫ মিনিটের কথা বলে টানা দুই ঘণ্টা আড্ডা চলল। এর মাঝেই দেখলাম টেকনিশিয়ান, ক্যামেরাম্যান, রিপোর্টার ও আইটির ছেলেমেয়েদের একের পর এক নতুন ধারণা, প্রযুক্তি, পদ্ধতি শেখানোর ত্বরিত তৎপরতা। মনে হলো, ওর হাতে বোধ হয় একদমই সময় নেই। শিশুর মতো উচ্ছ্বাস ও আগ্রহ।
আমার সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছে মাস দেড়েক আগে আমাদের স্কুলের বান্ধবী ইয়াসমিনের বাসায়। সেদিন আমার স্ত্রী ও বড় কন্যাসহ আমরা তিন বন্ধু ওকে একরকম জোর করেই অফিস থেকে পাকড়াও করে ঘণ্টা চারেক আড্ডা দিয়েছি। কিছু পুরোনো স্মৃতি ছাড়া প্রায় পুরো সময়ই আমরা ওর অভিজ্ঞতা আর স্বপ্নের কথা শুনেছি। সেই স্বপ্ন ছিল বাংলার মানুষের সত্যিকারের মুক্তি ও সম্ভাবনার স্বপ্ন। মনে হয়েছে, এক জনমে ওর কাজ শেষ হবে না। এই প্রথমবারের মতো একাত্তর-পরবর্তী ওর ব্যক্তিগত সংগ্রামের অনেক কথা সেদিন আমাদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছে। গভীর রাত হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছিল না। মনে মনে ভাবছিলাম, আহ্! আমার কথা বলার বন্ধুটি ফিরে এসেছে; নানা না পাওয়ার মাঝে ঢাকায় থাকাটা আরেকটু আনন্দময়, অর্থময় হয়ে উঠবে। কিন্তু আলোকবাহী মিশুক আমাদের সবার জীবন আরেকটু অন্ধকার করে দিয়ে চলে গেল; কিছুতেই মানতে পারছি না!
ম. তামিম : মিশুকের বন্ধু ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী।
ছোটবেলার টুকরো টুকরো বেশ কিছু স্মৃতি হঠাৎ মনের কোণে উঁকি দিয়ে যায়—খেলার কথা, ক্লাস পালিয়ে মুহসীন হলের লিফটে ওঠানামা করা, নাটক, কবিতা, দেয়ালপত্রিকার প্রকাশনা ইত্যাদি। একটু বড় হওয়ার পর থেকেই ওর ছবি তোলা এবং ক্যামেরার প্রতি ঝোঁক মোটামুটি ওর পরিচয়ে পরিণত হয়। প্রথম থেকেই প্রথাগত লেখাপড়ার প্রতি ওর একটা অনাগ্রহ ছিল, যে কারণে ক্লাসের ভালো ছাত্র ওকে কখনোই বলা যেত না। কিন্তু তার পরও ওর সহজাত সৃষ্টিশীল প্রতিভাকে অস্বীকার করার উপায় ছিল না। ভালো ছাত্র না হয়েও বন্ধু ও শিক্ষকদের কাছে মিশুক ছিল অত্যন্ত প্রিয়। ওর সঙ্গের ছোটবেলার কোনো ঘটনা বা স্মৃতির বিস্তারিত বর্ণনা আমার মনে নেই, কিন্তু যেটি রক্তে-মাংসে-অস্থিতে প্রোথিত হয়ে আছে, সেটি হলো ওর ব্যক্তিত্ব; আর সেই সঙ্গে একটা প্রচণ্ড ভালো লাগার, ভালোবাসার ও বন্ধুতার অনুভূতি।
পৃথিবীতে সত্যিকার অর্থে চোখ ও মনখোলা উদারচিত্তের মানুষের খুবই অভাব। আর আমাদের দেশে তো সে রকম মানুষ পাওয়া এককথায় বিরল। মিশুক ছিল এ দেশের সেই সব বিরল মানুষের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সদা হাস্য, জ্ঞান, বুদ্ধি, প্রতিভায় উদ্ভাসিত মিশুককে কখনো রাগ করতে দেখিনি। নিরহংকার, সহজ ও সত্যভাষী ছেলেটি প্রতিটি মানুষকে মানুষ হিসেবে প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে কথা বলত—তার সামাজিক অবস্থান বা পদ দেখে নয়। যে কারণে মুহূর্তেই সবাই তাকে বন্ধু হিসেবে বরণ করে নিত। ওর নামের সার্থকতা জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত সবাইকে বুঝিয়ে দিয়ে গেছে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। ওর বাবা শহীদ মুনীর চৌধুরীকে