ঢাকায় জীবন ঝুঁকিপূর্ণ by জামিলুর রেজা চৌধুরী
বেগুনবাড়ির ভবন উপড়ে যাওয়ার ঘটনার পর এখন পুরান ঢাকার নিমতলীর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আমাদের থমকে দিয়েছে। এতগুলো মানুষের জীবন এত করুণভাবে চলে গেল, এত পরিবার স্বজন হারা হলো যে তা সহ্য করা কঠিন। খুবই দুঃখের ও শোকের ঘটনা। কিন্তু এই ঘটনাগুলোকে নিছক দুর্ঘটনা বলা যায় না। এর দায় কাউকে না কাউকে নিতে হবে।
প্রথম দায় যারা আইন অমান্য করে ভবন নির্মাণ করেছে তাদের। বেগুনবাড়িতে উপড়ে যাওয়া ভবনটি যেখানে ছিল, সেখানে তো কোনো ভবনই নির্মিত হওয়ার কথা নয়। জায়গাটি বর্জ্য পদার্থ ফেলে ফেলে ভরাট করা হচ্ছিল। এ রকম নাজুক জায়গায় বিধিমালা অনুসরণ না করে ভবন বানানো অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। কেবল নির্মাণই নয়, ওই ভবনটির মালিক ওটাকে ওপরের দিকে বাড়িয়েও যাচ্ছিলেন। দ্বিতীয়ত, সরকারের যেসব সংস্থার ওপর ভবন নির্মাণ ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব ন্যস্ত রয়েছে, এটা তাদেরও ব্যর্থতা। তারা কেন দেখল না যে অনুমোদন ছাড়া ভবন তৈরি হচ্ছে? তারা যদি মনে করে, মানুষ তাদের কাছে অনুমতির জন্য নিজে থেকেই আসবে, তা ঠিক নয়। তাদের দায়িত্ব হলো, যেকোনো ভবন নির্মাণের সময় ইমারত নির্মাণ বিধিমালা পালন করা হচ্ছে কি না তা নজরদারি করা। তার জন্য তাদের যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া ছিল। কিন্তু তারা সেটা প্রয়োগ করেনি। এসব ক্ষেত্রে আগাম ভবন নির্মাণ বন্ধ করা যায়। সে কারণেই এটা যতটা না দুর্ঘটনা তার থেকে বেশি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা।
রাজধানীর ভবন নির্মাণ ও ব্যবহারের দিকটা দেখার জন্য রাজউক সৃষ্টি করা হয়েছিল। যখন এটা করা হয়েছিল তখন ঢাকার জনসংখ্যা ছিল মাত্র ১০ লাখ। কিন্তু এখন রাজধানীতে দেড় কোটির মতো লোকের বাস। ঢাকার আয়তন ও জটিলতা অনেক বেড়েছে। কিন্তু রাজউকের জনবল কেন বাড়ানো হলো না?
এখন রাজউকের ওপর অনেক দায়িত্ব। তারা জমি ডেভেলপ করে বিক্রি করে, তারা রাস্তাঘাট বানায়, ফ্লাইওভার বানায়। এসব ক্ষেত্রে তারা হলো বাস্তবায়নকারী সংস্থা। অন্যদিকে রাজউকই হলো ভবন নির্মাণের বিধিমালা বাস্তবায়নের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা। অর্থাৎ একই সঙ্গে নগর পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব তাদের। এ বিষয়ে অনেক কমিটি করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞ মহল ও নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে সরকারকে অনেক সুপারিশও করা হয়েছে যে একটি প্রতিষ্ঠান একই সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ ও বাস্তবায়নের কাজ করতে পারে না। টেলিফোন, জ্বালানিসহ অন্য অনেক ক্ষেত্রে এ দুটো দায়িত্ব আলাদা সংস্থাকে দেওয়া হয়েছে। বারবার সুপারিশ করা হয়েছে যে রাজউককে কিছু দায়িত্ব থেকে মুক্ত করা হোক, যাতে তারা ভালোভাবে কাজ করতে পারে। রেগুলেটরি দায়িত্ব তথা পরিকল্পনা প্রণয়ন ও মান নিয়ন্ত্রণসহ নজরদারির দায়িত্বটি অন্য কারও হাতে দেওয়া উচিত।
সিটি করপোরেশনেরও কিছু দায়িত্ব রয়েছে। মাঝেমধ্যে দেখা যায়, একই কাজের জন্য দুই সংস্থা থাকলে কার্যত কেউই দায়িত্ব নেয় না। এক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে বলে মনে হয়।
ঢাকার জনবসতি কমাতে হবে। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় আগুনের বিপদ বেশি থাকে এবং ক্ষয়ক্ষতিও বেশি হয়। পুরান ঢাকার ওই ভয়াবহ আগুনের বেলায়ও সেটাই দেখা গেছে। আবার সেখানেই দাহ্য পদার্থে ভরা শিল্প-কারখানা রয়েছে। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা কোনো কঠিন কাজ না। কারণ এগুলোর জন্য তো অনুমতি লাগে। সেই অনুমতি তাদের কে দিল?
অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলেই এসব মর্মান্তিক ঘটনা ঘটছে, ঢাকায় জীবনের ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে। যেসব পরিবার স্বজন হারিয়েছে তাদের শোক মর্মান্তিক। অন্যদিকে এত বড় দুর্ঘটনার খবর তো বিশ্বে প্রচারিত হবে। তাতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিরও তো সংকট হবে যে, সরকার কী করছে।
পুরান ঢাকার মতো সমগ্র ঢাকাই তীব্র ঘনবসতিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। নতুন ঢাকাতেও তো গায়ে গায়ে লাগানো ভবন। জাপান গার্ডেন সিটির মতো নতুন স্থাপনায়ও তো আগুন লাগছে। গুলশান ও ধানমন্ডির অভিজাত এলাকা ছাড়া বাদবাকি ঢাকার অবস্থা দিনকে দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারকে এখন সাধারণ ভবনমালিক থেকে শুরু করে ডেভেলপারদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বলা হয়, তারা অনেক শক্তিশালী। এটা কি কখনো হয় যে কোনো দেশের সরকার বলছে, তাদের চেয়ে প্রাইভেট সেক্টর বেশি শক্তিশালী, তারা কথা শোনে না? কারণটি এই, যারা ক্ষমতাবান ডেভেলপার তারা আবার রাজনীতিতেও ক্রিয়াশীল। রাজনীতির ওপর তাদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ দৃশ্যমান। তারা অনেক শক্তিমান।
এসবের বিরুদ্ধে কেউ তো তেমন কথা বলছে না। ওসমানী উদ্যান আন্দোলন, বুড়িগঙ্গা বাঁচাও আন্দোলনসহ নানা ইস্যুতে নাগরিক সমাজের নানা অংশ সোচ্চার ছিল। তারপর সরকার কিছু লোকদেখানো কাজ করেছে। দীর্ঘমেয়াদে কোনো সমাধানের তেমন চেষ্টা কেউ করছে না। তাই আমরা বড় কোনো সাফল্যের মুখ দেখি না। মূলত সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। যে আইন আছে তা সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
একটা শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে, যার দায়িত্ব হবে যত ভবন হবে তার মান নিয়ন্ত্রণ করা এবং তা পরিকল্পনামাফিক হচ্ছে কি না তা দেখা। এবং প্রতিষ্ঠানটি হবে বিকেন্দ্রীকৃত। বিভিন্ন স্থানে তাদের দপ্তর থাকবে। তারা সরেজমিনে ভবন নির্মাণ ও ব্যবহার সম্পর্কে যে আইন আছে, ঢাকাকে বাসযোগ্য করার জন্য যেসব নীতিমালা প্রণীত রয়েছে তা কার্যকর করবে।
জামিলুর রেজা চৌধুরী: প্রকৌশলী ও শিক্ষাবিদ।
প্রথম দায় যারা আইন অমান্য করে ভবন নির্মাণ করেছে তাদের। বেগুনবাড়িতে উপড়ে যাওয়া ভবনটি যেখানে ছিল, সেখানে তো কোনো ভবনই নির্মিত হওয়ার কথা নয়। জায়গাটি বর্জ্য পদার্থ ফেলে ফেলে ভরাট করা হচ্ছিল। এ রকম নাজুক জায়গায় বিধিমালা অনুসরণ না করে ভবন বানানো অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। কেবল নির্মাণই নয়, ওই ভবনটির মালিক ওটাকে ওপরের দিকে বাড়িয়েও যাচ্ছিলেন। দ্বিতীয়ত, সরকারের যেসব সংস্থার ওপর ভবন নির্মাণ ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব ন্যস্ত রয়েছে, এটা তাদেরও ব্যর্থতা। তারা কেন দেখল না যে অনুমোদন ছাড়া ভবন তৈরি হচ্ছে? তারা যদি মনে করে, মানুষ তাদের কাছে অনুমতির জন্য নিজে থেকেই আসবে, তা ঠিক নয়। তাদের দায়িত্ব হলো, যেকোনো ভবন নির্মাণের সময় ইমারত নির্মাণ বিধিমালা পালন করা হচ্ছে কি না তা নজরদারি করা। তার জন্য তাদের যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া ছিল। কিন্তু তারা সেটা প্রয়োগ করেনি। এসব ক্ষেত্রে আগাম ভবন নির্মাণ বন্ধ করা যায়। সে কারণেই এটা যতটা না দুর্ঘটনা তার থেকে বেশি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা।
রাজধানীর ভবন নির্মাণ ও ব্যবহারের দিকটা দেখার জন্য রাজউক সৃষ্টি করা হয়েছিল। যখন এটা করা হয়েছিল তখন ঢাকার জনসংখ্যা ছিল মাত্র ১০ লাখ। কিন্তু এখন রাজধানীতে দেড় কোটির মতো লোকের বাস। ঢাকার আয়তন ও জটিলতা অনেক বেড়েছে। কিন্তু রাজউকের জনবল কেন বাড়ানো হলো না?