আমরা বন্ধুর বাবা হিসেবেই দেখেছি। তাঁর মৃত্যুতে কিশোর মিশুকের মানসিক যন্ত্রণা, পারিবারিক সংগ্রাম—আমরা কিছুই বুঝতে পারিনি। শুধু ওর পছন্দের কাজের একাগ্রতাকে আরও শাণিত হতে দেখেছি। স্কুল-কলেজ পেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে যখন ভর্তি হলো, তখন ওর জীবনের দিকনির্দেশনা ঠিক হয়ে গেছে। সেই ছোটবেলায় ক্যামেরা খুলে দেখার মধ্যে কারিগরি অনুসন্ধিৎসার যে অঙ্কুরের জন্ম, সেটা ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হয়েছে গণমাধ্যমে প্রযুক্তির ব্যবহারের ব্যুৎপত্তি লাভের মধ্য দিয়ে। এই প্রযুক্তির জ্ঞান কিন্তু ওর স্বশিক্ষা আর অন্বেষার ফল; কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সাহায্য ছাড়াই। সাত বছর জাতীয় জাদুঘরে আর ১০ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পর ওর সব অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান প্রয়োগের সুযোগ আসে একুশে টেলিভিশনের সংবাদ বিভাগের দায়িত্ব লাভের মাধ্যমে। প্রচারবিমুখ ক্যামেরার পেছনের মানুষটি শুরু করে নতুন প্রজন্মের ক্যামেরার সামনের সৈনিক তৈরিতে।
মিশুক ২০০১ সালে ব্যক্তিগত কারণে কানাডায় পাড়ি দেয়। ১০ বছর পর গত বছর এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব নিয়ে ঘরের ছেলে আবার ঘরে ফিরে আসে। প্রায় ১০ বছর পর, এই বছরের শুরুতে মুন্নী সাহার অফিসে ওর সঙ্গে আমার আবার দেখা। চলন, বলন, আচরণ, হূদ্যতা, আন্তরিকতা, বুদ্ধির দীপ্তিতে আমি ফিরে পেলাম আমার সেই বালকবেলার মিশুককে। আনন্দ-উচ্ছ্বাসে দুজনই উদ্বেলিত হলাম। দেখলাম, আরও পরিণত, দায়িত্বশীল, অভিজ্ঞ এবং সর্বোপরি কাজ-পাগল, কিছুটা নতুন মিশুককে। ১৫ মিনিটের কথা বলে টানা দুই ঘণ্টা আড্ডা চলল। এর মাঝেই দেখলাম টেকনিশিয়ান, ক্যামেরাম্যান, রিপোর্টার ও আইটির ছেলেমেয়েদের একের পর এক নতুন ধারণা, প্রযুক্তি, পদ্ধতি শেখানোর ত্বরিত তৎপরতা। মনে হলো, ওর হাতে বোধ হয় একদমই সময় নেই। শিশুর মতো উচ্ছ্বাস ও আগ্রহ।
আমার সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছে মাস দেড়েক আগে আমাদের স্কুলের বান্ধবী ইয়াসমিনের বাসায়। সেদিন আমার স্ত্রী ও বড় কন্যাসহ আমরা তিন বন্ধু ওকে একরকম জোর করেই অফিস থেকে পাকড়াও করে ঘণ্টা চারেক আড্ডা দিয়েছি। কিছু পুরোনো স্মৃতি ছাড়া প্রায় পুরো সময়ই আমরা ওর অভিজ্ঞতা আর স্বপ্নের কথা শুনেছি। সেই স্বপ্ন ছিল বাংলার মানুষের সত্যিকারের মুক্তি ও সম্ভাবনার স্বপ্ন। মনে হয়েছে, এক জনমে ওর কাজ শেষ হবে না। এই প্রথমবারের মতো একাত্তর-পরবর্তী ওর ব্যক্তিগত সংগ্রামের অনেক কথা সেদিন আমাদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছে। গভীর রাত হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছিল না। মনে মনে ভাবছিলাম, আহ্! আমার কথা বলার বন্ধুটি ফিরে এসেছে; নানা না পাওয়ার মাঝে ঢাকায় থাকাটা আরেকটু আনন্দময়, অর্থময় হয়ে উঠবে। কিন্তু আলোকবাহী মিশুক আমাদের সবার জীবন আরেকটু অন্ধকার করে দিয়ে চলে গেল; কিছুতেই মানতে পারছি না!
ম. তামিম : মিশুকের বন্ধু ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী।
No comments