এখন রাজউকের ওপর অনেক দায়িত্ব। তারা জমি ডেভেলপ করে বিক্রি করে, তারা রাস্তাঘাট বানায়, ফ্লাইওভার বানায়। এসব ক্ষেত্রে তারা হলো বাস্তবায়নকারী সংস্থা। অন্যদিকে রাজউকই হলো ভবন নির্মাণের বিধিমালা বাস্তবায়নের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা। অর্থাৎ একই সঙ্গে নগর পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব তাদের। এ বিষয়ে অনেক কমিটি করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞ মহল ও নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে সরকারকে অনেক সুপারিশও করা হয়েছে যে একটি প্রতিষ্ঠান একই সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ ও বাস্তবায়নের কাজ করতে পারে না। টেলিফোন, জ্বালানিসহ অন্য অনেক ক্ষেত্রে এ দুটো দায়িত্ব আলাদা সংস্থাকে দেওয়া হয়েছে। বারবার সুপারিশ করা হয়েছে যে রাজউককে কিছু দায়িত্ব থেকে মুক্ত করা হোক, যাতে তারা ভালোভাবে কাজ করতে পারে। রেগুলেটরি দায়িত্ব তথা পরিকল্পনা প্রণয়ন ও মান নিয়ন্ত্রণসহ নজরদারির দায়িত্বটি অন্য কারও হাতে দেওয়া উচিত।
সিটি করপোরেশনেরও কিছু দায়িত্ব রয়েছে। মাঝেমধ্যে দেখা যায়, একই কাজের জন্য দুই সংস্থা থাকলে কার্যত কেউই দায়িত্ব নেয় না। এক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে বলে মনে হয়।
ঢাকার জনবসতি কমাতে হবে। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় আগুনের বিপদ বেশি থাকে এবং ক্ষয়ক্ষতিও বেশি হয়। পুরান ঢাকার ওই ভয়াবহ আগুনের বেলায়ও সেটাই দেখা গেছে। আবার সেখানেই দাহ্য পদার্থে ভরা শিল্প-কারখানা রয়েছে। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা কোনো কঠিন কাজ না। কারণ এগুলোর জন্য তো অনুমতি লাগে। সেই অনুমতি তাদের কে দিল?
অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলেই এসব মর্মান্তিক ঘটনা ঘটছে, ঢাকায় জীবনের ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে। যেসব পরিবার স্বজন হারিয়েছে তাদের শোক মর্মান্তিক। অন্যদিকে এত বড় দুর্ঘটনার খবর তো বিশ্বে প্রচারিত হবে। তাতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিরও তো সংকট হবে যে, সরকার কী করছে।
পুরান ঢাকার মতো সমগ্র ঢাকাই তীব্র ঘনবসতিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। নতুন ঢাকাতেও তো গায়ে গায়ে লাগানো ভবন। জাপান গার্ডেন সিটির মতো নতুন স্থাপনায়ও তো আগুন লাগছে। গুলশান ও ধানমন্ডির অভিজাত এলাকা ছাড়া বাদবাকি ঢাকার অবস্থা দিনকে দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারকে এখন সাধারণ ভবনমালিক থেকে শুরু করে ডেভেলপারদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বলা হয়, তারা অনেক শক্তিশালী। এটা কি কখনো হয় যে কোনো দেশের সরকার বলছে, তাদের চেয়ে প্রাইভেট সেক্টর বেশি শক্তিশালী, তারা কথা শোনে না? কারণটি এই, যারা ক্ষমতাবান ডেভেলপার তারা আবার রাজনীতিতেও ক্রিয়াশীল। রাজনীতির ওপর তাদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ দৃশ্যমান। তারা অনেক শক্তিমান।
এসবের বিরুদ্ধে কেউ তো তেমন কথা বলছে না। ওসমানী উদ্যান আন্দোলন, বুড়িগঙ্গা বাঁচাও আন্দোলনসহ নানা ইস্যুতে নাগরিক সমাজের নানা অংশ সোচ্চার ছিল। তারপর সরকার কিছু লোকদেখানো কাজ করেছে। দীর্ঘমেয়াদে কোনো সমাধানের তেমন চেষ্টা কেউ করছে না। তাই আমরা বড় কোনো সাফল্যের মুখ দেখি না। মূলত সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। যে আইন আছে তা সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
একটা শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে, যার দায়িত্ব হবে যত ভবন হবে তার মান নিয়ন্ত্রণ করা এবং তা পরিকল্পনামাফিক হচ্ছে কি না তা দেখা। এবং প্রতিষ্ঠানটি হবে বিকেন্দ্রীকৃত। বিভিন্ন স্থানে তাদের দপ্তর থাকবে। তারা সরেজমিনে ভবন নির্মাণ ও ব্যবহার সম্পর্কে যে আইন আছে, ঢাকাকে বাসযোগ্য করার জন্য যেসব নীতিমালা প্রণীত রয়েছে তা কার্যকর করবে।
জামিলুর রেজা চৌধুরী: প্রকৌশলী ও শিক্ষাবিদ।
No comments